এ যেন ঠিক কোনো নির্দিষ্ট সৈকত নয়, বালি-ফেনায় মাখা গর্জনের নির্জনতায় এক ফালি সময়। তা লেখাও হয়েছিল সে সমুদ্রতটের কিশোরীবেলায়, আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে, ফলে এখনকার সঙ্গে হয়ত কোন মিলই নেই সেই অর্জনটুকু ছাড়া। এই সমুদ্র গায়ে মেখে জলপরী হয়ে যাই আমি, এই প্রথমবার৷
---------
হাওয়ায় উড়ুক চুল
জলোচ্ছাসে দেহের বল্কল
হোক এলোমেলো।
অন্তহীন অপেক্ষার শেষে
না হয় সমুদ্র আজ
তোমাকেই খুঁজে পেলো
অপসৃত আবরণে,
সৈকতের নির্জন সন্ধায়।
ভুলে যাও তীরে দর্শক,
মনে কর কেউ নেই;
সমস্ত সমুদ্র জুড়ে তুমি
একা, নগ্ন, অনাবৃতা। -নির্মলেন্দু গুণ
এ আমার প্রথম সমুদ্রস্নান। মন্দারমণিতে। আমাদের চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিচে কেউ কখনো স্নান করে না। বাড়ির কাছে আছে এক আরশিনগর কক্সবাজার। কিন্তু সেথায় আমার যাওয়া হয়নি কখনও। আমাদের শহর চট্টগ্রাম থেকে মাত্র চার ঘন্টার দূরত্বের সেই সুবিস্তৃত সমুদ্রসৈকত, কিন্তু সেই দূরত্বটুকু আমার আজও পেরুনো হয়নি। তাই এই ভাবে চলে আসা মন্দারমণিতে। প্রস্তূতি ছাড়াই। ঢেউ ভেঙে ভেঙে খুব বেশিদূর এগুতে পারি না আমি৷অনভ্যস্ত পা। কষ্ট করে যাও বা এগোই ঢেউ আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসে ডাঙায়, যেন ফিরিয়ে দিয়ে যায়৷ যেন বলে, ওরে কোথায় যাচ্ছিস, ডুবে যাবি যে! আমি ভাবি বড় বড় সৈকতের কথা, পুরী, গোয়া, কোভালম আর না দেখে যে সব থেকে আপন, কক্সবাজার। আচ্ছা বিশালটা কি সে? ঢেঊ বুঝি আরো মস্ত প্রলঙ্কর কিছু। বিশাল এক ঢেউয়ের তলায় চাপা পড়ি আমি, নোনা জলে চোখ জ্বালা করে ওঠে। একই তো সমুদ্র, পড়ে থাকা বালি, দূরে তটরেখা বরাবর ঝাউ। আমি যেন কত দেখেছি। সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে নিই আমি। চোখে বালি ঢোকে কিচকিচ। আচ্ছা হবে হয়ত আলাদা। সেরা কোনো একটা দিকে হবে, এত যে কবিতা-টবিতা লেখা হল, গান-টান কিছু একটা আছে হয়ত, সে দিকে মন দিই না আমি। যেন খুঁজে নিতে চাই আরো আলাদা কিছুর স্বাদ, এই মন্দারমণির সৈকতে।
সকল দেশের সেরা সৈকত
এই কক্সবাজার
বালুর চরে ঢেউ খেলে হায়
একি চমৎকার
আহা রূপের কি বাহার।
পাহাড়ে বসাইছে রাডার
আরো বাতিঘর
বালুর চরে হোটেল মোটেল
ঝিনুকের শহর
প্রেমিক যুগল জোড়া জোড়া
প্রেম করিত যারা।। -লোকগান/ইকবাল হায়দার
ছোট ছোট চারটি গ্রাম নিয়ে এই মন্দারমণি ৷ দাদনপাত্রবার, সোনামুই, মন্দারমণি। চতুর্থ গ্রামের নামটি ভুলে গেছি৷ পাশাপাশি ছোট্ট ছোট্ট সব গ্রাম। আগে সমুদ্র বেশ দূরে ছিল এখান থেকে, এই গ্রামগুলো থেকে, ফসলী জমি থেকে, পুকুরভরা মাছেদের থেকে। ধীরে ধীরে সমুদ্র এগিয়েছে। জনপদের দিকে। ফসলের মাঠ, গৃহস্থের সংসার, ঘর-বাড়ি-পুকুর, গোয়ালের গরু, ছাগল একে একে সব সব গেছে সমুদ্রের পেটে। যেটুকু বাকি আছে, এখন তাতে মানুষের বসতি, তবে এও ক'দিন আছে বলা যায় না৷ সমুদ্রের গর্জন অহর্নিশি জানান দেয়, আমি আর দূরে নেই, একদম দূরে নেই।
