বিশ্ব জাদুঘর দিবসে কিছু এলেবেলে কথা

শেখ নজরুল এর ছবি
লিখেছেন শেখ নজরুল [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৮/০৫/২০১০ - ৬:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শেষ হয়ে আসা প্রতিটি রাতের সজীব গভীরতা থেকে বাংলাদেশ তুলে আনতে চেয়েছে প্রথম ভোরের লাল গোলাপের সকাল। যে সকাল থেকে শুরু হবে হাজার সকালের সোনাঝরা রোদপ্রাপ্তির প্রাক-প্রার্থনা। অন্ধকার যতই শাসাক ভোর হবেই। সেই ভোরে আমরা গোলাপের দিকে হাত বাড়িয়ে বলতে চাই- গোলাপ তোমাকে প্রণাম, তোমার সজীবতায় ভরে উঠুক সবার জীবন, প্রতিবিম্বিত হোক অনাগত সুখ এবং সমৃদ্ধি। এই বলা- কী প্রাপ্তি সেই প্রার্থনার বিপরীতে! নানান কারণে আমাদের সেই স্বপ্নগুলো এত অস্থির যে, তাকে ছুঁয়ে দেখা প্রায় অসম্ভব।

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’- বাঙালির রক্তে মেশা জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে আমাদের দেশাত্মবোধের অবস্থান আত্মার বিপরীতে। দেশের পনের কোটি মানুষের অধিকাংশই যে সঙ্গীতে আপ্লুত হয়, কষ্ট-আনন্দ কিংবা বেদনায় যার সুরে নিজেকে একজন আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশী হিসেবে দেখতে ভালোবাসে- সেই উচ্চারিত ভালোবাসার সঙ্গে বৈপরীত্যের নির্মম দশাই আছে। সম্ভাবনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমরা অনুপ্রাণিত মুহূর্তের কথা ভুলে যাই। ভুলে যাই নিছক ব্যক্তিস্বার্থ সংরক্ষণের গাঢ় ইচ্ছায়।

প্রত্যহ ফেলে আসা সময় আর অনাগত সম্ভাবনা নিয়ে ধারালো ছুরি হাতে ব্যবচ্ছেদে অংশগ্রহণ করতে হয় প্রত্যেককে। অতীত ইতিহাস সামনে রেখে সুন্দর ভবিষ্যতের কথা বলতে হয় ফলাফল শূন্য জেনেও। যদিও এই মূল্যায়ন তথৈবচ। এ সব কথাগুলো বলছি, আমাদের অতীতের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে ভুলে যাওয়া নিয়ে। আমরা পিছনটা সহজেই ভুলে যাই। পূর্বপুরুষ আমাদের কাছে অতিরিক্ত পুরুষ। আর পুরাতন ঐতিহ্য খুব বেশি ভাবায় না আমাদের।

হয়তো ভূমিকাটি ঠিকমতো হলো না, হয়তো এটি মন কাড়বে না অনেকেরই; কিন্তু কথা সত্য। যেমন সত্য বাংলাদেশের ইতিহাস এবং জাতিসত্বার নিদর্শন অমূল্য সম্পদ আমাদের অস্তিত্বের অহংকার প্রত্নতত্ত্ব; তেমনি তার বিপরীতে দড় প্রত্নতত্ত্বের প্রতি যথেচ্ছা আচরণ।

