গতকাল একটি ন্যাংটো শিশু মাদুরে শুয়ে চীৎকার করে কাঁদছে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম নন্দনের সামনের ফুটপাথে। আশে পাশে কেউ নেই। বড়জোর মাস তিনেক বয়েস হবে শিশুটির। দাঁড়িয়ে পড়ে ইতিউতি তাকাই, শিশুটির মায়ের খোঁজে।চোখে পড়ে, খানিক দূরে ফুটপাথেই দাঁড়িয়ে রোগা একটি মেয়ে এক পেয়ারাওয়ালার সাথে খেজুর করছে । ছেঁরা শাড়িতে শরীর যতটুকু ঢাকা খোলা তার চাইতে বেশি। মাঝে মাঝেই সে এদিকপানে তাকিয়ে দেখছে, নজর শিশুটির প্রতি। কেন যেন মনে হল, ও'ই শিশুটির মা। নাদুস নুদুস শিশুটি একটি মেয়েশিশু। গায়ে জড়ানো কাঁথা সরে গিয়েছে। শুধু মাদুরের উপর শুয়ে শিশুটি চিল চীৎকারে কাঁদছে আর নিজের হাত মুখে পুরে খাওয়ার খোঁজার চেষ্টা করছে। আমি দাঁড়িয়েই আছি দেখে পেয়ারাওয়ালার সাথে গল্প করা বাদ দিয়ে ফুটপাথবাসীনী মেয়েটি এগিয়ে আসে তার শিশুকন্যার দিকে। আমি ধীরপায়ে এগিয়ে যাই ওদেরকে পেছনে ফেলে। বারে বারেই তবু নিজের অজান্তেই যেন ঘাড় ঘুরে যায় ফেলে আসা পথে, শিশুটির দিকে। মায়ের ছেঁড়া আঁচলের আড়ালে শান্ত হয়েছে ছোট্ট মেয়েটি। দেখতে পাই, কটমিটিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে ওর মা। আমি শিশুটিকে মাথা থেকে নামিয়ে পা চালাই তাড়াতাড়ি।
দু'দিন ধরে ওই ফুটপাথবাসী মা ও মেয়েটি আমার মাথায় নড়ে চড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে অবিরত। আজ সকালেও জানলার ধারে বসে আধখানা বোজানো পুকুরে হারিয়ে যাওয়া পানকৌড়ি দুটিকে খোঁজার চেষ্টা করছিলাম মনে মনে। মন চলে যায় পেছনদিকে। বেশ অনেকটা পেছনে।
নাটোরের মেয়ে নীলুর সাথে আমার আলাপ হয় এই কলকাতাতেই। আমার পুরনো বাড়িতে একদিন আমাদের পরিচিত এক লোকের সাথে নীলু এসেছিল একটি সাহায্যের আবেদন নিয়ে। না। টাকা-পয়সার সাহায্য নয়, নীলু এক জজসাহেবের স্ত্রী। টাকা পয়সার তার অভাব নেই। সমস্যাটি কি সেটিও নীলু নিজমুখে বলতে পারছিল না। সাথে করে নিয়ে আসা চেনা মানুষটি আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে গল্পটি শোনালেন।
নীলু কলকাতায় এসেছে একটি শিশু সন্তানের জন্যে। নিজে সন্তান ধারণে অক্ষম নীলু শুনেছে কলকাতায় নাকি যেখানে সেখানে ফেলে যাওয়া, পরিত্যাক্ত শিশু পাওয়া যায়। সেই রকমই একটি শিশু নিজের জন্যে চায় নীলু। মা হতে চায় নীলু। বেশ কয়েকদিন ধরে কলকাতায় একটি হোটেলে নীলু ছিল তার স্বামীর সাথে, ছুটি শেষ বলে স্বামী তার ফিরে যাবে দেশে, নীলু থেকে যেতে চায় কলকাতাতেই, যতদিন না একটি শিশু খুঁজে পাওয়া যায়, যাকে নীলু মানুষ করবে নিজের সন্তান বলে। একা মহিলা হোটেলে কি করে থাকবে অনির্দিষ্ট কাল, তাই তার স্বামীর কোর্টের এককালীন মুহুরী সুশীলবাবুর দ্বারস্থ হয় নীলু, সুশীলবাবু তাকে আমার কাছে নিয়ে আসে, কিছুদিন যদি আমি থাকতে দিই আমার বাড়িতে!