সমুদ্রতীরবর্তী সব গ্রামে স্বাভাবিক ভাবেই ছিল বেশ কিছু নোনা জলের ভেড়ি৷ রোজভ্যালির মালিকেরা মন্দারমণিতে মাছের ব্যবসা করতে গেছিলেন বছর পাঁচেক আগে৷ সস্তার জমি কিনে মাছের ভেড়ি করলেন তারা৷ একটি দুটি ঘর তৈরি হল একটি গেস্টহাউস মতন৷ যেখানে মাছ কিনতে আসা লোকজন এসে রাত্রিযাপণ করতেন৷ সৈকতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁরা নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদেরও নিয়ে আসতে লাগলেন৷ ঘর বাড়তে লাগল স্ট্যান্ডবাই গেস্টহাউসের আর কিছুদিনের মধ্যেই সেই গেস্টহাউস রূপ নিল এক চারতারা হোটেলের৷ সমুদ্রের একেবারে ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেই হোটেল৷ মাছের ব্যবসা করতে আসা রোজভ্যালি সেখানে শুরু করল হোটেলব্যবসা৷ দেখাদেখি সেখানে দাঁড়িয়ে গেল আরও কিছু হোটেল, কটেজ৷ রমরমা ব্যবসা৷শনি-রবি কোনো হোটেলে, কটেজে একটি ঘরও খালি থাকে না সেখানে এখন জানাল গার্ডেন রিট্রিট নামের রঙচঙে কটেজের কেয়ারটেকার কাম ম্যানেজার বিশুবাবু৷
পাঁচখানা ঘর নিয়ে পাঁচমাস আগে হয়েছে এই গার্ডেন রিট্রিট কটেজ৷ রাস্তার ধারে খনিকটা জায়গা গোল করে ঘিরে নিয়ে মাথায় খড়ের ছাউনি দিয়ে রিসেপশন কাম সিটিংপ্লেস৷ পাশেই একটা লম্বাটে ঘরমত জায়গা, তারও মাথায় খড়েরই ছউনি৷ চারপাশ আদ্ধেকটা ঘেরা৷ কাঠের খুঁটির উপরে দাঁড়িয়ে আছে এই খাওয়ার ঘরের ছাউনি৷ খাওয়ার ঘরের পাশেই ডানধার ধরে একের পর এক ছোট ছোট এক কামরার ঘর, কটেজ৷ সাথে একফালি বাথরুম৷ সারি দিয়ে একের পর এক ঘর, শেষমাথার ঘরখানিতে আমরা ঠাঁই নিয়েছিলাম একবেলার জন্যে৷যাওয়ার কথা ছিল না তো, হঠাৎ গিয়ে পড়া। অপরিকল্পিত সমুদ্রস্নান। এই ঘরের পেছনে কাজ চলছে আরও পাঁচখানি ঘরের৷ তবে এই ঘরগুলি ইটের৷ কাজ অলমোস্ট শেষ হয়ে এসেছে, লাল ইটের ঘরগুলি প্রায় তৈরি৷গাঢ় লাল হাফ ইটের দেওয়ালের উপর গাঢ় সবুজ দরমার বেড়া আর মাথায় সাদা অ্যাসবেষ্টাসের চাল দেওয়া এই কটেজগুলির পোষাকি নাম গার্ডেন রিট্রিট ৷ কালো কাঁচের জানালার ধারগুলো সবুজে রাঙানো৷ কালো কাঁচের মাথা নিচু দরজা আর দুটো করে জানালা৷ ঘরের ভিতরে ঢুকতেই দেখা গেল নীল আর সাদা চৌকো চৌকো খোপকাটা ছাপওয়ালা স্যাটিন কাপড়ের শামিয়ানা টাঙানো অ্যাসবেষ্টাসের নিচে৷ আধো আধো আলো আঁধারির খেলা সেখানে৷ লাল, সবুজ, নীল আর সাদা রঙের সাথে কালো কাচের দরজা জানালা৷ সব মিলে মিশে সৃষ্টি করেছে এক অদ্ভুত রঙ্গ৷ গরমটাকে উপেক্ষা করতে পারলে শুধু এই রঙের খেলা দেখেই হয়ত কাটিয়ে দেওয়া যেত একটি বেলা৷ কিন্তু না৷ এই গরমকে উপেক্ষা করা গেল না কিছুতেই৷ আসবাব বলতে এক প্রশস্ত বিছানা, ছোট একখানি কাঁচের সাইড টেবল, আর দু'খানি প্লাস্টিকের চেয়ার৷ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে চোখে পড়ে এক মরা বেগুনের বাগান৷ এবড়ো-খেবড়ো শুকনো ধুলোময় বালুমাটিতে বাগানসুদ্ধু গাছগুলো মরা৷ দাঁড়িয়ে আছে কে জানে কার, কিসের সাক্ষী হয়ে৷ কাদের এই বাগান? এই কটেজ মালিকেরই কি? এখানকার লোকেরা ব্যবসা দেখতে এতটাই ব্যস্ত, এতটাই মগ্ন যে কারোরই একটু সময় হয়নি ঐ গাছেদের গোড়ায় একটু জল দেওয়ার৷ শুকিয়ে গেছে তাই এক বাগানভর্তি বেগুনগাছ! মরা বেগুনের বাগানের পাশেই সবুজ পত্রবহুল এক নিমগাছ৷নেহাত বড় বলে এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচেছে। কী অদ্ভুত!
