শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস এবং ভুক্তভোগী ছাত্রসমাজ

সচল জাহিদ এর ছবি
লিখেছেন সচল জাহিদ (তারিখ: বুধ, ০১/০৪/২০০৯ - ১১:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রসংগঃ ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কলেজ বন্ধ ঘোষনা , ছাত্র ছাত্রীদের হলত্যাগের নির্দেশ

ঘটনা ১

কবির ও মুহিব দুই বন্ধু, একই সাথে একই কলেজের ছাত্র ছিল। এইচএসসি পরীক্ষার পরে কবির ভর্তি হল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর মুহিব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর পর পার হয়ে গেছে ৭ টি বছর। মাঝখানে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারনে দুই জনের মধ্যে যোগাযোগ তেমন ছিলনা। আবার দুজনের দেখা হল কানাডায় এসে। কবির তখন সবে মাত্র মাষ্টার্স করতে এসেছে আর মুহিব দেশের ডিগ্রি শেষ করে কানাডায় এসে মষ্টার্স শেষ করে চাকুরীতে ঢুকেছে। গাড়ি কিনেছে আর বাড়ী কেনার কথা চিন্তা ভাবনা করছে।

ঘটনা ২

হাবিব আর শিহাব একই পাড়াতে থাকত ছোট বেলা থেকে, দুজনেই দুজনের প্রতিদ্বন্দী সব সময়ের। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ করে হাবিব দেশের একটি নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল আর শিহাব দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে ভারতের ব্যাঙ্গালোরে গেল পড়াশোনা করতে। যথারীতি হাবিব সেশনযটের পাল্লায় পড়ে ৪ বছরের ডিগ্রি ৬ বছরে শেষ করে যখন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করতে পেল দেখা গেল যে তাকে কাজ করতে হবে শিহাব এর অধীনে কারন শিহাব ততদিনে পড়াশুনা শেষ করে দু'বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে উচ্চ পদে কর্মরত।

******************************************************************

উপরে উল্লেখিত ঘটনা দু'টির নাম গুলো কাল্পনিক কিন্তু ঘটনা গুলি বাস্তবিক বিশেষ করে আমাদের বর্তমান সময়ের আঙ্গিকে। আমি ১৯৯৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেবার পরে ফলাফল পাই বোধকরি ঐ বছরের জুন বা জুলাই এর দিকে। সম্ভবত ডিসেম্বরে আমাদের বুয়েট ভর্তি পরীক্ষা হয় আর ক্লাস শুরু হয় ১৯৯৭ এর ৩১ শে আগষ্ট।সেখান থেকে চার বছর ধরলে আমাদের পাশ করা উচিৎ ছিল ২০০১ এর আগষ্টের মধ্যে, কিন্তু আমারা চতুর্থ বর্ষের শেষ পরীক্ষা দিতে পেরেছি সম্ভবত ২০০২ এর ডিসেম্বরে এবং ফলাফল পেয়েছি ২০০৩ এর ফেব্রুয়ারীতে। সহজ গনিত কষলে ক্লাশ শুরু থেকে চুড়ান্ত ফলাফল পেতে আমাদের সময় লেগেছে ৫ বছর ৬ মাস আর এইচএইচসি'র ফলাফল থেকে স্নাতক পাশ করা পর্যন্ত সময় লেগেছে সড়ে ছয় বছরেরও বেশী। উদাহরন হিসেবে আমাদের সাথে যারা আইইউটি (ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজী, গাজীপুর) থেকে পাশ করেছে তাদের সেক্ষেত্রে সময় লেগেছে চার বছর। তার মানে এখানেই তারা এগিয়ে গেল আড়াই বছর।

আমার বুয়েট জীবনে আমাকে তিন বার হল ভ্যাকেন্ট এর সম্মুখীন হতে হয়েছে। এক বার ছাত্রদের দ্বারা ক্যাম্পাস আর হল ভাঙ্গার জন্য ১৯৯৮ সালে, পরবর্তীতে সনি হত্যাকান্ডের জন্য ২০০২ সালে দুই দুই বার। সে যে কি এক দুর্বিসহ যন্ত্রনার ব্যাপার তা বলার মত না , দুই থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে হলের সব কিছু নিয়ে চলে যেতে হবে কারন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগ পর্যন্ত হলে প্রবেশ করা যাবেনা। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বিশাল পরিমান ছাত্র ছাত্রীকে একসাথে হলত্যাগ করতে হলে কি পরিমান ভুক্তভোগী হতে হয় তা যাদের অভিজ্ঞতা নেই তাদের বলে বুঝানো যাবেনা। রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, সিএনজি, টেম্পু, ক্যাব যে যা পাচ্ছে তাতেই সব কিছু নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সাথে অনেক ছেলে ছিল যাদের টিউশিনীর আয়ে তাদের পরিবার চলত, তাদের বিড়ম্বনা ছিল আরো প্রকট। একদিকে টিউশিনী ছাড়তেও পারছেনা আবার থাকার জন্য কোন থাকার জায়গাও পাচ্ছেনা। আমার অনেক বন্ধু ছিল যারা হল ভ্যাকেন্টের সময় একটা সাময়িক মেস বাসা জোগাড় করে নিত। শুধুমাত্র তিনবার হল ছাড়ার জন্যই নুন্যতম ভাবে আমরা পিছিয়ে গিয়েছিলাম ছয় মাসের মত। বাকী সময়গুলোর পরীক্ষা পিছানোর আন্দলনত বাদই দিলাম।

