মাঝে মাঝেই ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলবার জন্যে প্রাণ যখন আই-ঢাঁই কত্তে শুরু করে আমরা তখন বেরিয়ে পড়ি। এথায়-সেথায়, হেথায় বা হোথায়। এমনি এক দুপুরে ঠান্ডা মেশিনের হাওয়ায় যখন আমার খুব ঠান্ডা লাগতে থাকে আর পাখার বাতাসের অল্প গরম হাওয়ায় তার খুব গরম লাগে তখন আমরা বেরিয়ে পড়ি। কোথায় যাই? দিদিমনির কল্যাণে শহর স্তব্ধ। গাড়িও নাই ঘোড়া তো নাই ই। গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ ডাকছে বুকের ভেতরে কোথাও। যদ্দূর যাওয়া যায় আর যেমনি করে যাওয়া যায়। আমরা বেরিয়ে পড়ি পথে। এমনি করে আর অমনি করে কোনোরকম করে আমরা পৌঁছে যাই এক বাগানে।
ইয়াব্বড় এক বাগান। সেই আদ্যিকালে কোনো এক বদ্যিবুড়ো বানিয়েছিলেন। নানান রকম গাছ, লতা-পাতা, ঝোপ-ঝাড়, বাঁশের ঝাড় আর শুকিয়ে যাওয়া সব ছোট ছোট পুকুর বা ঝিলে পদ্মেরা আজও ফুটে আছে যত্নে বা অযত্নে। চারিদিকে সব সবুজ। কী সবুজ কী সবুজ! তাও তো আমার দ্যাশের মত নয়! তাতে কী। সে তো আছে বুকের ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গেই থাকে সর্বক্ষণ। আমরা এগোই। মাথা উঁচু লম্বা লম্বা সব গাছ। কোনোটা সাদাটে, কোনোটা ক্ষয়ে আসা। কোনো গাছে শুধুই ফুল, কোনো গাছ আবার শুধুই পাতায় ভরা। বৃদ্ধ গাছেরা মরে গিয়ে ভেঙে পড়ে আছে হেথায় হোথায়। সরকারি ডেথ সার্টিফিকেটের অপেক্ষায়। আমার মাথায়ও আছে কিছু মৃত কোষ, তাই ভুলে যাই বাৎলে দেওয়া সব গাছেদের নাম। ফিকে গোলাপি ফুলে ভরা গাছটার তাই নাম মনে নেই এখন আর। শুধু চোখ জুড়ে থাকে অযত্নে পড়ে থাকা এক বিশাল বাগান। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিই। তাজা বাতাসে দু-একটা মরে যাওয়া কোষ কি আবার বেঁচে উঠল? কে জানে! ডাক্তার ভাল বলতে পারত কিন্তু সে কোথায়? কদ্দিন কথা বলিনি তার সাথে...
বাহারী ক্যাকটাসেরা সব ঘরের ভিতরে বন্দী, লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা দরজার ওপারে। কী? না, লোকে নাকি চুরি করে নিয়ে যায়! যাগগে। আমাদের তো ওই ছায়ায় ঢাকা সরু পথ আর দুপাশে সব নাম না জানা অচেনা গাছেদের দেখতে দিব্য লাগে। মাঝে মাঝে জলহীন পুকুরে পদ্ম দেখি। এ নিশ্চয়ই স্থলপদ্ম নয় কিন্তু তাও বেঁচে আছে আছে এই বর্ষার জলহীন পুকুরে। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পুকুরে গোল গোল বিশাল বিশাল পাতারা ভেসে আছে, শুনলাম, সেই কোন সুদূর সাগরপারের দেশ থেকে আনা হয়েছে এই পাতাদের, চার-পাঁচ বছরের বাচ্চারা নিকি দিব্যি ভেসে থাকতে পারে এই পাতায়, নৌকোর মত করে! এই পুকুরে অবশ্য এই পাতায় বসলে কেউই ডুববে না কিন্তু সে অন্য কথা। আমার মাথার মৃত কোষেদের কল্যাণে এই পাতাদেরও নাম ভুলে গেছি..
দাঁড়াই মহুল গাছের নিচে। ছোট্ট ছোট্ট কালজামে ভরে থাকা গাছের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। দেখি দারুচিনি গাছ। আমি শুনেছি দূরে কোথায় যেন একটা দারুচিনি বন আছে। আমি কোনোদিনও সেথায় যাইনি। আছে কী নেই তাই বা কে জানে। আর যদি থেকেও থাকে তো সেথায়ও হয়তো কোনো দরজা দিয়ে তাতে আটকে দেয়া হয়েছে লোহার শেকল আর তালা। জানি না..
আমরা পৌঁছে যাই গঙ্গার ধারে। ফুরিয়ে আসা বিকেলে সরু রাস্তায় নটা-পাঁচটার সাইকেল। ক্ষণিক দাঁড়িয়ে ফিরতি পথ। ওই জালে ঘেরা গঙ্গা পোষায় না। ছোট ছোট পা ফেলে গঙ্গাকে পেছনে রেখে আমরা ঝিলের দিকে যাই। মেমসাহেবেরা যেখানে পা চালিয়ে সৌখিন নৌকো চালাচ্ছে। এই ঝিলের জল টলটলে। দু'পাশে বড় বড় গাছ ছায়া দেয় সর্বক্ষণ। শান্ত নিথর জলে সৌখিন নৌকোরা চলে একের পর এক। বিকেলে ঘরে ফেরার ডাকে পাখিরা সব গাছমুখী। যেতে যেতে শুনিয়ে যায় ঘরের ফেরার গান। আমরা কান পেতে শুনি..
মাথার ভেতর একটা হেলিকপ্টার চলার বিকট শব্দ বাজতে থাকে ক্রমাগত, কখনও বাড়ে, কখনও কমে। জালে ঘেরা গঙ্গার ওপারের পাওয়ার হাউস বলে দেয়, কপ্টার তোমার মাথায় নয়, এখানে চলছে! আমাদের এই জালে ঘেরা গঙ্গা চাই না, আমাদের গঙ্গায় নৌকা চলবে পাল উড়িয়ে, মাঝি গাইবে, 'মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না..'
আমরা সেই গঙ্গার খোঁজে বাইরের দিকে। বাগানে সন্ধে নামে সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে। পানায় ভর্তি এক সরু লেক পড়ে ফেরার রাস্তায়। মিনারেল ওয়াটারের খালি বোতল আর চিপসের খালি প্যাকেটেরা ভেসে বেড়ায় কচুরি পানার সঙ্গে সঙ্গে এই লেকের জলে। মাছের পচা গন্ধে নাক কুঁচকে আসে লেক কাছে আসতেই। ছোট্ট একখানি ভিড় লেকের ধারে, কালভার্টের উপর। লেকভর্তি কচুরি পানারা নাকি মরে গিয়ে বিষাক্ত করে তুলেছে জল, সেই বিষে দমচেপে মারা গেছে অজস্র অগুন্তি মাছ। ফুলে ফেঁপে ওঠা মাছ দেখতে পাই হলদে হয়ে আসা পানার ফাঁকে ফাঁকে। ভিড় করা মানুষেরা মাছের ওজন আর কতো মাছ মরে গেছে সেই হিসেব করছেন। কেউ দুষছেন বাগানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের তো কেউ হিসেব দিচ্ছেন লেকের দায়িত্বে থাকা লোকেদের কাজের মেয়াদ কবে ফুরিয়েছিল, জমা পড়া টেন্ডার কবে খুলবে আর কবে নতুন লোক কাজে লাগবে। সেই হিসেব খানিক শুনে নিয়ে আমরা আবার হাঁটি। এবার গঙ্গার খোঁজে...
[চলবে কী? তাইলে আরেকটু লেখা যাবে]
মন্তব্য
দারুণ...চলতেই হবে...
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
তাইলে চলবে:)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
ঠিক কতদিন পর তোমার লেখা পড়ছি বল তো!!!
চলবে কেন দৌড়ুচ্ছে রীতিমত এখনই।
মধুবন্তী মেঘ
ঠিক মেঘ,
বহু বহুদিন পর একটু লেখার চেষ্টা
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
চলবে তো বটেই। একটু অশান্তি একটু শান্তি । মিলেমিশে গদ্য।
অনেকদিন পর। অনেক ভালো লাগল।
_________________________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
হুম।
একটু শান্তি আর একটু অশান্তি।
মিলে-মিশে চলে একসঙ্গে।
ভালো আছ তো?
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
গাছপালার কথা শুনতে ভাল লাগে। সবুজের গল্পটা চলুক।
ফাহিম হাসান
শ্যাজাদি, দারুণ লিখেছেন। তারপর?
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
ভাল লেগেছে... অবশ্যই চলবে।
অনন্ত
অনেক সুন্দর!
চলুক...
__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!
__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!
আমি এর আগে আপনার আর কোন লেখা পড়িনি। এটা দিয়ে শুরু করলাম। এখন তো দেখছি সব গুলোই পড়তে হবে। আশা করি বুঝতে পারছেন লেখাটা কেমন লেগেছে।
লিখতে থাকুন।
--------------------------------------------------------------------------------
অনেক ধন্যবাদ মেহবুবা।
আপনি পড়ে মন্তব্য করে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
--
মন্তব্যের সংখ্যা না বাড়িয়ে এখানেই বলি, যাঁরা পড়েছেন, নিজের মত জানিয়েছেন, সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। একটু সময় পেলেই বাকিটা লিখে ফেলব।
সবাই ভাল থাকুন
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
নতুন মন্তব্য করুন