[ক্রমশ]
মন্তব্য
সুন্দর লেখা। চলুক।
একটা প্রশ্ন: বল্কল মানে কি?
অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম
@অমিত্রাক্ষর- বল্কল মানে গাছের বাকল/ছাল
@শ্যাজা- লেখা ভাল লাগলো।
ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে
হরফকে ডবল থ্যাঙ্কু।
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
এই সমুদ্র গায়ে মেখে জলপরী হয়ে যাই আমি, এই প্রথমবার...কি অদ্ভুত সুন্দর করে বললেন!
চিটাগাঙ এ পতেঙ্গার ধারে কাটিয়েছি আমি প্রায় এগারোটা বছর, কখনো কক্সবাজার দেখতে যাওয়া হয়নি। দেখেছি অনেক অনেক পরে।
লেখা অনেক ভাল্লাগলো। ৪ নাম্বার গ্রামটার নাম জানতে ইচ্ছে করছে। নামগুলো অন্যরকম।
ভালো লেগেছে গুনের কবিতাটাও...
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধন্যবাদ শিমুল।
ভাল লাগছে জেনে আনন্দ হচ্ছে।
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
আমি চট্টগ্রামের মানুষ। অথচ এই মন্দারমণি জায়গাটার কথা আগে শুনিনি। চমৎকার! যেতে হবে।
লেখাটা অনেক ভালো লাগলো, শ্যাজা।
অনেক ধন্যবাদ সুমিমা।
গেলে জানাবেনঃ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
চমতকার ভ্রমনকাহিনি। সিরিজ চলুক।
আচ্ছা মন্দারমণি কি চট্টগ্রামের কোন এলাকা? নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে না।
অ-পরিচিতরাই তো ধীরে ফহীরে পরিচিত হয়ে ওঠে। অপেক্ষা করাই তো ভাল।
অনেক ধন্যবাদ। চলবে জানানোয় ভরসা পেলাম।
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
বহুদিন আগে সিরিজের আগের লেখাটা দিয়েছিলেন, এত কম কম লিখলে হবে? লেখা ভাল লাগল। পশ্চিমবঙ্গেও একটা মন্দারমণি আছে, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম সেটার কথাই বলছিলেন।
অনেক ধন্যবাদ কিন্তু এই সিরিজের কোন লেখা? আহা মন্দারমণি তো প্রত্যেকেরই একটা করে আছে। কাঁটাতার টেনে টেনে তাকে বিষণ্ণ করি কেন।
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
সমুদ্রভ্রমণ সিরিজের এইটার কথা বলছিলাম - http://www.sachalayatan.com/shyaja/34863
আপনার দেখা মেলে চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণের মতো। সেখানে সিরিজ শুরু করলেন দেখে আশান্বিত হই, একটু আশঙ্কাও হয় - সিরিজ নিয়মিত চালাবেন তো? কুয়াকাটায় দেখেছিলাম কীভাবে গ্রাম্য সৈকতকে নাগরিক পর্যটন ব্যবসা গ্রাস করছে। মন্দারমণি তারই অনুরূপ বলে মনে হচ্ছে। সমূদ্র লোকালয়কে গ্রাস করছে কেন? ক্ষোভ থেকে বুঝি?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
না, এবার সিরিজটা আলাদা।
লেখা হয়েছে, অল্প অল্প করে দিচ্ছি।
সমুদ্র তো ক্ষোভ থেকেই সব গ্রাস করে, আমরা বলি ক্লাইমেট চেঞ্জ।
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
"সমুদ্র তো ক্ষোভ থেকেই সব গ্রাস করে, আমরা বলি ক্লাইমেট চেঞ্জ।"
এটা দারুণ বলেছেন তো!
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
নতুন মন্তব্য করুন