নকীব ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০০৭ এর জানুয়ারী মাসে। আমি তখন সবে এডমন্টনে এসেছি। আমাদেরকে বরণ করে নিতে ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টার বাংলাদেশী ছাত্র সংগঠন থেকে একটি নবীন বরণের আয়োজন করা হয়েছে, সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। বুয়েটের ছাত্র ছিলেন , কানাডায় আছেন অনেক বছর ধরে।অনুষ্ঠানের ফাঁকে আড্ডায় এখানকার সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিয়ে কথা হল, জানা হল ২০০৭ এর মাঝামাঝিতে এখানে বাংলা উৎসব হবে।সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকার কারনেই সম্ভবত জুটে গেলাম নকীব ভাইদের সাথে বাংলা উৎসবের আয়োজনে। নকীব ভাইয়েরই গ্রন্থনায় আর এখানকার বাংলাদেশী সাংস্কৃতিক শিল্পী ও নুতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সমন্বয়ে আমরা প্রায় এক ঘন্টার মত একটা আলেখ্যানুষ্ঠান করলাম বাংলা উৎসবে, যথেষ্ট সাড়াও পেলাম মানুষের কাছ থেকে। সেই সাথে নকীব ভাই আমাদের কাছে এখানকার বাঙালী সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন অপরিহার্য মানুষ হিসেবে বিবেচিত। সেই নকীব ভাই যখন এবারের (বিসিএই ২০০৯) এডমন্টনের বাংলাদেশ কানাডা সংগঠনের সভাপতি হলেন, আমরা ধারনা করেই নিয়েছিলাম এবারের একুশের অনুষ্ঠান আমাদের জন্য বিশেষ কিছু বয়ে আনবে। হলও তাই, প্রায় দু’ঘন্টার অনুষ্ঠান ‘চেতনায় একুশ’ মাতিয়ে রাখল আমদের সবাইকে অন্য এক জগতে, অন্তত সেই সময়ের জন্য ভুলে গেলাম যে আমরা দেশ থেকে অনেক অনেক দুরে, মুছে গেল প্রভাত ফেরীতে না যেতে পারার কষ্ট।
আমার আগের একটি লেখাতে উল্লেখ করেছি যে এখানে, মানে বাংলাদেশের বাইরে এই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মধ্যে বাঙালী সংস্কৃতির ঝান্ডা তুলে ধরার আপ্রান চেষ্টায় নিবেদিত কিছু মানুষের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।সেই বিচারে উল্লেখ করেছি রাফাত ভাইএর নাম। সেই ঝুলিতে আরো একজন মানুষ হলেন ইখতিয়ার উমর স্যার, বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক, এখানে আছেন অনেক বছর ধরে।দেশে থাকতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ছায়ানটের সাথে। এবারে নকীব ভাই যখন একুশের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করছিলেন ইখতিয়ার স্যারের উপর দায়িত্ব এসে পড়লো একুশের গানটি পরিচালনা করার জন্য। এই গানটির আমরা প্রথম কয়েকটি লাইনই সবসময় শুনে থাকি, এবারে পরিকল্পনা হলো গানটির ‘জাগো নাগিনীরা জাগো …’ অন্তরাটি অন্তত পক্ষে আমরা করব।নিচের লিঙ্কটিতে গানটির চুড়ান্ত অনুশীলনের অংশবিশেষ যুক্ত করলামঃ
ওদিকে ‘বিসিএই’ এর সাংস্কৃতিক শম্পা পাল, যে নিজে একজন গুনী নৃত্যশিল্পী প্রায় পঁচিশ জন শিশু, কিশোর শিল্পীদের নিয়ে ‘একুশ থেকে স্বাধীনতা’ শিরোনামের নৃত্যানুষ্ঠানের মহড়া শুরু করে দিলেন পুরোদমে।বিপূল উৎসাহে চলল অনুশীলন, সে এক অসাধারন উম্মাদনা ছোট বড় সবার হৃদয়ে।
২১ শে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যার দিকে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানটি দিয়ে শুরু হল ‘চেতনায় একুশ’।পুরো গানটির সময় ধরে হল ভর্তি দর্শক দাঁড়িয়ে একুশের শহীদদের স্মরণ করল বুকের গভীরতম ভালবাসাটুকু দিয়ে। একে একে পরিবেশিত হল এ প্রজন্মের শিশু কিশোরদের অংশগ্রহনে দেশাত্মবোধক গান, একুশের কবিতা আবৃত্তি।অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিক ছিল শিশু কিশোর ও বড় মিলিয়ে প্রায় ২৫ জন নৃত্যশিল্পীর অংশগ্রহনে একুশের বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠান ‘একুশ থেকে স্বাধীনতা।’ নৃত্যানুষ্ঠানের পর একে একে পরিবেশিত হল এডমন্টনের স্থানীয় শিল্পীদের অংশগ্রহনে রাষ্ট্রভাষা ও স্বাধীনতা কেন্দ্রিক কিছু গান এবং আবৃত্তি। অনুষ্ঠানের শেষ আকর্ষন ছিল রাফাত ভাইয়ের কন্ঠাভিনয়ঃ আনিসুল হকের স্বাধীনতা কেন্দিক একটি কলাম।কলামটি মুলত স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের একজন বাবা, একজন মা, একজন বোন আর একজন ভাইয়ের কথকতা।রাফাত ভাইয়ের ভরাট কন্ঠে আবৃত্তিটি এতটাই মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছিল যে আমরা অনেকেই চোখে জল ধরে রাখতে পারিনি, রাফাত ভাই নিজেও। ‘বীরের এই রক্তশ্রোত মাতার অশ্রুধারা সেকি ধরার ধুলায় হবে হারা’ কথাটি দিয়ে শেষ হল আবৃত্তিটি।কি এক অবাক বিস্ময়ের এই দেশপ্রেম ভাবতে অবাক লাগে। এই আমরা অনেকেই একুশ দেখিনি, একাত্তর দেখিনি, তবু কেন দু’চোখ ভরে আসে অশ্রুজলে, কেন আজও আমাদের স্বাধীনতার বীর সেনানী আর বীরাঙ্গনাদের কথা শুনে আমরা আন্দোলিত হই, কেন আজও রাজাকার আল বদরদের নাম শুনলে ঘৃনায় আর ক্রোধে আমাদের মুখে থুতু আসে?
