হালচাষ করতে যাচ্ছে মুতি মিয়া। কাঁধে লাঙল আর হাতে গরুর দড়ি নিয়ে ভোরের শিশিরের শীতল জল মাড়িয়ে অন্ধকারের ঘোর কাটার আগেই সে মাঠের পথে রওনা দিয়েছে। ঠাণ্ডা মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, ভিজে উঠছে পা কুয়াশা নিংড়ানো শিশিরের জলে; কিন্তু মুতি মিয়ার মনটা শীতল হচ্ছে না। সকাল থেকেই রাগে উত্তপ্ত হয়ে আছে তার মেজাজ। ভোরের বাতাসও তার মনটাকে ঠাণ্ডা করতে পারছে না।
মুতি মিয়া একমনে হাঁটছে আর হিসাব মিলাচ্ছে বিগত জীবনের। মিলছে না কিছুতেই। সারাদিন গাধার খাটুনি খেটে সংসার চালায় সে আর তার উপর বাহাদুরী করতে আসে তার বউ। এই সকালেই বউ তাকে শুনিয়েছে- মুরোদ নেই তিন বেলা খাওয়াবার আবার বড় বড় কথা। কথা সত্য, তিন বেলা খাবার প্রতিদিন জুটে না, কিন্তু মুতি মিয়া তো কম খাটুনি করে না, কাজের দিনে সকাল থেকে রাত কোন সময়টা সে অনর্থক বসে কাটায়? তারও কি ইচ্ছে করে না তিন বেলা খাবার খেতে? তাই বলে ঘুম থেকে উঠে এসব অভাব অভিযোগ শুনতে ভাল লাগে না তার। অথচ এই সকাল বেলায় বেশ কিছুক্ষণ ঝগড়া করে এসেছে তার বউয়ের সাথে।
ঝগড়ার সূচনা গতকাল থেকে। গতকাল দুপুরে যখন মাঠের কাজ শেষ করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল মুতি মিয়া, তার বউ তখন রান্না ঘরে। সে তার বউকে ডেকে বলল এক গ্লাস পানি দিতে। বউ তাকে বলেছিল- নিজে লইয়া খান। হয়ত কাজের চাপেই বলেছে, কিন্তু মুতি মিয়ার ক্লান্ত শরীর এতকিছু বিবেচনা করার ধার ধারে না, তার উত্তপ্ত শরীরের সাথে মাথাটাও উত্তপ্ত হয়ে যায়। সে রাগী সুরে ধমক দিয়েই বলে- এক গ্লাস পানি খাওয়াইতে পারবি না তো বিয়া বইছস ক্যান?
তার স্ত্রীও কম যায় না- সারাদিন বান্দির লেহান খাডি, তাও উনার পরান পুরে না; আউশ কইরা মুহে পানি তুইল্যা দেঅন লাগব। সেই থেকে শুরু। একের পর এক কথা বেড়ে চলে কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়তে রাজি হয় না। গলার স্বর ক্রমশ উচ্চ হতে থাকে। কথা বলার সময় দুজনেরই রক্তনালীগুলো ফুলে ফুলে উঠে, গলা দেখে মনে হয় এক্ষুণি রক্ত বেরুবে গলা ফেটে। তবু কেউ থেমে নেই বরং দুজনেই ব্যস্ত গলার স্বরকে আরও উচ্চতর করার প্রচেষ্টায়। কথাবার্তা শালীনতা ছেড়ে অশালীন হয়ে গেলে পাড়া পড়শীরা ছুটে এসে কোন মতে থামায় দুজনকে।
সারারাত বিছানায় ছটফট করে সকালে মুতি মিয়া ভেবেছিল ব্যাপারটা মীমাংসা হয়ে যাক। কিন্তু তার বউ আবার শুরু করলো। তাই সেও ছেড়ে দেয় নি, বংশ উদ্ধার করে ছেড়েছে। একেক বার মুতি মিয়ার ইচ্ছে হয় গরু পেটানোর এই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বউকে ঠাণ্ডা করে দেয়, কিন্তু বউয়ের উপর লাঠি কেন হাতও তোলার সাহস পায় না সে। কখনও ইচ্ছা করে তালাক দিয়ে চুকিয়ে দেয় সব ঝামেলা। কিন্তু সন্তানগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে সে ইচ্ছাও তার মিলিয়ে যায়। তাই বলে ছেড়ে দেবার লোক নয় মুতি মিয়া, একদিন সে এর সব হিসাব নিকাশ কড়ায় গণ্ডায় নিবে। হাড় মাংস এক করে সে উপার্জন করে অথচ এই সকালে তাকে বের হতে হয়েছে না খেয়ে। তাই তার মেজাজ এবং শরীর উভয়ই রাগে ও উত্তেজনায় অতি মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে আছে।
যত কিছুই হোক কাজ ছেড়ে দেয়া যাবে না, মাঠে তাকে যেতেই হবে, জমিতে চাষ দিতেই হবে। তাকে অনেক টাকা আনতে হবে; যত টাকা আনলে তার বউকে লাঠি দিয়ে পেটালেও ঐ বউ মুরোদ নেই বলে খোটা দিতে পারবে না।
শক্ত মাটির বুক চিড়ে লাঙল এগিয়ে যাচ্ছে। গরু দুটি টেনে নিয়ে যাচ্ছে লাঙল, রোদের ঝাঝ বাড়ছে, ক্ষুধার জ্বালা বাড়ছে। মুতি মিয়ার মাথা জুড়ে চিন্তা খেলা করছে, দুনিয়ার সকল চিন্তা, কেমন করে অনেক টাকা উপার্জন করে বউকে শায়েস্তা করা যায় সেই চিন্তা। গরুগুলো একমনে টেনে চলছে জোয়াল, টানতে টানতে এক সময় একটি গরু ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে মাটিতে। মুতি মিয়া তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। দু’বার চেষ্টা করেও উঠাতে পারে না। রোদের উত্তাপের সাথে, ক্ষুধার জ্বালার সাথে মুতি মিয়ার উত্তেজনা এক হয়ে মিশে যায়। হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরে প্রাণপনে একবার মারে গরুটার পিঠে, ক্লান্ত গরুটা বসে থাকে আগের মতই; মুতি মিয়া তার শক্ত হাত তুলে লাঠিটাকে আবার মারে, আবার, আবার......। অসহায় গরুটা ব্যথার যন্ত্রণায় ক্লান্তি ভুলে গিয়ে উঠে দৌড়াতে শুরু করে।
মন্তব্য
পড়ে কষ্ট পেলাম। কষ্ট না দিয়ে কিছু লিখতে পারেন না তপু মিয়া?
ভাই লজ্জা দিলেন। কষ্ট দেবার মত ক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারি নি, তবে আশায় আছি আপনার মত করে লিখব বলে। সেদিন সত্যিই আমার লেখা পড়ে কেউ কষ্ট পাবে।
নতুন মন্তব্য করুন