অমর একুশে বইমেলা এলেই মনে পড়ে চিত্তরঞ্জন সাহা'র নাম। গ্রন্থমেলার রূপকার, একুশের বইমেলার প্রবর্তক চিত্তরঞ্জন সাহার পিতার ছিলো কাপড়ের ব্যবসা আর পিতামহ ছিলেন সুদমহাজন। স্বভাবতই তারা চাইতেন তাদের সন্তান পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরবেন। চিত্তরঞ্জন সাহা এ সবের কিছুই পছন্দ করতেন না। বরং শৈশব থেকেই বইয়ে আসক্ত হয়েছিলেন। তবু পারিবারের চাপে তাকে প্রথম জীবনে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করতে হয়। বেশ লাভেরও মুখ দেখেন তিনি কিন্তু মনকে কাপড়ের সঙ্গে বেধে রাখতে পারেননি। দ্রুত বইয়ের ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে নিজেই হয়ে গেছেন প্রকাশনাশিল্প ইতিহাসের মূলাংশ। আমৃত্যু বইয়ের সঙ্গে গড়েছিলেন সখ্য। আজীবন ভালোবেসেছেন বই। জয়তু চিত্তরঞ্জন দা।
চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জের লতিফপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। লতিফপুর ও কল্যাণদী বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা আর ১৯৪৩ সালে নোয়াখালীর রামেন্দ্র হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে নোয়াখালীর চৌমুহনী কলেজ থেকে অর্জন করেন বিএ সার্টিফিকেট।
শুরু হয় তার বইভরি জীবন। ১৯৫০ সালে চৌমুহনীতে বইয়ের দোকান চালুর মাধ্যমে পাঠ্যবই বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু আগুনে দোকান পুড়ে যাওয়ায় তিনি প্রাথমিকভাবে বাধাগ্রস্ত হন। অথচ এই বাধা থেকেই ভাগ্যদেবী তার প্রতি সুপ্রসন্ন হন। ‘পুঁথিঘর’প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হয় প্রকাশনায় অভিযাত্রা। ১৯৫১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি বই প্রকাশের মাধ্যমে ‘পুঁথিঘর’-এর স্বপ্ন বাস্তবের পথে অনেকটাই এগিয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে ‘পুঁথিঘর’কে তিনি লিমিটেড কোম্পানিতেও উন্নীত করেন।
চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯৭০ সালে গাজী শামসুর রহমান, শওকত ওসমান, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ, সরদার জয়েন উদ্দিন প্রমুখ বিখ্যাত লেখকদের বই দিয়ে ‘পুঁথিঘর সাহিত্য সংসদ’ গড়ে তোলেন। শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তিনি দেশ ছেড়ে কলকাতা যান।
১৯৭১ সালের ২৮ মে কলকাতার পার্ক সার্কাসে সৈয়দ আলী আহসানের বাসায় খান সারোয়ার মুরশিদ, আনিসুজ্জামান, সত্যেন সেন, শওকত ওসমান, সৈয়দ আলী আহসান, সনজীদা খাতুনসহ প্রায় ৫০ জন বরেণ্য সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ভিত্তিক লেখা নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব দেন চিত্তরঞ্জন সাহাকে। তাঁরা প্রকাশনা সংস্থার নামও নির্ধারণ করে দেন-‘মুক্তধারা’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তধারা থেকে আবুল ফজল, আনিসুজ্জামান, আহমদ ছফা, সত্যেন সেন, শওকত ওসমান, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবদুল হাফিজ, গাজী শামসুর রহমানসহ বিশিষ্ট লেখকদের প্রায় ৩২টি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কামরুল হাসান, মুস্তাফা মনোয়ার, নিতুন কুণ্ডু, কাইয়ুম চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীরা এ সব গ্রন্থের প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন।
মুক্তধারার সমৃদ্ধির চিন্তায় বিভোর থাকেননি তিনি। বরং দেশে বইয়ের বাজার এবং পাঠক সৃষ্টিতে নিরন্তর কাজ করেছেন। অমর একুশে বইমেলার তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর সামনে আমগাছের নিচে চট বিছিয়ে বইয়ের দোকান দিয়ে একুশে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন তিনি। একটিমাত্র দোকান নিয়ে তিনি প্রায় দর্শক-পাঠকহীন বসে থাকতেন একরাশ স্বপ্ন বুকে। পরের বছর একইভাবে তিনি বাংলা একাডেমীর সামনে প্রায় পাঠক-দর্শকশূন্য সময় পার করেন।
১৯৭৪ সালে একই আমগাছের নিচে হার্ডবোর্ডের তৈরি ৮ বর্গফুটের স্টল সাজিয়ে বসেন। তাকে অনুসরণ করে ধীরে ধীরে অন্য বই বিক্রেতারাও জমতে শুরু করে। খান ব্রাদার্স, নওরোজ ও চট্টগ্রামের বইঘরসহ কয়েকটি পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ১৯৭৫ সালে তার সঙ্গে বই মেলায় যোগ দেয়। শুরু হয় একুশে বই মেলার গর্বিত যাত্রা।
বলা যায়, তার একক প্রচেষ্টায় একুশে বইমেলা রূপ পায় বাঙালির প্রাণের মেলায়। শুধু বই প্রকাশই নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় বইমেলার আয়োজন, পুরস্কার প্রবর্তনসহ চিত্তবাবু জীবনভর নানাভাবে প্রকাশনা শিল্পের সেবা করেছেন। তার প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
