জর্জ আর দীপালী আয়োজন করেছিল এই ক্যাম্পের। রামস্বামিকে জিজ্ঞেস করে পরে জেনেছি এই ছবি বিক্রির টাকা নাকি একটা চার্চে যাবে, আর শিল্পিরা যে সব ছবি এঁকে দিয়ে যাবেন তার নাকি একটা প্রদর্শনীও হবে, কবে কোথায় তার অবশ্য কিছুই ঠিক হয়নি এখনও। আর এক বন্ধুর কাছে পরে শুনেছি, ঐ দুজন নাকি আর্ট ব্রোকার। ওরা বিভিন্ন জায়গায় এরকম সব ক্যাম্পের আয়োজন করে, আর সেটাই ওদের কাজ-ব্যবসা। কিন্তু আমি রামস্বামির কাছে শুনেছি, চ্যারিটির জন্যেই নাকি এই কর্মশালা!!
মাহমুদুল হক স্যার গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়েই খানিক গল্প করলেন, আমি আর নার্গিস দুজনেই ফেরার জন্যে পা বাড়িয়েছি দেখে বললেন, থাকো না কিছুক্ষণ, আমরা দুটো প্রদর্শনী দেখব, চলো আমদের সাথে। দুজনেই কিন্তু কিন্তু করছিলাম, কিন্তু স্যার জোর দিয়ে বললেন, আরে চলো তো! সম্ভবত সাংকোচের কারণ অনুধাবন করেই বললেন, আরে, অতো ভাবো কেনো? বেশি ভাবলে মেয়েদের মুখে ভাঁজ পড়ে, সৌন্দর্য নষ্ট হয়, চলো তো! তারপর ওদিকে কার উদ্দেশ্যে যেন হাঁক দিলেন, আমার সাথে এই দুই সুন্দরী যাবে, গাড়িতে যায়গা না থাকলে ট্যাক্সি ভাড়া করো! ট্যাক্সি ভাড়া করতে হলো না, গাড়িতেই জায়গা হলো। বিশালাকারের দুই গাড়ির আয়োজন করে রেখেছিল দীপালীরা। প্রায় পনেরজন মানুষকে নিয়ে সেই দুই গাড়ি চললো গ্যালারি সংস্কৃত-র দিকে। গণেশ হালুই-এর ছবির প্রদর্শনী দেখতে। সন্ধে তখন ভালো মতনই ঘনিয়েছে। শীতের সন্ধে ৬'টাকেই রাত বলে ভুল হয়।
বলতে ভুলে গেছি, আমার কিছু প্রপ্তিযোগ হয়েছে। হাশেম খান আমাকে দিয়েছেন তাঁর একটি বই- নিরাবরণ কন্যার গল্প অল্প। ছোটগল্পের সংকলন। আমি লিখি সেটা তিনি আগেই শুনেছিলেন সেজন্যেই বইটা দিলেন, বললেনও সেটা আর ওঁর বই পড়বো কিনা সেটা জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলেন। আপ্লুতচিত্তে বই ব্যাগস্ত করে নিচে নেমে এসেছিলাম। হাশেম খানের ঘরেই দেখা হলো যোগেন চৌধুরীর সাথে, তিনি এসেছিলেন ওঁদের সাথে দেখা করতে। পরিচয় হলো কিন্তু কথা খুব একটা হয়নি, কারণ তিনিও বেরুচ্ছিলেন আর আমিও। গাড়িতে বসেই শুনলাম, রাতে খাওয়ার নেমন্তন্ন আছে শিল্পি শুভাপ্রসন্নর বাড়িতে আর সেখানেও হক স্যার আমাদের যেতে বলছেন। আবারও কিন্তু কিন্তু করার পালা। আমার যেতে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু ফিরতে রাত হয়ে যাবে আর আমি একলা, আর আরেকটা ব্যপার তো আছেই, আমি এঁদের কাওকেই চিনি না, নিমন্ত্রিতও নই কাজেই এবারের কিন্তু কিন্তুটা বেশ জোরালোই ছিল। হক স্যার কোন কথাই শুনতে রাজী নন, গাড়িতে বসেই অন্য গাড়িতে থাকা জর্জের উদ্দেশ্যে হাঁক দিলেন, আমার দুই বান্ধবী আছে, এদের নিয়া যাওয়া যাইব না তোমাদের শুভাপ্রসন্নর বাড়িতে? জর্জ জানায়, কোন সমস্যা নেই, চলুন!
