দ্বীপের মধ্যে দাঁড়িয়ে

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০৭/২০০৭ - ১২:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের গ্রামের বাড়িটা এমন একটা জায়গায় যে বর্ষার জল এলে বাড়িটা একটা দ্বীপের মধ্যে দাড়িয়ে আছে বলে মনে হয় ।

বাড়ির তিনপাশে জল ।

যেমন পৃথিবীর চারপাশে থেকেও ভাগের হিসেবে তিনভাগ ।

সে এক অদ্ভুত সুন্দর ।

বছরের মোটামুটি চার মাস ঐ জল থাকে ।

ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা রাস্তার সাথে যে সাঁকোটি আমাদের বাড়ির যোগসুত্র রক্ষা করে, আমার ছেলেবেলায় সেই সাঁকোটি ছিলনা, যদিও সাঁকো অনেকগুলি ছিল সারা ছেলেবেলা জুড়ে ।

তখন ' সুদিন 'এ ( শুকনো মরশুম কে সুদিন বলা হয় সে অঞ্চলে ) খাল পেরিয়ে রাস্তায় উঠতে হত আর বর্ষায় নৌকো করে সেই খাল পেরুনো । যে বছর বন্যা হয় ( প্রতিবারই হয় যদিও), সে বছর ইউনিয়ন বোর্ডের ঐ রাস্তাটিও ডুবে যেত, তখন প্রায় এক কিলোমিটার মত রাস্তা নৌকোতেই যাওয়া, তারপর বড় রাস্তা। এশিয়ান হাইওয়ে। যত বন্যাই হোক, ঐ রাস্তার বেশ নিচেই থাকত জল ।

প্রতি সপ্তায় বাবার বাড়ি যাওয়া বাঁধা ছিল, প্রায়শই সঙ্গে থাকতাম আমি, বন্যাই হোক আর বর্ষার জলই জমুক, বাবার বাড়ি যাওয়া আটকাত না আমার ও না ।

তেমনই এক বন্যার সময়। আমরা তখন সিলেটে, বাবা বাড়ি এসেছেন সপ্তাহান্তে সাথে আমি আর দাদা। ছোটপিসিকে নিয়ে আমরা ফিরে যাব সিলেটে। সিলেট থেকে আমাদের গ্রামের দুরত্ব 105 মাইল, নিকটস্থ রেল-ষ্টেশন গ্রাম থেকে 18 মাইল দুরে। ট্রেন থেকে নেমে আমাদের এক আত্বীয়ের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া সারার পর খোঁজ নিয়ে জানা গেল রাস্তা অর্ধেকেরও বেশি জলে ডুবে, কোন গাড়ি চলছেনা, নৌকো করে যেতে হবে ঐ 18 মাইল। বাবা বেরিয়ে নৌকোর ব্যবস্থা করে এসে আমাদের দুই ভাই-বোনকে নিয়ে নৌকোয় বসলেন। গ্রামের ভেতর ভেতর দিয়ে মাঝি নৌকো চালাল, বাবা বারণ করে দিয়েছিলেন বিলের ওপর দিয়ে যেন না যায়, আগাই নামে এক বিল আছে, যাতে ঢেউ থাকে খুব, নৌকোয় উঠেই আমি ঘুম। বাবা যখন ডেকে ঘুম ভাঙালেন, তখন বাড়ির ঘাটে নৌকো। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল, আমাদের সেই গ্রামে তখনো ইলেকট্রিসিটি পৌছয়নি, টিমটিমে হ্যারিকেন বাতি জ্বলে সবার ঘরে ঘরে। দাদু বেশ রাগ করলেন বাবার ওপর, এই বন্যায় কেন আমাদের নিয়ে এলেন ।

