সচলে যেহেতু অনেক ইঞ্জিনিয়ার/টেকনিক্যাল বিষয়ের লোক আছেন, তাদের কাছে রামানুজানের নাম নিশ্চয়ই নতুন ঠেকবে না। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গণিতের জগতে উল্কার মতো তাঁর আবির্ভাব - আবার উল্কার মতোই তিনি হারিয়ে যান। ভারতের এই জিনিয়াস গণিতজ্ঞ স্রিনিভাসা রামানুজান-কে নিয়ে একটি চমত্কার নাটক দেখার সৌভাগ্য হলো কয়েকদিন আগে, লন্ডনের বার্বিকান সেন্টারে।
রামানুজান জন্মেছিলেন তামিল নাডুর এক ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে। মাদ্রাজের পোর্ট অফিসে সামান্য কেরানির কাজ করতেন। ১৯১২ কি ১৯১৩ সালের দিকে বিলেতের বাঘা গণিতবিদ জি এইচ হার্ডি-র (G.H. Hardy) কাছে তিনি তাঁর কিছু উদ্ভাবিত উপপাদ্যের খসড়া পাঠান। হার্ডি সেই খসড়া দেখে মোটামুটি টাশ্কি খেয়ে যান। বুঝতে পারেন কি মানিক-রতন তার হাতে এসে পড়েছে। তিনি পাশ্চাত্যের গণিতবিদদের কাছে রামানুজানের প্রতিভাকে তুলে ধরতে চান - আর তারও বেশী রামানুজানের সাথে মিলে গণিতশাস্ত্রে রিসার্চ করতে প্রচন্ড আগ্রহী হয়ে পড়েন। সেই ১৯১৩ সালে মাদ্রাজের সরকারী কেরানি রামানুজানের জন্যে বিলেত যাত্রা একটি বিশাল পদক্ষেপ - যার ফলাফল ভালো-মন্দ উভয়ই ছিল। একদিকে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হার্ডির সাথে গণিতে তার সফল কোলাবোরেশান, অন্যদিকে বিলেতে তার প্রবল একাকীত্ব, বিরূপ ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানোর নিদারুন প্রচেষ্টা, আর খাঁটি ব্রাক্ষ্মণ হিসেবে পানাহার সহ দৈনন্দিন জীবনে হাজারো সমস্যা - এক সময়ে মোটামুটি আপেল খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতেন - এই সমস্ত বিষয়গুলোই নাটকে দারুনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। তার নানান শারীরিক ব্যাধি শুরু হয়, খারাপ থেকে তা আরো খারাপের দিকে যেতে থাকে, তাই ১৯১৯ সালে তিনি ভারতে ফিরে যান। আর অল্প কিছুদিন পরেই মাত্র ৩২ বছর বয়সে অবশেষে পরিবার-পরিজনবেষ্টিত হয়ে রামানুজান মৃত্যুবরণ করেন। ১৯২০ সালের ২৬শে এপ্রিল। তারপর থেকে গত ৮৭ বছর যাবত তার লেজেন্ড কেবল বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ভারতে তিনি জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়ে থাকেন, আর গণিতশাস্ত্রেও তিনি একজন অতি বিরল জিনিয়াস হিসেবে স্বীকৃত।
কমপ্লিসিতে (Complicite) নাট্যদল এই নাটকটি পরিবেশন করে। টিকেট পাওয়া ছিল অত্যন্ত দুষ্কর। শুরু থেকেই শো-টি একদম সোল্ড্ আউট। একদিন ২ ঘন্টা আগে গিয়েছিলাম returned tickets কাউন্টার থেকে কিছু পাওয়া যায় কিনা এই আশায় - গিয়ে দেখি বিরাট লম্বা লাইন, প্রায় ২৫-৩০ জন মানুষ ইতিমধ্যে কিউ-তে দাড়ানো, পরে শুনি এরকম প্রতিদিনই চার-পাঁচ ঘন্টা লাইন দিয়ে মানুষ অপেক্ষা করেছে ফিরতি টিকেটের আশায়। তাই শেষদিন আমিও ৩ ঘন্টা আগে চলে যাই, এবং টিকেটটাও কপাল ভালো পেয়ে যাই।
দর্শকে টইটুম্বুর হলঘরে বসে ভাবছিলাম যে অল্প বয়সে মরে যাওয়া রহস্যময় জিনিয়াসদের জন্যে আমরা সবসময় কি রকম একটা অদ্ভূত টান অনুভব করি। সে হতে পারে শেলী বা বায়রনের মতো কবি, চে'র মতো বিপ্লবী, এল্ভিস বা জিম মরিসনের মত রক শিল্পী, অথবা রামানুজানের মতো একজন স্বল্পখ্যাত ম্যাথ জিনিয়াস। মন্ত্রমুগ্ধের মতো নাটক দেখলাম দুই ঘন্টা কোন বিরতি ছাড়াই। বর্তমান সময়েও গাণিতিকরা কি রকম পাগলাটে হতে পারেন এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তা কি রকম পরিণতি বয়ে নিয়ে আসতে পারে, সে নিয়ে কিছু পার্শ্ব-চরিত্র আর একটি সাইড-প্লট ছিল। সেদিনই ছিল শো-এর শেষ দিন - তুমুল করতালির মাধ্যমে নাটক শেষ হয় - দর্শকদের অনুরোধে বারংবার শিল্পীদের ফিরে আসতে হয় মঞ্চে।
রামানুজান আর A Disappearing Number নিয়ে কিছু লিংক -
ঈভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার রিভিউ - The Magic of Maths
গার্ডিয়ান-এর রিভিউ
নাট্যকার সাইমন ম্যাক্বার্নি-র সাথে টাইম্স পত্রিকার সাক্ষাত্কার
P.S. যে বার্বিকান সেন্টারে নাটক দেখলাম, সেটাও একটা দেখার মতো জিনিস। ষাটের দশকে নির্মিত বিশাল এই সেন্টারটি লন্ডনে আধুনিকতাবাদী স্থাপত্যের এক রীতিমত ভীতিপ্রদ নিদর্শন। যথার্থই এর নাম দেয়া হয়েছে brutalist architecture - অমানবিক স্থাপত্য। বিস্ময়ে শিহরিত হলাম, আর সেন্টার ঘুরে ঘুরে শ'খানেক ছবি তুললাম। সেই ছবি সমেত পোস্ট আরেকদিন দেওয়ার ইচ্ছে রইলো।
মন্তব্য
ছবিগুলির অপেক্ষায় রইলাম।
হাঁটুপানির জলদস্যু
আমিও ...
ঠিকাছে
কি মাঝি? ডরাইলা?
নতুন মন্তব্য করুন