সৃজনশীল বই প্রকাশ, পাঠক তৈরিসহ বাঙালি মননের সমৃদ্ধিতে অবদানের জন্য চিত্তরঞ্জন সাহা ২০০৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৯৭ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সেরা প্রকাশক স্বর্ণপদক, ১৯৮৮ সালে নাট্যসভা পুরস্কার, ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিদ্যাসাগর পুরস্কার এবং ১৯৮৬ সালে নাটকগ্রন্থ প্রকাশের জন্য নাট্যদল থিয়েটারের শ্রদ্ধাঞ্জলিসহ বিভিন্ন সম্মাননা পান।
২০০৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর কীর্তিমান গ্রন্থমানব, বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, একুশে বইমেলার প্রবর্তক মুক্তধারার কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহা, সবার প্রিয় ‘চিত্তবাবু’ মারা যান। বইপ্রেমী মানুষটি আর অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় আসেন না। তবু তার বিদেহী আত্মা আজও ঘুরে বেড়াবে জন্মস্থানের সব সবুজ ছুঁয়ে সমস্ত বাঙালি পাঠক হৃদয়ে।
মন্তব্য
আমাদের দেশের মানুষের কাছে সস্তায় মান সম্পন্ন বই পৌছে দেওয়ার জন্য চিত্তরঞ্জন সাহার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বইমেলার প্রবর্তক এই সাধাসিধে মানুষটার কাছে এদেশের মানুষের ঋণ শোধ হবার নয়।
ভালো লাগল আপনার লেখা...শ্রদ্ধায় রইল চিত্তরঞ্জন সাহার স্মৃতি।
###তাসনীম###
সত্যিই তাই। এই ঋন আমার-আপনার। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে চিরকাল। ধন্যবাদ আপনাকে।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
অনেক কথা জানা হল ।
অনেক ধন্যবাদ ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
- অসাধারণ তথ্যাবলী। জানতাম না একুশে বইমেলার ইতিহাস। আপনাকে ধন্যবাদ।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
ভালোলাগলো! বই মেলা ও চিত্তরঞ্জন সাহা'র এই ইতিহাস জানা ছিল না।
কৃতজ্ঞতা রাখলাম।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
আমার চোখে এটা আপনার সেরা লেখা!
--------------------------------------------------
"সুন্দরের হাত থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়/
নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে..."
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আপনার এই মন্তব্য আমার জন্য বিশাল প্রাপ্তি। অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
সুন্দর একটা বিষয় নিয়ে লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।
অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
আমার ভুল না হয়ে থাকলে ১৯৭৮ সালে মুক্তধারা ছোটদের জন্য এক হাজারটা বই প্রকাশ করেছিল। এই কাজ করার জন্য একটা জাহাজের সমান কলিজা লাগে। আফসোস, অমন কলিজাওয়ালা মানুষ আর এই জীবনে দেখব বলে মনে হয় না। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলাদেশের প্রকাশনা - এই বিষয়গুলোতে মুক্তধারার অবদান নিয়ে একাধিক পিএইচডি থিসিস করা সম্ভব। আমি এই জীবনে যতগুলো বাংলা বই কিনেছি (সংখ্যায়) তার অন্ততঃ ৩০% মুক্তধারার, অথচ দামে সেগুলো মোট মূল্যের ৫%ও হবে না। এই প্রকাশনীটাকে ট্রাস্ট করে বাঁচানো সম্ভব ছিল। কিন্তু বাংলাবাজারের বেনিয়ারা তাকি হতে দেবে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এখনো সম্ভব। এবং এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির ভূমিকা অগ্রণী হওয়া উচিত।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
বিএনপি জামাতিরা একবার বইমেলা থেকে মুক্তধারা কে তাড়িয়ে দিয়েছিল। শেষমেষ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে মুক্তধারাকে বইমেলার এককোণায় ঠাঁই দেয়া হয়। যে মুক্তধারার স্থান ছিলো বাংলা একাডেমির স্টলের ঠিক পাশে তার স্থান হলো মেলার একবারে পেছনে নিভৃত এক জায়গায় আর মুক্তধারার জায়গা দখল করল জাতীয়তাবাদী প্রকাশনা অংকুর না কি যেন নাম। কষ্টে বুক ফেটে কান্না আসছিল সেবার। মেলায় যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলাম এরপর অন্তত চার/পাচ বছর। মুক্তধারার জন্য বাংলা একাডেমির পাশের স্টল টি সংরক্ষিত ঘোষণার দাবি জানাই।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা
আমি তো বেকার পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
শুধু তাই নয় দাদা। তাকে তিনমাস অজ্ঞাতস্থানে নির্যাতনও ভোগ করতে হয়েছিলো।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
মুক্তধারার উপর আরো লেখা চাই।
চেষ্টা থাকবে। অনেক ধন্যবাদ।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
নতুন মন্তব্য করুন