( ১৯৭১ ভেতরে বাইরে প্রকাশের পর থেকেই ‘প্রথম আলো’ গ্রুপের অতিপ্রচার ও সত্যবিমুখ কিছু টকশোজীবিদের হেঁড়ে গলার চিৎকারে বইটি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে রয়েছে। এই প্রসঙ্গের আতিশয্যে বইটির আরও অনেক আলোচনাযোগ্য অংশের ওপর তেমন কোন আলোকপাত করা হচ্ছে না। জয়পাকিস্তান সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে এখানে যথেষ্ট প্রামাণ্য আলোচনা হয়েছে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু সেদিন জয়পাকিস্তান বললেও তাতে কিছুই আসত-যেত না বলেই আমার ধারণা। একারণে বইয়ের এ সংক্রান্ত অংশটুকু সচেতনভাবেই এই নিবন্ধের বিস্তারিত আলোচনায় আনা হয় নি।
এ কে খন্দকার পদাধিকারবলে মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলেই বিবেচিত। তিনি যদি সত্যকে বদলে দেবার জন্য কুখ্যাত প্রথমা প্রকাশনের খপ্পরে পড়েন সেক্ষেত্রে তাঁর ব্যাক্তিগত অবস্থানের চাইতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বহুগুণে হুমকির সম্মুখীন হয়। এই প্রেক্ষিতে বইটির যথাসম্ভব পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এই চলমান নিবন্ধে সেই চেষ্টাটিই করা হয়েছে।
এই পর্বে ২৩২ পৃষ্ঠাসংখ্যা সংবলিত বইটির ২৩ থেকে ৫২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অংশ আলোচিত হল। আসন্ন পর্বসমূহে বইটির পরবর্তী অংশ ক্রমান্বয়ে আলোচিত হবে। মন্তব্য অংশে সকল পাঠকের সক্রিয় সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ধারাবাহিকতার স্বার্থে প্রথম পর্বের লিঙ্ক এখানে সংযুক্ত করা হল। )
বইটির ‘১৯৭১: জানুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ’ শীর্ষক দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক নিজের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের বিবরন দিয়েছেন গুরুত্বের সাথে। যদিও অধ্যায়ের শেষ দিকে প্রয়োজনের সময় তাঁর গুরুত্বহীনতার হতাশাব্যাঞ্জক ও স্ববিরোধী বর্ণনাও লিপিবদ্ধ হয়েছেঃ
মনে রাখতে হবে, আমি সামরিক প্রশাসনের ভেতরে থাকায় বা প্রশাসনের অংশ হওয়ার কারণে দেশের পরিস্থিতি ও পাকিস্তানিদের গতিবিধি রাজনীতিবিদ বা অন্যদের চেয়ে বেশী উপলব্ধি করতে পারতাম। আর এ কারণেই আমি সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরের খবর প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের কাছে পাঠাতে পারতাম। [ পৃষ্ঠা - ২৫ ]
এবং,
পাকিস্তান বাহিনী স্থলপথে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আক্রমন করতে না পেরে ২৯/৩০ মার্চ বিমানের সাহায্যে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে বোমাবর্ষণ করে। ২৮ বা ২৯ মার্চের পর থেকে বিমানবাহিনীর যুদ্ধজাহাজে বাঙালিদের পরিবর্তে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানী বৈমানিকদের উড্ডয়ন করতে দেয়া হত। আমিসহ সব বাঙ্গালি কর্মকর্তা তখন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে ছিলাম নামেমাত্র। আমাদের কোনও দায়িত্বে-কর্তব্যে নিযুক্ত করা হত না। পাকিস্তান বিমানবাহিনী কোথাও আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নিলে আমরা ধারণা করতে পারতাম, কিন্তু কবে/কোথায় তা নির্দিষ্ট ভাবে জানতে পারতাম আন। তাই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র আক্রমণের কথা অনুমান করতে পারলেও সুনির্দিষ্টভাবে আক্রমণের কোনও খবর জানতে পারিনি [ পৃষ্ঠা - ৫২ ]
মার্চের প্রথম সপ্তাহে সেনা আনয়নের বর্ননায় তিনি বলেনঃ
ঘটনার পরপরই আমি তখনকার ডিজিএফআই ঢাকা শাখার প্রধান উইং কমান্ডার আমিনুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করেছি কেন সৈন্য আনা হচ্ছে? তিনি কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। ... ... ... আমার মনে হয়েছে তিনি প্রকৃত তথ্যটি আমার কাছে গোপন করছেন। তবে এটাও হতে পারে পাকিস্তানীরা তাঁকেও অন্ধকারে রেখেছিল। উইং কমান্ডার ইসলাম বিমানবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকায় মুক্তিযুদ্ধে তাকে কোনও দায়িত্ব দেয়া হয়নি। বরং তাঁকে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। [ পৃষ্ঠা - ২৬ ]
এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে খন্দকার সাহেব এত দেরি সত্বেও নজরদারিতে পড়েননি কেন? তিনি আরও জানিয়েছেনঃ
২ মার্চ এমভি সোয়াত নামে একটি পাকিস্তানি জাহাজ প্রায় সাত হাজার টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করে। ... ... ... এ সংবাদ আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে অনেকে জানতেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভবত পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি’র এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাদের (পাকিস্তানীদের) শক্তিবৃদ্ধির দিকে ছিল না। তাদের একটি ধারণা ছিল তারা সমস্যাটিকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করে ফেলবেন। আমি মনে করি জাতির এধরণের ক্রান্তিকালে রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়াও একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা থাকা উচিৎ যাতে একটি ব্যার্থ হলেও অন্যটি প্রয়োগ করা যায়। আমি এমন কোনও তথ্য পাইনি যাতে মনে করতে পারি রাজনৈতিক পন্থা ব্যার্থ হলে আওয়ামী লীগের নেতারা বিকল্প পন্থা হিসেবে অন্য কোনও উপায় ভেবে রেখেছিলেন। [ পৃষ্ঠা - ২৭ ]
খন্দকার সাহেব ১৯৫১ সাল থেকে ধুম করে ২০ বছর ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে ফেলেছেন। ভাষা আন্দোলন ও ছয় দফা বাদ দিলাম, আগরতলা মামলা সম্পর্কেও তিনি একটু পড়েশুনে দেখবার চেষ্টা করেন নি। এটি কি ইচ্ছাকৃত কি না তা একমাত্র তিনিই বলতে পারেন। এর পর তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এই বলেঃ
আমি প্রায় ২০ বছর পর পূর্ব পাকিস্তানে এসেছি। তাই অল্প সময়ে আমার পক্ষে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি ও পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সব বাঙ্গালী কর্মকর্তা সম্পর্কে জানা বা পরিচিত হওয়া সম্ভব ছিলনা। [ পৃষ্ঠা – ২৬/২৭ ]
এ বইটি কেবল স্মৃতিকথা হলে এত কথার প্রয়োজন পড়ত না। সমস্যা হল।, যেসব ক্ষেত্রে খন্দকার সাহেবের সংশ্লিষ্টতা বা উপস্থিতি পর্যন্ত ছিলনা সেখানেও তিনি মতামত দেবার চেষ্টা করেছেন। তা তিনি দিতেই পারেন। কিন্তু বইপত্র ঘেঁটে গবেষণা করার দাবী নিয়ে লেখক যখন ছয় দফা ও আগরতলা মামলার মতন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে হোমওয়ার্ক না করে বেমালুম সেটাকে গালিচা-চাপা দেন তখন তা চোখে লাগে বৈকি। তখনকার প্রসাসনিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর ভাশ্যঃ
আন্দোলন জোরদার হওয়ার পটভূমিতে এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ তৎপরতার মুখে সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন। তারা দেশের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে বুঝতে পারেন। তারা অনুভব করতে পারেন এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তাদের প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে কোন নির্দেশনা বা কোনও সিদ্ধান্তের জন্য তাঁরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। ইতিমধ্যে শেখ মুজিব বেসামরিক প্রশাসন, শিল্প কারখানা, সাধারণ জনগণকে বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ দেন, যা সবাই মেনে চলছিল। [ পৃষ্ঠা - ২৯ ]
