আমি তখন অনেক ছোট। স্কুলে পড়ি কি পড়ি না আমি ঠিক জানি না। একদিন খুব সকালে মা আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলল। তারপর আমার ইজেরে হাত দিয়ে পরখ করে দেখল আমি হিসি করেছি কিনা। মার মুখটা বরাবরের মতোই গম্ভীর হয়ে গেল। তারমানে আমার মাজায় কালো সূতা দিয়ে বাঁধা তাবিজটা কোনও কাজ করছে না। অথচ এই তাবিজটা মাকে প্রায় জোর করে ধরিয়ে দিয়েছিল আমার নানী হায়েতুন্নেসা। তার ধারণা ছিল, এতে আমার বিছানায় মূত্রত্যাগের রোগ চিরতরে সেরে যাবে। কিন্তু কিসের কি..আমি বিছানায় রাতের পর রাত মুতেই চলেছি। হায়েতুন্নেসা আমার রাগ কমার চিকিৎসাও দিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, মুরগির গু মানুষের গু আর সব নানা হাবিজাবি আবর্জনামাখা সেই জলচিকিৎসা আমার কোনও কাজেই আসেনি।
বাবা আমার রাগ দেখে নিজে রেগেমেগে মারধোর শুরু করতো। কিন্তু বাবাকে মা মারতে দিতো না। বাবার সেসব মারের প্রায় সবটাই মার পিঠে পড়তো। তাই আমি বেঁচে যেতাম এবং রাতের বেলা পরীরা যখন আসতো..আমি তখন সব ভুলে ওদের সাথে খেলতে যেতাম। ওরা কত শত সব অজানা দেশে নিয়ে যেত আমায়। রাক্ষস খোক্কসেরা রাজকুমারীরাও আমাদের সাথে খেলতে আসতো। খেলাধুলা শেষে তারা সারি বেঁধে সিসি করতে বসতো। আমিও তাদের দেখাদেখি বসে পড়তাম, সিসিতে।
মা আমাকে কোলে তুলে নেয় এক হাতে। আরেক হাতে এক টানে আমার টেট্রনের কুচিপড়া ইজেরটা খুলে ফেলে। আমার নুন্টুশ ফুলে ফেপে থাকে। কারণ আমি রাতের বেলা রাজকুমারীদের সাথে ছিলাম। মা আমাকে কাঁধে তুলে নেয় আর হাঁটতে থাকে। আমি মার কাঁধে শুয়ে ঘুমাতে থাকি। মা আমাকে বেশিক্ষণ ঘুমাতে দেয় না।
ইন্দিরা পাড়ে এসে ভেজা ইটের উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি ঢুলতে ঢুলতে পড়ে যেতে চাই, কিন্তু পড়ে যেতে পারি না। সতর্ক হই, পড়ে গিয়ে মাথা ফাটতে পারে বলে। তাই আমি ন্যাটা দিয়ে বসে পড়ি। আর মাকে দেখতে থাকি।
মা ইন্দিরার দড়িতে বালতি বাঁধে। তারপর ঝুপ করে তা ফেলে দেয় অনেক গহীনে। দূর থেকে ঝপ কিংবা ধুপ করে একটা শব্দ ভেসে। আমার কানে এসে লাগে। আমি ঘুমের ঘোরে শুনতে থাকি মা বালতিটা ছলাত ছলাত শব্দে তুলে আনে। তারপর কোনও সুযোগ না দিয়েই সবটুকু বালতির জল আমার গায়ে ঢেলে দেয়। আমি তারস্বরে ভ্যাবাতে থাকি। মা বসে পড়ে আমাকে বুকে টেনে নেয়। চুমু খায়। কিন্তু আমার কান্না থামে না। মা আরও এক বালতি পানি ঢালে। তারপর সাবান মাখতে থাকে মাথায়, সারা শরীরে। আমি একদিকে কাঁদতে থাকি, আরেকদিকে হিসহিসিয়ে হিসি করতে থাকি। মা হাসে...পিঠে আলতো চাপড় মারে..আর বলে..ধুর শারামজাদা পানিতে পেশাপ করতে নাই। পানিতে শয়তান পেশাপ করে।
