টালির চৌচালা দাঁড়িয়ে আছে মাটির দেওয়ালে ভর করে। দেওয়ালের তিন দিন ঝকঝকে তকতকে গোবর নিকোনো আর একদিকের দেওয়াল জুড়ে আদিবাসী বধুর চিত্র পরিকল্পনা। তার টুকরো টুকরো সুখ, বছর জুড়ে ছেঁড়া কাপড়ের মত লেপ্টে থাকা সমস্ত দু:খকে একপাশে সরিয়ে রেখে মন-প্রাণ ঢেলে সে তার মেটে দেওয়ালখানিকে সাজিয়েছে মনের সমস্ত মাধুরী ঢেলে। হাতে তৈরি সব রং, হাড়ির তলার কালি, গাছের পাতার রসে সবুজ, পোড়ানো ইটের গুড়োয় তৈরি লাল আর আরও সব রং যা তার দরকার সব সে বানায় এই সব গাছ-পাতা- চুন-সুরকি আর ফুল-ফল দিয়ে।
বছরভরের অনাহার-অর্ধাহার সরিয়ে রেখে গায়ে জড়িয়েছে কড়কড়ে নতুন পাটাভাঙা লাল শাড়িখানি। একটি একটি পয়সা জমিয়ে যা সে কিনেছে মকরের এই সংক্রান্তির জন্যে। নবান্নের উৎসবের জন্যে। টুসু-র পুজার জন্যে। টুসু-ভাসানের মেলার জন্যে।
"টুসু মাকে ঘরে এনেছি ভাবনা কিসের আর,
কাটা ধানের পালুই কৈরে ভৈরেছি খামার।
এক কুচুরি ভাজান, আর চার কুচুরি ভাত,
এক কুচুরি রাইখ্যেছি বীজ, করব গো আবাদ।।"
নিকোনো উঠোনে যেন কেউ বিছিয়ে দিয়েছে সজনের ফুল। উঠোনের কোণার সজনে গাছের পাতা দেখা যায় না, শুধু ফুল শুধু ফুল। সরু সরু কচি সজনে ডাটা ঝুলছে ডাল জুড়ে। উঠোনে সদর্পে ঘুরে বেড়ায় পোষা লড়াকু ষাঁড়াটি (মোরগ)। বিকেলের মেলায় সে যাবে লড়াই করতে, জিতলে ঘরে আসবে আরেকটি লড়াকু মোরগ আর হেরে গেলে সে চলে যাবে লড়াইয়ে যে জিতেছে তার কাছে।
লম্বা ঘোমটার ফাঁকে দেখা কালো মুখটি, নাকে রুপোর নোলক গলায় মোটা বালার মত হার। কালো মুখ চকচক করে পুরোনো গয়নার ঝিলিকে। কথা বলতে গিয়ে অকারণ লজ্জায় রাঙা হয় বউটি। দেওয়ালচিত্রটি কার আঁকা জানতে চাইলে সলজ্জে সে জানায়, তারই আঁকা ঐ দেওয়াল জোড়া ছবি। প্রতি বছর মকরের মেলার আগে সে তার ঘরে দেওয়ালে নতুন মাটি লাগায়, মুছে দেয় আগের বছরের চিত্রকর্ম। হাত দিয়ে ঘষে ঘষে মসৃণতর করে তোলে দেওয়ালকে আর তারপর দেওয়ালে সে আঁকে। তার সমস্ত কল্পনা, মনের সবটুকু মাধুরী মিশিয়ে তার ভেতরকার শিল্পি ওই মেটে দেওয়ালখানিকে রূপান্তরিত করে এক বিশাল চিত্রকর্মে।
উঠোনে হামাগুড়ি দেয় ন্যাংটো শিশু।
শুধু ওই একটি বাড়ি বা একটি দেওয়াল নয়, পুরুলিয়ায় প্রত্যন্ত গ্রামে মকর সংক্রান্তির মেলা দেখতে গিয়ে দেখতে পেয়েছি এরকম অসংখ্য চিত্রকর্ম। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনের দেওয়াল জুড়ে আঁকা অতি সুক্ষ, অসাধারণ সব শিল্প। মুখে গান। টুসু'র গান। নবান্নের গান।
"লবান্নের ধান ভাইনলাম দিনক্ষণ কৈরে,
তরে-ও কুড়া রাইখলাম টুসালুর তরে।
টুসালু গো-রাই, টুসালু-গো ভাই,
তুয়ার দৌলতে মোরা ছবড়ি পিঠা খাই।"
আদিবাসী এই সব গ্রামগুলিতে অভাব এঁদের নিত্যসঙ্গী। পাথুরে মাটিতে ফসল ফলে না। জঙ্গলে গাছ নেই, পশু নেই। সরকারী সুযোগ-সুবিধা এঁরা কতটুকু পান সে ওঁদের চোখ-মুখে লেখা। কাজ বলতে দূরের আসানসোল, রানীগঞ্জের কয়লাখনিতে কুলি-কামিনের কাজ। কোন অভিযোগও নেই ওঁদের। অভিযোগ থাকলেও কার কাছে করবেন সম্ভবত তাও জানেন না। গৃষ্মে নিদারুণ দাবদাহে পোড়ে মাটি,শরীর। শীতে থরথর কাঁপে বস্ত্রহীন গোটা আদিবাসী সমাজ। শিশুর ভাঙা পায়ে মন্ত্র পড়া চুল বেঁধে দিয়ে মা ভাবেন, এতেই ঠিক হয়ে যাবে ভাঙা পা। সবার জন্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বড় বড় বুলি নেতারা তবুও আউড়েই যান।
মন্তব্য
দেওয়ালচিত্রের ছবি আপলোড করতে পারছি না, ছবি আকারে বড়। ঠিকঠাক করে পরে তুলে দেব।
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
ভালো লাগল। এ আদিবাসীদের গোত্রের নাম কি? টুসু কি দেবীর নাম?
