যথা রীতি আমি দেরি করেছি, মোবাইল ফোনে ক্ষণে ক্ষণে মেসেজ আসছে, তুমি কই ? আর কতক্ষন .... ইত্যাদি।
ছবি দেখা হয়নি তাই বুশরাকে আমার চেনার কথা না। টেলিফোনে আমাদের অনেক কথা হলেও সরাসরি সেই প্রথম দেখা। তবুও সে বলেছিলো, হলুদ ওড়না আর জিন্স পড়া থাকবে। এতোটুকু ইনফরমেশন নিয়ে স্টার্টফোর্ড স্টেশনে আসতে আসতে আমার ২৬ মিনিট দেরি হয়ে গেলো। বুশরার বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল, তার উপর মামাকে সঙ্গে নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, আর এতেই বুশরা চরম ক্ষেপে ছিল আমার উপর। রাত তখন ১১টা।
কাজের ব্যস্ততায়, সময়ের অভাবে শপিংএ যেতে পারছিলাম না। এদিকে কারি এ্যাওয়ার্ড ও চলে এসেছে। ওইদিন বুশরা শপিংয়ে গিয়েছিলো। কথায় কথায় বলেছিলাম, আমাকে প্লিজ একটা ডিনার সার্ট কিনে দাও, আমি অফিসের চাপে শপিংয়ে যেতে পারছিনা। ড্রেস কোড মেনটেইন না করলে আমাকে কারি এ্যাওয়ার্ডে ঢুকতে দেবে না।
আমি হন্তদন্ত হয়ে বুশরার সামনে পৌঁছতেই, আমাকে কথা বলার কোন সুযোগ না দিয়ে আমার হাতে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বুশরা। বলল, ১৪ সাইজের সার্ট জন লুইসে নেই, তাই ১৫ কিনতে হলো,আশাকরি তোমার হয়ে যাবে। এই বলে এক দৌড়; সেই যে গেলো, আজ পর্যন্ত দেখা করার কোন সুযোগ হয়নি।
বুশরা আমার কাছে এখনও সার্টের কেনার ৪০ পাউন্ড নেয়নি।
যাই হোক, গল্পের শুরুতে বুশরার আগমনের কারণ হলো আমার কারি এ্যাওয়ার্ডেসের প্রস্তুতিটা যে অনেক আগে থেকে সেটা বুঝাবার জন্যে।
কারি এ্যাওয়ার্ডয়ে যেতে হলে অবশ্যই ডিনার ড্রেস পড়তে হবে। সেই জন্য চাই কালো কোট আর বো টাই। কালো কোট আর বো টাই থাকলেও ডিনার সার্ট ছিলোন। বো টাই পড়ার জন্য এক ধরনের বিশেষ ডিনার সার্ট পাওয়া যায়। সার্টের কলারটা বিশেষ কায়দা করে বানানো হয় যেন টাইটা লাগানোর পর গলার সাথে আটকে থাকে। বাংলাদেশে এই টাই পড়া কাউকে দেখলেই আগে ভাবতাম চায়নিজ রেষ্টুরেন্টে কাজ করে বুঝি ? আর বিলেতে এসে দেখি পশ লোকজন ডিনারে বো টাই পড়ে।
নিজে কাক হয়ে একটু ময়ুরের পুচ্ছ ধারণের ব্যর্থ চেষ্টা করছি। যদিও ছবি তোলার পর দেখি আমাকে সেই চায়নিজ রেস্টুরেন্টের ওয়েটারের মতই লাগছে !
-----------------
১৯৩৬ সনে প্রথম বাঙালি রেস্টুরেন্ট হয় সেন্ট্রাল লণ্ডনের মার্লিবোন এলাকায়। তারপর পা পা করে বাঙালিদের আধিপত্য বাড়তে থাকে, কারি ইন্ডাস্ট্রির সফলতা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ব্রিটেনে। ব্রিটেনে বর্তমানে বাঙালি মালিকনাধীন রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ১২ হাজার। এসব রেস্টুরেন্টে কাজ করছে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশী।
চোঁখ ধাধানো একটা আয়োজন হলো এই ব্রিটিশ কারিএ্যাওয়াডর্স। সারা বছর ধরে যারা এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ব্রিটেনের খাদ্যাভাসে এনেছেন নতুন মাত্রা, যাদের জন্য আজ ব্রিটেনে চিকেন টিক্কা মাসালা হয়েছে ন্যশনাল ডিশ, সেই রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে সেরাদের হাতে উঠেছে সম্মাননা। তাদের কাছে এই এ্যাওয়ার্ড অস্কার সমতুল্য।
