ছেলেবেলা চলে গেছে সেই কবে..

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: শনি, ৩১/০১/২০০৯ - ৯:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সে অনেককাল আগের কথা। সে আমার ছেলেবেলার কথা। আমরা বছরে একবার করে বেড়াতে বেরুতাম। আমরা তখন সিলেটে থাকতাম। বেড়াতে যেতাম কখনও ঢাকা, কখনও চিটাগাং। তবে বেশির ভাগই ঢাকা যাওয়া হত, বড়কাকা ঢাকায় থাকতেন, তাঁর বাসায়। বেড়াতে যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকে আব্বা ট্রেনের টিকেট কেটে এনে আম্মাকে সব বিস্তারিত বলতেন, যা শুনতাম তার থেকে আমার কানে দুটো শব্দ শুধু আটকাত, এয়ার কন্ডিশন্ড আর রিজার্ভেশন। প্রথমবার শোনার পর আমি বেশ ছন্দে ছন্দে শব্দদুটি আওড়াতাম, উল্টে পাল্টে, বারে বারে। প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম, কবে, কখন সেই রিজার্ভড এয়ার কন্ডিশন্ড কামরায় গিয়ে উঠব। একদিন অপেক্ষা শেষ হত, সকাল থেকে আম্মা ব্যস্ত থাকত বাক্স গোছানো, বছরভর তুলে রাখা হোল্ড অলে বালিশ-কম্বল-চাদর গোছানো, আমাদেরকে গোছানো আর ট্রেনের জন্যে খাবার গোছানোতে। ট্রেনে খাওয়ার জন্যে আম্মা সব সময়েই বানাত পরোটা আর ভুনা গোশত। অধীর আগ্রহে দিন যেন কাটত না, রাতের ট্রেনে বসার জন্য, পরোটা মাংস খাবার জন্যে।

ট্রেন চলতে শুরু করলেই আব্বা কুপের দরজা বন্ধ করে দিতেন আর নিচের একটা বাঙ্কে শুয়ে পড়তেন। ছোট্ট সেই কুপে আমার জন্যে নির্ধারিত হত উপরের বাঙ্ক, আমি বার কয়েক উপর নিচ করে করে একটা সময় আব্বার বাঙ্কের জানলার ধারটা দখল করতাম। প্রথমে অপেক্ষা ট্রেনে ওঠার, তারপর অপেক্ষা কখন সব খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়বে তার, আর তারপর রাতভর জানলার পাশে বসে বসে কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম, কখন মেঘনা আসবে। মেঘনা। সে নাকি এক বিশাল নদী আর তার উপর আরও বিশাল এক ব্রীজ, যা দিয়ে ট্রেন যায়। এসব গল্পই ছোটকাকার কাছ থেকে শোনা। যতক্ষণ কামরায় আলো জ্বলত, জানলার কাঁচে ট্রেনের কামরারই প্রতিচ্ছবি দেখা যেত। একসময় বাতি নিভত, বাইরের অন্ধকার, পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া গাছগুলোকে দেখতে দেখতে একসময় ঘুম এসে যেত। ট্রেন থামলেই আমারও ঘুম ভাঙ্গে, কোন এক অজানা ষ্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ষ্টেশনের চাতালে কয়েকজন ঘুমন্ত মানুষ, গভীর রাতের নিস্তব্ধ ষ্টেশন। ভাইয়াকে ডেকে তুলি, ভাইয়া, সামনেই কি মেঘনা! বন্ধ জানালা দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সে, কোথায় এল ট্রেন, দুর, এটা তো আখাওড়া, ঘুমা তো তুই! আমি ঘুমাই না তবুও, ট্রেনটা তো এখান থেকেই বাঁক নেবে ঢাকার পথে আর সামনেই তো মেঘনা! ঘুমায় না ভাইয়াও। বসে বসে আমরা অপেক্ষা করি, কখন আসবে মেঘনা...

