আব্দুল গণি হাজারি সম্বন্ধে তেমন বেশি জানা নেই। ইন্টারনেট ঘেটে এতটুকুই জানতে পারি যে স্বাধীনতার আগে ও পরে তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন - সাংবাদিক, সম্পাদক অথবা প্রকাশক হিসেবে। মারা যান অল্প বয়সে (৫৫) কিন্তু আমাদের আধুনিক সাহিত্যের জন্যে অমর একটি কবিতা তিনি রেখে গেছেন। ষাটের দশকে রচিত কবিতাটি, কিন্তু এতই তীক্ষ্ণ ছিল কবির চোখ ও কলম (এবং এতই স্থবির আমাদের সমাজের গোত্র-বর্ণের কাঠামো) যে চল্লিশ বছর পরেও সমাজের উপরতলার একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রতিকৃতি হিসেবে কবিতাটি স্বার্থক হয়ে আছে। অনেকেই আগে পড়ে থাকবেন - কিন্তু যারা পড়েননি, তাদের জন্যে:
*
কতিপয় আমলার স্ত্রী
আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
তোমার দিকে মুখ ফেরালাম
হে প্রভু আমাদের ত্রাণ করো
বিশ্রামে বিধ্বস্ত আমরা
কতিপয় আমলার স্ত্রী
হে প্রভু আমাদের স্বামীরা
অগাধ নথিপত্রে ডুবুরি
(কি তোলে তা তারাই জানে)
পরিবার-পরিকল্পনায় আমরা নিঃস্ব
সময় আমাদের পিষ্ট করে যায়
আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
সকাল থেকে সন্ধ্যা
কোন মহৎ চিন্তার কিনারে
এবং ফ্যাশান পত্রিকার বিবর্ণ পাতা
দৈনিক কাগজ়েসিনেমার ইস্তেহার
স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের উলংগ ছবি
এবং একটি প্রাপ্ত-প্রায় মহত্ত্বের শিহরণ।
কোমরের উপত্যকায় মেদের আক্রমণ
উদরের স্ফীতি
চিবুকের দ্বিত্ব
স্তনের অস্বাস্থ্যে শংকিত
হে প্রভু আমরা
চর্বির মসোলিয়ামে হাঁসফাঁস
আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
ভাঁড়ার আমাদের লক্ষী
বালিশের ভাঁজে উদ্বৃত্ত হাত খরচ
আয়নার দেরাজে হেলেন কার্টিস
এনি ফ্রেঞ্চ-মিল্ক
এষ্ট্রিনযেন্ট
ডিওডরেন্ট
হ্যান্ড লোশন
রেভ্লন
ক্রিশ্চিয়ান ডিয়োর
এবং রুবিনষ্টিন
অবশ্য স্বামীদের কাছ থেকেই
উষ্ণ প্রেমের ঘাট্তির
প্রৌঢ় ক্ষতিপূরণ
আর্দালীর কুর্নিশে গর্বিত
স্বামীরা অফিসে সর্বক্ষণ
অন্যের পদোন্নতির বাধা
দরখাস্ত নাকচ
এবং কতিপয় পদস্থ দস্তখত
বাড়ী ফিরেও হায়
বন্ধুর প্রমোশনে ঈর্ষিত
বেনামী ব্যবসার লাভক্ষতি
তারপর টেলিফোন
তারপর টেলিফোন
তারপরও টেলিফোন
আমাদের ঠোঁটের রেভ্লন
মুখের ফাউন্ডেশন
কপালের সযত্ন টিপ
শুকিয়ে আসে
বৈকালের নিমন্ত্রণ বাসি
অতঃপর হে প্রভু
দ্বিতীয় ব্যক্তির চিন্তা
আমাদের উন্মনা করে যায়
পুরাতন প্রেমিক বিবাহিত
তরুণদের মাসী
সাবর্ডিনেটের আম্মা
বোনের সংসারে নানী
এবং বৈকালের নিমন্ত্রণ বাসি
বিলেতী পত্রিকার পাতায়
মেগির প্রেম
জ্যাকেলিনের স্তব
লিজ টেলরের ছেনালী
বি-বির মাপজোক
লোলার লোলুপতা
এবং মেরেলিনের আত্মহত্যা
এবং আত্মহত্যা
এবং আত্মহত্যা
হায়রে বৈকালের নিমন্ত্রণ
অতঃপর হে প্রভু
আমাদের রাত্রির শরীর পান্সে
জানালার চাঁদ নিরক্ত
ব্যবহৃত দেহ
নাকডাকা স্বামী
বিনিদ্র রাত
এবং ট্র্যাংকুইলাইজার
হে প্রভু অনন্যোপায়
তোমার দিকে মুখ ফেরালাম
আমাদের কোন কাজ দাও
ভ্যানিটি ব্যাগে আয়না
ফাউন্ডেশন আর গ্যালার রং
এবং সমাজ সেবা
কিন্ডারগার্টেনের শ্রাদ্ধ
লেডিজ ক্লাবের সামনের সীট
কিংবা স্বামীর পদাধিকারে
শিশুসদনের উদ্বোধন-
আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
হে প্রভু
যে-কোন একটা কাজ দাও
নিজেদের নিক্ষেপ করি
তার গহ্বরে।
-- আবদুল গণি হাজারী
*
[কাছাকাছি বিষয় নিয়ে ব্রাত্য রাইসুর কবিতাটি উল্লেখ্য। হাজারি বেশ কিছু ষাটের দশকের হলিউডি রেফারেন্স টেনেছেন - যেমন জিনা লোলোব্রিজিদা (লোলা), ব্রিজিত বার্দো (বি-বি), মেরিলিন মনরো ও লিজ টেইলর, এবং জ্যাকি ওনাসিস (প্রেসিডেন্ট কেনেডির বিধবা)।]
মন্তব্য
অসাধারন এই কবিতাটি তুলে দেবার জন্য ধন্যবাদ।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
এই কবিতা আর রাইসু'র কবিতা ,দুটিই পড়ে ভালো লাগলো।
বিএ পাস এর বাংলা কবিতা সংকলনে (অনন্য একটা সংকলন) এই কবিতাটাও ছিল।
বৃন্দ আবৃত্তি করে এমন সংগঠনগুলোর কাছেও এই কবিতা অনেক প্রিয়। টিএসসি এলাকায় এর আবৃত্তি শোনা যায় প্রচূর।
ও হ্যা, কবিতার জন্য বাংলা একাডেমি পুরষ্কারও পেয়েছিলেন আব্দুল গণি হাজারী।
অনেকদিন পর পরে একইরকম ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
অসাধারন কবিতা।
কিছুই পাল্টায় নি।
নতুন মন্তব্য করুন