নীল নির্জন পথে: কংসাবতী

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: শনি, ০২/০২/২০০৮ - ১২:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মোহনায় কাঁসাই আর কুমারীমোহনায় কাঁসাই আর কুমারী

ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল ঝাড়খন্ডের ঘাটশিলার। কাজের ফাঁকে দু'দিনের ছুটি কাটানোর হঠাত্ প্ল্যান আর আগেরদিন সন্ধ্যেয় টিকিট কেটে পরদিন ভোর ভোর বেরিয়ে পড়া। শীতের সবে শুরু হলেও ঠান্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে। ট্যাক্সিওয়ালার বেগড়বাইয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভোরের ট্রেনের সময় পার। এবং তারপরেও প্রায় ডবল ভাড়া দিয়ে ষ্টেশনে যাওয়া, টিকিটের পয়সা যদি খানিকটা হলেও ফেরত পাওয়া যায়। আদ্ধেক পয়সা হাতে নিয়ে পরবর্তী ট্রেনের খোঁজ, নাহ! এখন আর কোন ট্রেন নেই সেই বেলা দুটোর আগে। আর থাকলেই বা কী, উইদাউট রিজার্ভেশন থুড়ি না যাওয়া যাবে কোথাও!

বস্তা আকারের জ্যাকেট গায়ে, পিঠে ঝোলানো স্যাক। আমরা হাঁটি বাসষ্টপের উদ্দেশ্যে। এবং সেখানে পছন্দসই কোন বাস না পেয়ে হাওড়া বাসগুমটি থেকে ধর্মতলা বাসগুমটি।পৃথিবীর তাবত্ ট্যাক্সিওয়ালা তখন আমার শত্রু। গন্তব্যের ঠিকানা নেই, বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছি কোথাও একটা তো যাবই। আর এভাবেই ৯ঘন্টা বাসে বসে বসে পৌঁছে যাই বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরে। সন্ধে হয় হয়। ছোট্ট পাহাড়ি জায়গাটায় সন্ধে নেমেই গেছে। সারাদিন বাসে বসে থেকে থেকে হাতে-পায়ে খিল। পাহাড়ি জায়গায় শীতের সন্ধে বড় তাড়াতাড়িই নেমে আসে, আর বিশেষ করে আমাদের যেখানে কোন ঠিকানা নেই। ভরসা তবু থাকে, মাথা গোঁজার ঠাঁই একটা ঠিক জুটেই যাবে। আর জুটেও যায়। পঞ্চায়েত সমিতির এই গোলবাড়িটাকে আমি হোটেল বলেই ভেবেছিলাম। আর পাহাড়ের ঠিক কোলের উপর চাঁদের মত গোল বাড়িটাকে দেখে শীতের সেই ভর সন্ধেয় ভালই লেগেছিল। ঘরের ভিতরে গিয়ে ক্ষণিকের সেই ভালোলাগা উবে যেতেও অবশ্য সময় লাগেনি। টিমটিমে আলোতে আলো যতটা আঁধার তার চাইতে অনেক বেশি। নড়বড়ে দরজা, খটর খটর চৌকি, লাল প্লাষ্টিকের সবেধন নীলমণি একখানি চেয়ার, যার উপরে স্যাক আর জিনিসপত্রের ঢিপি আর ছোট্ট খুপরি জানালা। আরও একটা জিনিস আছে, একটি ছোট্ট ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি। ছাদের উপরে দূর থেকেই ডিশটিভির অ্যান্টেনা দেখে আশ্বস্ত হয়ছিলাম, যাক, শাহরুখ খানের মত আমরাও বসে বসে ডিশ করব আর উইশ করব আজ! তো এই আমাদের রাত্রিআবাস! ভয়চকিত চোখে এদিক ওদিক তাকানো দেখে সাথী আমার অভয় জোগায়, ভয় কী, আমি তো আছি!

