এবারের বইমেলায় হারিয়ে যাবার উসকানি থেকে কোনভাবেই বের হতে পারলাম না। এক চক্কর দিলেই (মেলার চারপাশে না, স্টলের) দিকভ্রান্ত নাবিকের মত ‘হাল ভেঙে হারায়েছে দিশা’ টাইপের অবস্থা। এর মাঝেও টুকটাক কিছু কিনে ফেললাম। আগের বইমেলায় আগে বই দেখে যেতাম, শেষ হবার আগ দিয়ে চট করে কিনে নিতাম। এবার আর সে সুযোগ নেই। প্রথম দেখাতে কিনে না ফেললে একই স্টল দুবার খুঁজে পাওয়ার চাইতে গেছোদাদাকে খুঁজে পাওয়া সোজা। এবার কোথাও কোনও পরিচিত মুখের দেখা নেই। চারপাশে ফুল-পাখি-লতা-পাতার অবাধ বিচরণ। তাঁরা আগামী’র স্টলে এসে খোঁজেন আবুল মোক্সুদুল মূ’মেনীন। কিংবা প্রথমা’য় এসে খোঁজ করেন হুমায়ুন আজাদ। কে জানে, অন্যপ্রকাশে কেউ আবার অভিজিৎ রায়ের খোঁজ করেছে কিনা। অবসরে অবশ্য বন্যাপা’র বইটা এবং অভিদা’র বইগুলো দেখলাম, এখনও হারিয়ে যায় নি। সেবা প্রকাশনী আর রোদেলা’র স্টল অবশেষে খুঁজে পেয়েছি। রোদেলা’র নতুন বইগুলো ভাল লাগে নি। বিভিন্ন উসকানিবিহীন থ্রিলারের অনুবাদ দিয়ে ভরা, আগের সেই বহুমাত্রিকতা অনুপস্থিত। কারও কি রাশান ‘আনাড়ি’ সিরিজটার কথা মনে আছে? আমার সমসাময়িক অনেকেরই শৈশবের এই হারিয়ে যাওয়া সাথীকে আবার পেলাম কোনও এক স্টলে। পুরো রঙ্গিন ছাপা, ১০টার সেট একবারে কিনলে বিশেষ ছাড়। কেনা হয়নি অবশ্য, পয়সা ছিল না। নিষ্ঠুর দুনিয়া। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের স্টলে আগের দিন ইবনে হিশামের ‘সিরাত’ দেখে এসেছিলাম। আজকে গিয়ে দেখি, প্রথম খন্ড বাদে বাকিগুলো আছে। একেবারে হোজ্জার গল্প। দোতলা-তেতলা রেখে নিচতলা ভেঙ্গে ফেলা। আমার ব্যাক্তিগত সন্দেহ, এই বইটা সম্ভবত সেন্সর করা হয়েছে। কেননা মূল বইটা উসকানিমূলক হতে পারে। সেটা আর যাচাইয়ের সুযোগ পেলাম না, আধখানা বই কিনে কি হবে?
ফাল্গুনস্য প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তদসংলগ্ন এলাকা একটি অভিশাপ। আগে একদা সেখানেই বসবাস ছিল, তখন বুঝি নি। মেলা ভাঙ্গার সময় মানুষ যখন বিরস মুখে পা চালাত, আমরা তখন উজ্বল মুখে টুক করে নীড়ে ফিরতাম পাঁচ মিনিটেই। সে দিন হয়েছে বাসি। এখন নিজের চিরচেনা প্রাঙ্গনে বহিরাগতের মতন চুপেচাপে আসি। দিনশেষে বিরস মুখে পা চালাই এক টুকরো বাস ধরবার আসায়। ফাল্গুনস্য পয়লা দিনে অবশ্য আসতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছিল। শেষ বিকালে শাহবাগ প্রান্ত দিয়ে কোনমতে ঠেলেঠুলে চারুকলা পর্যন্ত এলাম। গানের তালেতালে নিজস্বী’র অশালীন আধিক্য দেখে লিচুতলার চেনা যায়গাটাও বিসদৃশ ঠেকল। কাউকে কোনও উসকানি না দিয়েই ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম উল্টোপথে। বইমেলা পর্যন্ত পৌঁছুনো প্রায় অসম্ভব। জনমতের (পড়ুন জনস্রোতের) বিপক্ষে যেতে হবে কিনা। জনমত জিনিসটাকে বরাবরই ডরাই। তাই স্বতঃস্ফুর্ত পশ্চাদপসরণই শ্রেয়। ফিরে এসে আজিজে ঢুঁ মারলাম। কি এক বিটকেলে টি-শার্ট উৎসব হচ্ছে। তা হোক, কিন্তু টি শার্টের সাথে তাল ঠুকে