পায়ের তলায় সর্ষে- ঠিকানা ক্যাজুরিনা

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: রবি, ০৫/০৯/২০১০ - ৪:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাদাটে গোল সূর্যটা এক টকটকে লাল বলয়ে ঘেরা

সামনে আদিগন্ত সমুদ্র। বঙ্গপোসাগর। অবিশ্রাম ঢেউ এসে আছড়ে ভাঙছে বোল্ডারে, পান্থবিলাসের নিজস্ব বালুকাবেলায় আর বনবিভাগের এই বাংলোটির বীচের উপর দাঁড়িয়ে থাকা লাল, হলুদ, সাদা রং করা কাঠের রেলিঙে ঘেরা ছোট্ট কাঠের ডেকের তলায়। ঢেউ ভাঙে এক পায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউগাছগুলোর গোড়ায়। যদিও আকাশের রং ধূসর, কুয়াশা আর মেঘের আড়ালে সূর্য কিন্তু বেশিক্ষণ আড়ালে থাকতে রাজী নন সূর্যদেব, মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছেন কুয়াশার চাদর সরিয়ে সরিয়ে। বিশাল এক থালার মত সাদাটে গোল সূর্যটা এক টকটকে লাল বলয়ে ঘেরা। মেঘের গায়ে ফাঁটল ধরার লাল রং। সুর্যোদয়ের রং। এদিকে ওদিকে মেঘের গায়ে লালের ছটা। ধীরে ধীরে গোটা আকাশে ছড়ায় সেই লাল। মেঘ সরে যায় যেন শুধু আমারই জন্যে। হালকা শিরশিরে ঠান্ডায় চাদর মুড়ি দিয়ে সেই অন্ধকার ভোর থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আমি বিচের উপর গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের ডেকে, সূর্যের জন্যে, সূর্যোদয়ের জন্যে। ভোরের মিঠে রোদ পড়ে চড়া রূপোলী ঝিলিক ঢেউয়ের মাথায়। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না ও‌ই ঝিলমিল ঢেউয়ের দিকে, ধাঁধা লেগে যায় চোখে।

সুনসান বিচের উপর দিয়ে হেঁটে যায় গরুর পাল

ভোরের সুনসান বিচের উপর দিয়ে হেঁটে যায় গরুর পাল, সাথে ছোট্ট একরত্তি এক রাখাল। ছন্নছাড়া গরুর দল আপনমনে হেঁটে যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নি:সঙ্গ, একলা ফিঙে বসে থাকে ঝাউডালে, দোল খায়, উড়ে যায়, আবার এসে বসে। বসেই থাকে। ছোট্ট নৌকো থেকে নামে ছুটকো কিছু জেলে, মাছধরা জাল কাঁধে ঝুলিয়ে মাছের ঝোলা হাতে নিয়ে ডাঙার দিকে এগোয় সারারাত সাগরে কাটানো মেছো। ডাঙায় অপেক্ষায় কয়েকজন লোক, ঝাউগাছে সাইকেল ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে। জেলেদের থেকে মাছ যা পাওয়া যায় নিয়ে তারা যাবে নিকটস্থ বাজারে। যাওয়ার পথে একবার দাঁড়াবে বড়রাস্তার মোড়ে, কিছু মাছ এখানেও বিক্রি হয়ে যাবে এই আশায়।

জোয়ারের সময় সমুদ্র দখল নেয় চার-সাড়ে চার কিলোমিটার চওড়া বালুকাবেলার। ধুসর আকাশের কোথাও এতটুকুও নীল নেই। ধূসর, ঘোলাটে আর নোনা সাগর শুধু ফেনার মুকুট মাথায় নিয়ে ঢেউ হয়ে তীরে এসে পড়ে। কাছে দূরে দু-এক জোড়া মানব-মানবী হাঁটে হাত ধরাধরি করে, ঢেউয়ের থেকে নিরাপদ দূরত্বে, খানিকটা জেগে থাকা জমিতে, বালির উপর। পিতার হাত ধরে সমুদ্রস্নানে আসা ছোট্ট ছেলেটি ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঢেউ থেকে দূরে। মাঝে মাঝেই ঢেউ এসে তার পায়ের গোড়ালি ভিজিয়ে দিয়ে যায়, যেন বলে, অত ভয় পাস না রে, এই দ্যাখ, আমি কেমন তোকে ছুঁয়ে দিলাম, ভিজিয়ে দিলাম তোর পা!