বলাই বাহুল্য, ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা এতে উল্লিখিত হয় নি। এর পর তিনি আরও বলেছেনঃ
সত্যি কথা বলতে কি, আমরা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোনও নির্দেশ পাইনি। এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতারা আমাদের কিছু জানাননি। যদি কেউ বলেন যে তখন আওয়ামী লীগের নেতারা যুদ্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন তবে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলতে হয় যে তা সঠিক নয়। অন্তত আমি কোনও নির্দেশনা পাইনি। [ পৃষ্ঠা – ২৯/৩০ ]
এইখানে চাতুর্যপূর্ণ ভাষায় বহুবচনের ব্যাবহার লক্ষণীয়। ‘অন্তত তিনি’ কোনও নির্দেশনা পেয়ে না থাকলে সেই দায় সবার ওপর চাপাচ্ছেন কেন? নাকি তিনি নির্দেশিত হবার মত ‘বিশ্বাসযোগ্য’ ছিলেন না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অত্যন্ত তাচ্ছিল্য ভরে খন্দকার জানাচ্ছেনঃ
শোনা যায়, মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্ররা নিজ উদ্যোগে পুরানো ৩০৩ রাইফেল নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার প্রস্তুতি গ্রহন শুরু করেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের মত তথ্যপ্রযুক্তি এত উন্নত ছিলনা। তাই এধরণের কোনও তৎপরতার খবর আমি এবং অন্য সামরিক কর্মকর্তারা জানতে পারিনি। এর ফলে কর্মরত বাঙ্গালি সামরিক কর্মকর্তাদের ধারণা হয় যে রাজনৈতিক নেতাদের কোনও যুদ্ধপ্রস্তুতি নেই। ফলে ২৫ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমন করল তখন এটিকে প্রতিহত করার জন্য বাঙালি সেনাসদস্যদের কোনও প্রস্তুতি ছিল না। ... ... ... যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া শত্রুকে প্রতিহত করতে গিয়ে আমাদের ভীষণ ক্ষতি হয়েছিল। এই ব্যাপক ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হত যদি বাঙ্গালী সেনাসদস্যদের রাজনৈতিক উচ্চমহল থেকে চলমান পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য আক্রমণ সম্পর্কে যথাসময়ে অবহিত করা হত ও তা প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হত। [ পৃষ্ঠা - ৩০ ]
শোনা কথা নিয়ে ‘আবেগাক্রান্ত না হতে চাওয়া ও প্রমাণনিষ্ঠ’ লেখকের এত মাথাব্যাথা কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রনেতারা তখন জাতীয় রাজনীতিরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ছিলেন। এই সত্যটি কি খন্দকার সাহেব সজ্ঞানে ছাত্রদের ‘নিজ উদ্যোগের’ আড়ালে ঢেকে দিতে চাইলেন? যেদিনটি নিয়ে সারা দেশের পরিস্থিতি অন্য রকম সেদিনটি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতি সম্পর্কে লেখকের অভিজ্ঞতাঃ
সাতই মার্চের ভাষণের দিন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক ছিল, সবাই ব্যাস্ত ছিল নিজ নিজ কাজে। এদিন বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিলেন তা খুবই তির্যক ছিল। বাঙালিরা ভাবতে আরম্ভ করল সত্যিই কি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল? আমরা কি যুদ্ধে নামব, নাকি গ্রামে চলে যাব? [ পৃষ্ঠা – ৩১/৩২ ]
ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি তিনি শুনেছেন দাবী করছেন কিন্তু কোথায়/কখন/কিভাবে তা জানাননি। আগের অনুচ্ছেদে উল্লিখিত তথ্যমোতাবেক তিনি ঐদিন রেসকোর্স ময়দান নয়, বরঞ্চ ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন বলেই মনে হয়।
সাতই মার্চের ভাষণটি আমি শুনেছি। ... ... ... ওই কথাগূলো শক্তিশালী ছিল বটে কিন্তু তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের নেতাদের ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, তবে আমার মনে হয়েছে কিভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে তা তিনি পরিস্কার করেননি। তা ছাড়া জনগণকে যুদ্ধ করার জন্য যেভাবে প্রস্তুত করার প্রয়োজন, তা হয়নি। ভাষণে চুড়ান্ত কোনও দিকনির্দেশনা পাওয়া গেলনা। আওয়ামী লীগের পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় যুদ্ধ শুরু করার কথা বলাও একেবারে বোকামি হত। সম্ভবত, একারণেই বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকেন। [ পৃষ্ঠা - ৩২ ]
এ ব্যাপারে তিনি আরও জানাচ্ছেনঃ
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা আমি মনে করিনা। এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’। তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন ‘জয় পাকিস্তান’! এটি যে যুদ্ধের ডাক বা স্বাধীনতার আহ্বান তা প্রচন্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং তর্কাতীতও নয়। যদি আওয়ামী লীগের নেতাদের কোনও যুদ্ধপরিকল্পনা থাকত তাহলে মার্চের শুরু থেকে জনগণ ও সরকারি, বেসরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের স্বল্প সময়ে সঠিকভাবে সংগঠিত করা যেত। সেটা করা হলে আমার মনে হয় যুদ্ধটি হয়তোবা খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেত এবং আমাদের বিজয় নিশ্চিত হত। [ পৃষ্ঠা - ৩২ ]
এখন তিনি মনে করছেন না বটে, কিন্তু একটু আগেই কিন্তু তিনি জানিয়েছিলেনঃ “বাঙালিরা ভাবতে আরম্ভ করল সত্যিই কি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল? আমরা কি যুদ্ধে নামব, নাকি গ্রামে চলে যাব?” তিনি কি তাহলে নিজেকে বাঙ্গালিদের বাইরে কেউ ভাবতে পছন্দ করেন? খন্দকার জানাচ্ছেনঃ
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতেই সামরিক বাহিনীতে পাকিস্তানীরা কৌশলে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ডে বাঙ্গালীদের এড়িয়ে যেতে শুরু করে। ফলে বাঙ্গালী ও পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস ক্রমেই বাড়তে থাকে। [ পৃষ্ঠা - ৩২ ]
এবং
অন্যান্য সৈনিকের মত বাঙালি সৈনিকেরাও সাধারনত রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণ ও কুচকাওয়াজ করতেন। কিন্তু এ সময় বাঙ্গালিদের এ ধরণের কর্মকান্ড থেকে সরিয়ে রাখা হত, তাদের অস্ত্র দেয়া হতনা। যাদের নিরস্ত্র করা সম্ভব হয়নি, মিথ্যা অজুহাতে তাঁদের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের ছোট ছোট দলে ছড়িয়ে দেয়া হয় যাতে তাঁরা একসঙ্গে বড় শক্তি হয় না দাঁড়ায়। [ পৃষ্ঠা - ৩৩ ]
এই প্রেক্ষিতে তিনি আবার ও নিজের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান বর্ননা করতে ভোলেননিঃ
বিরাজমান অস্থির ও গুমোট পরিস্থিতে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পিআইএ বা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বাঙ্গালী প্রকৌশলী বা কলাকৌশলীরা মাজেহ মধ্যে আমার কাছে আসতেন পরামর্শ ও উপদেশ নিতে। আমি সবাইকে সবকিছু ধীরস্থিরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বলতাম ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তাঁদের কাজ বা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে বলতাম। আমি তাঁদের পাকিস্তানিদের অসহযোগিতা করা বা বিদ্রোহ করা ইত্যাদি কোনও পরামর্শ দিতে পারতাম না। কারণ, এখানে দুই ধরণের জটিলতা ছিল। প্রথমত আমি সব বাঙ্গালী টেকনিশিয়ানকে চিনতাম না বা তাই সামরিক কর্মকর্তা হিসাবে সবাইকে আমি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলতে পারতাম না। এ কাজটি আমার জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারত। দ্বিতীয়ত, আমি তাঁদের কোন সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলব? সেই আন্দোলন তো তখনো শুরুই হয়নি। সর্বোপরি, সব বাঙালি টেকনিশিয়ান যে আমার কথা শুনবেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করবেন, তারও কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। [ পৃষ্ঠা - ৩৩ ]
