তবুও আশা ……

সচল জাহিদ এর ছবি
লিখেছেন সচল জাহিদ (তারিখ: শুক্র, ০৬/০২/২০০৯ - ১২:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


জীবন এখানে অনেক যান্ত্রিক, একঘেয়ে, বিরক্তিকর| নিজের কোমল অনুভুতিগুলো কখন যে ভোঁতা হয়ে গেছে তা নিজেও জানিনা| যে সোনার হরিণের খোঁজে নিজের সংস্কৃতি ছেড়ে চলে এসেছি অনেক দূরে সেট চলছে সানন্দে| দিন রাত ধরে গবেষণা করে এ জাতির উন্নতি করছি আমরা সবাই, বিনিময়ে পাচ্ছি আমাদের উচ্চ শিক্ষার সনদপত্র, উন্নত আর ঝামেলাবিহীন জীবনের নিশ্চয়তা| মাঝে মাঝে মনে হয় এই ঝামেলাবিহীন জীবনই সকল সমস্যার উৎস| একসময় হাঁপিয়ে উঠি, যান্ত্রিকতার নিষ্পেষনে নিজেকে অসহায় মনে হয়| মনে পড়ে যায় বুয়েটের সেই দিনগুলির কথাঃ সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে ক্লাসে যাওয়া, ক্লাসের ফাঁকে ক্যাফেটিরিয়াতে সকালের নাস্তা করা, ক্যাফের সামনে লাল ইটের পিচে ক্রিকেট খেলা, ‘নিরবে’ খেতে যাওয়া, দুপূরের সেশনাল ক্লাসে একটা কফির গ্লাস নিয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে ঢোকা, বিকেলের সোনালী রোদে ক্যাম্পাসে আড্ডা দেওয়া, আরও কত কি !

মনে আছে আমরা যখন প্রথম বর্ষে পড়ি তখন ঝাঁকে ঝাঁকে সবাই একসঙ্গে ঢুকে পড়লাম ডিবেটিং ক্লাবে| চারিদিকে অচেনা অনেক মুখ| আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল বন্ধুত্বের বৃত্তের পরিধি| কখন যে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পরলাম আরও অনেক সংগঠন গুলিতে (বুয়েট ড্রামা সোসাইটি, মূর্ছনা, কন্ঠ বুয়েট, বুয়েট সেফ্‌টি মুভমেন্ট)মনে নেই| শুধু জানি, নিজের সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষন অনেক গুন বেড়ে গিয়েছিল বুয়েটে এসে এই সব সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে যুক্ত হয়ে| তাই দেশ ছেড়ে এসেও ভুলতে পারিনি সেই দিনগুলোকে| তীর্থের কাকের মত বসে থাকি, কখন এই তুষারে ঢাকা শহরটাতে একটু বাঙালি সংস্কৃতির ছোঁয়া পড়ে|

গত বছর ২০০৭ এ আমাদের এডমন্টনে একটা বাঙলা উৎসব হলো| এখানে বাঙালি মানে আমরা বাংলাদেশিরা, আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা| ঢাক ঢোল পিটিয়ে টানা দুই দিন ধরে নজরুল রবীন্দ্রচর্চা হলো| সবার মুখে তখন একটাই কথা রবীন্দ্র নজরুল ছাড়া বাঙালি সংস্কৃতি হয় নাকি| সেদিন গর্বিত হয়েছিলাম নিজেকে বাঙালি মনে করে| ভাবলাম শেষের দিন অনেক রাত অবধি থাকব| হায়রে ভাগ্য আমার, সেই রাত অবধি থাকাটাই কাল হয়ে দাঁডালো| মধ্যরাতের কিছু আগে মঞ্চে উঠলেন জনৈক পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী যিনি সম্প্রতি খুব নাম ডাক করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা করে| ব্যাস, শুরু হল হিন্দি গানের মাতম আর সেই সাথে আমাদের আমাদের আধুনিক বাঙালিদের আধুনিক নৃত্য| এই না হলে আর সংস্কৃতি চর্চা| তবুও ভাল লাগে অন্তত দূটো দিনতো পেলাম নিজের ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য|