হিড়িম্বাকন্ঠী গানের আক্রমণটা সহ্য হোল না। শেষে, রাস্তার উল্টোদিকে পাঠক সমাবেশে হানা দিলাম। অভ্যার্থনা টেবিলের আপুটা উসকানি দিয়ে বললেন- ‘ঐ ভিড় ঠেলে কি হবে, এখানেই সব আছে’। কি আর করা, মুজতবা আলীর মুন্ডুপাত করতে করতে পকেটাস্ত্র বিসর্জন। ফেরার পথে নীলক্ষেত থেকে কিনলাম আরো কিছু। পরের দিন অবশ্য তাড়াতাড়িই গেছিলাম। ঐদিন আবারও বুঝলাম- ‘ভালবাসা হইলা শরমের ব্যাপার, তয় এইটারও দরকার আছে’। আরে নাহ, ভালবাসা করার সময় পাইনি। তবে আশেপাশের জনতা আবেগঘন ভালবাসা করতে থাকায় স্টলে ক্রেতার সংখ্যা ছিল লুপ্তপ্রায়। এমন উসকানিমূলক ফাঁকা মাঠ পেলে কি আর করা। ইতিহাসের আদি থেকে, ফেব্রুয়ারি মাসটা কখনোই আনন্দের ছিল না, উদযাপনের ছিল না। এখনকার ফেব্রুয়ারির রূপ দেখে বুকে ধাক্কা লাগে।
শুদ্ধস্বরে গিয়ে দেখি পুনর্মূদ্রিত ‘পার্থিব’ এসে গেছে। নাড়াচাড়া করতেই এক বিক্রেতা আমাকে উসকানিমূলক ক্রেতা ভেবে ফিসফিসিয়ে জানালেন ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ এসেছে আবার। হাসিমুখে তাকে ফেরালাম। ‘ভালবাসা কারে কয়’ দেখলাম তাকে, পুনর্মূদ্রণ অবশ্যই। কাসেম বিন আবু বাকার মার্কা নতুন প্রচ্ছদটা একেবারেই ভালো লাগেনি। তবু নেড়েচেড়ে দেখলাম। ভেতরে পুরো বইটা ‘Vrinda’ ফন্টে ছাপা, ভয়াবহ ধাক্কা খেলাম দেখে। ‘সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ’ আর ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ আসেনি এখনও। আর জাগৃতি’র অবস্থাও আগের মতই। দীপনদা’র ছবিওয়ালা চাবির রিং পেয়ে নিয়ে নিলাম। সেখানেই পাশ ফিরতে গিয়ে কার সাথে জানি ধাক্কা খেলাম, ভদ্রলোকই আগ বাড়িয়ে সরি বললেন। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি দীপনদা’র বাবা, ফজলুল হক স্যার। স্যারের বিনয়ে আমিই লজ্জা পেয়ে গেলাম। জাগৃতি’র নতুন বইগুলোর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, প্রচুর ভুলে ভরা। দীপনদা’র অনুপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে ভাল মতই।
১। দস্যুয়িত দুটো বই কেনার কাফফারা হিসেবে দুটো আসল বইও কিনে ফেললাম। পকেটের দফারফা।
২। উসকানি মূলক কিছু ইতিহাসের বই। কোণার দিকেরগুলো একটু বেশি উসকানি মূলক।
৩। উসকানি মূলক কিছু বিজ্ঞানের বই। জানেন তো, বিজ্ঞানমাত্রই উসকানি মূলক।
৪। জীবনী, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। উসকানির জন্য জীবনীকার দায়ী।
৫। ওপরের বাম কোণের বইটা তীব্র উসকানিমূলক। তাছাড়া নিচের সারিতে কিছু উসকানিমূলক ভ্রমণ কাহিনী।
মাঝের সারির বইগুলো মোটামুটি নির্বিষ, তবে মধ্যমণি ভদ্রলোকের নামটাই আবার উসকানিমূলক, হুঁশিয়ার!
মন্তব্য
বইমেলায় যাওয়া হয়নি এবার, একদিনই মাত্র যেতে হবে। খুলনায় বইমেলা হচ্ছে, সেখান থেকে মাত্র একটা বই কিনেছি খুঁজেপেতে- ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’... আপনি কত বই কিনেছেন! লেখা এবং বইগুলো সবই রীতিমতো উসকানিমূলক!