০২

ঘুরে ঘুরে বাগানে সেই থেকে জল দিয়ে যাচ্ছেন আলম সাহেব। রবারের পাইপে করে ডিপ টিউবওয়েলের জল, বনবিভাগের নিজেদের তোলা জল। মাটির বুক চিরে আটশো ফুট গভীরে ঢুকে গেছে ডিপটিউবওয়েলের লোহার পাইপ। বঙ্গপোসাগরের এই ঘাড়ের উপর বসে থেকে মিষ্টি জল তুলে আনার জন্য। বারান্দার নিচে খোপকাটা লাল টাইলসের উপর ঝাউ পাতাদের ছায়া, রোদের জাফরিকাটা নকশা। খানিক দূরে পাথরের বোল্ডার ঠেলে ঠেলে নিচে ফেলছে কালো কালো কয়েকটি কামিন ছেলে, সুরক্ষিত করছে বনদপ্তরের এই সম্পত্তি, বাংলোর সীমানা। সকাল-সন্ধে যেখানে আছড়ে আছড়ে নিজেকে ভাঙে বঙ্গপোসাগরের ঢেউ, আর নড়বড়ে করে দেয় সান্ধ্যবিলাসের ও‌ই কাঠের ডেক, বাঁধানো জমির উপর একলা দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট বাড়িটির ভিত।

কুয়াশা বা মেঘ আড়াল করে রাখে দৃষ্টিসীমাকে, খুব বেশিদূর চোখ যায় না আমার। বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার থাকলে কুয়শার চাদরের ওপাশে একটি দুটি নৌকা দেখা যায়। যদিও বুঝতে পারি না ওগুলো কিসের নৌকা তবুও ধরে নিই ওগুলো মাছধরা নৌকা। এতটা দূর থেকে বোঝা যায় না ওগুলো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে নাকি চলছে। হয়ত কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে ওরা সমুদ্রে, মাছধরা ও‌ই নৌকায়। সমুদ্রের উপর নৌকোতেই মৎসজিবী ও‌ই মানুষগুলোর রান্না-খাওয়া-হিসু-পটি-ঘুম আর মাছধরা। জাল ফেলে ফেলে সমুদ্রের গভীর থেকে জালে করে মাছকে তুলে এনে নৌকোর উপর ফেলা, সার সার বিছিয়ে দেওয়া নৌকার পাটাতনে, বরফশয্যায়। ওরই থেকে ছোট-বড় কিছু মাছ নুন-হলুদ দিয়ে সেদ্ধ ক্ষুধা নিবারণ। আয়লা বা নার্গিসকে অগ্রাহ্য করে দিনের পর দিন সমুদ্রে বাস, ডাঙায় ফিরে সমুদ্র থেকে তুলে আনা মাছ বেচা টাকায় নুন-তেল-চিনি-চাল-ডাল-শাড়ি-চুড়ি আর গামছা কেনা। ঘরে অপেক্ষারত রমণীটির সাথে যখন তখন সোহাগ। এই তো জীবন...

০৩

আলম সাহেব। পুরো নাম শাহিদ মুহাম্মদ আলম। উড়িষ্যার জলেশ্বরে বাড়ি তবে সেখানে যান শুধু বেড়াতে। উড়িষ্যা বনবিভাগে তেইশ বছরের চাকরী তাঁর। ম্যট্রিক পাশ নন বলে তাঁর চাকরীটি দ্বিতীয় বা প্রথম শ্রেণীর নয় বলে মনে বেশ দুঃখ তাঁর। তাঁর কাজ বনবিভাগের এই বাংলো ক্যাজুরিনায়, কেয়ার টেকারের। উড়িষ্যার বিভিন্ন জায়গায় জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিয়ে এখন চাঁদিপুরে মোটামুটি থিতু। বাংলোর পেছনদিকে ছোট্ট কোয়াটারে বিবিকে নিয়ে আলম সাহেবের বাস। মিঞা-বিবি দু’জনের সংসার, কোনো ছেলে-পুলে নেই তাদের। আলম সাহেব বলেন, কী হবে ছেলে-মেয়ে দিয়ে? হয়নি যে সেটা আল্লাহর মেহেরবানি! দেখি তো চারদিকে সব, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের, তাদের জীবনে যত ঝামেলা সব এই ছেলে-মেয়ে নিয়ে। বুড়ো বাপ-মাকে কেউ দেখে না, যে যার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত, বাপ-মায়ের কাছে আসে শুধু ভাগ নিতে! আমার সরকারী চাকরী, আর কয়েক বছর পরে রিটায়ার করব, পেনশনের টাকায় দুজনের হেসে-খেলে চলে যাবে আর আমি মরে গেলেও বিবির কোনো চিন্তা নেই, তার ভবিষ্যত সেফ!