শেষ বাক্যটির রেশ একটু পড়ে আবার কাজে লাগবে, আপাতত মাথায় রাখুন। এরপর লেখক দাবী করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া স্ত্রীর মাধমে স্ত্রীর সহপাঠীদের তিনি নারায়নগঞ্জে একটি ডিপোতে আসাযাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করার গুরত্ব বুঝিয়েছেনঃ
চিশতি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে একদিন গোদানাইল যাওয়ার রাস্তাটি কেটে দেন এবং বেশ কিছু গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে রাখেন। এ কাজে নারায়ণগঞ্জের সাধারন মানুষও অংশগ্রহণ করে। ঐ সময়ে রাজনৈতিক নেতারা এসব কাজে সাহায্য করতে আসেননি। ... ... ... চিশতির সম্পূর্ণ নাম ও পরিচয় এখন আমার আর মনে পড়ছে না। তবে পড়ে জেনেছিলাম, ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানীদের আক্রমণে তিনি নিহত হন।[ পৃষ্ঠা – ৩৪/৩৫ ]
এখানেও লেখক সুচিন্তিত ভাবে বিস্মৃতির আশ্রয় নিয়েছেন, রেফারেন্স খুঁজে দেখেননি বা দেখতে চাননি। আমি যদি ভুল করে না থাকি তাহলে উল্লেখিত চিশতি হলেন ছাত্রনেতা চিশতি শাহ হেলালুর রহমান। তাঁর সাংগঠনিক পরিচয়টি কি লেখক ইচ্ছাকৃতভাবে বিস্মৃত হলেন? যা হোক তিনি আরও জানাচ্ছেনঃ
বারবার নাজেহাল করা গেলে পাকিস্তানিরা কিছুটা হলেও অসুবিধায় পড়ত। সারা দেশে এ ধরণের তৎপরতা চালিয়া পাকিস্তানিদের দৌড়ের উপর রাখা যেত। এতে ২৫ মার্চ এবং তাঁর কিছুদিন পর পর্যন্ত তাঁরা যে একতরফা খেলেছিল তা পারত না। [ পৃষ্ঠা – ৩৫/৩৬ ]
এবং,
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পরে কচুক্ষেতের সাধারণ মানুষ বাজারে কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে সেনানিবাসে বসবাসরত সামরিক ও বেসামরিক মানুষের নিত্য-নৈমিত্তিক খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়ে। ... ... ... একটি ছোট ও কার্যকর অবরোধের সংবাদ প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। কারণ, অবরোধটি ছোট হলেও এর প্রভাব ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। কচুক্ষেতের এই অসহযোগিতার কাজটি করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বেসামরিক বাঙালি কর্মকর্তা ও সৈনিক, যারা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে থাকতেন। এ ধরণের কিছু অবরোধ অন্যান্য সেনানিবাসেও হয়েছিল, তবে তা ছিল খুব সাময়িক ও অপরিকল্পিত। এগুলো হয়েছিল একেবারে স্থানীয়ভাবে কোনও সমন্বয় ছাড়াই। এরকম অবরোধ বা ঘটনা যদি সারা দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে ছড়িয়ে দেয়া যেত তাহলে হয়তো বা হানাদার বাহিনীকে আমরা খুব অল্প সময়েই দুর্বল করতে পারতাম। [ পৃষ্ঠা - ৩৬ ]
মার্শাল ল চলাকালীন সময়ে যেখানে সকল ঘটনার গোয়েন্দারিপোর্ট স্বয়ং প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে যেত তা লেখক নিজেই স্বীকার করছেন, কিন্ত পড়ে তিনি বারংবার ‘লিখিত/অফিশিয়াল’ আদেশের জন্য হা-হুতাশ করেছেন কেন? নিজে যেখানে ছোটখাট অসহযোগের মাধ্যমে পাকবাহিনীকে ‘দৌড়ের ওপর’ রাখার বুদ্ধি দিচ্ছেন সেখানে ওসমানীর অনুরূপ কথায় তিনি হতাশা ব্যাক্ত করছেন কেন?
কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে ১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর সামরিক উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেন। ২২ মার্চ অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকেরা বায়তুল মোকাররমে একটি বিরাট সমাবেশ করেন। সেখানে তাঁরা কর্নেল ওসমানীর কাছে দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁদের করনীয় সম্পর্কে জানতে চান। কর্নেল ওসমানী তাঁদের বললেন চিন্তা কোরোনা, আমরা অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ট্যাঙ্ক প্রতিহত করব। ... ... ... তাঁর এই কথা শুনে বাঙ্গালি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিকেরা হতাশ হন। পাকিস্তানিরা যেখানে ব্যাপক সামরিক শক্তি গড়ে তুলেছে সেখানে এ ধরণের কথা তাঁদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। [ পৃষ্ঠা – ৩৭/৩৮ ]
এখানে উল্লেখ্য, ওসমানী কিন্তু তখন ৭০ এর নির্বাচনে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি। অথচ সে অবস্থা চেপে গিয়ে লেখক কর্তৃক তাঁকে কর্নেল হিসেবে উপস্থাপন ভূল ধারনার জন্ম দেয়। কর্নেল ওসমানী কিন্তু এখানে সামরিক নেতা নন, রাজনৈতিক নেতা- যে ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে।
এই ঘটনার দুই দিন আগে অর্থাৎ, ২০ মার্চ নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। তাঁদের একজন বঙ্গবন্ধুকে বলেনঃ ‘হে বঙ্গবন্ধু, বাংলার স্বাধীনতা কিভাবে আদায় করতে হয় তা আমরা জানি। শুধু আপনি আমাদের পাশে থাকুন। আমাদের নেতৃত্ব দিন।’ এই সংবাদগুলো সে সময় পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছিল, তবু রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে কোনও সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। [ পৃষ্ঠা - ৩৮ ]
এইখানেও তিনি নিজে অনুপস্থিত ও জড়িত না থাকা সত্বেও অন্যের ভাষ্য জোড়া দিয়েছেন। অথচ, আগরতলা মামলা সংক্রান্ত পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে হোমওয়ার্ক এড়িয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার সম্পর্কে তিনি জানাচ্ছেনঃ
বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হবার খবর আমি কয়েকদিন পর পত্রিকা থেকে জানতে পারি। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতার গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদটি পড়ে প্রথমত আমার খুব দুঃখ হয়েছিল। দ্বিতীয়ত তাঁর গ্রেফতারের সংবাদটি জানতে পেরে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় যে বঙ্গবন্ধু কেন এই রকমের ভুল করলেন যা তিনি সহজেই এড়িয়ে যেতে পারতেন? পরবর্তী সময়ে এই কথা টি আমাকে খুবই পীড়া দিত যে এই ভূল না হলে মুক্তিযুদ্ধে হয়ত আমরা আরও ভাল করতে পারতাম। হয়তো অনেক মানুষকে জীবন দিতে হত না। বা সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হতনা। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন অথচ গ্রেপ্তারের আগে কোনও আদেশ, নির্দেশ বা ঊপদেশ দেননি, এবং পরিস্কারভাবে আমাদের ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে কিছু বলেননি। [ পৃষ্ঠা - ৪২ ]
এবং,
স্বভাবতই কেউ কেউ মনে করতেন যে তাদের ডেকে বঙ্গবন্ধুর বলা উচিৎ ছিল, ‘আমাকে (বঙ্গবন্ধুকে) যদি গ্রেপ্তার করা হয় তবে তোমাদের আন্দোলন এগিয়ে নেয়া এবং দেশকে স্বাধীন করার দায়িত্ব নিতে হবে। অতএব নিজ নিজ উদ্যোগে তোমরা গোপন স্থানে চলে যাও এবং পড়ে সুযোগ বুঝে তোমরা একত্র হয়ে আমার রেখে যাওয়া কাজগুলো শেষ করবে’। আমার জানামতে সেরকম কোনও নির্দেশ, কিংবা আদেশ কিংবা পরামর্শ তিনি কাউকে দেননি। ... ... ... ওই রাতে বঙ্গবন্ধু সবাইকে আত্মগোপন করার কথা বলেন, অথচ তিনি কোথায় যাবেন, সেকথা কাউকে বলেননি। [ পৃষ্ঠা - ৪৩ ]
এবং,
মার্চের শুরুতে পুর্ব পাকিস্তানে কমসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য উপস্থিত ছিল। বিপরীতে এখানে ছিল কয়েক ব্যাটালিয়ন বাঙালি সৈন্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ যাদের সংখ্যা পাকিস্তানিদের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। এ ছাড়া বিপুলসঙ্খ্যক অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিক অসহযোগ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল। এই সময়ে তিনি যদি বাঙালি সেনা, ইপিয়ার আর পুলিশকে কোনও নির্দেশ দিতেন, তাহলে আমার বিশ্বাস, সাধারণ জনগণের সহযোগিতা ও সমর্থনে অল্প রক্তপাতেই আমরা যুদ্ধ জয় করতে পারতাম। [ পৃষ্ঠা - ৪৪ ]
এবং,
২৫ মার্চ রাতে হাজার হাজার মানুষ বেঁচে যেত যদি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা ঠিক সময়ে যুদ্ধ শুরু করতে পারতাম। বারংবার মনে প্রশ্ন জাগে বঙ্গবন্ধু কেন ঐ রাতে কাউকে কিছু বলে গেলেন না? আবার ভাবি, উনি কাদের বলে যাবেন? হয় তাজউদ্দীন সাহেব, না হয় নজরুল সাহেব। তিনি হয়তো বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদেরও বলে যেতে পারতেন। [ পৃষ্ঠা - ৪৪ ]
এবং,
চট্টগ্রামে অবস্থিত ব্রিগ্রেডিয়ার এম আর মজুমদারের নেতৃত্বে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা একটি সামরিক পরিকল্পনা করেছিলেন। ... ... ... সেনা কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে চলে এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন। এ সময় চট্টগ্রামসহ সারা পূর্ব পাকিস্তানেই বাঙালি সেনাদের সংখ্যা অনেক বেশী ছিল। ফলে যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। [ পৃষ্ঠা - ৪৫ ]
এবং,
যুদ্ধের আগেই তাঁদের বলা উচিৎ ছিল যে আমাদের লক্ষ্য কি এবং এই লক্ষ্য পূরণে কী কী প্রস্তুতি নিতে হবে। এটা হলে আমরা একটি সফল মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারতাম। এ ছাড়া সংগ্রামে সহযোগিতার জন্য ভারত বা অন্য সঙ্গে কী আলোচনা করতে হবে এবং তাঁদের কাছ থেকে কী ধরণের সাহায্যের অনুরোধ করতে হবে তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকা উচিৎ ছিল। [ পৃষ্ঠা - ৪৬ ]
এবং,
আক্রান্ত হওয়ার পর আমরা দ্রুত পাকিস্তানিদের আক্রমন প্রতিহত করতে পারিনি। পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে আমরা তাঁদের যে পরিমান ক্ষতি করতে পারতাম সেটা করতে পারিনি। তাই পরবর্তী সময়ে অর্থাত পাকিস্তানিদের আক্রমনের পর দীর্ঘদীন আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিধ্বস্ত ও বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে একত্র হওয়ার জন্য এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রপ্রাপ্তির আশায়। এরপর আমরা যুদ্ধ শুরু করি। আমাদের যদি আগে থেকেই নির্দেশ দেয়া থাকত তাহলে আমরা অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে পারতাম এবং অনেক গুছিয়ে আক্রমন প্রতিহত করতে পারতাম বা নুন্যতম ক্ষতি স্বীকার করতে হত। [ পৃষ্ঠা - ৪৬ ]
ভাগ্যিস, (চক্ষুলজ্জার খাতিরে?) লেখক এটুকুও দাবী করে বসেননি যে ইয়াহিয়াখান ঠিক কবে কয়টার সময় হামলা চালাবে তা আগেভাগেই মাইকিং করে জানিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল। এই লেখা পড়ে কেন জানি মনে হচ্ছে ৬৫ সালের একটি আন্তঃরাষ্ট্র “সামরিক যুদ্ধে” সাফল্যের সঙ্গে অংশ নেয়া পাকিস্তানি বিমান কর্মকর্তা আব্দুল করিম খন্দকারের কাছে ‘প্রচলিত ধারার সামরিক যুদ্ধ’ আর ‘অপ্রচলিত ধারার মুক্তিযুদ্ধ’ এই দুয়ের মাঝে পার্থক্য পরিস্কার না। তিনি ঠিক কেমন আদেশ চাচ্ছিলেন সেটিও ভালভাবে পরিস্কার করেননি। তিনি কি অফিসিয়াল প্যাডে “ডিয়ার খন্দকার, প্লিজ ড্রপ সাম এটম বুমা অন ক্যান্টনমেন্ট” টাইপের কিছু চাচ্ছিলেন? নাহলে সবাই যখন যুদ্ধে নেমে পড়েছে তিনি তখনো একটা ‘আদেশ-নির্দেশ’ না পাবার দুঃখে হা-হুতাশ করছেন কেন?
চট্টগ্রাম থেকে ব্রিগ্রেডিয়ার মজুমদার পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সব অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিকের নাম-ঠিকানা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ও প্রস্তুতি গ্রহনের জন্য নির্দেশ দিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকেই পৌঁছে দিয়েছিলেন। মার্চ মাসে আমিসহ বেশ কিছু বাঙালি সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিলাম। এছাড়াও আরও কিছু বাঙালি কর্মকর্তা এ সময় ছুটিতে দেশে ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের উচিৎ ছিল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। যদি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে সামান্য যোগাযোগও করা হত তাহলে আমরা সঠিকভাবে প্রস্তুত থাকতাম। ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটি না নেয়ার কারণে ২৫ মার্চ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয় যা পূর্ব-পরিকল্পনা থাকলে সহজে এড়ানো যেত। [ পৃষ্ঠা - ৪৭ ]
এই ব্যাপারে আমি যদি ৩৩ পৃষ্ঠা থেকে খোদ খন্দকার সাহেবকেই উদ্ধৃত করে বলিঃ “সর্বোপরি, সব বাঙালি অফিসার যে তাঁদের কথা শুনবেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করবেন, তারও কোনও নিশ্চয়তা ছিল না।” তিনি মানতে রাজি আছন তো?
২৫ মার্চে ঢাকাসহ সারাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমনের খবর সবার কাছে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল টেলিফোনে হোক বা অন্য যেকোনো উপায়েই হোক সাড়া দেশেই খবরটি মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি সেনা, পুলিশ, ইপিআর নিজেদের প্রাণ বাচাতে নিজেরাই যুদ্ধ শুরু করে। [ পৃষ্ঠা - ৪৭ ]
পরবর্তী অধ্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণ কোনভাবেই লেখকের মনঃপুত হয় নি। অথচ, এখানে তিনি দাবী করছেন “টেলিফোনে হোক বা অন্য যেকোনো উপায়েই হোক” খবর পৌঁছানো সম্ভব ছিল। এই স্পষ্ট স্ববিরোধিতা কার স্বার্থে, খন্দকার সাহেব?
২৫ মার্চে পাকিস্তানিদের আক্রমণ এবং এর ফলে বাঙালিদের প্রতিরোধযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথমত, এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল কোনও রাজনৈতিক নির্দেশ ছাড়াই। যদি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যুদ্ধ হতো তবে এই যুদ্ধের ফলাফল ভিন্ন হত। দ্বিতীয়ত, বাঙ্গালীদের আক্রমনের প্রথম দিকটি ছিল নিজেদের রক্ষার উদ্দেশ্যে। [ পৃষ্ঠা - ৪৮ ]
খন্দকার সাহেব কি আবারও ‘সিলেবাসে’ পড়ে আসা যুদ্ধবিদ্যার সাথে এই সময়কে গুলিয়ে ফেলছেন? ভিন্ন ফলাফলটি কি এবং তা কিভাবে অর্জিত হত তা কিন্তু তিনি পরিস্কার করেননি।
সত্য এই যে আমরা কোনও যুদ্ধের নির্দেশ পাইনি। নির্দেশটা কেন আসেনি সেজন্য ঐতিহাসিক, গবেষক, লেখক প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন মতামত দেবেন। তবে আমি মনে করি রাজনৈতিক নেতারা যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেননা। তাই তাঁদের কাছ থেকে কোনও নির্দেশনাও আসেনি। তারা বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তাদের সাথে কোনও যোগাযোগ করেননি। এমনকি বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের পাঠানো সামরিক কর্মকর্তাদের পাঠানো সামরিক পরিকল্পনাগুলোকেও কোনও আমলে আনেননি। [ পৃষ্ঠা - ৪৮ ]
আবারও, খন্দকার সাহেব “বহুবচনের” ধোঁয়াশা ব্যাবহার করছেন কেন?
অসহযোগ আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অগ্রনী ভূমিকা নেয়। তাই পাকিস্তানী বাহিনী প্রথম চোটেই তা দখলে নেয় এবং বহু ছাত্র ও শিক্ষককে হত্যা করে। এরপর তারা আক্রমন চালায় পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পে ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। পুলিশ ও ইপিআরেরা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও তা অল্প সময়েই ভেঙ্গে পড়ে। অনেক জায়গায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে জনগণ এবং বাঙালি সেনারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে। তবে আমি আগেই উল্লেখ করেছি, সমন্বয় ও নেতৃত্বের অভাবে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া আধুনিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরণের প্রতিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। [ পৃষ্ঠা - ৪৯ ]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত থাকা এবং ছাত্রনেতাদের সাথে জাতীয় নেতৃবৃন্দের নিয়মিত যোগাযোগ থাকার বিষয়টি আবারও কি তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলেন? সারা দেশে যখন ইতোমধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে খন্দকার বিনা বাধায় ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও জানাচ্ছেনঃ
২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ভাবলাম এয়ারফোর্স অফিসার্স মেসে গিয়ে দেখি মেসের কি অবস্থা। মেসে গিয়ে দেখলাম কয়েকজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন। ... ... ... একটু পেছনেই ছিল নাখালপাড়া গ্রাম। নাখালপাড়া গ্রামটি ছিল গরিব রিকশাওয়ালা ও খেটে খাওয়া মানুষের বাসস্থান। পাকিস্তানের ধারণা ছিল এই গরিব মানুষগুলোই আসল শত্রু। কারণ, এরাই সব আন্দোলনের সম্মুখে থাকে। অগ্নিবর্ষক অস্ত্র দিয়ে এরা ঐ সব বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিল। ... ... ... আমার পাশে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কয়েকজন অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের একজন আমার সামনেই বলে উঠলেন ‘দিস ইজ দ্য ওয়ে টু ডিল উইথ দ্য বাস্টার্ডস’। এই কথাটা আমি জীবনে ভুলব না। নিজ চোখের সামনে এই ঘটনা দেখে আমি স্থির করলাম এদের সঙ্গে আমি আর এক মুহূর্তও থাকব না। [ পৃষ্ঠা - ৫১/৫২ ]
খন্দকার সাহেব অবশ্য কথা রাখেননি। আরও প্রায় ২ মাস তিনি তাদের সাথেই ছিলেন। কিন্তু, প্রশ্নটা হল এই সহজ কথাটা বুঝতে তাঁর এত দেরি হল কেন? তিনি কি তখনো পশ্চিম পাকিস্তানে কাটানো ২০ টি বছরের সুখস্মৃতিতে বিভোর ছিলেন? কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র নিয়েও লেখক হোমওয়ার্ক করেননি।
২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রূপ নেয়। এখান থেকে প্রথমে স্থানীয় নেতারা ও পরে মেজর জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম, পরে লে. জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। আমি মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি ও চট্টগ্রামে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা জানতে পারি। এই ভেবে উতফুল্ল হই যে আমরা আক্রান্ত হয়ে চুপ করা বসে নেই, আমরা আক্রমণও শুরু করেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। [ পৃষ্ঠা - ৫২ ]
তিনি কবে শুনেছিলেন তার উল্লেখ করেননি। কিন্তু, তাঁর ভাষ্যমতে “আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে” (যদিও আরেক স্থানে তিনি উল্টো কথা বলেছেন) এটি সত্য হলে ২৭ মার্চ তিনি অফিসার্স মেসে কি করছিলেন? আর প্রথম বাক্যটি দিয়ে তিনি কি বোঝাতে চাইলেন? বেতারকেন্দ্র টুপ করে আকাশ থেকে ঝরে পড়ল? লেখক যখন স্মৃতির ওপর ভরসা না করে হোম ওয়ার্ক করেছেনই, তখন বেলাল মোহাম্মদের বইটা এড়িয়ে গেলেন কেন?
মেজর আনোয়ার হোসেন রচিত “হেল কমান্ডো” (সংস্করণ অজ্ঞাত, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৬, সেবা প্রকাশনী) জানাচ্ছেঃ
প্রথম পরিচয়ের কথা আজও মনে পড়ে আনোয়ারের। ‘তুমি কি বাঙালি কমান্ডো?’ তাহেরের স্মার্ট কণ্ঠস্বর শুনেই আনোয়ার বুঝেছিল ইনি সাংঘাতিক মানুষ। ও তাড়াতাড়ি জাবাব দিয়েছিল ‘ইয়েস স্যার’। কয়েকটা কথার পরেই মেজর তাহের দৃঢ় কণ্ঠে বলেন ‘কমান্ডোতে যোগ দিয়েছ দেখে আমি বেহ খুশি হয়েছি। কিন্তু মনে রেখো দেশ স্বাধীন করতে হবে।’ বাংলায় কথা হচ্ছিল। আনোয়ার তো অবাক! মানুষটা বলে কি? ‘স্যার, পাকিস্তান তো একটা স্বাধীন দেশ। তবে কোন দেশ আমাদের স্বাধীন করতে হবে?’ সঙ্গে সঙ্গে মেজর তাহেরের প্রচন্ড ধমক, ‘গোল্লায় যাক পাকিস্তান। মনে রেখো তুমি একজন বাঙালি। এখন বুঝতে পেরেছ, কোন দেশ স্বাধীন করতে হবে?’ ব্যাপারটা ১৯৬৭ সালের। [ পৃষ্ঠা - ১৬১/১৬২ ]
যদিও ৭৫ সালে তাহেরের ভূমিকা অন্যরকম ছিল, তাতে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান তাতে বিন্দুমাত্র ম্লান হয় না। কথা হচ্ছে, ৪ বছর আগেই পাকিস্তানের ভূখণ্ডে তাহের যেটি বুঝতে পেরেছিলেন ২০ বছরেও খন্দকার সে কথা বুঝতে পারেননি কেন? কেন তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে নাখালপাড়া বস্তি জ্বালিয়ে দেয়া পর্যন্ত? তাহলে মুজতবা আলী’র ভাষায় কি তাঁকে বলতে হবেঃ ‘তবে রে! বুঝতে পারো নি, না?’