এ বারো হাজার রেস্টুরেন্টের মধ্য থেকে সেরা দশ রেস্টুরেন্টের মালিকদের হাতে পদক তুলে দেয়ার স্বপ্ন দেখেন এনাম আলী ২০০৫ সনে। লণ্ডনের সারে এলাকায় তার রেস্টুরেন্টের খাবার এতটাই সুস্বাদু যে ব্রিটিশরা সেই খাবার খায় প্লেনে চড়ে। এমন সুব্যবস্থাও আছে। চাইলেই যে কেউ ছোট একটা প্লেনে চড়ে দুপুরে লাঞ্চ সেরে আসতে পারবেন এনাম আলীর রেস্টুরেন্টে।
তিন বছর ধরে এনাম আলী ব্রিটেনে এই কারি এ্যাওয়ার্ড প্রচলন করেন। ৩০ হাজার নমিনেশনের মধ্য থেকে জুরিবোর্ড সেরা দশ রেস্টুরেন্টকে মনোনীত করেন। লণ্ডন ও সেন্ট্রাল লণ্ডন এলাকা থেকে লা পোর্টে ডি ইন্ডিজ, লণ্ডন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ব্রিলিয়ান্ট রেস্টুরেন্ট, সাউথ ইস্ট লণ্ডনের সেরা রেস্টুরেন্ট হিসাবে আজিজ রেস্টুরেন্ট, সাউথওয়েস্ট থেকে রাজপূত, ইস্ট মিডল্যাণ্ডস হতে মেমসাব, ওয়েস্ট মিডল্যাণ্ডস হতে লাসান, নর্থ ওয়েস্ট হতে দ্যা ভ্যালি, নর্থ ওয়েস্ট হতে ইন্ডিয়ান ওশান, স্কটল্যাণ্ড ও নর্দান আয়ারল্যাণ্ড হতে ব্রিটানিয়া স্পাইস ওয়েলস হতে বেঙ্গল ডায়নেষ্টি সেরা দশের পদক জিতে নিয়েছে।
সবচে' আনন্দের কথা হলো সেরা দশের সাতটাই বাঙালি মালিকানাধীন রেষ্টুরেন্ট।
ব্রিটেনে বাঙালিদের আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটিকে বলা হয়ে থাকে বর্ষসেরা আয়োজন। ব্রিটেনের বাঙালিরা বিচ্ছিন্ন, মেইনস্ট্রিমে অংশগ্রহণ নেই, এমন অনেক কথা প্রায়শ শুনতে হয়,কিন্তু কারি এ্যাওয়ার্ডের মতো আয়োজন দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় ! বাঙালিরাও চাইলে অনেক ভালো অনুষ্ঠান করে দেখাতে পারে।
হু ওয়ান্টস টু বি মিলিনিয়ার খ্যাত ক্রিস টরেন্ট যে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক থাকেন সেই অনুষ্ঠানে তার কথা শুনতে আর রসিকতা বুঝতে হলে সব সময় কান খাড়া করে রাখা চাই। এ অনুষ্ঠানেও তার ব্যতয় ঘটেনি। বলিউড ফিল্মের একদল ডানা কাটা পরী কিছুক্ষণ পর পর নৃত্যের মুর্চ্ছণায় যখন দর্শকদের ভাসিয়ে দেয়, তারই ফাকে ফাকে ক্রিস তার চমৎকার কৌতুকপূর্ণ কথা দিয়ে দর্শকদের হল রুমে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
যাদু শিল্পী শহীদ মালিক যখন তার সহ শিল্পী এরিনাকে নিয়ে মঞ্চে আসেন তখন দর্শকদের উৎসাহ আর থামে না। আমি মনে মনে ভাবি ... আহা জুয়েল আইচ এর চেয়ে কত ভালো যাদু জানে। জুয়েলকে ব্রিটেনের লোকেরা কতটুকু চেনে? এনাম আলী তো পারতেন জুয়েলকে তার অনুষ্ঠানে নিয়ে আসতে?
আগুন দিয়ে কাপড় পুড়িয়ে টুকরো কাপড় পুনরায় জোড়া দেয়া, আর বাক্স বন্দী এরিনাকে দুই ভাগ করে ফেলা আমাদের জুয়েল আইচের কাছে ছেলেখেলা। তাছাড়া আইচ এর হাসিতেই যেমন একটা যাদুর পরশ আছে তা শহীদ মালিকের মুখে নেই। তবুও শহিদ মালিকের যাদুর পরশে হল ভর্তি মানুষেল চক্ষু স্থির !!!
শেষ দৃশ্যে দিব্যা ডান্সারদের নৃত্য আর গ্র্যান্ড ফিনালে ছিলো সত্যিই তাক লাগানো। অনেকগুলো পতাকার মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা দেখে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলাম, খুব কাছে থেকে যে মেয়েটা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে নাচছিলো তার ছবি ক্যামেরা বন্দী করলাম।
একটু আক্ষেপ থেকে গেলো, একটাও বাংলা গান কিংবা নাচের সেগমেন্ট রাখেননি কোরিওগ্রাফার, পুরো অনুষ্ঠানের থিম মিউজিকই ছিলো হিন্দী ! আমাদের কি একটাও ভালো বাংলা গান নেই যার উপর টাইটেল মিউজিক করা যায় ?
