ভাইয়েরা আমার, বড়ই দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়া এই লেখা লেখতে বসলাম। মনে বড় শখ আছিলো, অনেকদিন তো এই দেশের ট্রেন-বাস-পাবলিক ট্র্যান্সপোর্ট ঠেললাম, একটু টাকা-কড়ি জমাইতে পারলে একটা গাড়ি কিনা ফেলতাম। লন্ডনের ২৫ নম্বর বাসে উঠলে এই দেশের অসভ্য পোলাপানের কীর্তি-কলাপ দেইখা মনটা তিতা হইয়া যায়। মোবাইল ফোন আছে সবতের, তার মইধ্যে ভরা আছে mp3 গান, বাসে উঠলেই সেই অতিশয় জঘন্য কর্কশ হিপ-হপ আর rap গান হাই ভলিউমে বাজাইয়া পুরা বাসের লোকেরে বিরক্ত করা এগো জন্মের স্বভাব। বাসের লোকেও পুরা ত্যানা - পোলাপাইনরে কিছু কইতে ডরায়, অনেক কালা পোলাপান আছে, যদি ছুরি চালান দিয়া দ্যায় বা ঐরকম কিছু একটা ডর। আবার এশিয়ান বা বাদামী চামড়ার অল্পবয়সী পোলাপাইনও কম যায় না। মোবাইলে জোরে জোরে গান বাজানো, চিল্লায় চিল্লায় নিজেগো মইধ্যে কথা কওয়া, সীটের উপর পা তুইলা পরেরে বিরক্ত করা এই পূর্ব লন্ডনের ঘেট্টো-বস্তির সিলেটি পোলাপানের অভ্যাস। তার উপর দুনিয়ার মাতাল-মদ্যপের ভক-ভক নিঃশ্বাস আর মাটিতে ছড়ানো ময়লা পেপার-পত্রিকা, মদের বোতল, বিয়ার ক্যান, এইসব তো আছেই। সব কিছু দেইখা মনে কয় - আহা যদি একখানা গাড়ি থাকতো আমার, তাইলে নিজেই চালাইয়া একলা উড়াল দিতাম। উইকেন্ডে শপিং করতে যাইতাম গ্রোসারি স্টোরে, গাড়ি বোঝাই কইরা খাওয়া-দাওয়া আর হাবিজাবি জিনিসপত্র কিনতাম, ৫০ কেজি ওজনের ১০০টা পলিথিন ব্যাগ নিয়া পাবলিক বাসে উঠার যুদ্ধ করন লাগতো না আর। আবার সময় পাইলে টান দিয়া ফ্রেন্ডগো বাড়িতে চইলা যাইতে পারতাম, ছুটির দিনে হাওয়া খাইতে লং ড্রাইভে যাইতাম, শহরের বাইরে, সমুদ্র সৈকতে, ডোভার, ব্রাইটন কিম্বা বোর্নমাউথে।
তাই দরকার গাড়ি। দাম বেশী না, ৫০০ পাউন্ড ফেললেই চলনসই জিনিস মিলা যায়। কিন্তু তার আগে দরকার আরো জরুরী জিনিস। ড্রাইভিং লাইসেন্স নামক এক স্বপ্নের বস্তু। এমনিতেই ব্রিটেনের লাইসেন্স অথরিটি-র বিশেষ দুর্নাম আছে এই বিষয়ে, যে হারামজাদারা সহজ়ে কাউরে লাইসেন্স দিতে চায় না। অনেকে দুই-তিন-চাইরবার টেস্ট দিয়া অবশেষে পাশ করে, পরীক্ষক ব্যাটা যদি দয়াপরবশ হয়। এইখানে প্রথমবার আইসা এইটা শুইনা মেজাজটা বেশ খারাপ হইছিলো। এতো টাফ করার কি দরকার??? মানুষের কি গাড়ি চালানোর প্রয়োজন নাই নাকি??? আম্রিকা দেশে যখন আছিলাম- আইজকা ৯/১১'এর ষষ্ঠ বার্ষিকী তাই সেইদিনটারে একটু স্মরণ কইরা লই - যা কইতাছিলাম, ঐ মার্কিন দেশে যখন আছিলাম, তখন কি আরাম কইরাই না লাইসেন্সটা পাইছিলাম। ড্যালাস থেকা ৫০-৬০ মাইল দূরে গেইন্স্ভিল (Gainesville) নামে এক টাউনে গেছিলাম গিয়া - একদম one-horse town যারে কয়, গেইন্স্ভিল ঠিক তাই। কিছুই নাইক্কা সেই টাউনে। পরীক্ষক খালি কইছিলো - গাড়িটা দুইখান চক্কর দাওতো দেখি বাবা। যেমন কথা তেমন কাজ, দুই চক্কর দেওয়াতেই লাইসেন্স দিয়া দিছিলো। সেইটা দিয়া শেষ ৬ মাস চালাইছিলাম, ২০ বছর পুরানো লক্কর-ঝক্কর এক কমলা রঙ্গের হোন্ডা একোর্ড, মাইলেজ তার প্রায় ২০০,০০০ মাইল!!! আমার জানের জান পরানের পরান, আমার কইলজার টুকরা, আমার প্রথম - এবং এখনতরি একমাত্র - গাড়ি।
যাউজ্ঞা, এই দেশে আইসা দেখি লাইসেন্স নেওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। একেতো রাস্তাঘাট পুরান ঢাকার চিপাগল্লির মতনই চিপা - আমার নাখালপাড়ার লগে ফারাক খালি এই যে এইখানের রাস্তাগুলা একটু বেশী পরিষ্কার, আর নাখালপাড়ার গল্লিতে ময়লা একটু বেশী। কিন্তু এই পুরানা শহরের সবচেয়ে পুরানা রাস্তাঘাট সেই ঢাকার মতনই সরু-সরু। টেক্সাসে গাড়ি চালাইয়া বরং কতো আরাম পাইতাম। বিরাট চওড়া চওড়া সব রাস্তা, সব শালা মানিক মিয়ার মতো, ইন ফ্যাক্ট, টেক্সাসে আমার বাসার পিছে যেই 'গল্লিটা' আছিলো সেইটা পর্যন্ত এই দেশের তথাকথিত 'হাইওয়ে'র থেকা বেশী চওড়া। কি আর করা। আইসা যখন পড়ছি, চালাইতে হইবো আফটার অল...
তাই গত কয়েক মাস যাবত ড্রাইভিং ক্লাস নিলাম, এই দেশের রাস্তাঘাটে চালানোর অভ্যাস হওয়ার লেগা। আমার ইন্সট্রাকটর প্রথম দিনেই আমারে কয়, আম্রিকায় যা শিখা আইছো, ব্যাবাকটি ভুইল্লা যাও, এইখানে চালানোর তরিকা অনেক ভিন্ন, নিয়মকানুন অনেক বেশী আর লাইসেন্স পাইতে অনেক বেশী কড়াকড়ি। সেই ইন্সট্রাকটর আবার আরেক চিজ! সিলেটি পোলা, নাম তার মাসুদ মিয়া (এইখানে ৫০% সিলেটির নাম কিন্তু মিয়া।)। সেই পোলা লম্বা চওড়া, চোখে সান্ গ্লাস, মাথায় বাবড়ি, হেভি টাইট সব গেঞ্জি পড়ে, মনে হয় জিম-টিমে যায় অনেক ব্যায়াম-ট্যায়াম করে। ফাঁক পাইলেই ছেমড়িগো লগে গপ-শপ চালায় মোবাইলে, আর সবচেয়ে ফানি হইলো তার হাঁটা - ঠিক কালাগো অনুকরণে চ্যাগায় চ্যাগায় হাঁটে, মনে হয় কেউ তারে পিছনে একটা পার্মানেন্ট বাঁশ দিয়া রাখছে। আর মেজাজ তার সবসময়ই ভীষণ তিরিক্ষি থাকে। গাড়ি চালানোর সময় পান থেকা শুধু চুন খসলে মাসুদ মিয়ার হাউকাউ শুরু হইয়া যায়, আমারে চিল্লায় চিল্লায় কয়, হোয়্যার্'স ইয়োর আইজ, ম্যান? ইউজ ইয়োর আইজ! আমি মনে মনে হারামজাদারে বাপ-মা তুইলা গাইল পাড়ি, কিন্তু কষ্ট কইরা মুখে প্রশান্তি বজায় রাখি।
