০১।
দেশের তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের এই বিভেদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে আজকে সবাই রাজনীতিবিদদের গুষ্টি উদ্ধার করতে ব্যাস্ত। এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা একদলীয় বলি কি করে? আদতে তারা তা ননও বটে। তত্ত্ব-পরীক্ষন-প্রয়োগ সবমিলিয়ে বিজ্ঞানীরা বরাবরই বহুধাবিভক্ত। তবে সে বিভক্তির জন্য তারা এক দল আরেক দলকে পেটাতে কিংবা ককটেল মারতে যান না অবশ্যই। এখানেই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য। আর পটভূমি যেহেতু কোয়ান্টামের রাজ্যের, আজ শোনাব কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে বিজ্ঞানীমহলের ত্রিধাবিভক্তির গল্প।
০২।
কোয়ান্টামের ছোট্ট রাজ্যে আমাদের দুনিয়ার নিয়ম-কানুন চলেনা সে তো আগেই বলেছি। কিন্তু চেশ্যায়ার বেড়ালের মত বিড়াল উধাও হয়ে যাবে আর হাসিটুকু ভেসে থাকবে এ আর কাঁহাতক সহ্য হয়? নতুন এই দুনিয়ার রহস্য উদ্ধারে তখনকার তাবৎ বড় বিজ্ঞানী প্রায় ঝাঁপিয়েই পড়লেন। কিন্তু মুশকিল হয়ে গেল মাপামাপির পদ্ধতিতে। কেউ ত্রৈরাশিকে চাইলে কেউ আবার ভগ্নাংশ চেয়ে বসেন। একজন জল মেশানো পছন্দ করলে আরেকজন জল ছাড়া পছন্দ করে বসেন। তা কোয়ান্টামের রাজ্যে বিজ্ঞানীদের দল হল মোটাদাগে তিনটি।
১। কড়া বাস্তববাদী (realist)
২। রক্ষনশীল (orthodox)
৩। অজ্ঞেয়বাদী (agnostic)
প্রথম দলটির নেতা ছিলেন আইনস্টাইন স্বয়ং। এঁরা ছিলেন অনিশ্চয়তার ঘোর বিরোধী। এঁদের মত ছিল অনিশ্চয়তা প্রকৃতির অংশ হতেই পারেনা। বরং আমাদের হয়তোবা তত্ত্বে কিংবা জ্ঞানে কিংবা প্রযুক্তিগত উতকর্ষে কোনও ঘাটতি আছে- যেটা হয়ত একদিন কাটিয়ে ওঠা যাবে। আইনস্টাইন এজন্য ‘লুকানো তথ্য’ (hidden variable) নামে নতুন একটা শব্দই চালু করেন। অর্থাৎ- কিছু কথা থাকনা গুপন।
০৩।
রক্ষনশীল দলটির সামনের কাতারে ছিলেন নীলস বোর প্রমুখ। তাদের দাবি ছিল কট্টরভাবে অনিশ্চয়তার পক্ষে। এঁদের মতে কোনও কিছু নিখুঁতভাবে মাপতে যাওয়াই বাতুলতা। কারন নিখুঁত ভাবে মাপতে গেলেই যাকে মাপা হবে তার টাকে চাঁটি নয় পিঠে গুঁতো কিংবা পেটে কাতুকুতু লাগা অবশ্যাম্ভাবী। অতএব যাকে মাপতে চাই তাকে নিখুঁত ভাবে আমরা কখনই পাবনা। এর দু’দলের বাইরে আরও একটি তৃতীয় শক্তিও ছিল বটে। এঁরা অনেকটা টকশোজীবী সুশীলদের মত। এঁদের ভাবখানা এমন যে জানতে পারব কি না পারব তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। ১৯৬৪ সালে অবশ্য বেল নামে এক বিজ্ঞানী তাঁর সুচিন্তিত তত্ব উপস্থাপন করে তৃতীয় এই মতটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।
০৪।
হিজিবিজবিজের কথা মনে আছে? সকালে তাঁর নাম থাকত আলু-নারকোল আর বিকেলে রামতাড়ু। কোয়ান্টামের রাজ্যেও একই অবস্থা, কোনও মুহূর্তে একটা কিছুর মান মেপে ধরা যাক ৫ পেলেন পরমুহূর্তেও সেটাকে যে আবার ৫ ই পাবেন তা নাও হতে পারে। তাঁর ওপর আছে দেখার আঘাত। ধরেন আপনাকে আমি চিনি, এখন রাস্তায় দেখা হলে যদি তাকাই তাতে কি আপনি ব্যাথা পাবেন? মোটেই না, বরঞ্চ না তাকালেই ভাববেন ব্যাটা অভদ্র কাহিকা। তাইনা? কিন্তু কোয়ান্টাম রাজ্যের ক্ষুদ্র প্রজাদের ভদ্রতাজ্ঞান আবার অন্য রকম। ফুলের ঘায়ে মুর্ছা যাওয়া তো অনেক পরের কথা, স্রেফ ‘দেখার’ আঘাতেই তারা নড়েচড়ে যায়। এটাকেই বলে ভেঙ্গে পড়া (collapse)। তা কি ভেঙ্গে পড়ে? সাইয়ের গল্প বলেছিলাম মনে আছে? ভেঙ্গে পড়ে সাই এর সমাধান। অর্থাৎ যখন আমরা কিছু ‘দেখতে’ যাই ঠিক তখন আমাদের ‘দেখার’ গুঁতোয় সাই বেচারা বাধ্য হয় একটা সমাধান দিতে। সেটা যে সবসময় এক হবে তার গ্যারান্টি নেই। খুব কড়াকড়ি ভাবে বলতে গেলে ব্যাপারটা এমন- আমরা যখন পুর্ণিমা রাতে আকাশের দিকে তাকাই আমাদের তাকানোর ফলস্বরূপ চাঁদটাকে দেখা যায়। কি বুঝলেন? কবিগুরু বলেছিলেন না- ‘আমারই চেতনার রঙে, পান্না হল সবুজ’ তেমন ব্যাপারস্যাপার।