আমার তখন শয়তানের উপর খুব রাগ হয়। আমি কান্না থামাই। মার সাবান ডলা হয়ে যায়। আরেক পশলা বালতির জল এসে আমাকে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। মা এক হাতে কয়লার গুড়া নেয়। তারপর আমার ছোট্ট মুখে তার বড় একটা আঙ্গুল ঢুকিয়ে দাঁত মাজতে থাকে। আমার পোকায় খাওয়া দাঁতটা নড়ে চড়ে ওঠে। আমি চিল্লাই।
মা দাঁত মাজা থামায়। হাতের তালুলে জল এনে আমার মুখে পুরে দেয়। আমি কুলি করে কয়লামাখা কালো কালো জল লাল ইটগুলোতে ফেলি। মা আবার জল দেয়, আমি কুলি করে তা ফেলে দিই লাল ইটে। থুথুমাখা সেইসব কালো কালো জল মিলে একটা ছোট্ট জলের স্রোত আস্তে আস্তে হেঁটে যায় আর সব জলের সাথে একটা ছোট্ট জুলিতে।
মা তার আঁচল দিয়ে আমার মাথা মুছে দেয়। তারপর সারা শরীর। তারপর কোলে তুলে আবার হাঁটতে থাকে, মার বড় বড় স্তনগুলি আমার মাথায় লেপ্টে থাকে। মা ঘরে ঢোকে, মা আমাকে চকিতে তুলে দেয়। তারপর একটা গোলাপী রঙের প্লাস্টিকের ঝুড়ি থেকে আমার ইংলিশ প্যান্ট বের করে আনে। কিন্তু ইংলিশ প্যান্টটি জায়গামতো ছেড়া। ওটা পরলে আমার নুন্টুশ বেরিয়ে থাকে। জীবনের সেই প্রথম থেকেই আমার প্যান্ট আর নুন্টুশের এই দ্বন্দ্ব। এর বহু বহু দিন পর একদিন গোপালপুরে এক কাণ্ড হয়েছিল।
ধলাবিলাই মানে আমার বড়বোন ছিল আমার মোটে দেড়বছরের বড়। আগুনের ফুরুঙ্গার মতো সুন্দরী। কিন্তু তার এক বান্ধবী ছিল সাক্ষাৎ পরী। একদিন ওরা আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসে। আমরা তখন থাকি হাতেম মৌলবীর বাড়ি। হাতেম মৌলবীর টিনের সেই লম্বা বাড়িটা দুই ভাগে ভাগ করা। এক পাশে থাকতো শাপলা আর ইভান ভাইরা। আরেক পাশে আমরা। শাপলা খুব গপ্পি ছিল। তার বাবা ছিল সৌদি আরবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা নাকি মটর সাইকেলে উড়ে উড়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। এই শুনে আমরা চার ভাইবোন হাসি।
শাপলা কিছু বুঝে না। আসলে সুন্দর মেয়েরা কেউই তেমন কিছু বুঝে না। নইলে শাপলা কি করে বলতে পারে, তাদের বাড়ির সামনের বরই গাছটাতে নাকি আমরা এ বাড়িতে ওঠার আগে বিদেশি ডল পুতুল ধরে থাকতো। আমরা আসার আগেই সেইসব ডল পুতুলেরা রাগ করে চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে। শাপলাকে তাই আমার ভাল্লাগে না। হোক সে সুন্দর।
তবে এটাও মিথ্যা নয় যে চোর পুলিশ খেলার সময় একমাত্র শাপলাই আমার কথা বোঝে। আমি যখন ডাকাত সেজে দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকি তখন শাপলারা সুলতানারা আর আমার বোনেরা আমাকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে ঘোরে। আমি কেবল শাপলাকেই একা পেয়ে জড়িয়ে ধরতে পারি। আর সে কেবল হাসে। আর বলে ধরছি..ধরছি।