‘প্রজ্ঞা পারমিতা’র মতো পুরাকীর্তি সংগ্রহ করতে আমাদের বহু বছর লেগেছে। অথচ দেশের অমুল্য ৪২টি প্রত্নসম্পদ গিমে জাদুঘরের উদ্দেশ্যে ফ্রান্সের বোয়িং ৬৭৩১ ফ্লাইটে উড়ে গিয়েছিলো, অনেকেরই মনে থাকার কথা। প্রত্নসম্পদ প্রদর্শনের জন্য ভিন দেশে যেতেই পারে কিন্তু আশংকা সৃষ্টি হয়েছিল কেন? কারণটা আর কিছু নয় বিতর্ক গিমে যাদুঘরকে নিয়ে। গিমে জাদুঘরের চৌর্যবৃত্তিক চরিত্রানুযায়ি এগুলো ফিরে আসা নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শঙ্কা অমূলক নয়। গিমে জাদুঘরের চোরাই প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহের নজির আছে। তাছাড়া তাদের প্রত্নতত্ত্ব নীতিমালায় সংগ্রহের বিষয়ে প্রশ্ন না তোলার বিষয়টি স্পষ্ট। ১৯৫৯ সালে ফ্রান্সে পাঠানো বাংলাদেশের অত্যন্ত মূল্যবান একটি প্রত্ননিদর্শন অদ্যাবধি ফেরত আসেনি। অন্যদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিশ্বের সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্য তাদের মূখ্য নয় বরং তারা নিজেদের জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করার বিষয়ে সচেষ্ট। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাজশাহী বরেন্দ্র্র জাদুঘরের নিদর্শনগুলো সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো যা স্থানান্তর যোগ্য নয়। তারপরও সিমেন্ট ভেঙে মাস্টারপিসগুলো বাক্সবন্দি করা হয়েছিল। ফ্রান্স দূতাবাস আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলেছিল এটা এটা চাই। আর আমরা দাসের মতো ১৮৯টি মূল্যবান পুরাকীর্তি তাদের হাতে তুলে দিতে দু’দেশের মধ্যে এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করেছিলাম।

আমরা তাদেরকে মহাস্থানগড় সার্ভে করার সুযোগ করে দিয়েছি। সেখানে তারা উলম্ব জরিপ করেছে যাতে অধিক মাটির নিচাংশ খুঁড়ে দেখা যায়। তারা আমাদের জানতেও দেয়নি কী পেয়েছে? এমনকি কোর রিপোর্ট জানাতে প্রয়োজন বোধ করেনি। গত ন’ বছরে ওরা বুঝতে পেরেছে আমাদের সহজেই ফাঁকি দেয়া যায়। আর ফ্রান্স তো ১৮০০ সাল থেকেই পৃথিবীজুড়ে প্রত্নতত্ত্ব চোরাই কাজে সক্রিয়। তারা চোরাকারবারীতেও বেশ পারদর্শী। ভারত, নেপাল ভুটান, কোরিয়া, জাপানসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রত্নতত্ত্বের ইউনিক মাষ্টার পিছ তারা এ ভাবেই সংগ্রহ করেছে। অথচ কীভাবে সংগ্রহ করেছে তার উত্তর দিতে তারা বাধ্য নয়। ফ্রান্সের কোন যাদুঘর চোরাই উপায়ে প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহ করলে সে সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করার বিধান সেখানে নেই। উল্লেখ্য, গিমে জাদুঘর চীনের ৩০ হাজার প্রত্নতত্ত্ব চুরির মাধ্যমে সংগ্রহ করেছে। যদিও চুরির পর তা হয়ে গেছে সে দেশের অহংকার, সভ্যতার শুশীল অবয়ব।

জাদুঘর পণ্ডিতের পাঠশালা। পুরাকৃতি সংরক্ষণ এবং গবেষণার সুতিকাগার। পুরাতত্ত্ব একটি জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি বিজ্ঞান সর্বোপরি সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাকে চিহ্নিত করে। প্রত্নসম্পদ সভ্যতার অনন্য নিদর্শন আর জাদুঘর সেই নিদর্শন সংরক্ষণ, প্রদর্শন এবং গবেষণার অন্যতম স্থল। জাদুঘর বা মিউজিয়াম শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক শব্দ ‘মউজিয়ন’ থেকে। গ্রীকদের কলাবিদ্যার দেবী মিউজেসের মন্দিরকে এক সময় মিউজিয়াম বলা হতো। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মিশরের আলেকজান্দ্রাতে টলেমি লাইব্রেরি স্থাপন করেন এবং এর নাম দেন মিউজিয়ম। মিউজিয়ম শব্দ দিয়ে তিনি জ্ঞানের তীর্থস্থান বোঝাতে চেয়েছিলেন।