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন রচিত ‘সেই সব পাকিস্তানী’ (প্রথম সংস্করণের পুনর্মূদ্রণ, ২০০১, ইউপিএল) বইয়ে উল্লেখিত ১৯৯৭ সালে পাকিস্তানস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে আয়োজিত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের বর্ণনা থেকে জানা যায়ঃ
এরপর অধ্যাপক আহমদ হাসান দানীকে আহ্বান জানানো হল কিছু বলার জন্য। অধাপক দানী আমাদের পরিচিত মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদীন অধ্যাপনা করেছেন। লিখেছে ঢাকার ইতিহাস, গড়ে তুলেছে জাতীয় জাদুঘর ও এশিয়াটিক সোসাইটি। অধ্যাপক দানী অমায়িক মানুষ, আমি তাঁকে দেখছি এক দশক ধরে। কোনদিন তাঁকে ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হতে দেখিনি। কিন্তু আজ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। অধ্যাপক দানী গম্ভীরভাবে বক্তৃতা শুরু করলেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, ঢাকা শহর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণ করলেন। বললেন বাঙ্গালিরা সবসময় তাঁকে নিজের লোক মনে করেছে। তিনি সেখানে থেকেছেন, তাঁদের ভাষা শিখেছেন এবং যত আন্দোলন হয়েছে তাও দেখেছেন। কারণ তাঁর বাসা ছিল নিমতলী কুঠিতে। আর সব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শহীদ মিনার। ... ... ... তারপর দেখা গেল তাঁর গলার স্বরে ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছে। বললেনঃ ‘বাঙ্গালিদের কি পাকিস্তানীরে মানুষ মনে করেছে? আমার খেয়াল আছে রেভিনিউ সেক্রেটারি ইকরাম একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাঙ্গালি মেয়েরা টিপ দেয় কেন? বললাম এটি একটি প্রাগৈতিহাসিক ঐতিহ্য। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ প্রথা চালু আছে। তারপর ইকরামকে বললাম, তোমরা সালোয়ার কামিজ পর কেন? এই সালোয়ার কামিজ পরাটাকেও তো এখানকার লোকেরা ঘৃণা করতে পারে।’... ... ... এ অধ্যাপক দানী আমাদের অচেনা। কি কারণে যেন আজ তাঁর সব ক্ষোভ ফেটে পড়ছে। বললেনঃ ‘পশ্চিম পাকিস্তানের মানুশজন এগুলো বোঝেনি। ঢাকায় থাকার সময় ভাবতাম, বাঙ্গালিরা কিভাবে এসব পাকিস্তানী অফিসারের খারাপ ব্যাবহার সহ্য করে? আমি ঢাকায় থাকতাম, বাঙালিরা আমার বন্ধু। এজন্য আমার সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করতেও পাকিস্তানী অফিসারেরা দ্বিধা করেনি। এ ধরণের ব্যাবহার অসহ্য হয়ে উঠলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিই। আমাকে ভিসি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কেন চলে যাচ্ছেন? আমি বলেছিলাম ইস্ট পাকিস্তান পাকিস্তানের সাথে থাকবে না। বাঙালিরা নায্য বিচার চেয়েছিল। তাঁদের তা দেয়া হয়নি এবং এ জন্য দায়ী আমলারা যারা অনেকে এখানে উপস্থিত আছেন।’ [ পৃষ্ঠা - ১৬৭ ]
পাকিস্তানী একজন অধ্যাপকও যেটা অনেক আগেই বুঝে গেলেন, সেটা বাঙালি খন্দকার সাহেবকে বোঝাতে নাখালপাড়া বস্তি উজাড় করতে হল? সে বই থেকেই পাকিস্তানের প্রথম ব্যাচের সিএসপি এবং ১৯৭১ সালের নীতিনির্ধারকদের অন্যতম রোয়েদাদ খানের জবানীতে আরও জানা যাচ্ছেঃ
আমাকে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে তথ্যসচিব করা হয়। কাজকর্ম বুঝে নিতে না নিতেই আমাকে বলা হয় ঢাকা যেতে। প্রেসিডেন্ট তখন ঢাকায়। জেনারেল টিক্কা খানের অফিসে ২৩ মার্চ প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করলাম। এমনি সাধারণ কথাবার্তা বলার পর ইয়াহিয়া খান বললেন সবধরনের অবস্থার জন্য প্রস্তুতি নিতে। ... ... ... পরের দীন আমার বন্ধু সানাউল হককে নিয়ে ফোন করে বললাম ইন্টারকন্টিনেন্টালে আসতে। আমাদের মধ্যে কোনও বৈরী ভাব ছিল না। কিন্তু আমার মনে হল ২৩ তারিখেই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। সেদিন ছিল পাকিস্তান দিবস, কিন্তু ঢাকায় কোনও পাকিস্তানী পতাকা ওড়েনি। [ পৃষ্ঠা - ১৭৬ ]
একই বইতে প্রৌঢ়ত্বে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং যৌবনে (১৯৬৪ সালে) কিছুদিন পাকিস্তানী আমলাতন্ত্রের অংশ হিসাবে সিলেটের এডিসি’র দায়িত্ব পালনকারী ফারুক লেঘারির জবানীতে জানা যাচ্ছেঃ
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যা ঘটেছে তা সত্যিই দূর্ভাগ্যজনক। কেননা পূর্ব পাকিস্তান ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ। আমার মনে হয় ন্যায় বিচার হলে বা ন্যায়বিচার হচ্ছে বা হবে এমন প্রত্যয় থাকলে স্বচ্ছতা থাকলে দেশ অভিন্ন থাকলে দেশ অভিন্ন থাকত। পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আলাদা হয়ে যাবার বেশ আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ডিনামিক্স সচল হয়ে ঊঠেছিল। [ পৃষ্ঠা - ১৬৩ ]
এই ডিনামিক্স পূর্ব-ভূখন্ডে অনুপস্থিতিহেতু খন্দকার সাহেবের অজ্ঞাত থাকতেই পারে। কিন্তু, এই ঘটনাপরম্পরা নিরাসক্ত-নিরাবেগ ভাবে ঠেলে সরিয়ে, তিনি যেভাবে হাইপার ডাইভ দিয়ে ১৯৫১ থেকে একলাফে ১৯৭১ সালে চলে এসেছেন তা অত্যন্ত তাৎপর্য্যপূর্ণ।
সিদ্দিক সালাম অনূদিত গোলাম ওয়াহিদ চৌধুরী ওরফে জি. ডব্লিউ. চৌধুরী (ইয়াহিয়ার মন্ত্রী এবং জাবি’র অধ্যাপক কাম যুদ্ধংদেহী টকমারানী দিলারা চৌধুরীর স্বামী) রচিত ‘অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলি’ (প্রথম সংস্করণ, ১৯৯১, হক কথা প্রকাশনী) থেকে পাওয়া যায়ঃ
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ঢাকায় পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। কোনও পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলিত করতে দেয়া হয়নি, এমনকি ব্যাক্তিগত বাসভবন ছাড়া সরকারি দালানকোঠাতেও না। দুটি নিঃসঙ্গ পতাকা উত্তোলিত হয় একটি প্রেসিডেন্ট ভবনে যেখানে ইয়াহিয়া অবস্থান করছিলেন, এবং অপরটি প্রাদেশিক গভর্ণর হাউসে। অবশ্য ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকাতেও পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলিত হয়। কেবলমাত্র পাকিস্তানি পতাকা উড়ানো বন্ধই রাখা হয়নি, বরং সর্বত্র একে পোড়ানো হয় এবং অসম্মান করা হয় এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। মুজিব তাঁর বাসায় বাঙালি প্যারামিলিটারি ইউনিটগুলোর কুচকাওয়াজের স্যালুট গ্রহন করেন। বাংলাদেশী পতাকা উত্তোলিত হয় জাঁকজমকের সাথে যেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ইতোমধ্যে কায়েম হয়ে গেছে। [ পৃষ্ঠা – ১৬২ ]
এবং,
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তারিখেই মুজিব পরিশেষে তাঁর নিজের খসড়া শাসনতন্ত্র সরবরাহ করেন। তিনি এ কাজ করেন ইয়াহিয়ার খসড়া শাসনতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে যাতে দেশ ভাঙ্গা বাদে ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের অনুমোদন করা হয়েছিল। মুজিবের নতুন প্রস্তাব প্রেসিডেন্ট ভবনের এক বৈঠকে বেলা ১১-৪৫ মিনিটে ড. কামাল হোসেন কর্তৃক ইয়াহিয়া সহযোগীদের নিকট পেশ করা হয়। এ তারিখ প্রকৃত অর্থে এক অখণ্ড পাকিস্তানের পরিসমাপ্তিকেই চিহ্নিত করে। [ পৃষ্ঠা – ১৬২/৩ ]
এবং,
অন্তর্বতীকালীন সরকারের জন্য মুজিবী পরিকল্পনা বিছিন্নতা পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবী করে- যা সব সময়ই ছয় দফার মাঝে লুক্কায়িত ছিল। [ পৃষ্ঠা – ১৬৬ ]
আফসোস, এ সময় খন্দকার সাহেব ক্যান্টনমেন্টে বিরাজমান ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতি’ উপভোগ করছিলেন। চিন্তার বিষয় হল, যে ছয় দফা আন্দোলন পাকিস্তানি জেনারেল/আমলাদেরও ঘামিয়ে ছেড়েছে সেই অধ্যায়টি খন্দকার সাহেবের হোমওয়ার্ক থেকে সুচিন্তিত ভাবে বাদ পড়ল কেন? আগেই বলেছি বইটি নিছক স্মৃতিকথা নয়। তা হলে এ কথা না থাকতেই পারত, কিন্তু তিনি যেহেতু হোমওয়ার্ক করে তাঁর অনুপস্থিতির অংশগুলো সম্পর্কেও উপর্যুপরি মতামত দিয়েছেন, সেখানে ঘটনাবহুল সত্তর দশকের যাবতীয় ঘটনাবলীর প্রতি তাঁর সুস্পষ্ট নিরাসক্তি পাঠকমনে সুতীব্র সন্দেহের উদ্ভব ঘটায় বৈকি।
‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ শীর্ষক মামলাটি যা ‘আগরতলা মামলা’ নামে সমধিক পরিচিত তার বিবরণ পাওয়া যায় কর্নেল শওকত আলী (মামলাটির ২৬ নং অভিযুক্ত ও পরবর্তীতে সংসদের ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত) রচিত “Armed Quest for Independence” (২০০১, আগামী) বইটিতে। এই বইটির বাংলা সংস্করণ ‘সত্য মামলা আগরতলা’ (প্রথম সংস্করণ/দ্বিতীয় মূদ্রণ, ২০১২, প্রথমা) থেকে বইটির নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়ঃ
আজও মামলাটির প্রসঙ্গ এলে প্রায় সবাই ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বলে থাকেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা যারা মামলাটিতে অভিযুক্ত ছিলাম, ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি তাঁদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ আমরা ষড়যন্ত্রকারী ছিলাম না। দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল একটি নির্দিষ্ট রাতে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব কটি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নেব, তাঁদের বন্দী করব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করব। [ ভূমিকা ]
এবং,
বিশেষ ট্রাইবুনালে মামলার বিচারকার্য শুরু হবার পর ট্রাইব্যুনাল কক্ষেই একদিন একান্তে বঙ্গবন্ধুকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম- তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য কি না? এর উত্তরে বঙ্গবন্ধু আমাকে কানে কানে বলেছিলেন- ‘হ্যাঁ’। বঙ্গবন্ধুর উত্তর শুনে আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছিলাম এবং গর্বে আমার বুক ভরে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তাকালেন এবং আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি জানি, তোমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগও সত্য। আমিও তোমার জন্য গর্বিত’। [ পৃষ্ঠা - ১৩৭ ]
মামলাটির বিবরণী বইয়ের পরিশিষ্টে যুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগনামার প্রথম অভিযোগটি হলঃ
০১। গোপনসূত্রে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে ভারত কর্তৃক সরবরাহকৃত অস্ত্র, গোলাবারুদ ও তহবিলের সহায়তায় সঙ্ঘটিতব্য সশস্ত্র বিদ্রোহের দ্বারা পাকিস্তানে একটি অংশকে বিচ্ছিন্ন করা এবং সেখানে ভারত স্বীকৃত স্বাধীন সরকার গঠনের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে কিছু ব্যাক্তিকে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস (ডিপিআর) এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরতদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অন্যান্য আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করা হয়। [ পৃষ্ঠা - ১৭৬ ]
তাঁদের কর্মপন্থা সম্পর্কে লেখক আরও জানাচ্ছেনঃ
ইতিপূর্বে আমি যে সকল বাঙালি অফিসার এবং অন্যান্য পদের বাঙালি সৈনিকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলাম তা মোয়াজ্জেমকে জানানো প্রয়োজন ছিলনা বলে সে সম্পর্কে কিছুই বলিনি। তাঁদের অর্থাৎ মোয়াজ্জেমদের গ্রুপ অন্যান্য কার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এবং যোগাযোগের ফলাফল কি আমিও মোয়াজ্জেমকে তা জিজ্ঞাসা করিনি। কারণ ঐ সময় তা জানা আমার কোনও প্রয়োজন ছিলনা। আমরা কোনও রকম আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ছাড়াই ‘যার যা জানা প্রয়োজন’ নীতিতে কাজ করতাম। [ পৃষ্ঠা - ৯৬ ]
এবং,
সম্ভবত সেটা ছিল ১৯৬৬ সালের জুন মাস। আনুষ্ঠানিক ও বিশদ আলোচনা ছাড়াই আমরা একমত হয়েছিলাম যে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গঠিত ‘বিপ্লবী সংস্থার সদস্য’। প্রয়োজন ব্যাতীত কিছু জানার চেষ্টা আমরা করব না। আবার জা জানা দরকার তা জানার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব। প্রথম দিনের আলোচনায় আমরা শুধু মূল পরিকল্পনার ব্যাপারে একমত হয়েছিলাম। ... ... ... সামনের দিকে এগিয়ে যাবার ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছিলাম। আর এই এগিয়ে যাবার ভিত্তি হবে যার যার দায়িত্ব পালনে তাঁর যা জানা দরকার তার বেশী সে জানতে চাইবে না বা তাঁকে জানানো হবে না। [ পৃষ্ঠা - ৯৭ ]
ইতিহাসের মনযোগী ছাত্র হয়ে থাকলে খন্দকার সাহেব কর্ণেল শওকত সহ আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের কাছে টিমওয়ার্ক সম্পর্কে শিক্ষা নিতে পারেন। তৎকালীন বিভিন্ন স্তরের মানুষের আন্তঃসম্পর্ক সম্বন্ধে কর্নেল শওকত আরও জানাচ্ছেনঃ
মোয়াজ্জেম ও তাঁর বিপ্লবী গ্রুপ এবং খুরশীদ নিজে ১৯৬১ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা চিন্তা করছিলেন ও নৌবাহিনীতে বিপ্লবী সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে এভাবেই বাঙালিরা যে যেখানে ছিল না কেন, যে পেশায়ই বা যে পদেই ছিল না কেন, ধীরে ধীরে স্বাধীনতার চেতনায় একাত্ম হচ্ছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে একে অপরের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে রাজনীতিবিদ, বেসামরিক কর্মকর্তা কর্মচারী, ব্যাবসায়ী, সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিরা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রশ্নে তাঁদের চিন্তা সমন্বিত করতে শুরু করেন। [ পৃষ্ঠা - ৯৮ ]
দাগ দেয়া অংশটুকু কর্নেল শওকত এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের দৃষ্টিসীমার সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করে। যাহোক, ১৯৬০ সালে স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিমত পোষণকারী একজন সহকর্মীর ১৯৬৬ সালে একই প্রসঙ্গে সহমত পোষণ প্রসঙ্গে কর্নেল শওকত জানাচ্ছেনঃ
সে অবশ্য উল্লেখ করেছিল যে সময় এখনো যথেষ্ট পরিপক্ক নয় এবং আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। হয়তো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। মালেকের যুক্তি ছিল, বাঙালি সৈনিকেরা যদিও পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ক্ষিপ্ত এবং ছয় দফার প্রতি প্রায় প্রকাশ্যেই সমর্থন ব্যাক্ত করছে, কিন্তু স্বাধীনতার ধারণা এখনো তাঁদের মাথায় সেভাবে ঢোকেনি। তা ছাড়া সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের নির্দেশ অমান্য করে স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালি অফিসারদের নেতৃত্বে সশস্ত্রভাবে সংগঠিত হবার মত পরিস্থিতি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ানগুলোতে তখনো বিদ্যমান ছিল না। [ পৃষ্ঠা - ১০০ ]
তখনকার নজরদারি সম্পর্কে লেখক জানানঃ
নুরুজ্জামান খুব বুদ্ধিমান অফিসার ছিলেন এবং চারিদিকের খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করতেন। তিনি হুদার মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছিলেন সম্ভবত আমাদের কর্মতৎপরতার ওপর পাকিস্তানী গোয়েন্দারা বিশেষ করে আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) নজর রাখা শুরু করেছে। আমাদের সবাইকে ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করতে নুরুজ্জামান হুদার মাধ্যমে আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। [ পৃষ্ঠা - ১০১ ]
[ এই অবস্থা ৭১ এর মার্চে কতটুকু বহাল ছিল বা বেড়েছিল তা সম্পর্কে খন্দকার সাহেব বিস্তারিত বলেননি, তিনি কেবলই উতলা হয়েছেন একটু অফিশিয়াল আদেশের জন্য। ]
কর্নেল শওকত আরও জানিয়েছেনঃ
তৃতীয় পাঞ্জাব অফিসার্স মেসে সামরিক হেফাজতে রাখা আমরা ১৩ জন প্রায়ই একসাথে বা আলাদাভাবে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলতাম। বঙ্গবন্ধু একদিন একান্ত আলাপে আমাকে বলেছিলেন, ‘এবার তো ধরা পড়ে গেলা। এরপর কি করবা?’ নিজের প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়ে বললেন, ‘এখান থেকে বের হয়ে আমি জনগণের ম্যান্ডেট নেয়ার জন্য একটা নির্বাচন করব। সেই নির্বাচনে আমরা বিপুলভাবে জয়লাভ করব। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের হাতে ক্ষমতা দেবে না। তখন একটা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। সেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থেকো।’ [ পৃষ্ঠা - ১৩২/১৩৩ ]
[ উল্লেখ্য, এসময় খন্দকার সাহেব পুর্বে আসেনও নি, পরে এ সম্পর্কে জানার চেষ্টাও করেননি। ]