০৫।
কোয়ান্টামের রাজ্যের গল্পে যদি শ্রোয়েডিঙারের বিখ্যাত বেড়ালের গল্পটা না বলি তবে ক্যামনে কী? বিজ্ঞানীরা অনেক সময় মনে মনে পরীক্ষা করেন। আইনস্টাইন প্রায়ই করতেন। গ্যালিলিও পিসার হেলানো মিনারের ওপর থেকে বিভিন্ন মাপের জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে পৃথিবী সবাইকে একই হারে দৌড়ের ওপর রাখে প্রমাণ করেছিলেন বলে কথিত আছে; এটিও আদতে একটি মনে মনে করা পরীক্ষা- সত্যি সত্যি গ্যালিলিও সেখান থেকে জিনিসপত্র ছোঁড়েননি। এই বহুল আলোচিত বেড়ালের গল্পটা আসলে একটা মনে মনে করা পরীক্ষা। গল্পের পটভূমিতে শ্রোয়েডিঙার ভেবেছেন একটা সবদিক বন্ধ বাক্সে আছে এক বেড়াল, আর একটা বিষের পাত্র। এমন কড়া বিষ- যে পাত্র খোলামাত্র বেড়াল অক্কা পাবে। সে বিষের পাত্র কে চিচিং ফাঁক হুকুম দেবার জন্য আবার আছে তেজস্ক্রিয় একটা পদার্থ। এখন তেজস্ক্রিয় পদার্থ হল গিয়ে কোয়ান্টামের রাজ্যের প্রজা। সে চলে তাঁর খেয়াল খুশি মত। সে ভেঙ্গে চৌচির হলে বিষের পাত্রেও গুঁতো লাগবে, বেড়ালও পটল তুলবে। কিন্তু লাটসায়েব কখন ভাঙবেন তা বলবার জো নেই। এমনকি আমাদের দেখবার ঘায়েও তিনি ফাটতে পারেন। তাহলে বাইরে থেকে আমরা কি বলব? বেড়াল জ্যান্ত নাকি মৃত? (Is it DEAD or ALIVE?) উত্তর হল দুটোই। বেড়ালটা আসলে জীবন্মৃত। (Simultaneously DEAD & ALIVE) এখন সে তো আমরা বাইরে থেকে বলছি। বাক্স খুললে কি দেখব? হ্যাঁ, তখন অবশ্যই বেড়ালকে হয় জীবিত দেখব, নয় মৃত দেখব। অর্থাৎ দর্শকই ‘দেখতে’ গিয়ে বেড়ালকে ‘মৃত’ পাচ্ছেন অথবা ‘জীবিত’ পাচ্ছেন। (মৃত্যু একটা একমুখী একমুখী প্রক্রিয়া হওয়াতে আসলে বেড়াল জিনিসটা ঠিক জুতসই নয়। তবে তা না হলে- একেক দর্শক বাক্স খুলে একেক রকম বেড়াল পেতেন।) বাস্তবতা নাকি গল্পের চেয়েও অদ্ভুত হয়। কোয়ান্টামের রাজ্যে আসলে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় বৈকি।
পাদটিকাঃ
বছর শেষ, সেই সঙ্গে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গল্পও আপাতত এখানেই শেষ। তাতে মন খারাপ করবেন না যেন। এর পরে বিজ্ঞানের আরো হাজারো গল্প অপেক্ষা করছে। ভাল থাকুন, আলোকিত থাকুন, আলোকিত রাখুন। নতুন বছরে বিজ্ঞানের তীব্র আলোয় ভেঙ্গে পড়ুক সকল অন্ধকার এই শুভকামনা রইল।
পাদ-পাদটীকাঃ
সিরিজ যেহেতু শেষ, পুরনো সব পর্বের লিংক নিচে যোগ করে দিলাম।
১। ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ
২। রমনার চিঠি থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্ধেক মালিকানা
৩। আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি
৪। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
৫। কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার
৬। ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল
৭। তুমি কোন পথে যে এলে
৮। আমি কোথায় পাব তারে
৯। আলোকের এই ঝর্নাধারায়
মন্তব্য
যা: শেষ হয়ে গেল!