সাহেবি স্টাইলের এই বাংলোয় ঘর মোটে তিনখানা। বিশাল সাইজের ঘর, পুরনো দিনের আসবাব সব, লাগোয়া ড্রেসিং রুম, বাথরুম। বিশাল একখানা ডাইনিং হল, যাতে তেমনি বিশাল এক খাওয়ার টেবিল। সরকারী বাংলোতে যেমন থাকে তেমনি এখানেও আছে এক ঘর ভর্তি সব বাসন-কোসন, জলের ফিল্টার, রান্নার সমস্ত আয়োজন কিন্তু এই বাংলোয় রান্না হয় না। কোনো এককালে হতো, রান্নার লোক ছিল, অতিথিরা বাজার করে নিয়ে আসতেন, রাঁধুনি পঞ্চব্যাঞ্জন রেঁধে দিতেন। তবে সে বহুকাল আগে। এখন এখানে লোক বলতে শুধু কেয়ার টেকার আলম সাহেব আর উর্দি পরা এক বুড়ো দারোয়ান, যিনি কিনা সারাদিন ব্যারাকে, তাঁর ঘরেই শুয়ে থাকেন লোহার গেটে শেকলে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে। যারা এখানে থাকতে আসেন তাদেরকে খাওয়ার ব্যবস্থা বাইরেই করতে হয়। ট্যুরিস্ট স্পট বলে অবশ্য আশে-পাশে, কাছে-দূরে প্রচুর হোটেল।

[চলবে]


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

চলুক চলুক। কিছু ছবি টবি দেবে নিশ্চয়।
ওদিকের বঙ্গ উপসাগরের তীরগুলো দেখার সাধ জাগে।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শ্যাজা এর ছবি
হাসান মোরশেদ এর ছবি

মন খারাপ ফ্লিকারে তুলে এখানে লিংক দিয়ে দাও। ঐটা সহজ আর তোমার ছবিগুলো থাকলো ও আলাদা ছবির জায়গায়।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শ্যাজা এর ছবি
মুস্তাফিজ এর ছবি

চমৎকার লাগলো

...........................
Every Picture Tells a Story

শ্যাজা এর ছবি

ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই।

ভালো আছেন তো?

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ভালো লাগল। ভাষায় একটা স্থিরতা পাই। অস্থিরতা ভালো লাগে না। তাই, ভালো লাগল বেশি।
_________________________________
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শ্যাজা এর ছবি
জাহামজেদ এর ছবি

পড়তে পড়তে মুগ্ধতার সাগরের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিলাম... কিন্তু বিধিবাম, সামনে স্পিডব্রেকার, থামতেই হলো !

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

শ্যাজা এর ছবি

ধন্যবাদ জাহামজেদ।
চেষ্টা করব যাতে স্পিড ব্রেকারে খুব বেশি থামতে না হয়ঃ)

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আচ্ছা ওদিকে কোথায় যেন ভাঁটায় বঙ্গপোসাগর চার কিলোমিটার সরে যায়, তারপর জোয়ারে আবার চার কিলোমিটার এগিয়ে আসে। সেটা কি চাঁদিপুর নাকি গোপালপুর?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শ্যাজা এর ছবি

অনেক জায়গাতেই এটা হয়। গোপালপুরে যাই নাই তাই বলতে পারছি না।
এখানে পশ্চিমবাংলায় বকখালিতেও তাই। ভাটায় সমুদ্র সরে যায় ওইরকম তিন-চার কিলোমিটার দূরে। বিচে হাঁটলে সমুদ্রের কোনো আওয়াজই পাওয়া যায় না। জুনপুটে সমুদ্র সরে গেছে প্রায় চার কিলোমিটার, থকথকে কাদায় ভরা গোটা এলাকা।
জোয়ারে খানিকটা পানি আসে বটে তবে কোনো ঢেউ নাই, আর পানি এত কম যে কোনো নৌকা পারে আসতে পারে না। যারা মাছ ধরতে যায়, তাদের নৌকা থাকে অনেকটা দূরে। গামছা বা লুঙ্গি হাতে নিয়ে পানির উপর দিয়ে কিলোমিটার খানেক হেঁটে তবে নৌকায় চড়ে তারা। একটা মৎস্যবন্দর ছিল সেখানে, এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

তিথীডোর এর ছবি

দারুণ লেখা, সঙ্গে ছবি,
ঠিক সোনায় সোহাগা!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

কৌস্তুভ এর ছবি

সমুদ্দুরে বেড়াতে আমি বড্ডো ভালোবাসি! সিরিজটা চলুক চলুক চলুক!

বাংলোয় একটা ভালো ভূতের গল্প জমানো যায় না?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।