রাষ্ট্রই মুক্ত সাংবাদিকতার অন্যতম অন্তরায়

শেখ নজরুল এর ছবি
লিখেছেন শেখ নজরুল [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৩/০৫/২০১০ - ২:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সংবাদ মাধ্যম রাষ্ট্রের প্যারালাল শক্তি হিসেবে বিবেচিত। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশে রাষ্ট্রের পক্ষে যা সম্ভব হয় না সংবাদ মাধ্যম তা অনায়াসে করতে সক্ষম হয়। যদি সাংবাদিকতা দায়িত্বশীল পেশায় যুক্ত হয়। এবং সেখানে মুক্ত মত প্রকাশের পরিবেশ নিশ্চিত থাকে।

তাই হয়তো সম্মানজনক পেশা হিসেবে অনেকেই সাংবাদিকতা পেশাকে বেছে নেন, নিয়েছেন। ফলে গত এক যুগে বাংলাদেশে অনেক নতুন পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে; পাশাপাশি বিকাশ ঘটেছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার। উচ্চারিত হয়েছে সাংবাদিকতার মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার নানান প্রতিশ্রুতি।

মুক্ত সাংবাদিকতার প্রশ্নে সারা বিশ্বে সাংবাদিকরা অধিকার সচেতন হলেও পেশাগত অধিকার পালনকালে তাদের নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি তবু বেড়েই চলেছে। মাত্র তিন বছর আগের ঘটনাচিত্র ছিলো বেশ নাজুক। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে একজন জন সাংবাদিকসহ অন্যান্য ১৫ টি দেশে ১৪৫ জন সাংবাদিক ও মিডিয়া নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ইরাকেই নিহত হয়েছেন ৬৫ জন সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মী। গত এক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিহতের সংখ্যা প্রায় দেড় সহস্রাধিক।

২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের দেশের বিভিন্ন সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা, নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের মোট ১৮২টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আহত ৩৫, নির্যাতন ৩২, মামলা ১৪, গ্রেফতার ১৩, হুমকি ৮৩, হামলা ১, মুচলেকা আদায় ১ এবং অন্যান্য ঘটনা ঘটেছে ৩টি। এর মধ্যে ডেইলি স্টারের রিপোর্টার তাসনিম খলিল গ্রেফতারের ঘটনা ছিলো উল্লেথযোগ্য। যদিও তিনি গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টা পর মুক্তি পেয়েছিলেন।

তবে জরুরি অবস্থার কারণে ২০০৮ সালে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ পেয়োছলো কম। বস্তুত ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’ পুরোপুরি কার্যকর ছিল না। তবে শাস্তিপ্রাপ্ত এবং বিচারের মুখোমুখি হয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিক-প্রকাশক কারাগারে প্রেরিত হয়েছিলেন-এটি সবার জানা।

বঙ্গে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা অতি পরিচিত। তৎকালীন ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে সমালোচনার কারণে ১৭৮০ সালে বেঙ্গল গেজেটের প্রকাশক জেমস অগাস্টাস হিকির কারাদণ্ড হয়। ১৯২২ সালের ২২ অক্টোবর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদিত ধূমকেতু ইংরেজদের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লেখায় তাকে এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করেতে হয় ।

১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনকে সমালোচনা করার দোষে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক অবজারভার পত্রিকা নিষিদ্ধ করে । ১৯৬৬ সালের জুন মাসে ইত্তেফাক বন্ধ ঘোষণা করে প্রকাশক-সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সংবাদ ও পিপল পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীও এই অবস্থার তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। একবিংশ শতাব্দির বাংলাদেশের অবস্থা আরও নাজুক। সব সরকারের সময়েই সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। সুস্থ ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাদের আর্থিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি এখনও অবহেলিত, অনিশ্চিত। তাদের নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের বিষয়টি অমীমাংসিত।

বর্তমানে সারা দেশ থেকে প্রকাশিত প্রায় ১৮০০টি পত্রিকার মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ৯৫০। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা প্রায় ৫৫০। বাকি ৪০০ পত্রিকা মাসিক, পাক্ষিক এবং সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। বিগত জোট সরকার ১৪৭ টি সংবাদপত্রের মিডিয়াভূক্তি সম্প্রতি বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। ফলে বহু সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবী বেকার হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটি মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য আজও সর্বোচ্চ হুমকী হিসেবে বিবেচিত।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলো ব্রডশিটে এবং প্রায় ক্ষেত্রে চাররঙা ছাপা হলেও মফস্বল থেকে প্রকাশিত প্রায় ৯০০ পত্রিকা প্রকাশিত হয় ট্যাবলয়েড আকারে এবং ছাপার মানও সন্তোষজনক নয়। তাড়াছা ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো ত্বরিৎ গতিতে মফস্বল শহরে পৌঁছে দেবার প্রবণতায় সেখান থেকে প্রকাশিত পত্রিকা অনেকাংশে পাঠকপ্রিয়তা হারাচ্ছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখনো পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না। অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগেও সাধারণ জনগণের তথ্য প্রাপ্তি এখনো একটি কঠিন বিষয়। ফলে জনগণকে গণমাধ্যমের শরণাপন্ন হতে হয়। এই ধারণার ওপরই পত্রিকা কিংবা গণমাধ্যমের উৎপত্তি। কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও প্রায় ক্ষেত্রে সংরক্ষিত। আমাদের সাংবাদিকরা প্রকৃতঅর্থে কতটুকু বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারছেন?

পত্রিকার প্রকাশক, মালিক পক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী কিছু সম্পাদককেও সরকারি এবং বেসরকারি মাধ্যম থেকে নানান সুবিধা প্রাপ্তির কারণে শাসকশ্রেণীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে দেখা যায়। ফলে জনগণ কিছু সংবাদপত্রকে সরকারের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে বিবেচনা করতে বাধ্য হয়। সংবাদপত্র প্রকাশের ইতিহাস সমৃদ্ধ হলেও মত প্রকাশের মৌলিক স্বাধীনতা আজো সর্বত্র বিপর্যস্ত।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর অব্যাহত হস্তক্ষেপও নিন্দনীয়। সেন্সর প্রথা, কারাদণ্ড প্রদান এবং কখনো কখনো মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মাধ্যমে মুক্ত সংবাদ পরিবেশনের অধিকার খর্ব করা হয়। তৃতীয় বিশ্বে রাষ্ট্রই মুক্ত সাংবাদিকতার প্রধান অন্তরায়। সাংবাদিকরাই ক্ষমতা কুগিত করার অপপ্রয়াসের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। সঙ্গত কারণেই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে মত প্রকাশের অধিকার। বিপর্যস্ত হচ্ছে মানবাধিকার। সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্রও হয়েছে ভয়ংকর।

বাংলাদেশে ২০০২ সালে হত্যা ২, মামলা ৭৫, জেল ৩৩সহ মোট ১১০ জন সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন। ২০০৩ সালে হত্যা ১, মামলা ৮৩সহ নির্যাতনের সংখ্যা ৮৪ জন। ২০০৪-০৫ সালে হত্যা ৬, মামলা ৭০, জেল ৩সহ মোট ৭৯ জন সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন।

২০০৬ সালের এই চিত্র ছিলো আরো ভয়ংকর। এ বছরে হত্যা ১৪, মামলা ১১৯, জেল ২সহ নির্যাতিত হয়েছিলেন ১২৫ জন সাংবাদিক। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকের কারা নির্যাতন চিত্রটি অবাধ তথ্য প্রবাহের ধারণাকেই পাল্টে দিতে পারে। ২০০২ সালে ১৩৬ জন, ২০০৩ সালে ৩৬ জন, ২০০৪ সালে ১২২ জন, ২০০৫ সালে ১২৫ জন, ২০০৬ সালে ৬৫৩ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে কারাবরণ করতে বাধ্য হয়েছেন।

নারী সাংবাদিকের মধ্যে শ্রীলংকার মুনুসামি পরমাশ্বেরী, ইবিত্রিয়ার সাইদিয়া আহমেদ, ইরাকের রাবেয়া আব্দুল ওহাব, উগন্ডা নিকুসিসহ অনেককেই পেশাগত কাজের মধ্যেই আটক করা হয়। ২০০৫ সালে মুক্ত সাংবাদিকতায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৭টি দেশের মধ্যে ১৫১তম অবস্থানে। বর্তমানে এই অবস্থার উন্নতি হয়েচে কিনা তার সঠিক তথ্য নেই। এই গাণিতিক দৃশ্যপটে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সংবাদকাজে অসহায়ত্বের চিত্রই ফুটে ওঠে।

আন্তর্জাতিক প্রেস ইন্সটিটিউটের প্রতিবেদনে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা লংঘনের ভয়াবহতা উলেখ করে বাক-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সনদের প্রতি সম্মান দেখাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বিষয়টি মর্মান্তিক উল্লেখ করে বলা হয়- গত শতাব্দীতে মানব সভ্যতা সব রকমের অগ্রগতি অর্জন করলেও বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ এখনো সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা স্বাধীনভাবে ভোগ করতে পারছে না।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চমতকার একটি লিখা ।

অচেনা পুরুষ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।