অত্যন্ত চমৎকার, অত্যন্ত দামী সিরিজ।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নাহলে অন্য সিরিজ শুরু করতে পারছি না তো
নতুন বছরের শুভেচ্ছা
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ঠিক, ঠিক! পরের সিরিজ শুরু করতে হবে!
নতুন বছরের শুভেচ্ছা
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
খুব ভাল লাগে আপনার সিরিজটা, এই রকম সিরিজ আরও চাই। নতুন বছরের শুভকামনা- ইসরাত
আসিতেছে...
নতুন বছরের শুভেচ্ছা
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
চমৎকার একটা সিরিজ শেষ হলো। অভিনন্দন!
এই পর্বটা আকারে একটু ছোটো হয়ে গেছে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
নতুন বছরের শুভেচ্ছা
তানভীর ভাই, ইপিআর প্যারাডক্স আর বেলের অসমতা এই অধ্যায়ে ঢোকাবার ইচ্ছে ছিল। অনেক ভেবেও ও দুটোকে সহজবোধ্য করে তুলতে পারলাম না। তারচেয়ে এটুকুই থাক।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এই পর্বটিরই নাম হওয়া উচিৎ ছিল "পাদটীকা"।
হু, বেশিই ছোট হয়ে গেছে
যাকগে, নতুন বছরের শুভেচ্ছা
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
শেষ
মুগ্ধতা নিয়ে শেষ হলো একটি সিরিজ। নতুন বছরে আপনাকেও শুভেচ্ছা।
মাসুদ সজীব
বিজ্ঞানের রাজ্যে গল্পের তো আর শেষ নেই... এরপর আপেক্ষিকতা আসবে... পরমাণুর অন্দরমহলের গল্প আসবে... বিদ্যুতের দৌড়াদৌড়ির গল্প আসবে... আকাশ ভরা নানা জাতের তারার গল্প আসবে... সুবিশাল মহাবিশ্বে এট্টূসখানি আমাদের এই বসুন্ধরা'টার গল্প আসবে... লাইনে থাকুন...
আর যতটুকু সম্ভব বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিন... তবেই লেখা সার্থক হবে
নতুন বছরের শুভেচ্ছা
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সাব্বাস। ফাডায়ালান।
..................................................................
#Banshibir.
হ, পীরগিরি কইরা আর কদ্দিন? লাইনে আসুন।
নয়া বছরের শুভেচ্ছা
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ও চাচ্চু পরমাণুর অন্দরমহল আর বিদ্যুতের ১০০ মিটার অলিম্পিক রেস কো?
..................................................................
#Banshibir.
রেডি তো। থিবো আর চন্ডিশীরার পরের পর্ব আসার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে দিয়া দিমু! কবুতর ফারুকের কসম।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
থিবো নয় সপ্তাখানেকের মধ্যে আসতেছে ক্যাপ্টেন ব্রুকস। লাইনে থাকেন। আর পরমাণুর অন্দরমহল নামান।
..................................................................
#Banshibir.
দিয়া চা-চু খাই গিয়া
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ভেঙে পড়লো কোথায়, গড়ে উঠছে দেখতে পাচ্ছি মশাই!
নতুন বছরে বিজ্ঞানের তীব্র আলোয় ভেঙ্গে পড়ুক সকল অন্ধকার এই শুভকামনা রইল।
কখনও নতুন করে গড়ার জন্যও ভাঙতে হয় বৈকি,
নতুন বছরের শুভেচ্ছা, তানিম্ভাই
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এই সিরিজ নিয়ে আর কিছু না বলি। বরং বলি - আপনার বই পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা দেবার কথা, কোথায়? না দেয়া পর্যন্ত বলতেই থাকবো, বলতেই থাকবো।
মহাকাশ নিয়ে সিরিজ আসবে কবে - সেই যে আকাশ ভরা সূর্য তারা? আপনার আশায় কিন্তু আমি বসে আছি!!
____________________________
লিখছি তো, সিমলা চুক্তি'র কথাটা বই পড়তে গিয়েই না মনে পড়ল
একটা শেষ করলুম কেবল... কদিন গড়িয়ে নিই... ধইজ্জ ধরুন
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন