বাংলার সূর্যালোক ফেরার গল্প

শেখ নজরুল এর ছবি
লিখেছেন শেখ নজরুল [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৭/০৪/২০১০ - ১০:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'এটিই সম্ভবত আপনাদের কাছে আমার শেষ ঘোষণা, এই মুহূর্ত থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আকুল আবেদন, আপনারা যে যেখানে আছেন এবং যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে। এবং যতক্ষণ না দখলদার বাহিনীর সর্বশেষ সৈন্যটি বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত হচ্ছে এবং আমাদের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হচ্ছে, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।' একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর অতর্কিত হামলা পরবর্তী রাত দেড়টায় গ্রেফতার হবার পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১৭ এপ্রিল বাঙালী জাতির অবিসংবাদী নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। ইতিহাস সাক্ষী; ১৭৫৭ সালে সিরাজ উদদ্দৌলার পতন হয়েছিলো পলাশীর যুদ্ধে হেরে। পলাশীর আম্রকাননে অস্তমিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। সেই পলাশীর আম্রকাননের অদূরে মুজিবনগরের আরেক আম্রকাননে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতার নতুন সূর্য জেগে উঠেছিলো। ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙালি অর্জন করেছিলো নিজস্ব ভূখণ্ড। সেই যুদ্ধের অন্যতম পরিচালিকা শক্তি ছিলো মুজিব নগর সরকার। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন এবং স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। এদিন স্বাধীনতার ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করা হয় এবং বিপ্লবী সরকার শপথ গ্রহণ করে।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই মুজিবনগর বিপ্লবী সরকার গঠন এবং সেই সরকারের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। শুধু তাই নয়; ১৯৭৩ সালে এই ঘোষণার ভিত্তিতেই আমাদের সংবিধান প্রণীত হয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাও বৈদ্যনাথতলার পার্লামেন্ট অনুমোদন করে।

যেহেতু বাংলাদেশে ৭ ডিসেম্বর হতে ১৭ জানুয়ারি ১৯৭১ পর্যন্ত সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং
'যেহেতু এই নির্বাচনে জনগণ ১৬৯ জনের মধ্যে ১৬৭ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেন যারা আওয়ামী লীগের সদস্য, (এ ছাড়া প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে) এবং
'যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান একটি সংবিধান প্রণয়নের নিমিত্তে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরকে মিলিত হওয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ আমন্ত্রণ জানান, এবং
'যেহেতু সে মত আহূত সভাটি অযৌক্তিক ও বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয় এবং
'.. বাংলাদেশের জনগণের সহিত আলোচনায় রত থাকিয়াও পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ একটি অনৈতিক ও বিশ্বাসহন্তা যুদ্ধ ঘোষণা করে, এবং
'যেহেতু এহেন বিশ্বাসহন্তা আচরণের ঘটনায় ও পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনগণের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের বৈধ অধিকার পূরণের জন্য ঢাকায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার একটি যথোচিত ঘোষণা দেন ...এবং
'..যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী ঐকান্তিকতা দ্বারা বাংলাদেশের এলাকায় কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন,
'জনগণ কর্তৃক অর্পিত নির্দেশের প্রতি, যাঁদের নির্দেশই চূড়ান্ত, সশস্ত্র অনুগত থাকায় আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আমাদের নিজেদেরকে লইয়া যথাযথভাবে সংবিধান রচনার গণপরিষদ গঠন করিলাম, এবং
'..ঘোষণা দিতেছি এবং প্রতিষ্ঠা করিতেছি যে, বাংলাদেশ হইবে সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র এবং এতদ্বারা ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে নিশ্চিত করিতেছি এবং
'..সংবিধান যে সময় পর্যন্ত প্রণীত না হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, এবং
'রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন,
'..আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া বিবেচিত হইবে।'

বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই Proclamation of independence বা স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে জানেন না। এমনকি বৈদ্যনাথতলার নামটি কেন মুজিবনগর হলো, এই মুজিবনগর সরকারের কি কাজ করেছিল, কারা নের্তেত্বে ছিলেন, তার অনেক কিছুই জানে না বর্তমান প্রজন্ম। অনেকেই ভুলে যান, ১৭ এপ্রিল, আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন- 'মুজিবনগর দিবস।' এমন কি মুজিব নগরকে ঐতিহাসিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে কোন সরকারই এগিয়ে আসেননি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হবার (১৯৯৬-২০০১) পর মুজিবনগরকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে হাত দেন। কাজ অনেকাংশ বাস্তবায়িতও হয়। কিন্তু পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকার (২০০১-২০০৬) ক্ষমতায় আসার পর কাজ আর এগোয়নি।

বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার পুণরায় মুজিবনগরকে স্বমহিমায় গড়ে তোলার জন্য স্কুল-কলেজ, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জাদুঘর, রেস্টহাউজ, পাঠাগার, সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র, অডিটরিয়াম প্রভৃতির সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স নির্মাণকাজ হাতে দিয়েছে; যা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হলে মুজিবনগর বর্তমান প্রজন্মের কাছে আরও পরিচিতি লাভ করতে পারবে।


মন্তব্য

রানা মেহের এর ছবি

শেখ নজরুল

বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের আগে স্বাধীনতার এই ঘোষনা কি কারো সামনে দিয়েছিলেন? তার গ্রেফতারের সময় তার সঙ্গে কে ছিলেন?
আসলে এই ঘোষনা নিয়ে একবার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম। উত্তর দিতে পারিনি। তাই আপনাকে জিগ্গেস করা।

অবাক হচ্ছি একটা ব্যাপার দেখে।
মুজিবনগর সরকারকে 'বিপ্লবী' সরকার বলা হচ্ছে কেন? বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ ঘোষিত হয়ে থাকলে এই সরকারই সরকার। কোন সমান্তরাল সরকার নয়। 'বিপ্লবী সরকার' কথাটাকে অন্যরকম করে অর্থ করা যায়।

মুজিবনগর সরকার নিজেরা কি 'বিপ্লবী' কথাটা ব্যবহার করতেন? করে না থাকলে এ শব্দ বাদ দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

FZ এর ছবি

@ রানা মেহের,
স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিশদ জানতে হলে নিচের লেখাটি পড়তে পারেন। আপনার প্রশ্নের উত্তর পাবেন।

http://www.mukto-mona.com/Articles/ajoy/25th_march_and_freedom.pdf

শেখ নজরুল এর ছবি

স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্দেশনার জন্য এ সরকার গঠিত- এটি সবার জানা। বিপ্লবী সরকার তখন তারা ব্যবহার করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাও বৈদ্যনাথতলার পার্লামেন্ট অনুমোদন করে।
ধন্যবাদ আপনাকে।

শেখ নজরুল

শেখ নজরুল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।