শেষ হল আরো একটি সফল অনুষ্ঠান, জানিনা আরো কতদিন আয়োজন করতে পারব আমরা।এখনো এখানে আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী না মুসলমান তা নিয়ে বিতর্ক হয়, নতুন প্রজন্মের জন্য বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের থেকে আরবী ভাষা শিক্ষার প্রতি বেশী জোর দেয়া হয়, নিজেদের তুচ্ছ স্বার্থের কারনে সমাজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কি দুর্ভাগ্য আমাদের, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি তার নিজের দেশে বসেই আমাদের দেশে পৌছে যাচ্ছে নিমিষে বা আরো ভাল করে বলতে গেলে আমরাই বাংলাদেশে বসে ঝুকে যাচ্ছি সেইদিকে আর তার বিপরীতে আমরা এই পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে বাস করেও আমাদের সংস্কৃতির ছোঁয়া আমাদেরই ঔরসজাত সন্তানদের মাঝে বিলিয়ে দিতে কুন্ঠবোধ করি।
বিঃদ্রঃ অনুষ্টানটির ধারকৃত কিছু অংশবিশেষ নিচে দেয়া হল। বন্ধু নিবির কে ধন্যবাদ ভিডিওগুলো ধারন করার জন্য।
পুঃনশ্চঃ উপরের ছবিটি অনুষ্ঠানে একুশের গানটির সময়কার। বা দিক থেকে মিলি আপা, বৌদি, পারভীন ভাবী, রুবী আপা, আনন্দ দাদা (তবলায়), ইখতিয়ার স্যার, অধম, খসরু ভাই এবং রুহুল ভাই।
মন্তব্য
আপনার লেখা এবং প্রবাসীদের কর্মকাণ্ডের স্বাদ দেশে বসে উপভোগ করলাম এবং আপনাদের সাথে একাত্ম হলাম।
ধন্যবাদ জুলফিকার আপনার মন্তব্যের জন্য
_____________________
জাহিদুল ইসলাম
এডমনটন, আলবার্টা, কানাডা
http://www.ualberta.ca/~mdzahidu/
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
ড্যানফোর্থে বাঙ্গালী কমিউনিটি শহীদ মিনারের রেপ্লিকাও বানিয়েছে দেখলাম। ব্রাভো!
বিস্তারিত এখানে
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
রেজওয়ান
রেপলিকাটি অসাধারণ হয়েছে। ধন্যবাদ ছবিটি আমাদের সাথে ভাগাভাগি করার জন্য।আপনার কাছে কি এই মিনারটির ফুলে ফুলে ভরা ছবিটি আছে? থাকলে আপলোড করবেন দয়া করে।
_____________________
জাহিদুল ইসলাম
এডমনটন, আলবার্টা, কানাডা
http://www.ualberta.ca/~mdzahidu/
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
অনুষ্ঠানটির কিছুটা বর্ধিত ভিডিও সম্প্রতি ইউটিউবে আপলোড করেছি। ইচ্ছে ছিল দেশে যারা আছে তাদেরকে আমাদের প্রবাসীদের অনুষ্ঠানটা দেখার সুযোগ করে দিতে কিন্তু হায় কপাল দেশে ইউটিউবই ব্যান করে দিল।
ধিক্কার জানাই সেসব মুর্খ কর্মকর্তাদের।
পর্ব ১
পর্ব ২
_____________________
জাহিদুল ইসলাম
এডমনটন, আলবার্টা, কানাডা
http://www.ualberta.ca/~mdzahidu/
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
নতুন মন্তব্য করুন