তো কয়েক মাস মাসুদ মিয়ার লগে ক্লাশ নেওয়ার পর আইজকা আছিলো আমার ড্রাইভিং টেস্ট। ড্রাইভিং ক্লাশ এমনিতেই এইখানে প্রচুর খরচের ব্যাপার - গত কয় মাসে কয়েকশো পাউন্ড অলরেডি গেছে গিয়া। প্রথম যাত্রাই তাই টেস্ট্টা আমার পাশ করা চাইই চাই। পয়সা তো আর গাছে ধরে না। অফিস থেকা হাফ-ডে ছুটি পর্যন্ত নিয়া রাখছি, শান্তি মতন যাতে টেস্ট সেন্টারে যাইতে পারি, পরীক্ষাটা দিয়া লাইসেন্সটা নিয়া ঘরে ফিরতে পারি।
সেন্টারে গেছিলাম দুপুর বেলা, হপায় ফিরলাম। কি আর কমু দুঃখের কথা। বিধি এক্কেরেই বাম। প্রথম দশ মিনিটের মইধ্যেই দুইটা সিরিয়াস ভুল কইরা ফালাইলাম। 'রিভার্স রাউন্ড আ বেন্ড' করতে গিয়া গাড়ির পজিশন ভজঘট লাইগা গেলো, ফেল-টা খাইয়া গেলাম। দুঃখ লাগতাছে খুবই। আবার এখন তিন মাসের ওয়েটিং লিস্ট, তার আগে টেস্টের তারিখ পাওয়া যাইবো না। আসার পথে মাসুদ মিয়া আমারে কোমল স্বরে জিগায় - কি কি ভুল করসো? আমি আর কথা বাড়াইলাম না। মনে মনে হালার নিকুচি করলাম উল্টা। ফেল করি আর পাশ করি, এই ব্যাটার কাছে আর কোন পয়সা দিমু না! এর চেহারা জানি আর কোন দিন আমার দেখতে না হয়! দেখি নভেম্বর ডিসেম্বরে আবার ট্রাই দিমু। ভাইয়েরা আমার জন্যে একটু খাস দিলে দোয়া কইরেন, নেক্সট টাইম জানি লাইসেন্সটা মিলা যায়। রোজার মাসে মুমিনের দোয়া উপরওয়ালা ফেলবো না বইলাই আমার বিশ্বাস...
মন্তব্য
ভাগ্যিস ফেল মেরেছেন; নইলে এই চমৎকার লেখাটি তো আর পেতাম না! দোয়া করছি, আপনি ফেল মেরেই চলুন!...
(অফটপিক:আমার মতো ক্ষীনদৃষ্টির অনলাইন পাঠকের জন্য আরো ছোট ছোট প্যারায় লেখা যায়?)
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
বিপ্লব ভাই, এর থেকা ভালো দোয়া করেন!
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
জটিল লাগলো লেখাটা।
থ্যাঙ্কস ভাই, আইডিয়াগুলা কাজে দিবো।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
বড় আনন্দ পাইলাম লেখাখানা পইড়া। জনগণরে চিপায় পরতে দেখলেই আমি বিশেষ আনন্দ পাই।তয় বেশী আনন্দও ভালা না...সো আশা করি নেক্সট টাইম লাইসেন্স পাইয়া যাইবেন। লাগলে কইয়েন পিরিচ চালান দিমু নে। হক মওলা !!!
দৃশা
সরেস হইছে
==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।
পড়ে মজা পেলাম, আপনার অবস্থা জেনে দুঃখ। চালিয়ে যান।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
বহুদিন পর একটা রম্য পেলাম যেটা পড়ে একাধিক বার ঠাঠা শব্দে হাসতে হলো।
সেই রকম হয়েছে লেখাটা!
যায় ভেসে যায় স্বপ্ন বোঝাই, নৌকা আমার কাগজের...
এ এক মহা যন্ত্রনা । যে ধরা পড়ছে,সেই জানে
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
নতুন মন্তব্য করুন