মামলার কৌশলগত দিক সম্পর্কে কর্ণেল শওকত জানানঃ
অভিযুক্তদের মধ্যে কেউ কেউ, বিশেষ করে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক (অভিযুক্ত-১৭) নিজেকে নির্দোষ দাবী করার বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য যা করেছি তা সবারই বিশেষ করে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সঠিকভাবে জানা উচিৎ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজে এবং আমাদের আইনজীবীরা তাঁদের নিবৃত্ত করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই নিজেদেরকে ‘নির্দোষ’ দাবী করি। ... ... ... মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার প্রশ্নটি ছিল একটি রাজনৈতিক বিষয় এবং আগরতলা মামলার সামগ্রিক বিষয়গুলোকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা উচিৎ। ট্রাইবুনালে উত্থাপিত অভিযোগগুলো স্বীকার করলে হয়তো অভিযুক্তদের ব্যাক্তিগত শৌর্যের প্রমাণ পাওয়া যেত, কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্থ হত। সে ক্ষেত্রে মামলার বিচারকাজ প্রলম্বিত হত না। [ পৃষ্ঠা - ১৩৪ ]
আগেই বলেছি পূর্বোল্লেখিত জি. ডব্লিউ. চৌধুরীর বইটি পাকিস্তানী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। অনুবাদক/প্রকাশক জাতে বাঙ্গালি হলেও আনুগত্য বাংলাদেশের প্রতি নয় মোটেই। তাই মুক্তিযুদ্ধকে “ভারতীয় ষড়যন্ত্র” প্রমান করতে এই বইয়ের পরিশিষ্টে ১৯৮৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ‘মেঘনা’ পত্রিকায় প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের একটি সাক্ষাৎকারের চুম্বকঅংশ যোগ করা হয়েছে। এই আগ্রহোদ্দীপক সংযুক্তিটির চুম্বকতমঅংশ নিচে উদ্ধৃত করলামঃ
ছয় দফা কর্মসূচী ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মাজহারুল হক বাকি ও আমাকে ডাকেন। তিনি যাবার পর ছয় দফা আন্দোলন ব্যাখ্যা করলেন। তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম ছয় দফাই কি শেষ? তিনি বললেন, ‘না, সাঁকো দিলাম। ওপারে যাবার জন্য।’ তখন আমি বুঝলাম তিনি স্বাধীনতার কথা চিন্তা করছেন। এরপর আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম এই যে এত বড় সংগ্রামে কে আমাদের সাহায্য করবে? তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেনঃ ‘আমেরিকা তোদের বিরোধিতা করবে। চীন তোদের সমর্থনে আসবে না। ভারত তোদের বন্ধু। আর একটা পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তোদের সাহায্য করবে। ১৯৬৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে সম্ভবত আমাদের সাথে এই বৈঠক হয়। [ পৃষ্ঠা - ২১৭ ]
আচ্ছা, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্কোয়াড্রন লিডার আব্দুল করিম খন্দকার যেন কি করছিলেন?
[চলবে]
মন্তব্য
চলুক
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ব্যাপক ঠান্ডা মাথা না থাকলে এই পুস্তক পড়া খুবই কঠিন হবে। আমার মতো 'স্থিরচিত্তের' মানুষেরই হড়হড় করে বমি করতে ইচ্ছে করছে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
মনে করায়া দিলেন ক্যান???
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করেছিলো যে পাকি অফিসার, সেই জেড এ খান (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) এর বই "দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ" পড়লে জানা যায়, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের অনেক আগেই ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে পাকিস্তানীরা নিষ্ক্রিয় করে পশ্চিম পাকিস্তান পাঠিয়ে দিয়েছিলো। ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুল হোসেন খানকে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের কাছ থেকে পাকি-আক্রমণের প্রেক্ষিতে করণীয় কী হবে সে নির্দেশ চাওয়ার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। অর্থাৎ এদের যে বিশ্বাস করা যায় না, সেটা পাকিস্তানিরা বুঝে গিয়েছিলো।
ইবিআরসিতে প্রায় দুই হাজার সেনাকর্তা ও সৈনিক ও তাদের পরিবারের লোকজন নিহত হয়েছিলেন ২০ বালুচ রেজিমেন্টের আক্রমণে। এদেরও পাকিস্তানীরা বিশ্বাস করতে পারেনি।
কিন্তু গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে তারা শুধু বিশ্বাসই করেনি, এখানে ওখানে নির্বিঘ্নে ঘুরঘুর করতে দিয়েছে মে মাস পর্যন্ত। কারণটা কী? তিনি কি তাদের কাছে আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন, নাকি লুথা হিসেবে?
০০১। "দ্যা ওয়ে ইট ওয়াজ" পড়িনি। একটু বিস্তারিত শেয়ার করতে পারেন? (সংস্লিষ্ট অংশ এই পোস্টের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে)। ব্রিগ্রেডিয়ার মজুমদারের গ্রেপ্তার হবার তথ্য জানা ছিল না। সেটি হয়ে থাকলে খন্দকার সাহেবের লেখার বিশাল এক অংশের অসাড়ত্ব প্রমাণের জন্য এই একটি তথ্যই যথেষ্ট।
০০২। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর
০০৩। ---------------- ঐ ----------------
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে গ্রেপ্তারের বর্ণনা রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের "লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে" বইটিতেও রয়েছে।
জহির আলম খানের বইটার খানিকটা অনলাইনে প্রকাশিত।
"তাদের মতলব সম্পর্কে আাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কেন তারা বাঙালী ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে বদলিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে এনেছে, কেন তারা নির্বিচারে জেটিতে আমাদের বাঙালীদের হত্যা করছে, কেন 'সোয়াত' জাহাজ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নামাতেই হবে? শত্রু কোথায়? শত্রু কি আমরা নই?......" 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' - রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম।[img]DSCN1673 by Kabir Ahmed 26, on Flickr[/img]
অনেক হিমু ভাই এবং প্রৌঢ়'দা।
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পড়েছি। ভুলে গেছিলাম। বইটা বাসায় রেখে এসেছি তাই এতদিন রেফারেন্স দিতে পারছিলাম না। পরের পর্বে এ থেকেও টুকে দেব।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়ে না
- আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের পার্থক্য না জানা মানুষ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পান।
- রাজনীতিবিদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, রাজনৈতিক দলের ভূমিকা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানশূন্য মানুষ ভীনদেশে দেশের দূত হন, এমপি হন, মন্ত্রী হন।
- ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার নিয়মকানুন না জেনে লোকজন নানা আঙ্গিকে ইতিহাস রচনা করে যান।
- শার্ট-প্যান্টপরা স্যারেরা মুক্তিযুদ্ধে লুঙ্গি-গেঞ্জীপরা ছোটলোকদের ভূমিকাকে কেবল মিনিমাইজ করে যান।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অসাধারণ কাজ হচ্ছে এই বিশ্লেষণ। ৫ তারা অবশ্যই।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
হুমম...
চান-তারা কেটেকুটে পেলুম পাচঁটা তারা
[ এই কথাটা ভুলেও জোকার নায়েকের আশেকানে মুরীদানের কারও সামনে বলবেন না যেন...
তাহলে কালকেই বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব/সৌরজগৎ নিয়ে নতুন জোক পীস্টিভিতে চলে আসবে ]
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ব্যবচ্ছেদ চলুক। পড়ছি।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আপনি খন্দকারের যে কোটেশনগুলি দিয়েছেন, তার অনেকগুলির জবাব প্রফেসর সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ তার এই লেখায় দিয়েছেন মনে হয় - http://www.samakal.net/2014/09/22/87696 । আপনার লেখার কাজে আসলেও আসতে পারে।
****************************************
কলরবে রাজীব ভাই এই লিঙ্কটি শেয়ার করার পর এই লেখাটার কথা জানতে পেরেছি। আগে জানলে কাজ অনেক কমে যেত।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
জবর!
চলুক চলুক!!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন