পায়ের তলায় সর্ষে- মৃদু মন্দে মন্দারমণি- ০২

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: রবি, ২৪/১০/২০১০ - ১:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

-২-

এখানে দাঁড়াও এসে চুপচাপ,
কান পাতো হাওয়ার গভীরে--
প্রাণ ভরে শোনো রুদ্র সমুদ্রের গান।
শ্যামের মুরলী আজি
কী লক্ষ্যে উঠিছে বাজি রাধার বিরহে,
কল্লোলিত সমুদ্র সমান।

এখানে দাঁড়াও এসে চুপচাপ,
বসো সমুদ্রবিরহী ভূমিতলে,
তারপর নেমে যাও, ধীরে ধীরে
নিজেকে নিক্ষেপ করো জলে।
ভেবো না আমার কথা,
সংসার- সমুদ্র থাক দূরে।

স্বার্থ-সঙ্কুচিত বন্দীজীবনের
প্রাত্যহিক গ্লানির ভিতরে
প্রবেশ করিয়া রুদ্র সমুদ্রের ঢেউ
জরাজীর্ণ জীবনের তটে
আজ হানুক আঘাত দলে দলে। -নির্মলেন্দু গুণ

মন্দারমণিতে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছোয়নি৷ তাতে কি? জেনারেটর আছে । আছে সমুদ্রের নন স্টপ সিম্ফনি। হোটেল, কটেজ সবই চলে জেনারেটরে৷ নামমাত্র খরচে যে যেভাবে পারে যেখানে সেখানে কটেজ তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছে ব্যবসা করতে৷ দরমার বেড়া, অ্যাসবেষ্টাসের চালের মাথা নিচু সেই সব কটেজে ঢুকলে জাহান্নামের আগুনের আঁচ খানিকটা টের পাওয়া যায়৷ জেনারেটরে চলা পাখার বাতাস যেন আগুন ছড়ায় সেই কটেজে৷ যারা চার অংকে বিল মেটাতে পারবেন তাঁরা ওঠেন রোজভ্যালির চারতারা হোটেলে, সেখানে ঘরগুলো তাপানুকূল৷ আমাদের মত পাতি মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের সম্বল ঐ জাহান্নামসম কটেজ৷

সেখানে করে খাচ্ছেন এখন বেশ কিছু মানুষ৷ কেউ বা দিয়েছেন বিস্কুট, সফট ড্রিংকস, চিপসের দোকান তো কেউ কিনেছেন গাড়ি৷ মারুতি ভ্যান, টাটাসুমো নিদেনপক্ষে একটি অ্যাম্বাসেডর৷ গাড়ি কেনার টাকা এসেছে ফসলি জমি বিক্রি করে৷ সেইসব জমি আবার কিনে সেখানে ঢালাও চলছে মাছের ব্যবসা৷ তৈরি হয়েছে সব ভেড়ি৷ বাগদা, পোনা, তেলাপিয়ারা সেখানে বড় হয় মানুষের দেওয়া খাবার খেয়ে৷ জমি বিক্রি করে যাঁরা গাড়ি কিনেছেন তাঁরাও ভালই করে খাচ্ছেন৷ দশ কিলোমিটার মতন রাস্তা কলকাতা দীঘা মহাসড়ক থেকে৷যেতে হয় চাউলখোলায় নেমে৷ ট্রেকার আর ইঞ্জিনচালিত ভ্যানরিক্সা ছাড়া যাতায়াতের একমাত্র সম্বল এই গাড়িগুলি৷ চড়া ভাড়ায় দল বেঁধে মানুষ চাপেন এই গাড়িগুলোতে৷ হোটেল, কটেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন গাড়ির মালিকেরা গাড়ি নিয়ে৷ বেড়াতে আসা যাত্রীদের পৌঁছে দিয়ে আসেন এঁরা কাঁথি, জুনপুট, দীঘা৷ দশ কিলোমিটার দূরের চাউলখোলায় যেতে একটি মারুতী ভ্যান ভাড়া নেয় দুশো পঞ্চাশ টাকা, কাঁথি নিয়ে গেলে নেয় সাড়ে চারশো টাকা৷ যাঁরা ফোন করে হোটেল-কটেজ বুক করে আসেন, তাঁরা চাইলে এই সব গাড়িগুলো এসে তাঁদের নিয়ে যায় কাঁথি, জুনপুট কিংবা দীঘা থেকে৷ ভাঙা এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার ঝাঁকুনি কিংবা ধুলো থেকে অনেকটাই বাঁচিয়ে দেয় এই গাড়ি৷ গরমের কথা বলাই বাহুল্য৷