মাঝে মাঝে বিদেশে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মদের কথা ভেবে আঁৎকে উঠি| এখানে বড় হওয়া বাংলাদেশি প্রজন্মকে দেখলে মাঝে মাঝে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়| মনে আছে একবার ‘ইত্যাদি’ তে হানিফ সংকেট ঈদের অনুষ্ঠানে বিদেশের অনেক তারকাকাদেরকে দিয়ে দর্শকদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিল| ‘ঈদ মোবারক’ কথাটি ইংরেজিতে বানান করে লিখে তাদের পড়তে দেয়া হত আর আমরা আনন্দিত হতাম প্রিয় তারকাদের মুখে বাংলা ভাষা শুনে| আর আজ যখন একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে এই উত্তর মেরুর নিকটবর্তী কোন শহরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করি, তখন আমাদের সন্তানদেরকে “ কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটি ……” কবিতাটি, কিংবা “ আমি বাংলায় গান গাই …” গানটি ইংরেজি বানানে লিখে দিতে হয়| তারপর তারা মঞ্চে যেয়ে বিদেশী তারকাদের মত বিদেশী ঢং এ আমাদের কবিতা পড়ে, গান গেয়ে শোনায়| আমরা পুলকিত হই, গর্বিত হয়ে হাততালি দেই| তারপর অনুষ্ঠান শেষ হয়, সেই সাথে শেষ হয়ে যায় একুশ, বাংলা ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি|

মাঝে মাঝে খুঁড়িয়ে চলা এই সংস্কৃতিকে দেখে বড় মায়া হয়, কষ্ট লাগে, কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়ে যায় বিপরীত একটা চিত্র| আজকাল যখন এখানে বসে দেশের অনুষ্ঠানগুলো দেখি, অবাক হয়ে লক্ষ্য করি ওরা কি সুন্দর ইংরেজী ঢং এ বাংলা বলছে| পৃথিবীর দুই প্রান্তে কি সুন্দর সদৃশ্যতা| তাহলে কাদেরকে দোষ দেব, ওদেরকে যারা বাংলাদেশে বসে বসে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করছে, নাকি যারা এদেশে বেড়ে উঠে ইংরেজী বানানে বাংলা কবিতা পড়ছে? আমি সমাধান খুঁজে পাইনা, হারিয়ে যাই নিজের প্রশ্নের মাঝে|

আমি জানি আমার প্রশগুলোর উত্তর আমার জানা নেই, হয়ত কারোরই জানা নেই| তবুও আশা বেঁধে রাখি, স্বপ্ন দেখি সেই দিনগুলোর যেদিন আমাদের প্রবাসি পরবর্তী প্রজন্মকে আর কখনো নজরুল রবীন্দ্র বা জীবনান্দের কবিতা বা গানগুলো ইংরেজী বানানে লিখে দিতে হবেনা, বাঙলা উৎসবের করূণ পরিনতি ঘটবেনা হিন্দি গানের মধ্য দিয়ে| বাঙালি জাতি তার স্বকীয়তা নিয়ে জয় করে নেবে অন্য সংস্কৃতির আগ্রাসনকে|


সচল জাহিদ
(জাহিদুল ইসলাম)


মন্তব্য

জিজ্ঞাসু এর ছবি

শিশুদের বাবা-মা যদি ওদের মুখে ইংরেজি ঢঙে বাঙলা শুনে খুশি হয় তাহলে কী আর করা যাবে বলুন। নিজের সংস্কৃতিকে ভালবেসে তড়পানো ছাড়া আর মনে হয় আপাতত কিছু হাতে নেই।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

রাফি এর ছবি

বিদেশের কথা আর কী বলবেন স্যার, দেশেই বাংলা সংস্কৃতির নামে আমরা যেদিকে এগোচ্ছি তাতে কিছুদিন পর নিজের দেশেও মঞ্চে গাওয়া হিন্দী গান শুনতে হবে; নেহায়েৎ তা না হলেও ইংরেজি-বাংলার জগাখিচুড়ী(এটাকে নাকি আবার ফিউশন বলে) মার্কা গান আমরা এখনো শুনছি। আমাদের বন্ধুদের ভেতরই একটা দল গড়ে উঠেছে যারা রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীত বা লালনগীতি প্রকৃত সুরে শোনে না, শোনে ফিউশন আর রিমিক্স করা গান।সময়ের সাথে সাথে রুচি এবং জনপ্রিয়তার ঝোঁক বদলাবে, এটাকে অস্বীকার করা যায় না, করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের মূল ধারার সংস্কৃতির চর্চার দৈন্য খুবই দুঃখজনক। আপনার অভিজ্ঞতা পড়ে খারাপ লাগল।

বুয়েটের দিনগুলি আসলেই বেশ আনন্দময়, পি.এল এ পড়াশোনার অসম্ভব চাপটা বাদ দিলে বুয়েটের শেষ হয়ে আসা সময়গুলোর অভাব এখনই অনুভব করতে পারছি।

অফটপিকঃ অন্য সবার কথা জানি না আপনাকে কিন্তু আমরা(সিভিল, B2) এখনো মিস্‌ করি, খুব বেশিই।