গ্যালারি সংস্কৃতে ছবি দেখতে গিয়ে আলাপ হল গ্যালারির অবাঙালি মালকিনের সাথে। তদারকিতে ব্যস্ত থাকলেও সম্মানিত অতিথি সমাগম হয়েছে সেটা তাঁর চোখ এড়ায়নি। সম্ভবত জর্জ আগে থেকেই বলে রেখেছিল অতিথিদের কথা। এগিয়ে এসে আলাপ করলেন প্রত্যেক অতিথির সাথে, নিজেই সাথে সাথে ঘুরে ফিরে দেখালেন গ্যালারির এমাথা ওমাথ, এঘর ওঘর। সালোয়ার কুর্তা পরা মাড়োয়াড়ি মহিলা, বয়েস খুব বেশি নয়, কথায় বার্তায় দারুণ চৌখস আর তুখোড় ব্যবসাদার মানুষ। মিষ্টি কিন্তু মাপা হাসি সারাক্ষণ মুখে ধরে রেখে সাথে সাথে থাকলেন, নিজে হাতে বিশাল কাঠের ট্রেতে করে চায়ের কাপ নিয়ে ঘুরে ঘুরে চা দিলেন সবাইকে। বিশাল হলঘরের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রচুর হ্যান্ডিক্রাফটের জিনিস পত্র, এমনভাবে রাখা, দেখলে মনে হয় যেন জাষ্ট ফেলে ছড়িয়ে অযতনে রেখে দেওয়া হয়েছে কিন্তু একটু নজর করলেই বোঝা যায় প্রতিটি জিনিসই ভীষণ যত্নে রাখা হয়েছে আর ইচ্ছে করেই ওভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেওয়ালের ধার ধরে সব চকচকে বাদামী কাঠের শেলফ, যাতে ছবি সংক্রান্ত সব বই, ম্যাগাজিন। বেরুনোর মুখে প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিলেন তাঁর নাম লেখা কার্ড, হাসিটি ধরে রেখে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন সবাইকে।
সল্টলেকে শুভাপ্রসন্নবাবুর বাড়ি যেতে রাজী হল না নার্গিস, গৌতমদা বাড়িতে একলা আছে আর ফিরতে সত্যিই রাত হয়ে যাবে বলে। গ্যালারি সংস্কৃত আর অ্যাকাডেমী অফ ফাইন আর্টস ঘুরে ৩টে প্রদর্শনী দেখে ওখান থেকেই বিদায় নিল নার্গিস, কাল আবার দেখা হবে বলে। সঙ্গীতের ছাত্রী নার্গিসের কাছ থেকে রনবী সুলুক সন্ধান নিলেন কোথায় কী গান পাওয়া যাবে। গাড়িতেই আলাপ হল শেখ আফজালের সাথে। তিনিও চারুকলায় পড়ান আর একসময় ছাত্র ছিলেন এঁদের, যাদের সঙ্গে তিনি এসেছেন। গানের ব্যপারে তিনিও আগ্রহী আর মিউজিক ওয়ার্ল্ডে তিনিও যাবেন গানের খোঁজে সেটা বলে রাখলেন।
রোকেয়া আর দীপালী বসেছিলেন গাড়ির সামনের সিটে, তাঁরা নিজেদের মধ্যেই কথায় মগ্ন রইলেন সারা পথ। সেই গাড়িতে আমি ছাড়াও ছিলেন আমিনুল ইসলাম, রনবী, হাশেন খান, শেখ আফজাল, মাহমুদুল হক আর আবু তাহের। আরও ছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের শিক্ষক অশোক ভৌমিক, যিনি সারা পথ তুমুল আড্ডা দিলেন সকলের সাথে, বাঙাল ভাষায় কথা বলে নিজের প্রায় ভুলে যাওয়া মাতৃভাষাকে আবারও খানিকটা যেন ঝালিয়ে নিলেন এই ফাঁকে। আরও দুজন ছিলেন, যাঁদের সাথে আমার কথা হলেও পরিচয় হয়নি, আমি এমনকি তাঁদের নামও জানি না। শিল্পি শুভাপ্রসন্ন'র বাড়িতে গিয়ে সকলেই প্রসন্ন হয়ে ফিরে আসবেন, এই বলে হাসি তামাশাও করলেন সকলে মিলে। সবচাইতে বেশি আলোচিত বিষয় ছিল এদেশীয় বাঙালিদের আতিথেয়তা। এ নিয়ে এক একজন আপন আপন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলে আর আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন, কী রকম আতিথেয়তা পাবেন যাত্রাপথের শেষে!
চলবে--
মন্তব্য
ছবির টাইটেলে এই desc=টা কেন আসছে?
হেল্পপপপপ...
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
প্রথম পর্বটা পড়েই অপেক্ষায় ছিলাম, খুব ভাল লাগছে। এরকম একটা লেখার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ স্নিগ্ধা...
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। তারপর?...
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
চলুক, চিত্রগল্প।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
নতুন মন্তব্য করুন