পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার ছিলেন রিজওয়ানুর রহমান। কোলকাতার এই যুবক শহরের তিলজলা নামের অস্বচ্ছল এক পাড়ায় থাকতেন। পিতৃহীন অবস্থায় বেড়ে উঠেন তিলজলার এক টিনের-চালা ঘরে, বিধবা মায়ের আদরে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে অনেকটা নিজের চেষ্টায়ই চাকরি যোগাড় করেন কোলকাতার এক মাল্টিমিডিয়া সেন্টারে। সেখানে কম্পিউটার গ্রাফিক ডিজাইন শেখাতেন তিনি।
তার ছাত্রী হিসেবে সেখানে ভর্তি হন প্রিয়াংকা টোডি। রিজওয়ানের থেকে বিপরীত মেরুর মানুষ প্রিয়াংকা। প্রচন্ড বিত্তশালী এক মারওয়াড়ি পরিবারের কন্যা। তার বাবা অশোক টোডি প্রভাবশালী শিল্পপতি। লাক্স হোসিয়ারী ইন্ডাস্ট্রির মালিক - ২০০ কোটি রুপির উর্দ্ধে তার সম্পত্তির হিসাব। কোলকাতার সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় তাদের বসবাস।
দুই মেরুর এই দুই মানুষের পরিচয় কোলকাতার সেই আইটি সেন্টারে। পরিচয় থেকে প্রেম। একেবারেই সেকেলে বাংলা সিনেমার মত। টোডি পরিবার যখন জানতে পারে এই ঘটনা, তখন সিনেমার মতোই লংকাকান্ড বেঁধে যায়। (অশোক টোডির ভূমিকায় ইনাম আহমেদ অথবা রাজীব - মুখে পাইপ, পায়ে স্লিপার, পড়নে ফুলের ডিজাইন করা গাউন...)
প্রিয়াংকা আর রিজওয়ান টোডি পরিবারের কথা শোনে না। দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক, তাই নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। কোর্টে গিয়ে বিয়ে করেন এই বছরের ৩১ আগস্ট। প্রিয়াংকা স্বামীর সাথে তিলজলায় চলে যান - টিনের চালার নীচে রিজওয়ানের পরিবারের সাথে শুরু করেন নতুন জীবন।
প্রায় সাথে সাথেই অশোক টোডি তার কন্যাকে 'পুনরুদ্ধার' করতে তিলজলায় যান। কিন্তু রিজওয়ান-প্রিয়াংকার সংকল্পের মুখে শূন্য হাতে তাঁকে ফিরতে হয়। এরপরে থেকেই শুরু হয় পুলিশ আর গোয়েন্দা দপ্তর কর্তৃক নানান ভাবে দুইজনের (বিশেষত রিজওয়ানের) হয়রানি আর নাজেহাল।
সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখে প্রিয়াংকা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার বাবা-মার বাড়িতে যান - অশোক টোডি অসুস্থ এরকম একটি খবর পেয়ে। ফিরে আসার কথা থাকলেও প্রিয়াংকা আর ফিরেন না। রিজওয়ান বারংবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন তার স্ত্রীর সাথে, কিন্তু সমস্ত দুয়ারই রুদ্ধ করে দেয়া হয়। তিনি মানবাধিকার সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেন - ততদিনে আইনরক্ষাকারী সংস্থাগুলো তাকে হুমকি দিচ্ছে চরম পরিণতির।
সিনেমায় যা কখনো হয় না, বাস্তবে তাই হয়। পর্দায় প্রতিকুলতার বিরুদ্ধেও ফারুক আর ববিতার হয়তো মিলন হয় অবশেষে। কিন্তু বাস্তবে সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখে রিজওয়ানের লাশ পাওয়া যায় কোলকাতার অদূরে রেললাইনের উপর। তার মাথায় ছিল আঘাতের চিহ্ন। দেহ আবিষ্কার হবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পুলিশ ঘোষণা দিয়ে দেয় - এটা সোজাসাপ্টা সুইসাইড কেস, তদন্তের কিছু নেই। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থা আর রহমান দম্পতির শুভানুধ্যায়ীরা তাতে শান্ত হয় না। আস্তে আস্তে প্রতিবাদ দানা বাঁধতে আরম্ভ করে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়। সুষ্ঠু তদন্তের দাবি ঘণীভূত হতে থাকে। অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও আর এই দাবি উপেক্ষা করতে পারে না।
ঈদের আগের দিন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তিলজলায় যান রিজওয়ানের পরিবারের সাথে দেখা করার জন্যে। রিজওয়ানের মা কিশওয়ার জাহান-কে আশ্বাস দেন সুবিচারের। কিন্তু আসলেই কি বিচার পাওয়া যাবে? বিচিত্র এক নেক্সাস জড়িত হয়ে আছে এই কেসে - বিত্তশালী অশোক টোডি, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন CPI(M), বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর তার চেলা পুলিশ কমিশনার প্রসূণ মুখার্জী, এমন কি ক্রিকেট তারকা সৌরভ গাঙ্গুলীর আপন ভাই পর্যন্ত।
দুঃখ-ভরা এই ঈদে কি বিচার পায় কিশওয়ার জাহান, সেটাই এখন দেখার বিষয়। গল্পের কিছু বিবরণ পাবেন লাইভজার্নাল ব্লগার বনবিবি'র কাছ থেকে। দৃষ্টিপাতের কাছে লিখেছে দৃক ইন্ডিয়া। আর গুগল নিউজও সংবাদটি কভার করছে।
মন্তব্য
এ খবরটা আমারো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মনটা খারাপ হয়েছিল আনন্দবাজারে পড়ার পর। এ কেমন আমাদের পৃথিবী!
আপনার পোস্টের জন্য কৃতজ্ঞতা। আশা করছি সুবিচার হবে!
ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি তোমায়!
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
খুব মন-খারাপ-করা এক কাহিনী।
সুবিচার পাবেন না রিজওয়ানের মা - এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তবে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলে আমি বড়ো আনন্দিত হবো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
খুবই খারাপ ঘটনা। আমাদের সব মিডিয়া সত্য উন্মোচনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আশাকরি আগামী একমাসের মধ্যে অপরাধী অন্ততঃ ধরা পড়বে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
পড়লাম। দুঃখজনক খুব।
এখনও গেলো না আঁধার - - -
এই যুগেও সেই পুরনো ঘটনাই ঘটে চলছে! আশ্চর্য অনাধুনিক ,সেকেলে,বর্বর মন এখনও আধুনিক মানুষের।
রেজোয়ান ফিরে আসবে না। কিন্তু বিচার পাক তার জননী, এই প্রত্যাশাই করি। ইন্টারনেটের এক কোনের ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে নিজস্ব প্রতিবাদ জানাচ্ছি পুরো ঘটনার।
--তিথি
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
তাওতো পত্রিকায় প্রকাশিত হলো...
অনেকেই জানলো
অনেকেই ভাবলো কিছু একটা করা দরকার
অনেকে এসে অন্তত আশ্বাস দিলো
কিন্তু একই ঘটনা
কেউ জানে না কিন্তু ঘটে যায় এবং ঘটে যাচ্ছে
আছে না?
তাদের সবার জন্য বলা
পক্ষে না দাঁড়াতে পারি
বিপক্ষে যাওয়ার মতো যেন কুবুদ্ধি না হয় আমার
কি নির্মম!
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
দুঃখজনক...আসলে এই পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
নতুন মন্তব্য করুন