সিনেমা দেখে, চ্যাট করে এবং তারপর বই পড়ে রোজই ঘুমাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। অনিবার্য ফল হিসেবে ঘুম থেকে প্রায়ই উঠি সকাল দশটা-এগারোটার দিকে। আজও সকাল বেলা এমন জম্পেশ ঘুম দিচ্ছি, হঠাৎ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে মনে হলো আমার পাশের রুমে কেউ কাঁদছে। ঘুমের ঘোরে ভুল শুনেছি ভেবে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সাড়ে দশটায় তারেকের ফোন পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। দাঁত ব্রাশ করতে করতে শুনি মা যেন বাবার সাথে নিচু গলায় কী এক ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে, গলায় হতাশার সুর। তখনো ঘুমের রেশ পুরোপুরি, তাই আর জিজ্ঞেস করা হয় নি। কিছুক্ষণ পর খেতে দেওয়ার সময় মা'র কাছে জানতে চাইলাম কী হয়েছে।
আমাদের বাসায় একজন ভদ্রমহিলা কাজ করতে আসেন। আশে পাশের আরো কয়েক বাসাতেই তিনি কাজ করেন, যাকে চলতি বাংলায় বলে ছুটা বুয়া। যাই হোক, এই ভদ্রমহিলাকে আমরা সবাই খালা নামেই ডাকি। এমনিতেই আমাদের বাসায় এ ধরনের নিত্যদিনের গৃহসহায়িকাদের সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করা হয়, তার উপর আমার মা আবার এদের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। মাঝে মাঝে অবশ্য এই সহানুভূতির মাশুলও গুনতে হয়েছে মা'কে - সে কথা অবশ্য আলাদা।
তা যাই হোক, মা'র কাছে শুনতে পেলাম খালার ছোট মেয়ের স্বামী কিছুদিন আগে তাকে ফেলে চলে গিয়েছে। এরপরই সে মেয়ে আবিষ্কার করে যে তার স্বামী শুধু তাকে দুই শিশু সন্তানসহই ফেলে যায় নি, সেই সাথে আশে পাশের প্রতিবেশী এবং সমিতির কাছে এক বিশাল ঋণের জালেও ফাঁসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। টাকার অংকটা ঠিক কতো তা খালাও মা'কে বলতে পারে নি, তবে অংকটা যে সামর্থ্যের বাইরে তা অনুমান করতে পারছি। এ'দিকে খালার ছেলেরা, যাদের সাথে খালা থাকেন, তারা তাদের এই বোনকে কোনরকম সাহায্য করতে অস্বীকার করেছে (অবশ্য তাদের সামর্থ্যও সম্ভবত নেই) এবং একই সাথে তাদের বাসায় পর্যন্ত উঠতে দিচ্ছে না। মেয়ের এই দুরবস্থার কথাই খালা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলো।
এমনই অসম্ভব অবস্থায় খালার মেয়ে টাকা বের করার এক রাস্তা বের করে ফেলেছে- সে তার দুই ছেলেকে বিক্রি করে দিয়ে ধারের টাকা শোধ করবে।
সত্যি সত্যি কথাটা শোনা মাত্র বিষম খেয়ে গেলাম আমি। নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কতো সহজেই কেউ নিজের সন্তানকে বিক্রির কথা চিন্তা করতে পারে! আমি খুব দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি, আমার মা'র কাছে আমি ঠিক যতোটা প্রিয়, আদরের, ভালোবাসার ঠিক ততোটাই সেই মায়ের কাছে তার ছোট্ট বাচ্চা দুটি। আমি তখন শুধু ভাবছিলাম ঠিক কতোটা অসহায় হলে মানুষ এতো কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমার মুখ দিয়ে আর খাওয়া উঠছিলো না। আমার এই হতবাক অবস্থা দেখে আমার বাবা মলিন একটা হাসি দিয়ে জানালো, তৃনমূল মানুষকে বহুদিন ধরে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে যে, বাচ্চা বিক্রি একটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা এদের জন্য, পেটের দায়ে অনেকেই করে।
আজ সারাটা দিন যখনই কথাটা মনে পড়েছে খুব অসহায় লেগেছে। আমি জানি না ধার দেনার পরিমাণটা ঠিক কতো... আমাদের সাধ্যে কুলোলে হয়তো আমরা ঠেকাতে পারবো। সাধ্যে না কুলালে ঠিক কী হতে পারে ভাবতে চাই না...
রাতের বেলা রিকশায় আসতে আসতে ভাবছিলাম, এরকম কতো মা হয়তো নিরুপায় হয়ে বাধ্য হয় তার আদরের ধন সন্তানটাকে বিক্রি করে দিতে। আমাদের এমন বিচ্ছিন্ন সাহায্যে আর ক'টা মাকেই বা আর আমরা এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারি।
নিজের অসহায়ত্বে একেক সময় নিষ্ফল আক্রোশ ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না আমার...
মন্তব্য
...