ছেলেবেলা চলে গেছে সেই কবে.. বহু বহু কাল পরে আমি আবার রাতের ট্রেনে, এবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা। না। এই কামরা এয়ার কন্ডিশন্ড হলেও রিজার্ভড নয়। স্লিপিং কোচের টিকিট পাওয়া গেল না কিছুতেই তাই এক কম্পার্টমেন্ট লোকের সাথে বসে বসে যাত্রা। সঙ্গী ভদ্রলোকটি ট্রেনে ওঠার সাথে সাথেই ঘুম। আমার ছেলেবেলা যদিও চলে গেছে কিন্তু রাতের ট্রেনে জেগে বসে থাকার অভ্যেস এখনও যায়নি তাই সারা রাত কেটে যায় জানালার বাইরে চেয়ে থেকে। রাতের ট্রেনে কামরাভর্তি লোক, আধেক তাদের ঘুমোয় আর আধেক জেগে রয়। ক্যাটারিংএর লোকেরা বারে বারেই আসে চা-কোল্ড ড্রিংক-চিপস-চকোলেট আর খাবারের প্যাকেট নিয়ে, বারে বারে চেয়েও আমি পাই না একটা জলের বোতল। ঝকঝকে আলো ঝলমল কামরায় জেগে থাকা লোকেরা কত কথা বলে যায়, আমি জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকি। চেনা ষ্টেশনেরা সব একে একে পেছনে রয়ে যায়, যেমন রয়ে গেছে স্বজনেরা... ট্রেন এগোয় ঢাকার পথে...

[ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে পরদিনের লেখা এটি, খানিকটা লিখে খসড়ায় রেখে দিয়েছিলাম, আজ তুলে দিলাম]


মন্তব্য

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

নস্টালজিক লেখা। ছোটবেলায় গ্রামে গেলে ট্রেনে করে যেতে হতো। সে ছিল খুব মধুর কিছু স্মৃতি। এটা নিয়ে একটা পোস্টও লিখেছিলাম। মনে পড়ে গেল।

শ্যাজা এর ছবি
অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

কষ্ট করে খুঁজতে হবে না দিদি, তেমন কোনো ভালো লেখা না, শুধু বিষয়বস্তু মিলে গেল জন্য বললাম। তবুও নষ্ট করার মতো সময় হাতে থাকলে ঢুঁ মারতে পারেন এখানে

বাউলিয়ানা এর ছবি

একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন?...রাতের বেলায় ট্রেন চলতে থাকলে শব্দ শুনে বলে দিতে পারবেন যে ট্রেনটা এখন কেমন এলাকা পার করছে..

ফাঁকা ফসলের মাঠের মধ্য দিয়ে যখন ট্রেন চলে তখন একরকম শব্দ, লাইনের দুপাশে দু-সারি গাছের মাঝ দিয়ে চলে্ল আরেকরকম...আবার নদীর উপর ব্রীজ পার হবার শব্দ এমন যে, পুরো শরীরে একটা ঝংকার উঠে...

শ্যাজা এর ছবি

আবার যখন পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে যায় তখন আরেক রকম শব্দ..

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

রানা মেহের এর ছবি

ভালো লাগলো লেখটা পড়ে

আমি অতন্দ্র আর ধুসর গোধুলীর একসাথে ট্রেনে চড়ার প্লান আছে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

যাক, আপনি যে মনে রেখেছেন এবং মৌন সম্মতি এখানে প্রকাশও করে দিলেন, এটা দেখে খুব খুশি লাগছে। এই খুশিতে ট্রেনে আপনাকে বাদাম খাওয়াবো। হাসি

রানা মেহের এর ছবি

শুধু বাদাম? মন খারাপ
আমড়া ডাব?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আখাউড়া স্টেশন দিয়া গেলে ডাইলও খাইতে পারো । হাসি

শ্যাজা এর ছবি
অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

আমড়া, ডাব, ডাইল - সবই খাওয়াব, কোনো সমস্যা নাই।
সাথে ফ্রী হিসাবে পাবেন ভাই-ভাই চানাচুর, ব্রিটল বিস্কুট (ভাইবেন না ব্রিটেনের কোনো ব্র্যান্ড), তিলের খাজা, ইত্যাদি ইত্যাদি চোখ টিপি

রানা মেহের এর ছবি

দোয়া করো আরিফ ভাইয়া।
অনেক দিনের খায়েশ।
তোমার জন্যও আনবোনে কিছু চোখ টিপি
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

'পায়ের তলায় শর্ষে' মনে পড়ে গেল।

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

লেখাটা পড়ে আমার ও ছোটবেলায় ট্রেনে ঢাকা চট্রগ্রাম যাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল।
হোল্ড অল শুনলেই সেসব ট্রেন জার্নির কথা মনে পড়ে যায়।
আর ট্রেনের হুইসেল টা আমার খুব বিষন্ন মনে হয়। ছোটবেলায় মনে হতো। এখন ও মনে হয়।

মৃন্ময় আহমেদ এর ছবি

পলকের সেই ছেলেবেলা...