আজকের খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে ছাত্র ছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ এবং জানা গেল এই নিয়ে তিন তিন বার তাদের পরীক্ষা পেছাল। আমার ঘরনী ডাক্তার সুতরাং আমি যতটুকু যানি তার ভিত্তিতে বলছি, বাংলাদেশ এমবিবিএস পাশ করতে লাগে একাডেমিক ভাবেই ৫ বছর এখন আবার ইন্টার্নশীপ ২ বছর এবং এই সাত বছর একাডেমিক গত এর সাথে হল ভ্যাকেন্ট, পরীক্ষা পেছানো সব যোগ করলে চিকিৎসাশাত্রের মৌলিক শিক্ষার সময়টা কততে গিয়ে দাঁড়ায় একটি ভেবে দেখুন। অথচ আমরা পড়াশুনা করছি দেশের গরীব মানুষদের খেটে খাওয়া পয়সায়, আর সেই ঘামে ভেজা অর্থের শ্রাদ্ধ হচ্ছে দুই গ্রুপের মধ্যে নিছক হল দখল আর চাঁদাবাজিতে। ঢাকা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত তার কান ঘেষে শাহাবাগ থানা, অথচ সংবাদপত্রের ভাষ্যমতে দেড় ঘন্টা ধরে সেখানে তান্ডব চলল আর প্রশাসন কি করল তখন ? নাকি সন্তাসীরা মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েছিল !!

আগের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি এখন কি হবে, আমরা সবাই এটা নিয়ে লেখালেখি করব, একটি তদন্তকমিটি গঠিত হবে যার রিপোর্ট আমরা কখনই জানবনা, রিপোর্টের ভিত্তিতে কিছু ছেলের বিরুদ্ধে শাস্তি হবে যারা হাইকোর্টে গিয়ে একটা রীট পিটিশন দিলেই সব কিছু আলিফ লায়লার জ়ীনের যাদু মন্ত্রে ঠিক ঠাক হয়ে যাবে আবার, আমাদের প্রিয় শিক্ষাঙ্গনের চত্বরে পুলিশের ছাউনী বসবে যদিও ঘটনার পরে সেটার দরকার কখনো থাকেনা, নেতারা বিবৃতি দেবে, খবরের কাগজ আর টিভি চ্যালেনগুলোর কাটতি বাড়বে, তারপর সব চুপ চাপ। ছাত্রছাত্রীদের জীবন থেকে ঝড়ে যাওয়া সময় গুলি আর কখনই ফিরে আসবেনা। থাকবে শুধু হতাশা আর বিড়ম্বনা।


মন্তব্য

স্বাধীন (মোস্তফা) এর ছবি

জ়াহিদ

মন্তব্যে প্রথম হবার লোভ টা সামলাতে পারলাম না। না হ লে পাচঁ মিনিট পরে টিএ আছে। বলি কি ব্লগ বাদ দিয়ে পড়ালখা কর এবং আমিও করি। না হলে আমাদের ও ৪ বছরের জায়গায় ৬ বছর লাগবে। ইমোটিল কোথায় পাই? একটা হাসির ইমো চিন্তা করে নাও।

সচল জাহিদ এর ছবি

না হলে আমাদের ও ৪ বছরের জায়গায় ৬ বছর লাগবে

মোস্তফা ভাই দিলেনত আবার পড়ার কথা মনে করাইয়া । এই কইদিন বাসা বদলের অছিলায় পড়া শুনা না করার একটা ভাল কারন পাইছিলাম এবং মনে মনে বেশ পুলকিতও (!!!) ছিলাম।

-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এই জিনিসটাই আমরা বুঝিনা যে রাজনীতি করে ছাত্রদের আসলে কোনো লাভ নেই। লাভ হয় উপরের দুই একজনের।
...............................
নিসর্গ

আজমীর এর ছবি

এখনতো মনে হয় উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল খারাপ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটাই লাভজনক। ভাল ফল হলে চাপ বেড়ে যায় নিজের উপর সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার জন্য। অর্থাৎ কিনা ভালদের ভবিষ্যৎ কষ্টকর, আর মোটামুটিদের ভবিষ্যৎ আরামদায়ক।

তাই বলে আবার কেউ মোটামুটির দিকে যাবেননা যেন। কারণ, কষ্ট করলেই কেষ্ট মেলে।

আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.

আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.

সচল জাহিদ এর ছবি

ভয়াবহ ব্যাপার হল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন ঠিক রাজনীতি না হলেও আন্দোলন প্রবনতা শুরু হয়েছে। কদিন আগে দেখলাম আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতেও মারামারি, ধর্মঘট চলল। আসলে আমাদের পরিত্রান নেই।

-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

স্বাধীন [অতিথি] এর ছবি

কি যে দেখাইলা আমার সারা দিনতো সচলেই গেলো। একটা নতুন পোষ্ট দিলাম। এটা মেইনলি সুবিনয় ভাই এর কাছে অর্থনীতির কিছু জ্ঞান নেবার জন্য।

http://www.sachalayatan.com/guest_writer/23062

সচল জাহিদ এর ছবি

হে হে হে ...নিজে ফাইস্যা গেছিত তাই আপনারে ফাসাইয়া বেশ পুলকিত হইলাম হাসি । চলেন ভাইয়া আরো কিছু মুরগী ধরি তাইলে দলটা ভারি হবে।

-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।