খানিক বাকরুদ্ধ অবস্থায় থেকে ঘরের ভেতরে যাই নীলুর কাছে। নীলুকে বলি, থাকুন আপনি আমাদের কাছে, আপনার যতদিন প্রয়োজন। নীলু উঠে এসে আমার হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে। বলে, আপনাদের কষ্ট হবে জানি কিন্তু আমি নিরূপায়!
গড়পরতা বাঙালীর তুলনায় একটু বেশিই লম্বা বলে মনে মনে আমার বেশ একটা অকারণ অহংকার ছিল কিন্তু নীলুর সামনে নিজেকে আমার বেঁটে বলে মনে হল। কম করেও পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা ( পরে জেনেছি নীলুর উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি) নীলু আর তেমনি দশাসই চেহারা। গায়ের চকচকে কালো রঙে আলো যেন ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। মাথায় তেমনি কুচকুচে কালো কোঁকড়া চুল ঘাড়ের উপরে ছোট করে কাটা। বাঙালী বলে ভাবা শক্ত নীলুকে। ধবধবে সাদা মুক্তোর মত দাঁতে নীলুর হাসিটি ভারী মিষ্টি। তবে নীলুর মুখে হাসি আমি কমই দেখেছি।
সুশীলবাবুর সাথে নীলু তখনকার মত বেরিয়ে যায়, ওর স্বামী চলে গেলে জামা কাপড় নিয়ে আমার এখানে নীলু থাকতে আসবে পরদিন সকালে। নীলুর স্বামী তখন নীলুর সাথে আসেননি, শুনলাম তার মত নেই নীলুকে এভাবে এখানে রেখে যাওয়ার, একে বিদেশ তায় অচেনা লোকের বাড়িতে এভাবে জোর করে অতিথি হওয়া। আমার কেন জানি মনে হল, যেটুকু শুনলাম গল্প বোধ হয় শুধু এটুকুই নয়। কিন্তু প্রায় অপরিচিত একজন মানুষের কাছে তার ব্যাক্তিগত কোন কথা জানতে চাওয়াটা শোভন নয় বলে মুখে হাসি ধরে রেখে নীলুকে বিদায় দিই, কাল সকালে নীলু আসবে থাকতে।
বিকেলে আবার ডোরবেল। নীলু। স্বামীকে সাথে করে নিয়ে এসেছে আলাপ করিয়ে দিতে, কোথায় থাকবে কাদের কাছে থাকবে সেটাও ভদ্রলোক দেখে যাবেন! ইনি পলু! নীলু আলাপ করিয়ে দিল। জজসাহেবকে আগে কখনো না দেখলেও তার আসল নামটি আমার অজানা বা অচেনা নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কোর্টের তখনকার সাবজজ ইনি। জমি-জমা সংক্রান্ত একটি মামলার জেরে আব্বা কোর্টে গেছিলেন একবার, তখন এই জজসাহেবের নাম শুনেছি আব্বার মুখে। ধপধপে ফর্সা গায়ের রং। মাঝারি উচ্চতার পলুকে ভীষণ ভালো দেখতে। ভীষণ মিষ্টি এক হাসি পলুর মুখে। ধন্যবাদ জানাতে এসেছে পলু। নীলুকে যেন একটু দেখি এই আবেদন পলুর চোখে মুখে ।
পরদিন নীলু আসে স্যুটকেস সহ। সুশীলবাবুও আসেন সাথে। ইনি সারাদিন ঘুরে বেড়ান নীলুকে সাথে নিয়ে। বস্তিতে, হাসপাতালে অনাথ আশ্রমে। একটি অনাথ বা পরিত্যাক্ত শিশুর খোঁজে। সকালে বেরিয়ে নীলু রাতে ফেরে। মুখ হাত ধুয়ে আমার কাছে বসে গল্প করে, সারাদিনে কোথায় কোথায় গেল, কী কী দেখল। বাচ্চা বোধ হয় এবার একটা পাওয়া যাবে! আরো নানান কথা। নীলুর নিজের কথা। ধীরে ধীরে জানতে পারি নীলুর গল্প।
