শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন মন্ত্রিসভাকে দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমই চমক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আওয়ামী লীগ ও প্রধান কয়েকটি শরীক দলের প্রভাবশালী নেতাদের অনুপসি'তি আর নতুন মুখের আধিক্যই বোধ করি এমন বিবেচনার প্রধান কারণ। দিন বদলের স্বপ্ন দেখিয়ে মহাবিজয়ের সুবাতাস পাওয়া মহাজোট সরকারের চমকপূর্ণ এই মন্ত্রিসভাটি কার্যক্ষেত্রে কতোটা সফল হবে তা সময় বলবে। তবে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষিত হবার পর দেশের অনেক জেলার মানুষ যে সন'ষ্ট হননি, তা তাদের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
না, মন্ত্রিসভায় কারা ঠাঁই পেয়েছেন, কার্যত তারা কতোখানি দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অসন'ষ্ট এই মানুষগুলো মাথা ঘামাননি। বরং তাদের মাথা ঘামানোর বিষয় হলো, কারা মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেতে পারতেন, কিন' পাননি। আরো স্পষ্ট করে বললে, দেশের সেইসব অঞ্চলের মানুষই অসন'ষ্ট যাদের অঞ্চল থেকে নয়া সরকারের মন্ত্রিসভায় একজন সাংসদেরও স'ান হয়নি। শেখ হাসিনার চমক আর আঁটসাট মন্ত্রিসভার পূর্বঘোষণার প্রতিফলনের মধ্য দিয়েই এবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কেউ মন্ত্রী হতে পারেননি। আমাদের দেশে প্রচলিত লটবহরপূর্ণ ঢাউস আকারের মন্ত্রিসভা থেকে এর স্বাতন্ত্র আছে বৈকি। তবে সেই স্বাতন্ত্র মন্ত্রী বঞ্চিত এলাকার মানুষ সহাস্যে গ্রহণ করছেন না।
মোটা দাগে যদি মন্ত্রীত্ব না পাবার অসনে-াষগুলোকে শ্রেণীবদ্ধ করার চেষ্টা চলে, তাহলে দেখা যায়, একেক অঞ্চলে মন্ত্রীত্ব কাঙ্ক্ষিত ছিলো একেক কারণে। কোনো জেলায় এমন কোনো সরকারই হয়নি, যেখানে তাদের সাংসদ মন্ত্রী হননি। এবার তারা প্রথমবারের মতো মন্ত্রীত্ব নিয়ে হাপিত্যেশ করতে গিয়ে হতাশ। কোনো জেলায় জীবনে আওয়ামী লীগ বা তার মিত্রস'ানীয় কোনো দলের প্রার্থীর জয় হয়নি। এবার জেলার সব আসনেই হয়েছে। কিন' তারপরেও মন্ত্রীত্ব না পেয়ে হতাশা বেড়েছে। আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের শরীক দলের নামডাকওয়ালা বড় নেতারা কোনো জেলায় ছিলেন। সাংসদ নির্বাচিত হবার পর তারা মন্ত্রীত্ব পাবেন না, এমনটা এলাকার মানুষ কখনো কল্পনাই করেননি। কিন' বাস-বে তা ঘটেছে বলে মানুষ হতাশ হয়েছে। এছাড়া অঞ্চল ভেদে মন্ত্রীর সংখ্যা নিয়েও হতাশা রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ গঠনের পর থেকেই অসন'ষ্ট মানুষের প্রতিক্রিয়ায় একটি বিষয় স্পষ্ট, তারা মনে করেন, জেলায় অন-তঃ একজন মন্ত্রী না থাকলে এলাকার উন্নয়ন হয় না। যে এলাকার মানুষ যার মন্ত্রীত্ব না পাবার জন্যই আক্ষেপ করুক না কেনো, তাদের সবার চিন-াধারায় এই উন্নয়নজনিত কারণটি অভিন্ন।
মন্ত্রী হলে উন্নয়ন হবে বলে সাধারণ মানুষ যে ধারনাটি পোষণ করে, তা কিন' এমনিতেই তাদের ভেতর গেড়ে বসেনি। আমাদের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে যে সংস্কৃতি বিদ্যমান, তারা সেখান থেকেই অভিজ্ঞতার আলোকে এই ধারনা অর্জন করেছে। অতীতের সবগুলো সরকারের আমলেই দেখা গেছে, একজন মন্ত্রী তার নিজের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন নিয়ে যতোটুকু ভাবেন তার তুলনায় কমই ভাবেন সারা দেশ নিয়ে। একজন সাংসদ নিজের এলাকায় এখানে