বাস থেকে নেমে হাত পা সোজা করার ফাঁকে রাস্তার ধারের অশোক হিন্দু হোটেলের চা খেয়ে একটু খোঁজ খবর নেওয়া গেল, রাতের খাওয়া কোথায় জুটবে সেটাও ভাবনা, সারাদিন তো বাসে বসে প্যাকেটের কেক,বিস্কুট খেয়েই কেটেছে কাজেই অশোক হিন্দু হোটেল দেখামাত্রই ভাতের ক্ষিদে পেয়ে গেছে। আমাদের গাইডও জুটে গেল বাস থেকে নামামাত্রই, ভ্যানচালক। সে আমাদের ব্যাগ-ব্যাগেজ ভ্যানের উপরে বসিয়ে দিয়েছে বাস থেকে নামামাত্রই, হোটেলের নাম-ঠিকানা, বেড়ানোর জায়গার সব খোঁজও দিয়ে দিল দু মিনিটের মধ্যেই। কাল সকালে এসে বেড়াতে নিয়ে যাবে সে ব্যবস্থাও পাকা ও‌ই দু মিনিটেই। হিন্দু হোটেলের পরিচালক জানিয়ে দিলেন, রাতে খেতে হলে অর্ডার দিয়ে যাবেন, রান্না করে রাখব। সোনাঝুরি পাহাড়ের উপরে সোনাঝুরি হোটেলের বিজ্ঞাপণ রাস্তার ধারে ধারে, আমার সেখানেই যাওয়ার ইচ্ছে হল পাহাড়ের উপরে হোটেল শুনে কিন্তু ভ্যানচালক শোনালেন, পাহাড়ের গায়ে থাক কাটা কাটা সিঁড়ি যেগুলো বেয়ে হোটেলে পৌঁছুতে হয়, শুনেই উৎসাহ গেল, এই অন্ধকারে জিনিসপত্র নিয়ে পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে চড়া সম্ভব নয় অগত্যা পাঞ্চায়েত সমিতির গোলবাড়ি লজ।

লজের ঘরে জিনিসপত্র নামিয়ে রেখে একটু হেঁটে আসার জন্যে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তার ধারে ধারে বেশ দূরে দূরে একটা করে ল্যাম্পপোষ্ট, মরাটে হলদে আলো খুব বেশিদূর যায় না যদিও। চড়াই বেয়ে খানিকটা হাঁটার পর একটা রাস্তা দেখলাম বাঁদিকে চলে গেছে, সে রাস্তা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত আর দুধারে সারসার সব দোকান, ঠিক যেমনটা দেখা যায় সমুদ্রের ধারের যে কোন বেড়ানোর জায়গায়। তবে কী আমরা সমুদ্রের ধারে কোথাও এলাম? না । তা কী করে হবে! আমার কোন ধারণা নেই তখনও কোথায় এসেছি। বাসের টিকিট করা হয়েছিল মন্দির শহর বিষ্ণুপুরের জন্যে, পোড়ামাটির সব মন্দির নাকি আছে সেখানে, কিন্তু আমার কেন জানি বিষ্ণুপুরে নামতে ইচ্ছে করল না, তাই আবারও টিকিট কেটে চলে এসেছি মুকুটমণিপুর, কী আছে এখানে আমি অন্তত জানি না, বাসগুমটির দাদু অবশ্য বলেছিলেন, আপনারা মুকুটমণিপুর চলে যান, ভালো লাগবে। কেন ভালো লাগবে সেটি জিজ্ঞেসও করা হয়নি আর তিনিও বলেননি। আমার সবজান্তা সঙ্গী হয়তো জানেন কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল না। কোথাও একটা গেলেই তো হল। দু'দিন কাজ-কর্ম ছাড়া থাকা, প্রকৃতির কাছাকাছি কোথাও একটা থাকা, কাজেই কী আছে জেনে কী হবে... দেখা যাক...

... ... ... ... ...
‌‌‌‌‌


মন্তব্য

মৃন্ময় আহমেদ এর ছবি

বাহ... বেশ তো।

====================
অবিরাম ছুটে চলায় হঠাৎ থমকে যাওয়া

'

=========================================
নিজেকেই নিজে চিনি না, পরকে চেনার মিছে বাহানা

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

অতীব খাসা!

এ জীবনে পৃথিবীর বহু জায়গা অদেখা থেকে যাবে বলে ভ্রমণকাহিনীগুলো সোত্সাহে গিলি। আর সুলিখিত হলে তো কথাই নেই!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

কারুবাসনা এর ছবি

জমেনি,এগোও।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

শ্যাজা এর ছবি

হুমম...


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।