খুব অস্থির লাগছিলো, এক বসায় কোনমতে উগড়ে দিলাম সারাদিন ধরে বয়া চলা অস্থিরতাটুকু।
লেখাটা হয়তো আরো একটু চিন্তাভাবনা করে আরো উন্নত শিল্পমানের করে তোলা যেত, কিন্তু আমার আর হাত উঠলো না। সে জন্য দুঃখিত।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
হুম
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
দুঃখজনক। একই সাথে অস্কার পাওয়া "স্লাম ডগ মিলিওনেয়ার" ছবির শিশু অভিনেত্রীর কথা মনে পড়ে গেল।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
আমার মনে হয় মেয়েটির প্রয়োজন আইনী সহায়তা। প্রতারক স্বামীটির করা ঋণ পরিশোধ করার জন্যে সে বাধ্য কি না, সে প্রশ্নটাই আমার মনে জাগছে। প্রতিবেশী ও সমিতির লোকজন কেন পলাতক স্বামীটির নামে মামলা না করে অসহায় ও দরিদ্র মেয়েটিকে নিঙড়ে টাকা নিচ্ছে, সেটি আমার কাছে অস্পষ্ট নয়, কিন্তু দায়ী লোকটিকে ভুক্তভোগী করা উচিত বলে বারবার মনে হচ্ছে।
হিমু ভাই, একদমই আমার মনের কথাটা বলেছেন।
আমি সকালবেলা শুনে একদম এ কথাটাই বলেছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে আইন খুব একটা ভরসা করার মত জায়গায় নেই। আমার আশংকা হচ্ছে এই আইনী জটিলতায় যেতে ওরা সাহস পায় না কি, আর এই ডামাডোলে না বাচ্চাটাই বিক্রি হয়ে যায়।
তাই আইনী দিকটা নিয়ে ভাবার এই মুহূর্তে সুযোগ পাচ্ছি না। তবে বাংলাদেশের একটি প্রখ্যাত আইনী সহায়তা দানকারী এবং মানবাধিকার সংস্থার সাথে আমার কিছুটা যোগাযোগ আছে। আমি তাদেরকে জানানোর ব্যাপারে মনস্থ করেছি আজ সকালবেলাতেই।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
প্রথমেই তাহলে একটা জিডি করতে হবে থানায় গিয়ে । যথেষ্ট বলা হয়েছে ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
তেঁজগা থানায় "ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে" যোগাযোগ করে দেখুন।
অমানবিক!
আইন ও সালিশ কেন্দ্র ধরায়ে দেন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
কোন উপদেশ জানা নেই। বাংলাদেশে এরকম ঘটনা বিরল না। আইনী প্রক্রিয়ায় গিয়ে কোন সমাধান হবে না বাড়তি জটিলতা ছাড়া। ক্ষমতাহীনদের জন্য কোন আইন নেই এদেশে।
সন্তান বিক্রি করে যতটা পাওয়া যাবে সেই টাকাটা যোগাড় করে মহিলার হাতে দেয়াটাই উত্তম এবং সেটাই সহজ সমাধান। মানুষের দাম খুব কম এদেশে। দুটো বাচ্চার দাম কতই বা হবে!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আহ, কি দুঃখজনক! তবে নীড় ভাইয়ের কথাটাই বাস্তব, জীবন এখানে বড়ই সস্তা। তবু যদি সবজান্তা ভাই কিছু করতে পারেন...
তিনটা আইডিয়াই পছন্দ হলো, সেগুলো ট্রাই করে দেখেন সামর্থ্য অনুযায়ী।
আর আপনাকে অনেক শুভ কামনা করছি। 'অনেক ঘটনা ঘটছে' আর 'আমি একটা ঘটনা নিজের চোখে দেখেছি' এ দুয়ের মাঝে ফাঁরাক কিন্তু আকাশ পাতালের; আপনার প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক এবং উপকারী।
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
হায়রে ! .........
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
- আরেফীন ভাইয়ের আইডিয়াটার কথা আমারও। লেখার বিষয়ে বলার ভাষা নেই, সাহসও না।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপডেট করেন, যদি সম্ভব হয়। তবে সন্তান বিক্রি করে টাকা পরিশোধের দায় ও মহিলার হবেনা কখনোই। অবশ্যই আইনের দ্বারস্থ হতে হবে।
একখন্ড জীবন্ত মাংসপিন্ড
জুয়েইরিযাহ মউ
এমন কিছু ঘটনা হয়ত আমাদের ভেতরটাকে ফাঁকা করে দেয় নিমেষে। হাহাকার ওঠে হৃদয়ের অন্তস্থলে। একখন্ড জীবন্ত মাংসপিন্ড যে কত সুখ নিয়ে আসে! তা এক বিস্ময়কর অনুভব। অথচ যখন কাঠখোট্টা বাস্তবতার পেষণে সন্তানকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার মতো এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন মা-বাবাকে তখন বলতেই হয় "ধরণী, দ্বিধা হয়!"
এরকম ঘটনা আমি অনেকবার ঘটতে দেখেছি। আমার পরিচিত তিনটি পরিবার এমন তিনটি শিশুর প্রতিপালন করছেন। অন্তর্দৃষ্টিতে ধরা দেয় এমন ঘটনার তিনটি ভিন্ন দৃশ্যপট :
একদিকে দরিদ্র পরিবারে অনাহার,অপুষ্টির অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যত ফেলে এসে নিঃসন্তান দম্পতির কোল আলো করে আছে ফুটফুটে মুখ। বেড়ে ওঠছে মায়া-মমতা আর স্বপ্নিল ভবিষ্যতকে আশ্রয় করে।
অন্যদিকে গন্ডা-গন্ডা সন্তানের মুখে ভাত দিতে না পেরে একটি সন্তানকে বিক্রি করার কষ্ট বুকে নিয়ে বেঁচে থাকবে প্রকৃত জন্মদাতাদের আকুল প্রাণ।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে এসন ঘটনার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়, রোধ করা একান্ত প্রয়োজন। এ ঘটনার প্রধান কারন শ্রেণীগত দারিদ্রসীমা।
কোন মানবাধিকার সংস্থার দ্বারস্থ হলে উল্লিখিত সমস্যার সমাধান হবে হয়ত।
নতুন মন্তব্য করুন