=============
"কথা বল আমার ভাষায়, আমার রক্তে।"
টুসু এক আদিবাসী কন্যা যে এখন দেবীরূপে পূজিত হয়। টুসুর কথা লেখার ইচ্ছে আছে। খুব শিগগিরই লিখব।
মাহাতো, ওরাও, সাঁওতাল, মুন্ডা, লোধা-শবর, মালপাহাড়ি আর আরও সব আদিবাসী জনসমাজে টুসুর পুজো হয়।
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
আশ্চর্য। কাকতালীয় ভাবেই, এই লেখা পড়ার সময় আমার ঘরে সত্যজিতের আগন্তুকের সউন্ডট্রাকটা বাজছিল, মাদোলের বাজনায় এই লেখাটি একাকার হয়ে গেল।
চমৎকার ভিজুয়ালাইজেশান। শিঘ্রি স্ক্রিনপ্লে লেখা শুরু করুন।
দুর্দান্ত,
স্ক্রিনপ্লে?
এই লেখা পড়ে এটাকে কি সিনেমা বা নাটক বলে মনে হল নাকি!
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
একদম...আমি তো এর মধ্য উঁচুদরের একটা ডকুড্রামার গন্ধ পেলাম। আপনার উপস্থাপনার যে শক্তি, তা শুধু লেখক/পাঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা অন্যায়। দ্যাখক আর শুনকদের ও সুযোগ করে দিন...
আপনার এই লেখায় মাটির গন্ধ পেলাম।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
লেখা পড়ে সত্যি বোঝা গেল না দেওয়ালের মধ্যে কাজগুলোর বিস্তার ঠিক কতটুকু ছিল, আরেকটু বিশদভাবে লেখ বিশেষ করে ম্যাজিকের জায়গাগুলো।
যেমন- গাছের মত এক মানুষ দাঁড়িয়ে পাঁকের শরীরের পরে তার মাথা যেন এক মস্ত পদ্মফুল। এইগুলো একটু বিশদে ব্যাখ্যা কর, তার এই সামাজিক বাতাবরণের মধ্যে সে কী করে এই ধারণায় উপনীত হ্য়, কিভাবে আসে তার আলো বাতাস। আর যদি তার স্নায়ুতন্ত্রধর্মী রেখাগুলো নিয়ে একটু বিশ্লেষণ কর, তাহলে ভালো লাগবে।
আহা! ম্যাজিক তো কী অপূর্বভাবে আছে। মটিফতত্বের কথা মাথায় রেখ। যেখানে মনুষ্যজীবন একটা ছোট্ট পাখির মত আর রূপ রসে ভরা প্রকৃতি এক মস্ত ফুল। তুমি দেখেছ কি?
বড় করে না লিখলে ওই শিল্পের গুণমান যে কত বড় তা কি বোঝা সম্ভব?
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
কারুবাসনা,
হুমম...
বোঝা আর না বোঝার মাঝখানে যেন আটকে গেলাম।
আমি ব্লগ লেখার সময় একটা শর্টকাট তো দিইই আর সেটা প্রায় সব সময়েই। তবে ওই ছবিগুলো দেখে তুমি যা বুঝবে বা সেটা যেভাবে বলতে পারবে সে, সেভাবে আমি কোনোদিনই পারব না এটা নিশ্চিত। আমি ওই বউটির কথা বলতে পারব, খানিকটা হয়তো বুঝে, খানিকটা নিজের বোধ থেকে। কিন্তু ওই ছবি নিয়ে? উঁহু...
সে অনেক উঁচুতলার জিনিস। আমার হাত অতদূর পৌঁছোয় না... তুমি একটু বেশি বেশিই আশা কর আমার কাছ থেকে...
ম্যাজিক অবশ্য আমিও দেখি মাঝে মধ্যে তবে সেও খুব একটা ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে নয়। বেশ দূরেরই বস্তু।
যাগগে,
তোমার আইজলে ঠান্ডা কেমন?
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
ঠিক।
আইজল?
আমি তো বাড়ি বসে!
ছবি লাগান গেল না তাইলে!!
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
নাহ...
ছবি দেওয়া গেল না। খালি এরর আসে।আমার বোধ হয় কোটা শ্যাষ
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
ছবি তুলে দিলাম।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
রোজ রোজ কি সম্ভব?
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
নতুন মন্তব্য করুন