আমিও তাকে চুপচাপ জড়িয়ে ধরে থাকি। কিন্তু দুদ্দার পায়ের শব্দ শুনেই শাপলাকে কিল ঘুষি মেরে ফের পালিয়ে যেতে থাকি। শাপলা হাসে..কেবলই হাসে। তার বিদেশি ডল পুতুলের মতো।
তাই শাপলাকে আমার ভালো লাগতো না, খুব বেশি। কিন্তু ধলাবিলাইয়ের বান্ধবী পরীর মতো সুন্দর শিউলী আপাকে অনেক বেশি ভালো লাগতো। একদিন সে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এল। আমি খুশিতে একটার বদলে তিনটা ডিগবাজি খেয়ে ফেললাম। আমি যতবার ডিগবাজি খাই শিউলি আপা ততবারই খিলখিল করে হেসে ওঠে। তাই আমিও আর ডিগবাজি থামাই না, সেও তার হাসি থামায় না, খিলখিল। কিন্তু সময় ফুরিয়ে যায়, থাকে না। নদীর স্রোতের মতোই সময় শুকিয়ে মরে যায় মানুষের জীবনে। তাই শিউলি আপাও তার হাসি থামিয়ে চলে যায়, আমিও ডিগবাজি থামাই, এক সময়।
শিউলি আপা চলে গেলে পরে ধলাই বিলাই আমাকে ধরে ফেলে। তুই শিউলিরে দেইখা এইরকম ডিগবাজি শুরু করলি ক্যা? আমি সাফ জানিয়ে দেই... ইচ্ছা হইছে... করছি...। আপা এইবার হাসতে হাসতে বলে ফেলে...শারামজাদা ও তো তোর নুন্টুশ দেইখা এই রকম হাসতে ছিল।
আমার কান লাল হয়ে যায় মুহূর্তে।
তো, মা আমাকে সেই নুন্টুশ বের হয়ে যাওয়ার ভয়ে ইংলিশ প্যান্টটি তুলে রাখে। খুঁজে খুঁজে নতুন একটা প্যান্ট বের করে আনে। যেটা আবার আমার পছন্দ না। কারণ ওই প্যান্ট আমার হাঁটু গলে আরও নিচে নেমে আসে। আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারি না। কিন্তু মার হাতে আর কোনও বিকল্প নেই। মা আমাকে প্যান্ট আর একটা শার্ট পরিয়ে আমাকে গছিয়ে দেয় সাজু খালার হাতে। সাজু খালা আমাকে খাওয়াতে বসে।
আমার খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই মার স্নান শেষ হয়ে যায়। মা আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আর কাকই দিয়ে আচড়াতে থাকে তার চুল। মা বার বার সিঁথি করে সিঁথি ভাঙ্গে..মার লম্বা চুলগুলি পিঠ ছাপিয়ে কোমর বেয়ে নামে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে তার চুল আচড়ানো দেখি, পাউডার স্নো মাখা দেখি। মা কিন্তু লিপস্টিক মাখে না। কোনও দিনও মাখতে দেখিনি। বাবা মাখতে দেয় না, নাকি মায়ই মাখে না, আমি ঠিক জানি না। তবে জানি, মা কোনওদিন লিপস্টিক মাখতো না।
তারপর মা আমাকে কোলে তুলে নেয়। আম কাঁঠাল জাম জামরুল কদবেল, নারকেল সুপারি বাগান ঘেরা সন্তোষের জমিদারদের নায়েব বাড়ি এখন ইসমাইল হোসেনের। ইসমাইল হোসেন মওলানা ভাসানীর আদরের শিষ্য ছিলেন। তার মেঝো মেয়ে হাসিনা খাতুন আমাকে কোলে তুলে নিয়ে রওনা হয়। ভেতর বাড়ি থেকে বাইর বাড়ি। বাইর বাড়ি থেকে হাফিজাদের বাড়ি। পাঁচআনি দিঘি। বাঁশের সাঁকো বাঁধা স্রোতস্বীনি খাল। মওলানা সাহেবের মসজিদ, মাজার পার হয়ে ছয়আনি পুকুর। বাঁয়ে পড়ে থাকে রাজবাড়ি। বকুল ফুল গাছ, ভূত ও প্রেতেরা। তারপাশে লিচু বাগান, লবণ খাইয়ে মেরে ফেলা সেই বাচ্চার মুখ, সন্তোষ গার্লস স্কুল ও মেয়েদের হোস্টেল। আহা সিলসিলা জামা পরা সেইসব মেয়েরা।
সন্তোষ বাজারে এসে মা একটা রিকশা নেয়। আমরা চলতে থাকি রিকশাওলার গতিতে। পিছনে একে একে পড়ে থাকে মওলানার নাটখানা, বাড়ি, বাজার, ক্লাব ঘর, রেশম গুটির ঘর, পশু হাসপাতাল, মার একশ এক দুয়ারী জাহ্নবী স্কুল, সূর্য ঘড়ি, চালতা গাছ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের আলিশান বাড়ি, লাগোয়া শিশু পার্ক, কাগমারী কলেজ, পালপাড়া, অতি উঁচু লোহার পুল, নিচে ধ্বজভঙ্গ লৌহজঙ্গ নদী, বেবিস্ট্যান্ডের পাশে মেথর পট্টি ও নটিপাড়া এড়িয়ে আমরা শান্তিকুঞ্জে মোড়ে চলে আসি একসময়। তারপর থানা পাড়া, আলিয়া মাদ্রাসা, থানা, মালঞ্চ সিনেমা হল, নিরালা মোড়, ঘ্যাগের দালান, মামুন সু স্টোর, রওশন টকিজ ভিক্টোরিয়া রোড হয়ে পুরান বাসস্ট্যান্ডে।
মা রিকশা ভাড়া মেটায়। আমরা একটা বাসের জন্য অপেক্ষা করি। অনেকক্ষণ পর একটা বাস আসে। লোকজন আমাদের ফেলেই ঠেলেঠুলে বাসে চড়ে। মা আমাকে নিয়ে মহিলা সিটে বসে, আরও সব মহিলাদের সাথে। গাড়ি চলতে থাকে, গাছেরা দুলতে থাকে। ইট কাঠ দোকান পাট সব পেছনে পড়ে যেতে থাকে।
বাস কোথাও থামে, কিছু লোক নামে। নতুন লোক ওঠে। আবার চলতে থাকে। গাছেরা বাসের সাথে সাথে দৌড়ায়। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি। কন্ডাকটর আসে, তার চামড়ার ব্যাগ ঝুলিয়ে। তার বাঁ হাতের পাঁচ আঙ্গুলে গুঁজে থাকা টাকারা অনেকটা ফুলের মতো। আমি তাদের দিকে চেয়ে থাকি, আমার ভালো লাগে সেইসব টাকাদের দেখে।
মা ভাড়া মেটায়। একটা সময় বাস থামে। মা আমাকে নিয়ে কোথায় যেন নেমে যায়, রাস্তার পাশে। চারপাশ শুনশান, প্রখর রোদের দুপুর। আমার মাথা ধরে। আমি খ্যান খ্যান করে কাঁদি। মা আমাকে নিয়ে হাঁটতে থাকে পাশেই একটা মাটির হালট দিয়ে।
মা হাঁটতে থাকে, মা হাঁটতে থাকে... মা হাঁটতে থাকে..আমি খ্যান খ্যান করতে থাকি খ্যান খ্যান করতে থাকি ..মা তার আঁচল দিয়ে আমাকে ঢেকে দেয় রোদ থেকে বাঁচাতে। আমি তার গোলাপী আঁচলের ভিতর থেকে গোলাপী রোদ দেখি, আমাকে একা পেয়ে পরীরা আসে...রাজকুমারী হাসে। রাক্ষস খোক্কসেরা আমাকে দৌড়ানি দেয়, আমি ঘুমের ঘোরে উথাল পাথাল দৌড়াতে থাকি।
