গতকাল রাতে ঘুমাতে যাবো, এমন সময় ফেসবুক চ্যাটে নক করে আমার বোন জানালো, ঋতুপর্ণ আর নেই!
নেই! - কিছু কিছু শব্দকে অনেক বেশি ভারি মনে হয়। ছোট্ট একটা শব্দ, 'নেই'- আমার মনে হলো পায়ের নিচ মাটি থেকে সরে গেলো। ঋতুপর্ণ ঘোষ কেন চলে যাবেন? তার চেহারাতে কোনোদিন বার্ধক্যের ছাপ দেখিনি- অথচ তিনি নিঃশব্দে চলে গেলেন।
শব্দের যেমন শক্তি আছে, তেমনি ব্যবহার প্রাচুর্যে বিশিষ্টতা হারায় কিছু বাক্য। যেমন, ঋতুপর্ণের মৃত্যুতে অনেকেই বলছেন, এই ক্ষতি অপূরণীয়। এ আর এমন কী- বিখ্যাত যে কারো মৃত্যুতেই একথা আমরা হরদম শুনতে পাই। প্রতিটা মানুষের মৃত্যুতেই যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা সবসময়ই অপূরণীয়। আমরা শুধু ভুলে থাকি বা ভুলে থাকতে চাই, তাই শূন্যতাটুকু চোখের আড়ালেই থেকে যায়। কিন্তু ঋতুপর্ণ তো তেমন মানুষ নন। তার মৃত্যুতে যে শূন্যতা, যে ক্ষতি সিনেমার হলো, তা প্রকাশ করা শব্দের অতীত। দিস্তা দিস্তা কাগজ ক্ষয় করেও সে শূন্যতাকে ফুটিয়ে তোলার সাধ্য আমার কলমের নেই।
সিনেমার দর্শক আমি খুব বেশি দিন না। সত্যিকারের 'ভালো' সিনেমা দেখতে শুরু করেছি বেশ পরে, সেগুলিও ইংরেজিতে। সেসময় সমকালীন বাংলা সিনেমা নিয়ে আমার ভেতরে বেশ তুচ্ছতাচ্ছিল্য ছিলো। দেখার মধ্যে ঋত্বিক ঘটক আর সত্যজিত। সে জায়গাটা থেকে একটানে আমাকে অনেক দূর সরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ঋতুপর্ণ! মুগ্ধ হয়েছিলাম সিনেমা বানানোর শৈলীতে। সত্যজিতের পর অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ঋতুপর্ণ! তার সিনেমা সম্পর্কে আমার একটিমাত্র বিশেষণকে সবচে যুতসই মনে হয়- সাবলীল। কোথাও তার গল্প বলা আটকায় না। খুব গূঢ়, জটিল ছবিগুলিকেও এঁকেছেন প্রাঞ্জলভাবে। বোধ করি, এই জন্যেই তার দর্শকগোষ্ঠীতে সবাই আছেন- চশমা নামিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকানো সিনেমাবোদ্ধা থেকে শুরু করে অতি সাধারণ দর্শক। ঋতুপর্ণ সবার জন্যই সিনেমা বানিয়েছেন- যে যার মতো করে তার অংশটুকু বুঝে নিয়েছেন।
সিনেমা খুব শক্তিশালী একটি মাধ্যম, একটি পরিপূর্ণ শিল্প। সিনের পর সিন জোড়া দিয়ে সিনেমা হয় না। একজন পরিচালক, একজন চিত্রনাট্যকারের যথেষ্ট পড়ালেখা করতে হয়, থাকতে হয় মেধা এবং শিল্পের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা। সস্তায় বাজিমাত করতে চাওয়ার এ যুগে ঋতুপর্ণের মতো পরিচালক তাই বিরল। তার পরিচালিত সিনেমা, তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট হয়ে উঠে- হুট করে, একদিনেই তিনি 'ঋতুপর্ণ' হননি। গভীর পড়াশোনা, নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট এবং সিনেমার প্রতি অসম্ভব ভালোবাসাই তাকে ঋতুপর্ণ করে তুলেছে। শুধু সময়ই জানে, তার মাপের আরেকজন পরিচালকের জন্য বাংলা সিনেমাকে আরো কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে!
মৃত্যু অমোঘ। ঋতুপর্ণ প্রকৃতির নিয়ম মেনেই চলে গেলেন। শুধু আফসোস- আরো অনেক কিছু দেওয়ার ছিলো তার। কোনো পরিচালকই যে চরিত্রের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি, সেই ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়েও কাজ শুরু করেছিলেন শুনে খুব আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম- সেই অপেক্ষা অনন্তের দিকেই ধাবিত হলো। জীবনের শেষদিককার ছবিগুলিতেই তিনি আরো অনেক বেশি এক্সপেরিমেন্টাল হয়ে উঠছিলেন। বয়োঃসন্ধিতে আটকে থাকা বাংলা সিনেমা হয়তো তার সবকিছু সহজভাবে নিতে পারেনি, তবে তিনি দমে যাননি- ক্রমাগত ভেঙ্গেছেন সবকিছু। মহাভারত থেকে রবীন্দ্রনাথ- নিজের ভাবনার আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন সবকিছু নিয়েই।
ঋতুপর্ণ এতো বিশাল, আমাদের এই সময়ের উপর তার প্রভাব এতো বিশাল যে, তার সবটুকু এই লেখার পরিসরে ধারণ করা অসম্ভব। তার রবীন্দ্রভাবনা, তার পড়াশোনার বিশাল গণ্ডী, নিজের লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে তার দৃঢ় অবস্থান- সব কিছু নিয়েই আলাদাভাবে লেখা সম্ভব। তার বিদায়ের এই শূন্যতা হৃদয়ে বাজবে আরো বহুদিন।
নিরীশ্বর এই আমি পরকালে আস্থা রাখি না- মৃত্যুর পর তিনি ভালো থাকবেন, এই শুভকামনা তাই জানাই না। অনেক আগে এক বন্ধুর মুখে একটা কথা শুনে ভালো লেগেছিলো- 'মানুষ বেঁচে থাকে স্মৃতিতে'। আমাদের স্মৃতির মধ্য দিয়েই ঋতুপর্ণ ভাস্বর থাকুন সহস্র বছর, তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই ফিনিক্সের মতো জেগে উঠুক তার লালিত শিল্পবোধ, চেতনা।
আপনাকে অনেক মিস করবো ঋতুপর্ণ, বিদায়!