খুঁতখুঁতে স্বভাবের আমি আবারও অনুষ্ঠানের খুঁত খুঁজতে বসেছি। খুব বেশি চাওয়া পাওয়া থাকে আমাদের। এতো সুন্দর একটা আয়োজনের দুই একটা ভুল বাদ দিলে পুরো অনুষ্ঠানের স্বার্থকতা এনাম আলীকে দিতেই হবে। তবে উনিকিন্তু বাংলাদেশের বন্যার্তদের জন্য একটা বড় অংকের সাহায্য যোগাড় করেছেন । প্রবাসে থেকে নিজের দেশের জন্য এতটুইবা কম কিসের ?
মন্তব্য
নেম ইজ আহমেদ, তানভীর আহমেদ
লেখা/ছবি ভালৈছে!
ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি তোমায়!
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
মজা লাগল। বাঙ্গালীরা এতদূর এসেছে ভাবতেই ভালো লাগে।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
অমিত ভাই,আপনের ঠেলায় লেখা হইলো আরকি, মাঝে মধ্যে একটু গুতা না খাইলে লিখতে ইচ্ছে করেনা।
-------------------------------------------
জল ভরো সুন্দরী কইন্যা, জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
কি সোন্দর সোন্দর ছবি!!
কি মাঝি? ডরাইলা?
সেরা দশগুলোর মালিকানা কোন দেশীয় অভিবাসীদের জানালে ভালো হতো ।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ছাত্রাবস্থায় ছুটিতে লন্ডন গিয়ে কয়েকবার কাজ করেছি কয়েকটি রেস্টুরেন্টে। বরাবরই আমার খটকা লেগেছে একটা ব্যাপারে: বাঙালি মালিকানাধীন এই রেস্টুরেন্টগুলোর নাম, ডিজাইন, মেন্যু - সব কিছুই ভারতীয় ঘরানার। আর পরিচিতিও 'ইন্ডিয়ান' রেস্টুরেন্ট হিসেবে। কিন্তু অধিকাংশ মালিক আর কর্মচারী প্রচণ্ড ভারতবিদ্বেষী! যদিও দিনে অন্তত একটি হিন্দি ছবি না দেখলে ভাত হজম হয় না তাদের অনেকের।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট বলার কারন হলো অধীকাংশ জনপ্রিয় রেষ্টুরেন্টগুলো হয়েছিলো ৭১ এর আগে। তাছাড়া রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা বাঙালি হলেও রান্নার যাবতীয় কাঁচামাল মসলাপাতি ও কোর্স সবকিছুই আসে ভারত থেকে।
যদিও দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের রেষ্টুরেন্ট মালিকরা এই বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট বলার প্রচারও করছে , অনেকে আবার সাহস পায়না পাছে দীর্ঘ দিনের পুরোনো কাষ্টমার হারায় এই ভয়ে।
তবে ব্রিটিশরা এখন জেনে গেছে বাঙালিরাই ব্রিটেনের কারি ব্যবাসার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
---------------------------------
জল ভরো সুন্দরী কইন্যা, জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট বলায় আমি কিন্তু আপত্তি করিনি। আমার আপত্তি এইসব রেস্টুরেন্ট সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ ব্যক্তির কৃতঘ্নতাসূচক ভারতবিদ্বেষে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
তবে আমার কাছে এমনটা চোখে পড়েনি!! আমি প্রায় শতাধীক ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে গিয়েছি........ কই ভারতীয় বিদ্বেষী ভাবতো চোখে পড়েনি!! বরং অধীকাংশ রেষ্টুরেন্টের নামের সাথে ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট জুড়ে দেয়া আছে। সেই সাথে অনেক ইন্ডিয়ান চিত্র কলাও চোখে পড়েছে।
আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা একটু খুলে বলবেন কি??
-----------------------------------
ভারত জল ভরো সুন্দরী কইন্যা, জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
আমি কিন্তু শুরুতেই লিখেছি, "বাঙালি মালিকানাধীন এই রেস্টুরেন্টগুলোর নাম, ডিজাইন, মেন্যু - সব কিছুই ভারতীয় ঘরানার। আর পরিচিতিও 'ইন্ডিয়ান' রেস্টুরেন্ট হিসেবে। " এ-ক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে আমার মতপার্থক্য নেই।
আমি পাঁচটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেছি। সাকুল্যে প্রায় আট মাস। থেকেছি অন্যান্য কর্মচারিদের সঙ্গে। মালিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিলো প্রতিদিনের। ফলে তাদের আমি দেখেছি, জেনেছি অনেক কাছ থেকে। তাদের জীবনযাত্রা ও জীবনদর্শন সম্পর্কে আমি মোটামুটি ওয়াকিবহাল ছিলাম। তাদের অধিকাংশের (সবার নয়) ভারতবিদ্বেষের কথাটি আমি তখনই জানি।
আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম, ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করে অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান হওয়ার মধ্যে যে-কন্ট্রাডিকশন আছে, সেটির কথা। রেস্টুরেন্টের নামে 'ইন্ডিয়ান' শব্দটির ব্যবহার, ভারতীয় চিত্রকলা সমৃদ্ধ ডেকোরেশন সম্ভব স্রেফ ব্যবসার খাতিরে । তা কারুর প্রো-ইন্ডিয়ান মনোভাব প্রকাশ করে, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
নতুন মন্তব্য করুন