আলেকজান্দ্রায় তখন বিজ্ঞান ও ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বহু পুরাকৃতির সমাবেশ ঘটেছিলো। রোমান যুগে মিউজিয়ম শব্দটি ইউনির্ভাসিটি হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণে পোপ চতুর্থ সিক্সটাস (১৪৭১-১৪৮৪) পোপ ৬ষ্ঠ আলেকজান্ডার (১৪৯২-১৫০৩) এবং দ্বিতীয় জুলিয়াস (১৫০৩-১৫১৩) ব্যাপক অবদান রাখেন। তবে পুরাকৃতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা তখনও শুরু হয়নি। ষষ্ঠদশ শতকে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রত্নতত্ত্ব চর্চা শুরু হয় ইংল্যান্ডে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬৮৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দ্য আশমোলিয়াম মিউজিয়াম’ প্রতিষ্ঠা হয়। তখনও ভারতীয় উপমহাদেশে কোন জাদুঘর স্থাপিত হয়নি।

১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি স্যার উইলিয়ামের উদ্যোগে কলকতার ফোর্ট উইলিয়ামে ‘এশিয়াটিক সোসায়টি’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ১৭৯৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জাদুঘর স্থাপনার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ফোর্ট উইলিয়ামে প্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত ডেনিস উদ্ভিদবিদ ড. ন্যাথানিয়েল ওয়ালিচ জাদুঘরটির প্রথম তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। বিশ্বব্যাপী বিষয়ভিত্তিক জাদুঘরের অস্তিত্ব ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। চিত্রশিল্প জাদুঘর এর অন্যতম।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো, পাবলো পিকাসো, ভ্যানগগ, সালভাদোর দালি, মনেটসহ বহু প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্ম সংরণে বিশ্বের যে সব যাদুঘরের খ্যাতি আছে লুভ মিউজিয়াম তার অন্যতম। ফ্রান্সের রাজপ্রাসাদে গড়েওঠা এই যাদুঘরে ‘ভেনাস’ এবং ‘মোনালিসা’সহ বহু মূল্যবান চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে। ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত রোমান ক্যাথোলিক চার্চ থেকে নয় মাইল দূরে অবস্থিত ভ্যাটিকান মিউজিয়াম লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো, পাবলো পিকাসো’র চিত্রকর্মে সমৃদ্ধ হয়েছে। নিউ ইয়ার্ক সিটিতে অবস্থিত ‘মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আট’ সেন্টার বিভিন্ন দশকের বহু চিত্রকর্মে সজ্জিত। প্রায় দুই হাজার গ্রীক স্থাপত্য এবং ইউরোপীয় চিত্রকর্মে যাদুঘরটি বিশ্বের অন্যতম বৃহদ শিল্পকর্ম দর্শনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হতে পেরেছে।

ক্যালিফোনিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসে সেন্ট্রাল যাদুঘরে ‘ভ্যানগগ’-এর দুর্লভ চিত্রকর্মসহ অসংখ্য চিত্রকর্ম আছে। এর চারপাশে সাজানো বাগানে যাদুঘরটিকেই একটি অনন্য পেন্টিংস মনে হয়। ভ্যানগগের ‘Starry Night’শোভিত প্যারিসের Musee d'Orsayর বিশেষত্ব হচ্ছে ঊনিশ এবং বিশ শতকের বিভিন্ন চিত্রকর্ম সংরক্ষণ। ইতালির ফোরেন্সে স্থাপিত Uffizi Gallery বিশ্বের অন্যতম পুরাতন যাদুঘর হিসেবে বিবেচিত। এখানে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলোর বহু চিত্রকর্ম সংরতি আছে। ‘আর্ট ইনস্টিটিউট অব শিকাগো'তে দর্শণীয় চিত্রকর্মের মধ্যে ‘Haystacks’সহ ত্রিশটি চিত্র মনেটের আঁকা। লন্ডনের টেমস নদীর তীরে অবস্থিত Tate Modern অধিবাস্তবাদ বিষয়ক সংগ্রহের জন্য বিশ্বখ্যাত যাদুঘর। এই যাদুঘরে সালভাদোর দালির Forgotten Horizon, তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন। Goya, Velasquez, Murillo, and El Greco চিত্রকর্ম নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে স্পেনের প্যারাডো যাদুঘর। ওয়াশিংটনের The National Gallery of Artএর পূব পাশের এলাকাটি Jackson Pollock, Roy Lichtenstein and Andy Warhol এর চিত্রকর্মে সমৃদ্ধ।

এ বঙ্গে ভারতের মুদ্রাতত্ত্ব গবেষক ও ব্রাহ্মলীপির প্রথম পাঠ উদ্ধারকারী জেমস প্রিসেপ ১৮৩৭ সালে জাদুঘর স্থাপনের প্রথম প্রস্তাব পেশ করেন। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ১৮৬৬ সালে ভারতের জাদুঘর স্থাপিত হয়। ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৩ সালের ৭ আগষ্ট। পরে ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা জাদুঘরের নাম পরিবর্তন করে জাতীয় জাদুঘর নামকরণ করা হয়। তবে বাংলাদেশের প্রাচীনতম জাদুঘর হচ্ছে রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর।

বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রত্নসম্পদ অন্বেষণে এবং গবেষণায় এটির অবদান ব্যাপক। ১৯১০ সাল থেকে বরেন্দ্র যাদুঘরের প্রত্মসম্পদ অন্বেষণ এবং গবেষণা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দয়ারামপুরের জমিদার শরৎকুমার রায়, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অয় কুমার মৈত্র এবং রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলের শিক রমাপ্রসাদ চন্দ। পরে তাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রামকমল সিংহ এবং কলকাতা জাদুঘরের রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তারা সকলে বিপুল পুরাকৃতি সংগ্রহ করেন। বরেন্দ্র জাদুঘরের বর্তমান পুরাকৃতির সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার।

বরেন্দ্র জাদুঘরটি নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯১০ সালে এবং শেষ হয় ১৯১৩ সালে। ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এটি উদ্বোধন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগ হবার পর পাকিস্তানী শাসকের বৈরী আচরণের ফলে বরেন্দ্র জাদুঘরটি আর্থিক সংকটে পড়ে। ১৯৬৪ সালে এটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে এর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধিগ্রহণ করে। এবং নতুনভাবে পরিচালনা শুরু করে। তখন থেকেই জাদুঘরটি একটি পরামর্শক কমিটির মাধ্যমে পরিচালনা শুরু হয়।

বরেন্দ্র জাদুঘর নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে হাজার বছরের সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন আছে। মহেনজোদারো সভ্যতা থেকে সংগৃহীত অসংখ্য প্রত্নতত্ত্ব এবং সহস্রাধিক পাথরের ভাস্কর্য এই জাদু ঘরের অনন্য নিদর্শন যা পৃথিবীর অন্য কোন জাদুঘরে নেই। খ্রিস্টিয় একাদশ শতকে নির্মিত সূর্য মূর্তি, বুদ্ধ মূর্তি, ভৈরবের মাথা, দূর্গা-মহিষ, অর্ধনারী-শিবের মূর্তি, গঙ্গা মূর্তি বরেন্দ্র জাদুঘরের অমূল্য সম্পদ। প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহের দিকদিয়ে জাদুঘরটি অনেকবেশি সমৃদ্ধ। মোগল আমলের রৌপ্যমুদ্রা, গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গোলাকার রৌপ্য মুদ্রাসহ অমূল্য শিলালেখ যাদুঘরটির বিশেষ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। পুঁথির বিশাল ভান্ডার (৫০০০ পুঁথির মধ্যে ৩৬৪৬টি সংস্কৃত এবং বাকি বাংলা পুঁথি), অষ্ট্র সাহস্রিকা প্রজ্ঞা পারমিতা, পালযুগ থেকে মুসলীমযুগ পর্যন্ত অংকিত চিত্রকর্ম, প্রজ্ঞা পারমিতা পুঁথিচিত্র থেকে মুঘল যুগের বিভিন্ন মিনিয়েচার, সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের পিতা ইমাদ উদ দৌল্লার অলংকৃত চিত্র নিয়ে এটি সমৃদ্ধ জাদুঘর হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিতি পেয়েছে।