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

সচল জাহিদ এর ছবি

ধন্যবাদ রাফি তোমার মন্তব্যের জন্য।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আজকে আমাদের এই সাংস্কৃতিক দৈন্যতার জন্য অনেকাংশে দায়ী আমাদের অনুকরন প্রবনতা। সংস্কৃত আসলে বহমান নদীর মত, সুতরাং সে পরিবর্তিত হবেই এবং আমি মনে প্রানে পরিবর্তনের পক্ষে। কিন্তু পরিবর্তনের নামে এখন যা হচ্ছে তাকে আর সংস্কৃতি না বলে অপসংস্কৃতি বলাটাই শ্রেয়। তথাকথিত রিমিক্সকারদের বিষয়ে আমার ইতিবাচক বক্তব্য হচ্ছে তারা অন্তত পক্ষে আমাদের মুলধারার কিছু গানকে এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পেরেছে । উদাহরন হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে আব্দুল করিম শাহ এর অনেক গানই এই প্রজন্মের শিল্পী হাবিব আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। আমি বলছিনা সেই তুলে ধরাটা সঠিক ভাবে হয়েছে কিংবা হয়নি কিন্তু আমরা অন্তত গানগুলি পেয়েছি। আর তাদের বিষয়ে আমার নেতিবাচক মন্তব্য হচ্ছে তারা প্রকৃত সুরকারের সুরকে অনেকাংশে বিকৃত করে গানগুলিকে আমাদের সামনে তুলে ধরছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে তা হলো আমরা গানটার আসল আবেদনটাকে হারাচ্ছি। সেদিন আমি ইউটিউবে ' ভ্রমর কইও গিয়া ' গানটা শুনছিলাম। গানের প্রকারভেদে এটি একটি বিঃচ্ছেদি গান এবং সেটি বিচারে রেখেই রাধারমন দত্তের এই গানটি সুর করা হয়েছে। আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো সেই গানটির আবেদন সম্পূর্ন রূপে নষ্ট করে দিয়ে জনৈক শিল্পী সেটী রিমিক্স করেছেন। আসলে আমাদের এই ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া উচিত। আমরা যেটা করতে পারি আমরা এই গানগুলিকে বর্জন করতে পারি তাহলে হয়ত তারা আগ্রহ হারাবে, রক্ষা পাবে মূল ধারার গানগুলি ।

পুনঃশ্চঃ বুয়েট আমাকে এখনও পিছুটানে, নিয়ে যেতে চায় ফেলে আসা দিনগুলিতে

জাহিদুল ইসলাম
ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টা, এডমনটন, কানাডা


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি

ABCD দের আমি দোষ দেইনা। ওদের জন্যতো আম্রিকান ভাষা/সংস্কৃতি শেখাটা স্বাভাবিক। আমরা বরং আমাদের সংস্কৃতির একটা উত্তরাধিকার রেখে যাবার তাড়নায় ওদের মধ্যে আমাদের সংস্কৃতি কিছুটা চালান করি। ঐ সংস্কৃতির জন্য ওদের খুব বেশি আকুতি না থাকাটাই স্বাভাবিক। বয়েস-বুদ্ধি হলে হয়তো হতে পারে।

কিন্তু DBCD (deshi born confused deshi) রা পুরাপুরিই তাদের বাপ মায়ের ভণ্ডামির শিকার। আর চার পাশের মিডিয়ার ভণ্ডামিতে তারা আজ নিজেরাও ভণ্ড।

আমার এক আত্মীয় আছেন, ঢাকাই মধ্যবিত্ত, হাল ফ্যাশনে ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ান, বাসায় এলে ছেলের সাথে ইংরেজীতে বাত্-চিত্ করেন। আর আমাকে মাঝে মাঝে ফোনে উপদেশ দেন আমার বিলেতে জন্মানো পিচ্চিকে বাংলা শেখাতে!

দৃশা এর ছবি

ঝরঝরে লেখা। ভাল লাগলো পড়তে।
নিজের দেশের সোনার সন্তানদের যা উন্নতি(!!) দেখি বৈদেশের ফিরিঙ্গি বাঙ্গালী শিশুদের কর্মকান্ডে তাই অবাকও হইলাম না দুঃখিতও হইলাম না। ঘরে ঘরে একই ঘটনা... কত আর দুঃখিত হওয়া যায় !
.......................................................................................
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

সাইফ তাহসিন এর ছবি

জাহিদ ভাই, আমি আর আপনে একই গাছের নিচে দাড়িয়ে মাথা চুলকাচ্ছি আর ভাবছি, আমাদের করণীয় কী !! লেখাটা খুব ছুয়ে গেল।

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।