অনেকেই একবেলার জন্যে এসে ঘুরে যান এই মন্দারমণিতে৷ গাড়ি করে সকাল সকাল এসে ঘুরে বেড়িয়ে, সমুদ্রস্নান করে আবার ফিরে যাওয়া জুনপুট, দীঘা কিংবা কলকাতায়৷ চমৎকার দীর্ঘ সৈকত, প্রবল গর্জনে আছড়ে পড়া সমুদ্র আর দূরে বিস্তৃত নারকেল বন৷ একটু নীরবতা প্রার্থীদের বেড়াতে আসার জন্যে আদর্শ স্থান৷ সাথে গাড়ি থাকলে ঘুরে আসা যায় আঠেরো কিলোমিটার লম্বা এই বিচ, যার সাথে সাথেই এগিয়েছে নারকোলের বনও৷ গাড়ি না থাকলে চুপটি করে বসে পড়া যায় কোথাও একটা জায়গা দেখে নিয়ে৷ তবে যাঁরা রাত্রিবাস করবেন না তাঁদের এখানে বেলা বেশি না করাটাই শ্রেয়৷ নইলে মিস করতে হতে পারে কলকাতা ফেরার সাড়ে চারটের লাস্ট বাসটি৷ যেমন আমরা করেছিলাম৷ তারপর? একটি বাসের অপেক্ষায় হা পিত্যেশ! মেচেদা, হলদিয়া৷ যাহোক কিছু একটা! সময় বুঝে আকাশের কোণে জমে ওঠে ঘন, কালো মেঘ ৷ দেখতে দেখতেই তা ছড়িয়ে যায় গোটা আকাশে, দেয় গুরুগম্ভীর ডাক আর নেমে আসে অঝোর বৃষ্টি৷ রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকা, টিনের চাল ভেদ করে মাথায় বৃষ্টির ফোটারা এসে মাথায় পড়ে টুপটাপ টুপটাপ৷ কিছুই না পেয়ে অগত্যা উল্টো দিকের বাস ধরে যেতে হবে দীঘায় আর যাওয়ার আগে অবশ্যই মনে মনে একটা হিসেব করে নিতে হবে, হাতে এক্সট্রা সময় আর পয়সাকড়ি আছে তো!

মফিজুল৷ মারুতী ভ্যানের মালিক৷ নিজেই গাড়ি চালিয়ে পর্যটকদের নিয়া আসা যাওয়া করে, কাঁথি, জুনপুট, দীঘা৷ আবার ফিরে আসে মন্দারমণি৷ মফিজুলের বাড়ি সোনামুই'তে৷ গ্রামের নামটি কি সোনামুখী? না না৷ সোনামুখী নয়, সোনামুই! মফিজুলদের একসময় বিঘা তিরিশ জমি ছিল৷ সম্পন্ন চাষী পরিবার৷ কিন্তু এখন আর নেই সেই জমি৷ সমুদ্র খেয়ে নিয়েছে ওদের চাষের জমি৷ এখনও খানিকটা আছে বেঁচে, বিঘে দশ মতন৷ তবে এও যেতে পারে সাগরের পেটে যে কোনো সময়৷ সময় থাকতে মফিজুল তাই বেঁচে থাকা জমিটুকু বিক্রি করে দিয়েছে মাছের ব্যবসা করতে আসা একজনের কাছে, সেই টাকায় মফিজুল কিনেছে এই গাড়ি আর একটি ট্রাক্টর৷ গাড়িটি সে নিজেই চালায়৷ ট্রাক্টর ভাড়ায় খাটে৷ যাত্রীর আশায় মফিজুল যখন দাঁড়িয়ে থাকে কটেজের সামনে তখন পরম মমতায় পালকের ঝাড়ন দিয়ে ধুলো ঝাড়ে গাড়ির গা থেকে৷ নরম কাপড় দিয়ে মুছে মুছে চকচকে করে তোলে সে তার গাড়ির শরীর৷ মফিজুলদের গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ যায়নি৷ মন্দারমণি থেকে মাইল পাঁচেক দূরে বিদ্যুৎএর শেষ খুঁটিটি দাঁড়িয়ে আছে৷ এরপরে আর কবে এগোবে তা মফিজুল জানে না৷ তবে এগোবে এটুকু জানে৷ কারণ, যেভাবে বাইরের মানুষ মন্দারমণিতে আসছে, মাছের ব্যবসা, হোটেলব্যবসা করছে, তাদের নিজেদের ব্যবসার গরজেই তারা বিদ্যুৎএর জন্যে দৌড়-ঝাঁপ করবে আর আলো নিয়ে আসবে এটা মফিজুলের বিশ্বাস।

-ক্রমশ


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

দিদি, প্রথম পাতায় দুটো পোস্ট দিলেন?

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এ সংক্রান্ত নীতিমালা এখানে


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শ্যাজা এর ছবি
কৌস্তুভ এর ছবি

আরে, কতগুলা মন্দারমণি যাবেন আপনি? খাইছে

লেখা ভাল লাগল।

শ্যাজা এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সুন্দর লেখার জন্যে। ঘুরতে বড়ই ভালু পাই কিন্তু পয়সা আর টাইমের সাথে পারিনা। তাই ভ্রমণকাহিনী পড়তে বড়ই ভালু পাই।

রাতঃস্মরণীয়

কৌস্তুভ এর ছবি

তাই? তাহলে আফ্রিকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কে, অ্যাঁ? খাইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

দাপাদাপি যা করি তা তো আর নিজের ট্যাকের পয়সায় করিনা ........ হেহেহেহেহে। তবে আফ্রিকায় দাপাদাপিতে আপাততঃ ক্ষান্ত দিচ্ছি, চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এমাস শেষে ভেগে যাচ্ছি। আপনি সাবধান কৌস্তভ ভাই, পটেনশিয়াল নেক্সট ডেসটিনেশান পাকিস্তান, ভূনর্গ।

রাতঃস্মরণীয়

কৌস্তুভ এর ছবি

অ্যাঁ খাইসে!

সৈয়দ আফসার এর ছবি

ভালো লাগল।
__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!

__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!

শ্যাজা এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

বোন,
খানিকটা আপনার লেখায় আর খানিকটা কল্পনার ম্যাজিক ব্রুমে ভর করে মন্দারমণি ঘুরে এলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
রোমেল চৌধুরী

শ্যাজা এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।