====================
অনিকেত প্রান্তরে ভেসে বেড়াই

'

=========================================
নিজেকেই নিজে চিনি না, পরকে চেনার মিছে বাহানা

শ্যাজা এর ছবি
পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

আমার ট্রেনে চড়া হাতেগোনা কয়েকবার।
কেন যে আমার ট্রেনে চড়া হয়ে উঠে না! অতন্দ্র প্রহরী, শ্যাজাদি ও অন্যান্যদের মতো ট্রেনে চড়ার মধুর স্মৃতি নিয়ে রোজনামচা করতে পারি না!

শ্যাজা এর ছবি
কীর্তিনাশা এর ছবি

ট্রেনে আমার খুব মক চড়া হয়েছে। গ্রামের বাড়ি দক্ষীন অঞ্চলে বলে বহুবার লঞ্চে চড়েছি। কত যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে লঞ্চকে ঘিরে !

আপনার লেখা খুব ভালো লাগলো শ্যাজাদি।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

শ্যাজা এর ছবি

আমি কখনও লঞ্চে চড়িনি.. শোনাও না তোমার লঞ্চের স্মৃতি..

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

আহ্! স্মৃতির ট্রেন আমারো আছে। তাতে দিন দিন বাড়ছে বগি। জমছে ব্যবহৃত জিনিষের স্তূপ, অপাওয়া মানুষদের রূপ। ইঞ্জিনটা আর টানতে পারে না। সন্ধ্যার আগে আগে কিংবা ঠিক ভোরে ভোরে পৌঁছবো তো অন্তিম স্টেশনে?

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

শ্যাজা এর ছবি

অত তাড়া কিসের..!
জমে জমে পাহাড় হোক, তারপর খোঁড়া হোক সেই পাহাড়.. কত কী মণি-মাণিক্য উঠে আসবে..

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

ভিসার ঝামেলা মিটেছে ? আসছেন তো ?

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

শ্যাজা এর ছবি

কিস্যু মিটে নাই বরং আরও ভালমতন পাকাইসে মনে হয়।
মেলা যে এক তারিখ থেকে শুরু হয় সেটাই আমার জানা ছিল না। ফেব্রুয়ারীর ৩য় সপ্তাহ থেকে শুরু হয়ে এক মাস চলবে এটাই জানা ছিল আমার আর আমি সেইমত অর্র্ধেক কাজ বাকি রেখে দিয়ে চলে এসেছি, ধীরে-সুস্থে হবে ধরে নিয়ে ( কেন যে আমি সব ধরে নিই!!)। বাকি কাজগুলো যার করার কথা তিনি চরম ব্যস্ত, সময় নাই সময় নাই.. ১৩-১৪তারিখে (যদি, যদি হাইকমিশন দয়া করে ভিসা দেয় তবেই) গিয়ে তারপর আর কদ্দূর কী হবে আল্লাহ মালুম মন খারাপ

আমার এখন হাত-পা ছড়িয়ে চিল্লিয়ে বসে কাঁদতে ইচ্ছে করছে..

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

সৌরভ এর ছবি

গ্রামে থাকতাম, ট্রেন চলে যেতো তামাক বা আখ লাগানো জমিগুলোর ওপার দিয়ে। ট্রেনগুলো একেকটা ছিলো ঘড়ি, সকালের ট্রেন টা যেতো ফজরের আযানের একটু পরে, মাঝদুপুরে একটা, সন্ধ্যায়, মাঝ-রাতে। মালগাড়ি তেমন শব্দ করতো না। তাই এইসব ট্রেন এসে আমাদের জাগিয়ে দিতো, ঘুম পাড়াতো, খেলা ছেড়ে বই ধরে পড়তে বসতে বলতো।

জীবনে প্রথম ট্রেন চড়াটা তিন-চারে। মনে আছে এখনো স্পষ্ট। খুব বেশি বলার মতো অভিজ্ঞতা নয়। মা কাঁদছে, বাবা মা কে নিয়ে ব্যস্ত, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে - শহরে হাসপাতালে যাওয়া, মা-ন্যাওটা আমাকে রাখা যায় নি, তাই সাথে করে যাওয়া হয়েছিলো।

ছেলেবেলা চলে গেছে। নিয়ে গেছে সব। একটু একটু করে বুড়ো হই আর স্মৃতির পাতাগুলো ক্ষয়ে যায়।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

শ্যাজা এর ছবি

ছেলেবেলা চলে গেছে। নিয়ে গেছে সব। একটু একটু করে বুড়ো হই আর স্মৃতির পাতাগুলো ক্ষয়ে যায়।

পোলায় কয় কী!

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

s-s এর ছবি

আহ্ ! ---- ---- ---
কি মন্তব্য করি ---- বুঝতে পারছিনা -----
আবার পড়ি, তারপর বলি -----

জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

কারুবাসনা এর ছবি

মজা কম। ইস্প্রেড করার ছিল।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।