আমি একটা খেঁজুরের পাটিতে শুয়ে আছি, মাটির উপর। পাশে চেয়ে দেখি মা এক মহিলার সাথে গল্প করছে। পাশেই একটা লোক বসে গল্প শুনছে। লোকটার মাথার উপর ঝুলে আছে বেশ কয়েকটা ছিকা আর পেছনে একটা বড় মাচা। মাচায় বড় বড় পাতিল, মাটির মটকি, ধানের গোলা।
মা আমাকে চোখ মেলতে দেখে কোলে নিয়ে বসে। মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করে বাবু তোমার নাম কি। আমি উত্তর দেই না। আমার লজ্জা লাগে। তবুও মহিলা আমাকে বারবারই জিজ্ঞেস করতে থাকে। মাও আমাকে কও বাবা কও বলে তাগাদা দেয়। আমারও একটা সময় বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমার নামটা আমার মুখে এসে পোকায় খাওয়া দাঁতের কাছে আটকে থাকে। আমি কাঁদতে থাকি হু হু করে। মা আমাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে। তখন ওই মহিলা বলে, হাস্না তুমার পুলার খিদ্যা লাগছে মনে হয়।
মা আমাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা তুমার খিদা লাগছে? আমি হু বলি আর কাঁদি। মা তখন ওই মহিলাকে বলে, জেসমিন তুমাগো বাড়িতে খাবার কিছু আছে?
মহিলা বলে, আছে তো পান্তা ভাত।
তখনও লোকে হররোজ পান্তা ভাত খেতো। কিন্তু পান্তা ভাত খেতে আমার ইচ্ছা করতো না। পান্তা ভাত ছিল একটা বিস্বাদ প্রাণীর মতোই অর্থহীন খাবার। আমার ডিমভাজি দিয়ে গরম ভাত খেতে ভাল্লাগতো।
মা আমাকে জিজ্ঞেস করে, পান্তা ভাত খাবা বাবা? আমি বলি, না। আমার পান্তা ভাত খেতে ইচ্ছা করে না। তবু মা বলে..ভালো কইরা মাখাইয়া দেই..কাঁচা মরিচ পিঁয়াইজ দিয়া? আমি আবারও বলি..না।
মা বিপাকে পড়ে যায়। ভদ্রমহিলাও অস্বস্তিতে পড়ে। মা না পেরে জিজ্ঞেস করে, আর কিছু নাই..জেসমিন? উনি বলে..আর কি থাকবো...মুড়ি আছে...তুমার পুলা কি গুড় দিয়া মুড়ি খাবো?
গুড় দিয়া মুড়ি খাওয়া আরেকটা বাজে জিনিস। মুড়ি খেতে হয় গরুর মাংস দিয়ে। আর নেহায়েত কিছু না হলে ডাল কিংবা তরকারির ঝোল। কিন্তু এ বাড়িতে পান্তা ভাত..ফলে তরকারি টরকারি না থাকাই স্বাভাবিক। আমি খুন খুন করতে থাকি। মা এবার আর পারে না। বলেই ফেলে পান্তা ভাতই দেও। সুন্দর কইরা মাখিয়া দেই। মহিলা তিনটা প্লেটে পান্তা ভাত বাড়তে থাকে। তারা তিনজনে পান্তা ভাত মাখাতে থাকে। কাঁচা মরিচ পিঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খেতে থাকে।
মা আমাকে বারবার খাওয়ানোর চেষ্টা করেও পারে না। মার পান্তা ভাতওয়ালা হাতটাকে আমার পোকায় খাওয়া দাঁত মুখের ভেতরে ঢুকতে দেয় না। বরং আমি খুন খুন করে ডিমভাজির কথা বলতে থাকি। মা শুনেও না শোনার ভান করে...বুঝেও যেন বোঝে না। মাকে আমার রাগ লাগে। মার উপর অভিমান হয়। আমি খুন খুন করতেই থাকি। এক পা দিয়ে আরেক পা ঘষি। আমার রাগ কমে না। অভিমান থামে না। ভাবি, ইষ্টি বাড়িতে কেউ পান্তা ভাত দেয় কি?