মাঝে একদিন থেকে তার পরদিন ফেরা, এবার সাথে পিসি। বাবা আগের দিন গিয়ে নৌকো ঠিক করে এলেন তিতাস থেকে, সেখানে পানসিরা সব অপেক্ষা করে দূরে যাওয়ার জন্য। ভোর ভোর উঠে কাকিমা ভুনা খিচুড়ি আর ভুনা মুর্গী রেঁধে দিল দুপুরে খাওয়ার জন্যে। আমি ছোটপিসিকে বললাম, কেন কাকিমা রান্না করে দিচ্ছে? তুমি তো যাচ্ছ সাথে, মাঝিরা যেমন নৌকোয় রেঁধে খায়, তেমন করে আমরা কেন খাবনা? পিসি বোঝাল, ওরা নৌকোতেই থাকে তাই রাঁধে, আমরা একবেলার জন্য নৌকোয় রাঁধব? খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে নৌকোয় রেঁধে খাওয়ার বায়না ছাড়তে হয়েছিল কিন্তু পরক্ষণেই আবার খুশি, রান্না হবেনা তো কি হয়েছে? খাওয়া তো হবে! পিসি একটা ঝুড়িতে খাওয়ার জল, থালা, বাটি গেলাস নিয়ে নিল আর টিফিন ক্যারিয়ারে কাকিমার দেওয়া খাবার। আমরা বেশ পিকনিক পিকনিক মুডে নৌকোয় চাপলাম। দাদু বড়কাকাকে বললেন আমাদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসতে। দাদু, ঠাকুমা, কাকিমা ও আর সবাই বেশ চিন্তিত, উদ্বিগ্ন মুখ নিয়ে দাড়িয়ে থাকল বাড়ির ঘাটে । যতদুর দেখা যায় ওরা দাড়িয়েই ছিল ।

আমি আর দাদা পিসিকে বললাম গল্প শোনাও, পিসি গল্প শোনাল বেশ কয়েকটা, এরই মাঝে কানে আসছিল মাঝির সাথে বাবা, কাকার কথা-বার্তা। নৌকো আগাই বিলের পথ ধরে যাচ্ছিল, আমাদের বিকেলের ট্রেন ধরার কথা। আমরা শুধু বাবার কাছে গল্প শুনেছি এই বিলের, বর্ষায় যা সমুদ্রের চেহারা নেয়। প্রতি বছরই বেশ কিছু নৌকাডুবি হয়, বাতাস ছিলনা সেদিন, আকাশের কোথাও মেঘের কোন চিহ্ন ও ছিল না, তবু বাবা বেশ চিন্তিত মুখে বসেছিল । আমরা ছই এর ভেতরে মাঝিদের পেতে দেওয়া বিছানায় শুয়ে বসে গল্প করছিলাম, হাল্কা ঢেউএর দুলুনি বেশ সুন্দর এক আমেজ তৈরি করেছে। বাইরে তাকালে দূর দূর পর্যন্ত কোথাও কোন গ্রাম কিংবা গাছপালার চিহ্ন ও চোখে পড়ছেনা, মাঝি জানান দিল আগাইয়ের কাছে এসে পড়েছি, আপনারা খাওয়া দাওয়া সেরে নিন তার আগে। মাঝি এ ও জানান দিল বেশ হাওয়া উঠেছে । বাবার মুখ থমথমে হয়ে উঠছে ।

আমরা ও চুপ করে গেছি, ঢেউ এর দুলুনি বাড়ছে, এতক্ষনে ভয় করতে শুরু করল, নৌকোতে পাল ছিল, বাবা মাঝিকে বলল পাল নামিয়ে দিতে, নৌকো যত এগুচ্ছে, ঢেউ তত বাড়ছে, আকাশ তখনো পরিষ্কার কিন্তু জোর হাওয়া দিচ্ছে, প্রচন্ড ঢেউয়ে নৌকো ততক্ষনে একটা খেলনা । পিসি সজোরে দরুদ পড়ছে, কাকা ভেতরে এসে আমাকে কোলে নিয়ে বসেছে, কারন আমি কান্না আরম্ভ করেছি, ভাইয়া পিসিকে জড়িয়ে ধরে পিসির কোলে মুখ গুঁজে পড়ে আছে ।

আমাদের যা যাত্রাপথ ছিল ঢেউটা আসছিল সেদিক থেকেই, যেকোন মুহুর্তে নৌকো উল্টানোর সম্ভাবনা । বাবা মাঝিকে বলল, উল্টোদিকে নৌকো ঘুরিয়ে দিতে, মাঝি তখনও বলছে, তাহলে আজকে আর পৌছুতে পারবেননা, বাবা চেঁচিয়ে উঠে বলল বচ্চাদুটো আছে সাথে, তুমি নাও ঘোরাও । বাবা গিয়ে হাল ধরে বসল, আর প্রাণপণে সেই হাল ধরে বসে রইল । দুই ঘন্টা ধরে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ চলল, আমরা ভেতরে মৃতবত্। অনেকক্ষণ নাকি অনন্তকাল পর শুধু অনুভব করলাম ঢেউয়ের ঐ উন্মাদনা একটু যেন কমল । মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, জল একটু শান্ত, আর এই দুঘন্টায় বাবা এই প্রথম কথা বলল, এমু, আমরা আগাই পার করে এসেছি, আর কাঁদে না ।

দূরে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে, বাবাও জানে না যে ঐ বাতাস আর ঢেউ আমাদের নৌকোকে কোথায় নিয়ে এসেছে, মাঝিকে জিজ্ঞেস করে বাবা জানল, যে গ্রামটি দেখা যাচ্ছে তার নাম নরহা। কাকা বলল এখানে আমাদের এক আত্মীয় বাড়ি আছে, সেখানে যাওয়া যেতে পারে ।

দুজন মাঝি আর বাবার জামা কাপড় কিছুই শুকনো ছিলনা, পিসি তোয়ালে বের করে দিল বাবাকে, বাবা বলল, আগে নামি তারপর । হাঁটুজলে নেমে বাবা একে একে আমাকে আর দাদাকে কোলে করে নামাল । পিসি নিজেই নামল কাপড় ভিজিয়ে ।

যে বাড়িটিতে আমরা গেলাম, সেটা কাকিমার এক দিদির বাড়ি, তারা আমাদেরকে দেখে ভীষণ অবাক, বাবা এই বাড়ির বড়দের কাছে আর একপ্রস্থ বকুনি খেল কেন এই ভরা বর্ষায় ছেলে-মেয়ে দুটিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরুল আর সাথে সাথেই বাবা প্রচুর বাহবা ও পেল, ঐ বাতাস আর ঢেউ এর মাঝে নৌকো বাঁচিয়ে তীরে নিয়ে এসেছে বলে, মাঝিরা তো পরিষ্কার বলে দিল, যে আজ সাহেব হাল না ধরলে তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না নাও নিয়ে বেঁচে ফেরার ।

ঐ বাড়িতে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার বেরুলাম, গৃহকর্তা অনুরোধ করছিলেন আমরা যেন রাতটা থেকে পরদিন রওয়ানা হই। বিকেলের ট্রেন ততক্ষনে চলে গেছে, উল্টোদিকে এসে পড়ার দরুন এখন বেশ অনেকটা পথ আবার নৌকোয় গিয়ে রাতের মেল ট্রেন ধরে সিলেট পৌছুতে পরদিন সকাল হবে । তাই আর দেরী না করে আমরা আবার নৌকোয়। এবার আর নৌকোয় চাপতে চাইছিলাম না, বাবা বুঝিয়ে শুনিয়ে কোলে করে নৌকোয় তুলল ।

দাদা তখন বাহাদুরি দেখাচ্ছে সে একটুও ভয় পায়নি এই বলে, পিসি ও বলছে, সেও নাকি ভয় পায়নি কিন্তু আমি কান্নার ফাঁকে ঠিক দেখেছিলাম পিসিও ভয়ে কাঁদছে । সন্ধ্যে হয়ে গেল ষ্টেশনে পৌছুতে পৌছুতে । ট্রেন আসবে রাত এগারটায়, ওয়েটিং রুমের বেঞ্চেবাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ঘুমচোখে আমি, পরের বার বাবা বাড়ি আসার সময় আমাকে সাথে করে নিয়ে আসবে কিনা মাথায় সেই চিন্তা । কারণ বাবা দু বার বকুনি খেয়েছে আমাদের সাথে নিয়ে এসেছে বলে । কানে কানে পিসিকে জিজ্ঞেসও করে ফেললাম কথাটা। পিসি তখন বলল, অত ঘাবড়াসনা । ঠিক নিয়ে আসবে তোকে । নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়েই ঘুম ।

ট্রেন কখন এসেছে, কখন বাবা কোলে করে ট্রেনে তুলে সিটে শুইয়ে দিয়েছে, কখন কাকা চলে গেছে কিছুই জানতে পারিনি। ঘুম ভেঙেছে সকালে বাবা যখন ডেকে তুলেছে, ট্রেন তখন সিলেট ষ্টেশনে ঢুকছে ।


মন্তব্য

শ্যাজা এর ছবি

নতুন কোন লেখা হচ্ছে না।
পুরনো লেখার তাই স্থানবদল, ওঘর থেকে এঘরে।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

অরূপ এর ছবি

চমৎকার লেখা
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

দিদি আপনার নুকতা কোডেড লেখাটা বদলে আস্ত অক্ষর ওয়ালা ভার্সন করে দিলাম।

পরে এধরনের নুকতা ওয়াল লেখা বদলে আস্ত করতে যা করবেন:

১। প্রথমে নুকতাওয়ালা লেখা সচলায়তনে পেস্ট করবেন
২। পুরো লেখাটা সিলেক্ট করবেন
৩। টেকস্টবক্সের উপরে ডানে বদলাও লেখাটাতে ক্লিক করবেন
৪। পপ-আপ হওয়া টেকস্ট বক্সে nukta বা nuk টাইপ করবেন
৫। ওকে ক্লিক করবেন।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

নুকতা কোডেড লেখাটা রেফারেন্সের জন্য রেখে দিলাম:


আমাদের গ্রামের বাড়িটা এমন একটা জায়গায় যে বর্ষার জল এলে বাড়িটা একটা দ্বীপের মধ্যে দাড়িয়ে আছে বলে মনে হয় ।

বাড়ির তিনপাশে জল ।

যেমন পৃথিবীর চারপাশে থেকেও ভাগের হিসেবে তিনভাগ ।

সে এক অদ্ভুত সুন্দর ।

বছরের মোটামুটি চার মাস ঐ জল থাকে ।

ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা রাস্তার সাথে যে সাঁকোটি আমাদের বাড়ির যোগসুত্র রক্ষা করে, আমার ছেলেবেলায় সেই সাঁকোটি ছিলনা, যদিও সাঁকো অনেকগুলি ছিল সারা ছেলেবেলা জুড়ে ।

তখন ' সুদিন 'এ ( শুকনো মরশুম কে সুদিন বলা হয় সে অঞ্চলে ) খাল পেরিয়ে রাস্তায় উঠতে হত আর বর্ষায় নৌকো করে সেই খাল পেরুনো । যে বছর বন্যা হয় ( প্রতিবারই হয় যদিও), সে বছর ইউনিয়ন বোর্ডের ঐ রাস্তাটিও ডুবে যেত, তখন প্রায় এক কিলোমিটার মত রাস্তা নৌকোতেই যাওয়া, তারপর বড় রাস্তা। এশিয়ান হাইওয়ে। যত বন্যাই হোক, ঐ রাস্তার বেশ নিচেই থাকত জল ।

প্রতি সপ্তায় বাবার বাড়ি যাওয়া বাঁধা ছিল, প্রায়শই সঙ্গে থাকতাম আমি, বন্যাই হোক আর বর্ষার জলই জমুক, বাবার বাড়ি যাওয়া আটকাত না আমার ও না ।

তেমনই এক বন্যার সময়। আমরা তখন সিলেটে, বাবা বাড়ি এসেছেন সপ্তাহান্তে সাথে আমি আর দাদা। ছোটপিসিকে নিয়ে আমরা ফিরে যাব সিলেটে। সিলেট থেকে আমাদের গ্রামের দুরত্ব 105 মাইল, নিকটস্থ রেল-ষ্টেশন গ্রাম থেকে 18 মাইল দুরে। ট্রেন থেকে নেমে আমাদের এক আত্বীয়ের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া সারার পর খোঁজ নিয়ে জানা গেল রাস্তা অর্ধেকেরও বেশি জলে ডুবে, কোন গাড়ি চলছেনা, নৌকো করে যেতে হবে ঐ 18 মাইল। বাবা বেরিয়ে নৌকোর ব্যবস্থা করে এসে আমাদের দুই ভাই-বোনকে নিয়ে নৌকোয় বসলেন। গ্রামের ভেতর ভেতর দিয়ে মাঝি নৌকো চালাল, বাবা বারণ করে দিয়েছিলেন বিলের ওপর দিয়ে যেন না যায়, আগাই নামে এক বিল আছে, যাতে ঢেউ থাকে খুব, নৌকোয় উঠেই আমি ঘুম। বাবা যখন ডেকে ঘুম ভাঙালেন, তখন বাড়ির ঘাটে নৌকো। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল, আমাদের সেই গ্রামে তখনো ইলেকট্রিসিটি পৌছয়নি, টিমটিমে হ্যারিকেন বাতি জ্বলে সবার ঘরে ঘরে। দাদু বেশ রাগ করলেন বাবার ওপর, এই বন্যায় কেন আমাদের নিয়ে এলেন ।

মাঝে একদিন থেকে তার পরদিন ফেরা, এবার সাথে পিসি। বাবা আগের দিন গিয়ে নৌকো ঠিক করে এলেন তিতাস থেকে, সেখানে পানসিরা সব অপেক্ষা করে দূরে যাওয়ার জন্য। ভোর ভোর উঠে কাকিমা ভুনা খিচুড়ি আর ভুনা মুর্গী রেঁধে দিল দুপুরে খাওয়ার জন্যে। আমি ছোটপিসিকে বললাম, কেন কাকিমা রান্না করে দিচ্ছে? তুমি তো যাচ্ছ সাথে, মাঝিরা যেমন নৌকোয় রেঁধে খায়, তেমন করে আমরা কেন খাবনা? পিসি বোঝাল, ওরা নৌকোতেই থাকে তাই রাঁধে, আমরা একবেলার জন্য নৌকোয় রাঁধব? খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে নৌকোয় রেঁধে খাওয়ার বায়না ছাড়তে হয়েছিল কিন্তু পরক্ষণেই আবার খুশি, রান্না হবেনা তো কি হয়েছে? খাওয়া তো হবে! পিসি একটা ঝুড়িতে খাওয়ার জল, থালা, বাটি গেলাস নিয়ে নিল আর টিফিন ক্যারিয়ারে কাকিমার দেওয়া খাবার। আমরা বেশ পিকনিক পিকনিক মুডে নৌকোয় চাপলাম। দাদু বড়কাকাকে বললেন আমাদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসতে। দাদু, ঠাকুমা, কাকিমা ও আর সবাই বেশ চিন্তিত, উদ্বিগ্ন মুখ নিয়ে দাড়িয়ে থাকল বাড়ির ঘাটে । যতদুর দেখা যায় ওরা দাড়িয়েই ছিল ।

আমি আর দাদা পিসিকে বললাম গল্প শোনাও, পিসি গল্প শোনাল বেশ কয়েকটা, এরই মাঝে কানে আসছিল মাঝির সাথে বাবা, কাকার কথা-বার্তা। নৌকো আগাই বিলের পথ ধরে যাচ্ছিল, আমাদের বিকেলের ট্রেন ধরার কথা। আমরা শুধু বাবার কাছে গল্প শুনেছি এই বিলের, বর্ষায় যা সমুদ্রের চেহারা নেয়। প্রতি বছরই বেশ কিছু নৌকাডুবি হয়, বাতাস ছিলনা সেদিন, আকাশের কোথাও মেঘের কোন চিহ্ন ও ছিল না, তবু বাবা বেশ চিন্তিত মুখে বসেছিল । আমরা ছই এর ভেতরে মাঝিদের পেতে দেওয়া বিছানায় শুয়ে বসে গল্প করছিলাম, হাল্কা ঢেউএর দুলুনি বেশ সুন্দর এক আমেজ তৈরি করেছে। বাইরে তাকালে দূর দূর পর্যন্ত কোথাও কোন গ্রাম কিংবা গাছপালার চিহ্ন ও চোখে পড়ছেনা, মাঝি জানান দিল আগাইয়ের কাছে এসে পড়েছি, আপনারা খাওয়া দাওয়া সেরে নিন তার আগে। মাঝি এ ও জানান দিল বেশ হাওয়া উঠেছে । বাবার মুখ থমথমে হয়ে উঠছে ।

আমরা ও চুপ করে গেছি, ঢেউ এর দুলুনি বাড়ছে, এতক্ষনে ভয় করতে শুরু করল, নৌকোতে পাল ছিল, বাবা মাঝিকে বলল পাল নামিয়ে দিতে, নৌকো যত এগুচ্ছে, ঢেউ তত বাড়ছে, আকাশ তখনো পরিষ্কার কিন্তু জোর হাওয়া দিচ্ছে, প্রচন্ড ঢেউয়ে নৌকো ততক্ষনে একটা খেলনা । পিসি সজোরে দরুদ পড়ছে, কাকা ভেতরে এসে আমাকে কোলে নিয়ে বসেছে, কারন আমি কান্না আরম্ভ করেছি, ভাইয়া পিসিকে জড়িয়ে ধরে পিসির কোলে মুখ গুঁজে পড়ে আছে ।

আমাদের যা যাত্রাপথ ছিল ঢেউটা আসছিল সেদিক থেকেই, যেকোন মুহুর্তে নৌকো উল্টানোর সম্ভাবনা । বাবা মাঝিকে বলল, উল্টোদিকে নৌকো ঘুরিয়ে দিতে, মাঝি তখনও বলছে, তাহলে আজকে আর পৌছুতে পারবেননা, বাবা চেঁচিয়ে উঠে বলল বচ্চাদুটো আছে সাথে, তুমি নাও ঘোরাও । বাবা গিয়ে হাল ধরে বসল, আর প্রাণপণে সেই হাল ধরে বসে রইল । দুই ঘন্টা ধরে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ চলল, আমরা ভেতরে মৃতবত্। অনেকক্ষণ নাকি অনন্তকাল পর শুধু অনুভব করলাম ঢেউয়ের ঐ উন্মাদনা একটু যেন কমল । মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, জল একটু শান্ত, আর এই দুঘন্টায় বাবা এই প্রথম কথা বলল, এমু, আমরা আগাই পার করে এসেছি, আর কাঁদে না ।

দূরে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে, বাবাও জানে না যে ঐ বাতাস আর ঢেউ আমাদের নৌকোকে কোথায় নিয়ে এসেছে, মাঝিকে জিজ্ঞেস করে বাবা জানল, যে গ্রামটি দেখা যাচ্ছে তার নাম নরহা। কাকা বলল এখানে আমাদের এক আত্মীয় বাড়ি আছে, সেখানে যাওয়া যেতে পারে ।

