ভালোলাগার মতো কবিতা; মনে রাখার মতো কবি

শেখ নজরুল এর ছবি
লিখেছেন শেখ নজরুল [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১২/০৩/২০১০ - ৪:৪৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাষ্ট্রনায়করা যখন কবিতা লেখেন স্বভাবতই তার বিষয়বস্তু হয়ে যায় রাজনৈতিক। কিন্তু প্রকৃতপ্রেমী মানবতাবাদী কবি কালাণৈল কবিতায় মানবতার জয়গান ধ্বনিত হয়েছে; সাধারণ মানুষের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শৈশব থেকে তিনি সমুদ্র এবং আকাশের নীল সীমান্ত স্পর্শ করতে চেয়েছেন। বাস্তব জীবনে তিনি সফলও হয়েছেন। সাহিত্য এবং বিজ্ঞান- এ দুই মেরুর মধ্যে সেতুবন্ধনের জনক ড. আবুল পাকির জয়নুল আবেদীন আবদুল কালামের জন্ম দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের হিন্দু তীর্থস্থান রামেশ্বরমে ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবরে ।

ভারতের মতো শক্তিধর দেশের ব্যস্ততম রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি কবিতাচর্চায় ছিলেন বিশেষ মনোযোগী। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি বিজ্ঞানমনস্ক কবি হিসেবে কালামকে অভিহিত করেছেন। বাস্তবের সঙ্গে যিনি স্বপ্নের যুগলবন্দি সুর সংযোজন করেছেন কাব্যচর্চায়। এটিকে তিনি কালামের অলৌকিক ক্ষমতা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।

‘কাম্বাকোনামের মৃত শিশুদের জন্য প্রার্থনা’ কবিতায় তিনি মানবতার পক্ষে তার ব্যক্তিগত দর্শনকে স্পষ্ট করেছেন-

‘আমি জানি, সন্তানরাই বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে কবরস্থ করে
সেখানে কাম্বাকোনাম দেখেছে তার বিপরীত দৃশ্য; কষ্টের!
কান্নারত মায়েরা তাদের ছোট্ট শিশুদের কবর দিয়েছে।’

তিনি দার্শনিক এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। বহু ভাষায় পারদর্শী প্রকৃতিপ্রেমী কালাম ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিদিনের সকাল শুরু করেন সূর্য বন্দনায়। নামাজ পড়েন নিয়মিত। কুসংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক, বীণায় পারদর্শী, বাগ্মিতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং আদর্শবাদী এই শিক্ষকের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ Wings of fire প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তামিল তথা ভারতীয় সাহিত্যাঙ্গনে তিনি স্থায়ী আসন করে নেন। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার দ্বিতীয় গ্রন্থ Songs of Soul হিন্দি, ইংরেজি, কোরিয়ান এবং ফার্সি ভাষায় একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়। চিত্রধর্মী কলমসৈনিক কালাম সাহসী ভাষা প্রয়োগে সার্থকতা লাভ করেন।

‘আমার প্রিয় সৈন্যগণ’ কবিতায় তিনি সাহস এবং আত্মোপলব্ধি একত্রে প্রকাশ করেছেন-

‘যখন ঘুমিয়ে পড়ি আমরা নিশ্চিন্তে/তোমরা তখনও শপথের ঝাণ্ডা তুলে রাখো
বন্য বাতাসের দিনে, বরফ সকালে/জ্বলন্ত সূর্যের নিচে ঘর্মাক্ত শরীরে।’

কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ছিলেন একজন সাধারণ শিক্ষক। পরে বিশ্ববিদ্যালয় এবং সবশেষ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের অনুরোধে সরকারের সামরিক বিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। ভারত সরকার তাকে ভারতরত্ন উপাধি দিয়েছেন। তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু সব পুরস্কার ছাড়িয়ে তিনি রচনা করেছেন একের পর এক জীবনের অবশ্যম্ভাবী পাঠ। ‘জীবন-বৃক্ষ’ কবিতা পাঠে আমরা তার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারি-

‘কোথায় বাস করে আমার বর্ণ/বাস করেছে লক্ষ-কোটি বছর
এবং বাস করবে আরও অগুনতি সময়/অন্তত যতদিন সূর্য আলো ছড়াবে।’

তিনি ভারত এবং ভারতবাসীর স্বাধীনতা নিয়ে সর্বদাই উদ্বিগ্ন। মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি আপসহীন। ৩০০০ বছরের ইতিহাসে ভারতবাসী পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশ কর্তৃক শাসিত হওয়ার বিষয়টি তাকে কষ্ট দেয়। গ্রেট আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে গ্রিক, তুর্কি, মোগল, পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, ফ্রান্স, ডাচ সবার শাসনকেই তিনি সমালোচনা করেছেন। যা ভারতবাসীরা অন্যদের ওপর করেনি তা তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেন না। তারা ভারতের ভূমি দখল করেছে কিন্তু ভারতবাসী তা করেনি। তারা ভারতবাসীর জীবনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিন্তু ভারতবাসী তা হয়নি। তিনি সবার প্রতি ‘কেন’ প্রশ্ন রেখেই উত্তরে বলেছেন, ভারতবাসী অন্যের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং এই গুণ অন্য কোনো জাতির আছে কি-না সন্দেহ।

‘প্রস্তর-দেয়াল’ কবিতায় আমরা স্বাধীনতার প্রশ্নে তার সেই সহজ স্বীকার উক্তি পাই-

‘রঙিন আলোক রশ্মির ভেতরে/ফুল আমাকে সৃষ্টির বিস্ময় জাগায়
কেন আমি সুন্দরের পথে দেয়াল তুলবো?/আমার কোন বাড়ি নেই আছে উন্মুক্ত আকাশ
যা সত্য, অসীম এবং স্বপ্ন দিয়ে ভরা/আমি দেখতে চাই মাতৃভূমির সমৃদ্ধ অধ্যায়
দেখতে চাই তার প্রতিপর্বে সুখ এবং শান্তি।’

তার উদ্ভাবিত ‘কার্বন কার্বন’ প্রসঙ্গে তিনি একটি গল্পের উল্লেখ করেন, নিজাম ইনস্টিটিউটের এক অর্থপেডিক সার্জেন্ট একবার তার ল্যাবরেটরি পরিদর্শন করেন। তিনি কার্বন কার্বন উঁচু করে দেখেন যা তার কাছে ভীষণ হালকা মনে হয়। তিনি কালামকে তার হাসপাতালে নিয়ে যান এবং তার রোগীকে দেখান। যেখানে ছোট ছোট বালক-বালিকারা তাদের পায়ে মেটালিক ক্যালিপার্স বহন করছিল যার ওজন ৩/৪ কেজি। এই অতিরিক্ত ওজনের কারণে তাদের পায়ের পাতায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ডাক্তার কালামকে তার রোগীদের ব্যথা ভালো করার পরামর্শ চান। কালাম তিনশ’ গ্রাম ওজনের ক্যালিপার্স তৈরি করে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান। শিশুরা বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তাদের বাবা মার চোখে আনন্দাশ্রু দেখে সেদিন তিনি নিজেই কেঁদেছিলেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাকে অনেক বার কাঁদিয়েছে।

‘রাখিদিনের পুণ্য’ কবিতায় তাই তিনি লিখেছিলেন-
‘সুখের বারান্দা ভরে যায় রুপালী জোছনায়/বোন রাখি বেঁধে দেয় ভাইয়ের হাতে
বলে দেয়- কোনটি সত্য এবং সঠিক-/কুমকুম পায়ে এঁকে শস্য প্রার্থনায়
সব ঘর এক একটি দেশ হয়ে যায়।’

কালাম নীতি এবং আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন। তিনি তার এক লিখিত বক্তব্যে বলেছিলেন, এই তুমি যে অনায়াসে সিগারেট খেয়ে ভারতের রাস্তায় যত্রতত্র ফেলছ সেটি তুমি সিঙ্গাপুরের রাস্তায় করতে পারবে না। এ রকম বহু উদাহরণ দেয়া যাবে। তুমি কখনো দুবাইতে রমজানে খোলা জায়গায় খাবার খেতে পারবে না। তুমি ওয়াশিংটনে ৮৮ কিমি./ঘণ্টার নিচে গাড়ি চালাতে পারবে না। অন্যায় করে ট্রাফিককে বলতে পারবে না Do you know who I am? I am so and so's son. যে তুমি অন্য দেশের নিয়ম-নীতি মানো সেই তুমি নিজের দেশে মানো না। আমেরিকায় কিংবা জাপানের রাস্তায় কুকুর নিয়ে হাঁটলে সঙ্গে একটি পাত্র থাকে এবং মালিক নিজেই তার পায়খানা পরিষ্কার করে। কে এইসব পরিবর্তন করবে? অন্যের কথা বললেও নিজের কথা আমরা কেউ বলি না। তার কবিতায়ও এসব বিষয় জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘স্বপ্নের ক্ষত’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-

‘হিংসার বিষয় নয় এসব আমার/দ্রষ্টার সারিতে আজ দাঁড়িয়ে বলছি
আমরাও পারি এক হলে সব কিছু/প্রজ্ঞায় বিশ্বাস রেখে সামনের পথে যেতে।’

আবদুল কালাম রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করেছিলেন দুটি স্যুটকেস নিয়ে। সেই দুটি ছোট স্যুটকেস নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবন ত্যাগ করেছিলেন তিনি। নিরামিষভোজী আবদুল কালাম সততার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। আদর্শ ও মূল্যবোধের চর্চার বিষয়ে তিনি উচ্চকিত। তিনি তার ‘জীবন-বৃক্ষ’ কবিতায় লিখেছেন-

‘সুন্দর সকাল থেকে সূর্যোদয়, মেঘ কেটে কেটে/কাকাতুয়া এবং কোকিলের ডাক সুরেলা কণ্ঠে
হলুদ ফুলের স্বর্গ যেখানে, সেখানে গোলাপ স্থির/নিজস্ব সুরভিতে সাদা এবং গোলাপী বর্ণে
যাদের পিছনে তোলে মুয়ূর পেখম/সেখানে জীবন বৃরে সবুজে বিভোর’

ভারতের সাবেক সফল রাষ্ট্রপতি, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী, আদর্শ শিক্ষক যে নামেই তাকে অভিহিত করা হোক না কেন মানুষের অধিকার উচ্চারিত তার অসংখ্য কবিতা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

[ব্যবহৃত সব কবিতাংশ লেখক কর্তৃক অনুদিত]


মন্তব্য

আসমানী-মডু এর ছবি

অন্য একটি ব্লগে লেখাটির একটি ভিন্ন উপস্থাপনা প্রকাশিত: http://prothom-aloblog.com/users/base/sknazrul/28
নিজ ব্লগে প্রকাশ করা হল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।