বরেন্দ্র জাদুঘর থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিলো। বর্তমানে প্রকাশনার কাজ হচ্ছে না। ১৯১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘তারাতন্ত্রম’, ১৯১৯ সালে প্রকাশিত ধাতু প্রদীপ, ১৯২৬ সালে প্রকাশিত ‘অলংকার কৌস্তুভ’ আজও রতি আছে এই জাদুঘরে। যা গবেষণার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাদুঘরটি পরিদর্শন করে ধন্য করেছেন মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, স্যার আশুতোষ মুখ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

বাংলাদেশে এখন জাদুঘরের সংখ্যা শতাধিক। এখানে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক জাদুঘরও স্থাপিত হয়েছে। রেলের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ সৈয়দপুরে রেল জাদুঘর, পঞ্চগড়ে রক মিউজিয়াম, ঢাকায় মুদ্রার জাদুঘর বিষয়ভিত্তিক জাদুঘর হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ঢাকার শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘর অন্যান্য সকল জাদুঘরের সীমাবদ্ধতা অনেক, সেই সীমাবদ্ধতা পরিসরের নয় বরং এটির পরিদর্শন এলাকা ২০০০০ বর্গ মিটার এবং ৪৪টি গ্যালারী নিয়ে তিনটি অডিটোরিয়াম, একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, স্থিরচিত্র কর্ণার আছে এখানে। বুদ্ধমূর্তি, ব্রহ্মলিপি, স্থাপত্য, পুরাণ আরবী এবং ফার্সী ক্যালিগ্রাফি জাতীয় জাদুঘরের অমূল্য সম্পদ।

জাতীয় জাদুঘরের কয়েন গ্যালারীটি বিভিন্ন সভ্যতার গবেষণা কাজে ব্যাপক ব্যবহৃত হচ্ছে। সংস্কৃত এবং বাংলার আদি পাণ্ডুলিপি, হ্যান্ডমেড কাগজে লেখা হস্তলিপি, তালপাতায় লেখা হস্তলিপি, তেরাকোটাসহ বিভিন্ন তৈলচিত্র জাতীয় জাদুঘরের সমৃদ্ধদানে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

জাতীয় জাদুঘর চারটি বিশেষ কর্ণার বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বুদ্ধিজীবি হত্যা এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের তৈলচিত্র গ্যালারী বাঙালী জাতির হাজার বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাসকে ধারণ করে আছে এই চারটি বিশেষায়িত গ্যালারী। ঢাকার ঐতিহ্য মসলিন, কাঠের কারুকাজ, উপজাতীয় সংস্কৃতি, বিভিন্ন সময়ের সংগৃহীত নৌকাসহ ৮৫ হাজার অবজেক্ট ধারণ করিয়ে জাতীয় জাদুঘরের মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্ব সংরক্ষণ এবং গবেষণার চেষ্টাও জিঁইয়ে আছে- হয়তো এখানে কিছুটা সান্তনা।


মন্তব্য

হরফ এর ছবি

নজরুল আপনার লেখাটি দরকারি এবং তথ্যবহুল কিন্তু আবেগ জরজর প্রথম ৫টি পরিচ্ছেদ লেখা কি খুব জরুরি ছিল? আমি নিশ্চিত আমার মতো আরো অনেক পাঠকের-ই "যে নদী হারালো স্রোত " দশা হবে পাঠ শুর করে এবং অনেকে হয়তো শেষ অবধি পড়ার ধৈর্য-ও রাখতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে তো লোকশান দু-তরফেরই, তাই না? একটু ভেবে দেখুন।
------------------------------------
"ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে"

ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল নজরুল ভাই।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।