এইসময় আমার চেয়ে অনেক বড় একটা মেয়ে আর আমার চেয়ে একটু বড় একটা ছেলে স্কুল থেকে আসে। তারা হই হই করে ঘরে ঢোকে। ছেলেটার সামনে দুইটা দাঁতই নাই। মা বলে জেসমিন নামের মহিলার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। আমার মা এই সময় তার ব্যাগ থেকে একটা কাগজের ঢোঙ্গা বের করে দেয়। ছেলেটা হাতে নিয়ে দেখে ভেতরে নাবিস্কো লজেন্স। ছেলেটা আরেকটা চিৎকার দিয়ে দৌড়ে উঠানে চলে যায়। তার পিছু পিছু ছোটে মেয়েটাও। মা আমাকে ঠেলা দেয়, যাও বাবা তুমিও খেলো গা... ওদের সাথে। কিন্তু আমার খেলতে ইচ্ছা করে না। ডিমভাজি দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু জেসমিন নামের মহিলাও আমাকে তাড়া লাগায়, পুরুষটাও কথা বলে উঠে..যাও বাবা যাও। খেলো গা।
আমি খুবই অনাগ্রহে মার কোল থেকে উঠে দাঁড়াই। তারপর হাঁটতে থাকি দরোজা পেরিয়ে দুয়ারে। দুয়ারের পাশেই একটা ভাঙ্গা খড়ির বেড়া। তারপাশেই আরেকটা বাড়ি। তবে এ বাড়ির মতো ধনী বাড়ি না। খড়ির বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটা কাকে যেন ডাকে। মেয়েটা তাকে সাবধান করতে থাকে। কিন্তু ছেলেটা শোনে না। সে ডাকতেই থাকে। আমি দুয়ারে নেমে আসি।
একটা কুইচা মুরগি তার ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পাশেই আরও তিন চারটা ডেকি মুরগি। আরেকটা ধারী মোরগ। এ বাড়িতে ডিম থাকা স্বাভাবিক, যেমন আমাদের বাড়িতে থাকে। কিন্তু তারা আমাকে ডিম ভাজি খাওয়ায় না, পান্তা ভাত সাধে।
একটা দোপাটি আর মোরগফুলের পাশে একটা কলাবতীর ঝোপ। পাশেই ভাঙ্গা খড়ির বেড়া। ছেলেটা ঝোপে দাঁড়িয়ে ডাকছে...যাতে তার বাবা মা না দেখে? মেয়েটা তাকে নিষেধ করেই যাচ্ছে। কিন্তু সে শুনছে না। আমি ওদের পেছনে দাঁড়াই। দেখি..খড়ির বেড়ার ওপারে একটা মেয়ে আর কয়েকটা আমার চেয়ে বড় বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা ঠোঙ্গা থেকে ওদের লজেন্স দিচ্ছে। কিন্তু ওর বোন আমাকে কাছে আসতে দেখে বলল, ওরে দুইটা দে। কিন্তু ছেলেটা আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।
আমার মন খারাপের মতো হয়। আমি লজ্জা পেয়ে মাটির দিকে তাকাই। আমার পায়ের খুব কাছেই মুরগির গু। আমি আরও অনেক ছোটবেলায় একদিন আমাদের উঠানে এ রকম পাতলা গুড় রঙের মুরগির গু দেখে খেয়ে ফেলেছিলাম। হাহাহাহা। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। বসে পড়ি। বসে পড়ে মাটিতে আঙ্গুল দিয়ে কী কী যেন আঁকি। আমার ভালো লাগে না।
এই সময় মা আমাকে ডাকে...বাবা তুমি এইখানে বইসা আছো? আমি আমার সমস্ত রাগ ক্ষোভ অভিমান ভুলে যাই। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে মার শাড়ির কুচিতে মুখ লুকাই। জেসমিন নামের মহিলাটা বারান্দা থেকেই বলে..প্রমোশন পাইয়া গুপালপুর গেলা গা। আমাগো আবার ভুইলা যাইও না। মাঝে মাঝে আমাগো চিঠি পত্র দিও।