মন্তব্য
হ্যাঁ, মানুষ বেঁচে থাকে স্মৃতিতে। তাই ঋতুপর্ণ বেঁচে থাকবেন অনেক, অনেক বছর।
লেখা ভাল লাগল। লেখার সাথে পুরাই একমত।
সত্যি এরকম একজন মানুষের চলে যাওয়া মনটাকে ভারি করে দেয়।
আপনার পোষ্টটার জন্যে ধন্যবাদ।
আমিও চেষ্টা করছি, একটু বিস্তারিত কিছু লেখার।
ঋতুপর্ণের জন্যে
তার বিদায় সুস্থ ও ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণে এক বড় শূন্যতা। কাল শুনে মনটা বিসন্নতায় ছেয়ে গেছে। আসলেই তাকে অনেক মিস করবো।
facebook
খবরটা কাল সকালে শোনার পর বিশ্বাসই হতে চাচ্ছিল না। চারপাশে আজকাল এত এত খারাপ সংবাদ। অনুভূতি সব ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ঋতুপর্ণকে আসলেই অনেক মিস করছি, করব। আরও অনেক কিছু পাওয়ার কথা ছিল তার কাছ থেকে।
ঋতুপর্ণ কিন্তু ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে সত্যান্বেষীর কাজ শেষ করে গেছেন। এ বছরই মুক্তি পাবে আশা করা যায়।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।
শেষদিনের শুটিং ও হয়ে গেছে।
শুধু পোষ্ট প্রোডাকশনের কাজ বাকি।
খবরটা শুনে ভালো লাগলো। তার মৃত্যুসংবাদটা পাওয়ার পরই যেনো কোন একটা পত্রিকাতে পড়লাম, ব্যোমকেশ বক্সী তার অসমাপ্ত কাজ। শুনে মনটা খারাপ হয়েছিলো। অবশ্য পোস্ট প্রোডাকশন যেহেতু হয়নি, সে অর্থে অসমাপ্তই বটে।
অলমিতি বিস্তারেণ
সদ্যই জানতে পারছি যে উনি নাকি উনার চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় ফেজ এ প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। বন্ধুমহলে প্রায়ই অভিযোগ করতাম উনি উনার প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেন নি খেলা, সব চরিত্র কাল্পনিক এবং দি লাস্ট লেয়ার সিনেমায়। উনি নিজের সৃষ্টি করা টাইপ একটি শিল্পকলার মধ্যে থেকে বের হতে পারছেন না। তিনি নিজেকে ভাঙ্গেন না, গড়েন না। কেমন নিজের ঘেরাটোপে বন্দী এক সৃষ্টিশীল মানুষ। তাই আজ তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর এই দ্বিতীয় ফেজ এ প্রবেশের আকাংখা হাহাকারকে যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। শেষ জীবনে তিনি নাকি বন্ধু বিহীন হয়ে পড়েছিলেন। একাকী থাকতেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের যেন শুন্য করে দিয়ে গেল। আর তিনি এমন একজন পরিচালক জীবদ্দশায় যাকে নিয়ে তেমন আলোচনাই হল না কোথাও, হলনা কাটাছেঁড়া, হলনা বিশ্লেষণ। অথচ হাল আমলের বাংলা সিনেমার মধ্যে তাঁর চলচ্চিত্রই সবচাইতে বেশী আলোচনার দাবী রাখে বলে মনে করি।
ঋতুপর্ণ ভীষণভাবে এক্সপেরিমেন্টাল একজন মানুষ ছিলেন, তার কাজেই সে প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি রবীন্দ্রসংগীতের বিশাল ভক্ত হলেও, তাতে এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারে কোনো ছুৎমার্গ পুষতেন না। সম্ভবত তার 'উৎসব' সিনেমাটিতে এমন একটা ডায়লগও আছে।
নিজেকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে চূর্ণ বিচূর্ণ না করা পর্যন্ত শিল্পের উৎকর্ষে পৌছানো মুশকিল। চারপাশের অনেককেই দেখেছি ঋতুপর্ণের এই ট্রানজিশন তারা সহজভাবে নিতে পারেননি। তবে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম তার আরো এক্সপেরিমেন্ট দেখবার। আফসোস, সেই সুযোগ দিলেন না।
অলমিতি বিস্তারেণ
ঋতুপর্ণকে মিস না করে উপায় নাই
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
যারা পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন, সবাইকে ধন্যবাদ
অলমিতি বিস্তারেণ
নতুন মন্তব্য করুন