নাটোরের এক বিশাল বড়লোকের একমাত্র মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে প্রেমে পড়ে কুষ্টিয়া থেকে পড়তে আসা এক নিম্নবিত্ত ছেলে রাশেদ ( সঙ্গত কারণে আসল নামটি দিলাম না)। কিভাবে কখন দুজনে কাছে আসে, প্রেমে পড়ে সে নীলু নিজেও জানে না। ইউনিভার্সিটিতে নীলুকে ছেলে-মেয়েরা কম ক্ষেপায় না কালো কুচ্ছিত বলে। নিগ্রো বলে লোকে প্রকাশ্যেই আওয়াজ ডেয় নীলুকে। ছেলেবেলা থেকেই শুনে শুনে এসব নীলুর গা সওয়া। কান দেয় না সে এই সব কথা বা আওয়াজে। রাশেদ একমাত্র ব্যাতিক্রম যে কোনদিন নীলুকে তার চেহারা নিয়ে কিছু বলেনি। নীলু নিজেও জানে যে রাশেদের সঙ্গে ওকে মানায় না। কিন্তু প্রেম! সে যে মানে না মানা।।
বাড়িতেও এক সময় জানাজানি হয়ে যায়। প্রবল শাসন হয় দু' তরফ থেকেই। নীলু আর রাশেদ লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলে পড়াশোনা শেষ না করেই। নীলুর বাবা মেয়েকে বলে দেন, সে যেন আর মুখ না দেখায় বাবাকে। রাশেদের বাবা বলেন, তার স্বপ্ন ছিল ছেলে তার হাকিম হবে। কোথায় হাকিম কোথায় কি, ছেলে কোথা থেকে এই অলম্বুস ঘরে নিয়ে এসেছে! রাশেদের বাবা যদিও তাড়িয়ে দেন না বাড়ি থেকে কিন্তু কিছু শর্ত আরোপ করেন। খেতে পরতে দেবেন তিনি ঠিকই ছেলে-বৌকে কিন্তু রাশেদের পড়াশোনার খরচ তিনি আর দেবেন না। রাশেদ মেনে নেয় সব শর্ত। নীলুর কানে সবই আসে। মাথা নত করে চুপ করে থাকে নীলু।
চারদিকে তখন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সবে মাথা গজিয়ে উঠতে শুরু করেছে। সেই রকমই একটা স্কুলে চাকরী নেয় নীলু। রাশেদকে পড়া শেষ করার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত পাঠায় সে। ভাত কাপড় তো শ্বশুরই দেন, নীলুর চাকরীর পয়সায় পড়াশোনা চলে রাশেদের। ততদিনে সে নতুন নাম পেয়েছে নীলুর কাছ থেকে। পলু। ঢাকায় বেড়াতে গেছিল ওরা একবার। সেখানে চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়ে কী এক অদ্ভুত পাখি দেখেছিল ওরা, পলু পাখি। সেই থেকে রাশেদ হয়ে যায় পলু।
আজ এটুকুই থাক...
মন্তব্য
বাকিটা কবে পা্ওয়া যাবে ভাই?
বেশ সাবলিল লেখা আপ্অনার।
আততায়ী
শিগগিরি লিখছি..
ধন্যবাদ আপনাকে। পড়েছেন, মতামত জানিয়েছেন...
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
ভালো লাগছে পড়তে... পরের অংশের অপেক্ষায় থাকলাম
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। পরের অংশটা তাড়াতাড়ি ছাড়েন!
ভাল লাগছে,চলুক।।।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
যেমন বিষয়, তেমনই লেখনী...চমৎকার হচ্ছে। কী যে ভালো লাগে পড়তে।
কিন্তু তারপর? জলদি শ্যাজাদি...
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
তারপর?
চির আমি
সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ..
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
খুব অদ্ভুত জায়গায় এনে ছেড়ে দিলা।
তাড়াতাড়ি বাকিটা লিখো।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
প্রায় মাঝরাতে লিখতে বসেছিলাম, ঘুম আসছিল বলে ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়লাম
লিখছি তাড়াতাড়িই...
সচলায়তনে সবচেয়ে অচল সচল, কুইড়া সচলের কোন ক্যাটাগরি নাই? থাকলে আমি ফার্ষ্টো হইতাম নিশ্চিত
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
আমি পড়িলাম, বাকীটা আগামীতে....
-মাছরাঙ্গা
নতুন মন্তব্য করুন