ইতিহাস, বিষয়বস্তু, পর্যালোচনা ও সমালোচনার পর সিরিজের এই পর্ব থেকে শুরু হচ্ছে গঙ্গা চুক্তি পরবর্তী অবস্থার একটি সংক্ষেপিত চিত্র। গুগল নিউজ, গুগল স্কলার, ও দেশী বিদেশী বিভিন্ন পত্রপত্রিকার আর্কাইভের সাহায্য নিয়ে ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি সময়ানুক্রমে এই চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন মতবিরোধ ও আলোচনাগুলি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশের চেষ্টা করব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিউজ আর্কাইভ গুলোর নিবন্ধন না থাকার কারনে অনেক খবরের বিস্তারিত পড়তে পারিনি বলে দূঃখ প্রকাশ করছি। পাঠকরা যদি আমার আলোচনার বাইরে কোন খবর পড়ে থাকেন তাহলে যথাযথ তথ্যসুত্র দিয়ে তা মন্তব্য উল্লেখ করলে সবাই উপকৃত হবে।
আগের পর্বগুলি পড়ুনঃ
প্রথম পর্ব-প্রারম্ভিক তথ্য ও চুক্তিপূর্ব ইতিহাস (১৯৫১-১৯৭৬)
দ্বিতীয় পর্ব-চুক্তিপূর্ব ইতিহাস (১৯৭৭-১৯৯৬)
তৃতীয় পর্ব- ’৯৬ এর চুক্তির বিষয়বস্তু
চতুর্থ পর্ব- ’৯৬ এর চুক্তির পর্যালোচনা
পঞ্চম পর্বঃ ’৯৬ এর চুক্তির কিছু দূর্বল দিক
গঙ্গাচুক্তি আসলে বাংলাদেশ ভারত তথা সারা বিশ্বেই একটি আলোচিত বিষয় ছিল।আর তাই এই চুক্তি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমেরও উৎসাহের কোন কমতি ছিলনা।চুক্তির পরের বছর গুলিতে এর কার্য্যকারীতা নিয়ে তাই বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
১৯৯৭ সালের ২৫ মে জন এফ বার্নস ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’ তার “Sharing Ganges Waters, India and Bangladesh Test the Depth of Cooperation” শীর্ষক রিপোর্টে উল্লেখ করেন,
“মার্চ ২৭, (১৯৯৭) এ যখন গঙ্গার প্রবাহ বাংলাদেশের অনুকূলে হওয়া উচিৎ, হার্ডিঞ্জ ব্রীজে তদারককারী দল মাত্র ৬,৫০০ কিউসেক পানি পেয়েছে যা কিনা সর্বকালের সর্বনিম্ন পরিমান”[১০]
একই রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশীদের অভিযোগ আছে যে ভারত রাতে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেয় কারন সেই সময় কোন তদারককারী দল থাকেনা [১০]। তিনি বাংলাদেশী পানি বিশেষজ্ঞ ডঃ নিশাত এর বিবৃতি উল্লেখ করেনঃ
“অসংখ্য বাংলাদেশী আছে যারা বিশ্বাষ করে যে ভারত রাতের অন্ধকারে পানি চুরি করে”[১০]।
এই জাতীয় অভিযোগ অবশ্য নিছক বলে ভারতীয়রা মনে করে যার প্রমান পাওয়া যার একই রিপোর্টে যেখানে রামস্বামী আর লিয়ার নামের একজন ভারতীর সাবেক সরকারী কর্মকর্তা যিনি এই চুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি মন্তব্য করেনঃ
“যখনই কোন সমস্যা হয় তখন প্রথমেই বাংলাদেশীরা যা বলে যা হলো, ‘আহ ভারতীয়রা আবার এই কাজটা করেছে, তারা আবার আমাদের পানি চুরি করেছে’, এই জাতীয় অবিশ্বাস নিয়ে কাজ করা খুবই কঠিন” [১০]
ফারাক্কায় কম পানি প্রবাহিত হবার আরো কিছু নমুনা পাওয়া যায় ১৯৯৭ সালের ৬ মে ‘বিজনিস স্টান্ডার্ডের’ রিপোর্টে যেখানে উল্লেখ করা হয় যে, লোক সভার কংগ্রেস সদস্যরা সরকারকে এই মর্মে অভিযোগ করেছেন যে গঙ্গা চুক্তি প্রনয়নের পুর্বে পর্যাপ্ত পরিমান সাবধানতা অবলম্বন করা হয়নি [১১]। কংগ্রেস চীফ হুইপ সন্তোষ মহন দেব এবং সাবেক মন্ত্রী প্রিয়া রঞ্জন দাস মন্ডল উল্লেখ করেন যে ফারাক্কায় গঙ্গার কম প্রবাহ বিহার ও উত্তর প্রদেশকে হুমকীর মধ্যে ফেলবে। এর প্রতিউত্তরে মন্ত্রী শ্রী জানেশ্বর মিশ্র জানান যে ২২ মার্চে ফারাক্কায় গঙ্গার পানি ৫০,০০০ কিউসেকের কম প্রবাহিত হয়েছে এবং ভারত বাংলাদেশের সাথে জরুরী আলোচনার পদক্ষেপ নিচ্ছে চুক্তির উপযোজনের জন্য [১১]।
পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ২০ জুলাই বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এবং ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রী শীষ রাম ওলা এক যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন [১২] যেখানে শীষ রাম ওলা বাংলাদেশ কম পানি পাচ্ছে এই অভিযোগকে নাকচ করে দিয়ে বলেন,
“বাংলাদেশ চুক্তিতে উল্লেখিত পরিমানের চেয়ে বেশী পানি পাচ্ছে”[১২]।
তিনি আর যোগ করেন যে এই সমস্যা সমাধানের জন্য তারা একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করবেন এবং চুক্তিতে যা লেখা আছে তা বাস্তবায়ন করবেন।