দুজন মাঝি আর বাবার জামা কাপড় কিছুই শুকনো ছিলনা, পিসি তোয়ালে বের করে দিল বাবাকে, বাবা বলল, আগে নামি তারপর । হাঁটুজলে নেমে বাবা একে একে আমাকে আর দাদাকে কোলে করে নামাল । পিসি নিজেই নামল কাপড় ভিজিয়ে ।

যে বাড়িটিতে আমরা গেলাম, সেটা কাকিমার এক দিদির বাড়ি, তারা আমাদেরকে দেখে ভীষণ অবাক, বাবা এই বাড়ির বড়দের কাছে আর একপ্রস্থ বকুনি খেল কেন এই ভরা বর্ষায় ছেলে-মেয়ে দুটিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরুল আর সাথে সাথেই বাবা প্রচুর বাহবা ও পেল, ঐ বাতাস আর ঢেউ এর মাঝে নৌকো বাঁচিয়ে তীরে নিয়ে এসেছে বলে, মাঝিরা তো পরিষ্কার বলে দিল, যে আজ সাহেব হাল না ধরলে তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না নাও নিয়ে বেঁচে ফেরার ।

ঐ বাড়িতে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার বেরুলাম, গৃহকর্তা অনুরোধ করছিলেন আমরা যেন রাতটা থেকে পরদিন রওয়ানা হই। বিকেলের ট্রেন ততক্ষনে চলে গেছে, উল্টোদিকে এসে পড়ার দরুন এখন বেশ অনেকটা পথ আবার নৌকোয় গিয়ে রাতের মেল ট্রেন ধরে সিলেট পৌছুতে পরদিন সকাল হবে । তাই আর দেরী না করে আমরা আবার নৌকোয়। এবার আর নৌকোয় চাপতে চাইছিলাম না, বাবা বুঝিয়ে শুনিয়ে কোলে করে নৌকোয় তুলল ।

দাদা তখন বাহাদুরি দেখাচ্ছে সে একটুও ভয় পায়নি এই বলে, পিসি ও বলছে, সেও নাকি ভয় পায়নি কিন্তু আমি কান্নার ফাঁকে ঠিক দেখেছিলাম পিসিও ভয়ে কাঁদছে । সন্ধ্যে হয়ে গেল ষ্টেশনে পৌছুতে পৌছুতে । ট্রেন আসবে রাত এগারটায়, ওয়েটিং রুমের বেঞ্চেবাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ঘুমচোখে আমি, পরের বার বাবা বাড়ি আসার সময় আমাকে সাথে করে নিয়ে আসবে কিনা মাথায় সেই চিন্তা । কারণ বাবা দু বার বকুনি খেয়েছে আমাদের সাথে নিয়ে এসেছে বলে । কানে কানে পিসিকে জিজ্ঞেসও করে ফেললাম কথাটা। পিসি তখন বলল, অত ঘাবড়াসনা । ঠিক নিয়ে আসবে তোকে । নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়েই ঘুম ।

ট্রেন কখন এসেছে, কখন বাবা কোলে করে ট্রেনে তুলে সিটে শুইয়ে দিয়েছে, কখন কাকা চলে গেছে কিছুই জানতে পারিনি। ঘুম ভেঙেছে সকালে বাবা যখন ডেকে তুলেছে, ট্রেন তখন সিলেট ষ্টেশনে ঢুকছে ।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

দিদি,প্রচন্ড জ্বরে কাবু থাকায় তারপর আর যোগাযোগ করতে পারি নাই।
পারলে একটা মেইল দিও তো ।jebtik@gmail.com

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

কারুবাসনা এর ছবি

আমি দিলে যদি চলে তো এখনই দিতে পারি।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

শ্যাজা এর ছবি

আরিফ'দা,
আপনারে মেইল দিতে গিয়া দেখি মেইল যায় না মন খারাপ

কিছু একটা এরর দেখায়। আপনে একটা মেইল দেন দেখি এই ঠিকানায়,

এস এম বাবু,
এই নুকতা জিনিসটা কী একটু বুঝাইয়া দেন!


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।