মা আমাকে কোলে তুলে নেয়। হাসতে হাসতে হাঁটতে থাকে। তারপর মাটির রাস্তা, ধানক্ষেত..পাটক্ষেত..গাছগাছালি...শুভল্যা বাজার। গাড়ি আসে। মা গাড়িতে উঠে মহিলা সিটে বসতে পারে না। পুরা সিটটা ভর্তি থাকায়। ফলে মাকে বসতে হয় গরম বনেটে। ড্রাইভার ঘন ঘন গিয়ার বদলায়। গরমে মা ঘামতে থাকে। গাছেরা বাসের সাথে দৌড়ায়। আমি গাছেদের দৌড় দেখি। পরীরা আসে..রাজকন্যারা আসে...আসে রাক্ষস খোক্কস। আমি ঘুমের ভেতর দৌড়াতে থাকি। ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি..মা আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে...কিন্তু সে হাঁটতে পারছে না... সে ঘেমে যাচ্ছে।
মন্তব্য
আপনার লেখা দুর্দান্ত লাগে এটাও লাগলো, কতটুকু মর্মার্থ আমি ধরতে পারি জানিনা, কিন্তু ভাল লাগে।
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
অনেকটা কবিতার মত। কিন্তু কিছুটা কবিতার মত নয়।
কিছুটা বোঝার মত। অনেকটাই বোধের বাইরের- চিন্তার জন্যই হয়তো।
পড়ে গেছি, নিস্তরঙ্গ পুকুরের জলে চিৎ সাতারে আকাশের দিকে মুখ করে ভেসে থাকার মত করে। ক্লান্তি ছিলো না; আবেগ ছিলো কি না বুঝি নি। শুধু একটা ক্যানভাস ছিলো, আর ছিলো মেঘ; অগুনতি।
ভালো থাকবেন কবি।
---- মনজুর এলাহী ----
চমৎকার গল্প। ভালো লেগেছে।
...........................
Every Picture Tells a Story
বাঘ মামা, সেরাম হইছে, কাইটা গেল একদম, এলা আবার নুন্টুস বাইর কইরা পরীগো নগে সিসি করতে বইসো না
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
শাপলা - শাপলু। ঘটমা কি?
ঝুপ করে নিজের ছেলেবেলাটা যেন হানা দিলো। কত, কত কিছু মনে পড়লো পড়তে পড়তে। লেখাটার জন্য কৃতজ্ঞতা জানবেন।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
চমৎকার লাগলো।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
তুমার লেখা আগে পড়িনাই, গিরিন বাগ (মারুফ)
অ.ট. এটা একটা মডেল হতে পারে সচলে প্রকাশিত গল্পের মানের ক্ষেত্রে। ইদানিং সচলে আসা নিহত/আধমরা গল্পগুলি যেরকম নাকেকান্নাএশকেমুহাব্বতে ভরা থাকে সেগুলি সচলের পাতায় বেমানান।
লেখা প্রসঙ্গে : এই ধরণের লেখাগুলি একেকটা ট্রেণ্ড সেট করে দেয়।
অজ্ঞাতবাস
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
মনখারাপ লাগলো, ছোটবেলার কথা মনে পড়লো। অনেক ভাল লাগলো বাঘাদা।
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
সচলে কিন্তু নিয়মিতই ভালো গল্প আসে। কিছুদিন আগেই চরম উদাসের রাতের বালা নামের একটা গল্পের কথা মনে পড়ে। কিন্তু কিছু লেখা এতো অন্যরকম হয় যে সেটার রেশ বহুদিন ধরে থাকে।
বাঘাদার এই গল্প আমার মনে থাকবে।
অসাধারণ একটা গল্প
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ভালো লেখা। টানা পড়ে গেছি, একটুও থামিনি। তোমার অভুক্ত থাকাটা এখনও কষ্ট দিচ্ছে।
অদ্ভুত ভালো লাগল লেখাটা।
নতুন মন্তব্য করুন