গঙ্গা পানি চুক্তির সাফল্যকে বেগবাগ করতে ১৯৯৮ সালের ৮ মার্চ ঢাকাতে তিন দিন ব্যাপী একটি সেমিনার শুরু হয় যার মূল আলোচ্য বিষয় ছিল গঙ্গা ব্যারেজ নির্মান।এই সেমিনারে গঙ্গা ব্যারেজের কারীগরী বিষয়ে সমীক্ষা করার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহনের প্রস্তাব রাখা হয় [১৩]।বিবিসি’র সংবাদদাতা ফ্রান্সিস হ্যারিসন তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন,
“সবাই এই বিষয়ে একমত হযে বাংলাদেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলের ৩৫ মিলিয়ন মানুষ, যাদের জীবন ও জীবিকার জন্য তারা গঙ্গার পানির উপর নির্ভরশীল তাদের জন্য কিছু জরুরী ভিত্তিতে কিছু করা উচিৎ। ভারতে গঙ্গার উজান থেকে পানি উত্তোলনের কারনে এই মানুষগুলোর দারিদ্রতা আরো বেড়েছে”[১৩]।
মজার বিষয় হলো এই রিপোর্টে ফ্রান্সিস আরো উল্লেখ করেন যে, ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তির পরে এই প্রথম বাংলাদেশ জানে যে তারা কি পরিমান পানি পাবে এবং চুক্তির এই পানি যে ব্যবহৃত হচ্ছে সেটা দেখানোর তাগিদ থেকেই বাংলাদেশ সরকার এই ব্যারেজ নির্মান করতে চাচ্ছে [১৩]।
ওদিকে বাংলাদেশ ও ভারতে গঙ্গা পানি চুক্তি নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি। ১৯৯৮ সালে বিজেপি যখন সরকার গঠন করতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে বিজেপির পশ্চিম বঙ্গ শাখা গঙ্গা চুক্তি বাতিলের দাবী শুরু করে [১৪]। তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এই মর্মে হুশিয়ার করে দেয় যে গঙ্গা চুক্তি কলকাতা বন্দরকে কোনভাবে প্রভাবিত করলে তারা চুক্তির বিপক্ষে আন্দোলন শুরু করবে [১৪]। কলকাতা বন্দর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান বিক্রম সরকারও এই চুক্তির বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং বিবৃত প্রদান করেন যে এই চুক্তি কলকাতা বন্দরকে হুমকীর মধ্যে ফেলবে কারন বন্দরের নাব্যতা রক্ষার জন্য সারা বছরই ৪০,০০০ কিউসেক পানি প্রয়োজন [১৪]।বাংলাদেশে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বিএনপির খালেদা জিয়া উল্লেখ করেন যে সরকার গঙ্গা চুক্তি করে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে এবং গঙ্গা চুক্তি আসলে ভারতের স্বার্থেই করা হয়েছে [১৫, ১৬]।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য উপাত্ত বিশ্লেষন করে মতামত প্রদান করেন। ডঃ আইনুন নিশাত ও এমএফকে পাশা তাদের প্রবন্ধে [৪] ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালের ফারাক্কা ও হার্ডিঞ্জ ব্রীজের পানির প্রবাহ নিয়ে একটি বিশ্লেষন প্রকাশ করেন। তাদের বিশ্লেষনে দেখা যায় যে, ১৯৯৭ সালের জানুয়ারীর ১ থেকে ২০, এপ্রিলের ১ থেকে ১০ ও পুরো মে মাস বাংলাদেশ চুক্তিতে উল্লেখিত পরিমানের চেয়ে পানি কম পেয়েছে তবে জানুয়ারী ১ থেকে মে এর শেষ অবধি মোট প্রবাহ হিসেব করলে তার পরিমান চুক্তির উল্লেখিত পরিমানের চেয়ে বেশী এবং ১৯৯৮ সালেও একই চিত্র লক্ষ্য করা যায় [৪]।
তথ্যসুত্রঃ
[৪] ডঃ আইনুন নিশাত ও এমএফকে পাশা কতৃক লিখিত প্রবন্ধঃ “A Review of the Ganges Treaty of 1996” যা ২০০১ সালে “Globalization and Water Resources Management: The Changing Value of Water” শীর্ষক আলোচনা সভায় উপস্থাপিত হয়।
[১১] বিজনিস স্টান্ডার্ড ৬ মে ১৯৯৭
[১২] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ২১ জুলাই ১৯৯৭
[১৩] ফ্রান্সিস হ্যারিসন কতৃক বিবিসি’র রিপোর্ট (মঙ্গল বার, মার্চ ১০, ১৯৯৮)
[১৪] আশীষ চক্রবর্তী কতৃক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর রিপোর্ট (সোমবার, মার্চ ১৬, ১৯৯৮)
মন্তব্য
সিরিয়াস লেখা! চলুক !!
মন দিয়ে পড়ছি। সিরিজের শেষ পর্বে এসে আমার ভাবনাগুলো জানাবো। বল এখন তোমার কোর্টে
ধন্যবাদ মামুন ভাই।
-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
সংশোধনঃ
তথ্যসুত্র ১০ এর তারিখ ভুল হয়েছে, রবিবার মে ২৫, ১৯৯৭ হবে ( ভুলে ১৯৯৮ দিয়েছি)। মডুরা কেউ একটু ঠিক করে দিলে ভাল হবে।
-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
করা হল।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
ধন্যবাদ মাহবুব
-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে বিশদ কিছু লিখুন জাহিদ ভাই।
নতুন মন্তব্য করুন