ওখানে সবখানে যেভাবে মাথা ভরে দেন, তার চেয়ে খুব কমই গুরুত্ব দিয়ে দেখেন আইন প্রণয়ন সংক্রান- তার নিজের দায়িত্বটিকে। ফলে সাংসদ হলে হয়ে যান এলাকার দন্ডমুন্ডের কর্তা। মন্ত্রী হলে তো কথাই নেই। হয়ে যান উন্নয়নের প্রাণপাখি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এলাকায় মন্ত্রী চান। সে আকাঙ্ক্ষা কারো রাজনৈতিক উত্তরণের প্রশ্নে নয়, সে আকাঙ্ক্ষা নিজের এলাকার তথাকথিত উন্নয়নটি সুনিশ্চিত করার জন্য। কারণ আমাদের দেশে এখনো উন্নয়ন মানে রাস-াঘাট, ইমারত, ত্রাণ আর তদবির। আর সেইসব উন্নয়নের সবকিছুতেই আমাদের মন্ত্রী আর সাংসদদের জয় জয়কার! যদিও বিশালাকার মন্ত্রিসভা কোন জনমে এলাকার কতোখানি টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে পেরেছে, তার হিসাবটা কখনোই কষা হয় না।
তো, এমনধারা সংস্কৃতি যেখানে বিদ্যমান সেখানে সাধারণ মানুষ নিজেদের অঞ্চল থেকে মন্ত্রী না পেয়ে অসন'ষ্ট হবেন- এটাই স্বাভাবিক। শেখ হাসিনার নয়া মন্ত্রিসভা অন্য যতো কারণেই প্রশংসার দাবিদার হোক না কেনো, মন্ত্রীবঞ্চিত এলাকার মানুষদের তাতে কিছুই যায় আসে না। এবং এখানেই পরীক্ষার বিষয়টি রয়েছে। মন্ত্রী আর সাংসদরাই এলাকার উন্নয়নের মূল শক্তি বলে জনগণের মধ্যে যে ধারনার জন্ম হয়েছে তা ভাঙতে হবে। যুগ যুগ ধরে তেলাপোকার মতো টিকে থাকা তৃণমূল মানুষদের নাড়ির খবর জানা সেই ইউনিয়ন পরিষদ সমেত স'ানীয় সরকার ব্যবস'া যে স'ানীয় উন্নয়নে মূল ভূমিকা পালন করে, সেই আস'াটিও জনগণের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সুষম উন্নয়নের যে ধারনা তার বাস-ব প্রয়োগ ঘটাতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনা হতে হবে স'ানীয় সরকার কেন্দ্রীক, সামাজিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবং অবশ্যই তা মন্ত্রী সাংসদদের অযাচিত হস-ক্ষেপের বাইরে। মন্ত্রী এবং সাংসদরা স'ানীয় সরকারের ওপর যে খবরদারি ফলান বলে আমরা অতীতে দেখেছি, সেই খবরদারি যদি অবশিষ্ট থেকেই যায়, তাহলে সব পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ সুষম উন্নয়ন না হলে মন্ত্রীত্ব নিয়ে অসনে-াষ উন্নয়ন বঞ্চনার কারণে আরো প্রকট হয়ে উঠবে।
বলাই বাহুল্য, কাজটি মোটেই সহজ হবে না। কারণ ইতিমধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নবঞ্চিত যেসব এলাকা রয়েছে সেগুলোর মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন মন্ত্রী না দেয়ার কারণেই তাদের উন্নয়ন এ দফা আর হলো না। এই ভাবনায় হাওয়া দেয়ার মতো প্রভূত উপলক্ষ্য এবং কর্মতৎপরতা ভবিষ্যতে নানা দিক থেকে হাজির হওয়া বিচিত্র নয়। এখানে মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে, দেশের উত্তর এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ নিজেদেরকে অন্য এলাকার মানুষদের তুলনায় অনেক বঞ্চিত বলে মনে করেন দীর্ঘদিন ধরেই। সুষম উন্নয়ন না হওয়া এবং এই অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলার কোনো কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া মানুষকে এই ভাবনায় তাড়িত করছে। এই তাড়না তলে তলে বহুদূর এগিয়েছে। এর প্রমাণ মেলে ইদানিংকালে এ অঞ্চলের মানুষের নানা কথাবার্তায়। সদ্য সাবেক প্রধান উপদেষ্টা গত বছর যখন রাজশাহীতে আঞ্চলিক সংলাপে এসেছিলেন, তখন এ অঞ্চলের বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠককে তার সামনে বলতে শোনা গেছে, ‘যমুনার এপার আর ওপারের মধ্যে যুগ যুগ ধরে যে বৈষম্য চলছে, তা নিরসন না হলে এ অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ এরপর অক্টোবর মাসে রাজশাহীতে জ্বালানি নিরাপত্তা ও উন্নয়ন বিষয়ক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. ম তামিম সেই সেমিনারে হাজির ছিলেন। সেমিনারটির বিশেষ যে দিকটি ছিলো তা হলো, এখানে রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা সিটির ৩ মেয়র উপসি'ত ছিলেন। তারা সেদিন সম্মিলিত ঘোষণা দেন, উত্তর বা দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল নয়, এখন থেকে উন্নয়ন বঞ্চিত যমুনার এপারের এই অঞ্চলটিকে তারা একসঙ্গে পশ্চিমাঞ্চল হিসেবে আখ্যায়িত করবেন এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে একযোগে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলবেন। সেদিনের সেমিনারে এই ৩ বিভাগের অনেকেই বর্ক্তৃতা করেছেন। সেমিনারটিতে ফুলবাড়ি কয়লাখনির কয়লা উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে তোলার জন্য কাউকে কাউকে ওকালতি করতেও দেখা গেছে। তবে মোটের ওপর বক্তাদের সবাইকে একসুরে বলতে শোনা গেছে, যমুনার এপার-ওপারের বৈষম্য স্বাধীনতাপূর্ব দুই পাকিস-ানের বৈষম্যকেও হার মানিয়েছে। তারা এথেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজনে কঠোর পথে যাবেন বলেও সেদিনই হুমকি দিয়ে রেখেছেন।
রাজশাহীসহ এ অঞ্চলের বেশ ক’টি জেলা থেকে একজনকেও মন্ত্রীত্ব না দেয়া, বরিশাল এবং খুলনা বিভাগ থেকে কম সংখ্যক মন্ত্রী হবার খবরে অসন'ষ্ট মানুষের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সেদিনের সেই হুমকি যদি যোগ হয়, তাহলে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে বৈকি। এর সঙ্গে নানা উদ্দেশ্য হাসিলের রাজনীতি যুক্ত হলে বিপদ বাড়বে। অথচ নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে মহাজোট স্ববিরোধী কাজই করতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। একদিকে তারা মন্ত্রিত্ব প্রসঙ্গে পুরনো ধারায় যায় নি। অন্যদিকে তারা ঠিকই স্থানীয় সরকারকে কীভাবে সাংসদদের খবরদারির মধ্যে রাখা যায়, সেই চিন্তা শুরু করেছে। কাজেই এখানে আঞ্চলিক স্বার্থ প্রসঙ্গে মানুষকে উস্কে দেয়া খুব কঠিন কিছু হবে না কারো জন্যই। আর কে না জানে, অপরিণত আঞ্চলিক ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছদ্মবেশে অনেকেরই স্বার্থ উদ্ধারে পারঙ্গম।
মন্তব্য
ভাল লাগলো ...... চমৎকার বিশ্লেষণ
শিবলী ভাই, আপনার বিশ্লেষণ ভাল লাগল। ঢাকা-কেন্দ্রিক বাংলাদেশে ঢাকার সাথে অন্য সব অঞ্চলের বৈষম্য যেমন বাড়ছে, সেটা পশ্চিমে গিয়ে আরো প্রকট পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্যের রূপ নিয়েছে। এই বৈষম্য অল্পদিনের না। এরই মধ্যে এর গভীরতা অনেক বেড়েছে।
খেয়াল করলে দেখবেন নিকট-ইতিহাসের বেশ কিছু তৃণমূল আন্দোলন পশ্চিমাঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে। বাম-চরমপন্থী রাজনীতির বিকাশও ঐ অঞ্চলেই বেশি। সেটার কারণ আছে নিশ্চই।
এই বৈষম্যের দিকে নজর না দিয়ে ঢাকার উত্কট মেদস্ফীতি আর কতদিন চলবে কে জানে?
পরিনতিই বলে দিবে উদ্দেশ্য আর পন্থা ভুল কিংবা সঠিক ছিল
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
নতুন মন্তব্য করুন