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
একবই বাদে 'বই' জিনিসটাই তো উসকানিমূলক
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সাক্ষী
গতবারের বইমেলায় মেলা থেকে ফিরে একটা পোস্ট দিয়েছিলেন আপনার কেনা বইয়ের লিস্টি দিয়ে, সে থেকে মুফতে পেয়ে গিয়েছিলাম মেলা থেকে সংগ্রহ করার মত কিছু বইয়ের তালিকা। এবারেও আপনার পোস্ট থেকে মেলায় একটা ভার্চুয়াল ভ্রমণ হয়ে গেল. তবে এবারের পাওনা একটু বেশি। লেখা পড়তে পড়তে একেবারে নিচে এসে উস্কানিমূলক ভ্রমণ গ্রন্থের তালিকায় নিজের লাল মলাটের বইখানি ও দেখতে পাচ্ছি কিনা তাই. ধন্যবাদ আপনাকে।
গুডরিডস
প্রিয় জীবনযুদ্ধ,
প্রথম বই প্রকাশের অভিনন্দন জানবেন।
[ আপনার ভ্রমণপোস্টে প্রতিমন্তব্য করা হয়নি, কিন্তু বইয়ের নামটা তখনই টুকে রেখেছিলাম। ]
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
গুডরিডস
বইমেলায় এবারও যাওয়া হবেনা। আপনার লেখা গুলোই পড়ছি আর নতুন বই গুলো দেখছি। পরে কোন এক সময় কিনে ফেলবো। আগের লেখাটাও সুন্দর ছিল।
সোহেল ইমাম
সমবেদনা+
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
স্বাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ এসেছে। শুদ্ধস্বর এই বইটা আর প্রকাশ করছে না। ঐতিহ্যে পাবেন।
মাজহার ঝুমন
এটা জানা ছিল না,
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এইবার যে পরিমান বই কেনার ইচ্ছা আছে সেই পরিমান টেকাটুকা নাই
হায় কী যে করি এই মন নিয়া, সে যে টেকারও হুতাশে ওঠে উছলিয়া
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ট্যাকাটুকা একটি অভিশাপ। আর, এইবার ভাল বই কম কম লাগতাছে নজরুল ভাই।
[আঙ্গুর ফল টক টাইপের কম না, সত্যি সত্যিই কম! ঈমানে কইতাছি, চশমার কসম]
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
গন্দম আমাদের অমিতের প্রথম পুস্তক। সচলেও আছে কয়েক পর্ব। এর সূত্র ধরেই দীপনদার সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিলো।
সেবারের বই মেলায় আমাদের অনেক স্মৃতি...
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
হ্যাঁ, অপু ভাই। ঐ বোলগ পড়েই বইটার কথা জানছিলাম। সামনে পেয়ে না কিনে থাকা গেল না। শুদ্ধস্বরে 'শমন শেকল ডানা' বইটাও পেয়েছিলাম, ঘুরে এসে কিনতাম কিন্তু দিকভ্রান্ত হয়ে গেছি!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বইগুলোর জন্য
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
উসকানি দিচ্ছেন? হুমম!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সাক্ষী নিত্যানন্দ ভাই, এই জবড়জং আরবী/ফারসি টাইটেলডারে খুব ভালা পাইছি (কিতাব আল গাইর ইস্তিফাজ)। কিন্তু এর অর্থ জানি না, একটু জানাবেন আশা করি। আর এই সাবটাইটেল (ওয়ালিমাঃ ওয়াহিদ, আশ'না, সালা'সা) গুলোর অর্থও জানতে চাই। ঈমানে কইতাছি, উস্কানি দেওনের লাইগা জানতে চাইতেছি না, এমনিই জানতে চাইতেছি!
- আবুল ফজল
সাক্ষী নিত্যানন্দ ভাই, তাত্তারী এই পোশ্নের উত্তর দ্যান!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সরি ভাই, মাফ চাই, দু'আও চাই! ('দোয়া' নয় কিন্তু; আরবী শব্দ বিকৃত যেন না হয়, খিয়াল রাইখতে হপে!) আপনাকেই বলছি, সাক্ষী সত্যানন্দ ভাই!) গুগল কইরা পাই নাই অর্থ, তাই আপনেই কইয়া দ্যান!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ম্যালা বই কিনেছেন দেখি! আগে বইমেলা সংক্রান্ত পোস্টে হিংসে ছড়িয়ে বেড়াতাম, তাতে চিত্তের আরাম হতো।
এখন ঐ হিংসেটাই হয় না আর..
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন