ইয়ারলুং সাংপু থেকে ব্রহ্মপুত্রঃ
হিমালয় পর্বতমালার তিব্বত অংশে অবস্থিত কৈলাশ পর্বত আর তার পাশেই জিমা ইয়াংজং হিমবাহ। এই হিমবাহের গলত বরফ থেকেই উৎপত্তি ইয়ারলুং সাংপু নদের [২]। উৎস থেকে যাত্রা শুরু করে তিব্বত মালভুমির উপর দিয়ে প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার পূর্বদিকে চলার পর এটি 'নামছা বড়া' পর্বতকে ঘিরে এক 'U' আকৃতি ধারন করে। পরবর্তীতে এটি দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করে 'সিয়াং' ও আরো ভাটিতে গিয়ে 'দিহাং' নাম ধারন করে। এর ব্রহ্মপুত্র নামটি আসে মূলত আসামে প্রবেশ করার পরে। বাংলাদেশে প্রবেশ করার পরে এটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়, মূল ধারাটি যমুনা নাম নিয়ে পরবর্তীতে গঙ্গার সাথে মিলিত হয়ে পদ্মা নাম ধারন করে আর আরেকটি ধারা ব্রহ্মপুত্র নামেই ময়মনসিংহ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরবে গিয়ে মেঘনার সাথে মিলিত হয়। এই দুই ধারাই পরবর্তীতে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।
ইয়ারলুং সাংপু গিরিখাতঃ
চীনের ইয়ারলুং সাংপু প্রকল্পের সাথে জড়িয়ে আছে এর গিরিখাতের নাম। মূলত এই গিরিখাতই চীনকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ইয়ারলুং সাংপু থেকে পানিকে হিমালয়ের ভিতর দিয়ে উত্তরে নিয়ে যাওয়ার। উপরের পরিচ্ছেদে বলেছিলাম যে ইয়ারলুং সাংপু নদ হিমালয়ের নামছা বড়া পর্বতকে ঘিরে এক U আকৃতি গঠন করে এবং এই প্রায় ১৮০ ডিগ্রি দিক পরিবর্তনই গঠন করে 'ইয়ারলুং সাংপু গিরিখাত' যাকে বর্তমান কালে ধরা হয় বিশ্বের সবচাইতে গভীর গিরিখাত।এই গিরিখাতের স্থলে ইয়ারলুং সাংপু নদ মাত্র ২০০ কিলোমিটার পথ চলতে প্রায় ৩০০০ মিটার নিচে নামে যা এই গিরিখাতকে দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভাবনা ( Hydroelectric Potential)[৫]।
প্রকল্পের ইতিহাসঃ
সাধারণ ভারতীয় জনগণ এই প্রকল্পের কথা জানতে পারে মূলত ১৯৯৭ সালের ১৮ ই জুন ভারতের আউটলুক ম্যাগাজিনে আশীষ বিশ্বাষের ' A River Runs Through It' শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে[৭]। এই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয় পারমানবিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে হিমালয়ের মধ্য দিয়ে ২০০ কিমি দীর্ঘ সুড়ংগ করে ব্রহ্মপুত্র থেকে পানিকে চীনের শুষ্কাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে। একই প্রবন্ধে বাংলাদেশ প্রসংগে উল্লেখ করা হয়,
'বাংলাদেশের প্রথম সারির পানিবিজ্ঞানী ডঃ আইনুন নিশাত ঢাকায় এক সেমিনারে এই প্রকল্পে চীনের একক সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেন এবং এই ক্ষেত্রে বিষয়টিকে নিয়ে চীনের সাথে আলোচনা করার জন্য ভারতের সমর্থন আশা করেন'
যদিও ইতিপূর্বে এই প্রকল্প নিয়ে হইচই পড়ে যায় ১৯৯৬ সালে যখন 'সাইন্টিফিক এমেরিকান' ম্যাগাজিনে জন হরগ্যানের 'Peaceful Nuclear Explosions (PNE)' শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে[৮],
'চীনের উত্তরাঞ্চল যেখানে রয়েছে গোবি মরুভূমি তা মোট ভুখন্ডের প্রায় অর্ধেক অথচ স্বাদু পানির মাত্র প্রাপ্যতা রয়েছে মাত্র শতকরা ৭ ভাগ। সাম্প্রতিককালে কিছু চীনা প্রকৌশলী ব্রহ্মপুত্র নদ, যা কিনা ভারত ও বাংলাদেশে প্রবেশের পূর্বে চীনের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী এলাকায় বাঁক নিয়েছে, সেখান থেকে পানি স্থানান্তর করে চীনের এই শুষ্কাঞ্চলে নিয়ে যাবার প্রস্তাব রেখেছে। গত ডিসেম্বরে বেইজিং এ 'চীনা প্রকৌশল পদার্থবিদ্যা একাডেমী' র এক সভায় প্রকৌশলীরা এই মর্মে মত প্রকাশ করেছে যে এই প্রকল্প গতানুগতিক পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন অসম্ভব তবে আনবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করা যেতে পারে'
যুক্তরাষ্ট্র এই PNE নির্ভর এই পরিকল্পনাকে 'সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য' বলে মত প্রকাশ করে[৮]।
পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদপত্র ' দি ডেইলী টেলিগ্রাফ' এ ২২ অক্টোবর ২০০০ 'ডেমিয়েন মেকেলরয়' এর 'China Planning Nuclear Blasts to Build Giant Hydro Project'[৯] শীর্ষক খবর প্রকাশিত হয়।এই খবরে উল্লেখ করা হয় যে ২০০৯ সালে 'থ্রি গর্জ ড্যাম' বাস্তবায়ন শেষ হলে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। রিপোর্টে ভাটির দেশের সমস্যা নিয়ে উল্লেখ করা হয়,
'সমালোচকদের মতে এই প্রকল্পের ভাটি অঞ্চলের ( ভারতের আসাম, বাংলাদেশ) সামগ্রিক জীবনযাত্রা চীনা কতৃপক্ষের দয়ার উপর নির্ভরশীল হবে যারা তাদেরকে বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারে বা তাদের পানির সরবরাহও বন্ধ করে দিতে পারে'
তথ্যসুত্রঃ
কিছু ফাইল আমি আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে রেখে দিয়েছি যার লিঙ্ক নিচে দিলামঃ
[১] ‘Dams and Development: A New Framework for Decision Making’, World Commission on Large Dams.
[২] উইকিপিডিয়া
[৪] দক্ষিণ-উত্তর পানি প্রত্যাহার প্রকল্পের ওয়েবসাইট
[৬] ‘No Chinese dam over Brahmaputra: PM assures Arunachal’, Hindustan Times 21 October 2009.
[৭] Ashis K. Biswas, 'A River Runs Through It', Outluk, 18 June 1997
[৮] John Horgan, 'Peaceful Nuclear Explosions (PNE)', Scientific Americans, June 1996.
[৯] Damien Mcelroy, 'China planning nuclear blasts to build giant hydro project', The Daily Telegraph, 22 October 2000.
ছবিসুত্রঃ
ছবি ১ - উইকিমিডিয়া কমনস
ছবি ২ - দক্ষিণ-উত্তর পানি প্রত্যাহার প্রকল্পের ওয়েবসাইট
ছবি ৩ - দক্ষিণ-উত্তর পানি প্রত্যাহার প্রকল্পের ওয়েবসাইট
ছবি ৫- উইকিমিডিয়া কমনস
ছবি ৬- আন্তর্জাল
মন্তব্য
বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে লিখছেন। চালিয়ে যান।
যুক্তরাষ্ট্র এই প্রকল্পকে কি অর্থে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বলেছে জানতে ইচ্ছে করছে।
--------------------------------
~পর্যবেক্ষণ-অসাধ্য তত্ত্ব অর্থহীন~
ধন্যবাদ ধ্রুব।
যুক্তরাষ্ট্র এই প্রকল্পকে অগ্রহণযোগ্য বলার পেছনে মূল কারন PNE যার মানে হচ্ছে 'শান্তিপূর্ণ আনবিক বিস্ফোরণ'। শান্তিপূর্ণ আনবিক বিস্ফোরণ বলতে আমরা বুঝি সেই সব আনবিক বিস্ফোরণকে যা কোন উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেকোন আনবিক বিস্ফোরণই কিন্তু এটিকে সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য তথ্যাদি সরবরাহ করে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভয় হচ্ছে এর মাধ্যমে চীন এর ক্ষুদ্র এবং প্রাথমিক স্তরের আনবিক গবেষণাকে কোন বাঁধা ছাড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। বিস্তারিত জানার জন্য এই প্রবন্ধের তথ্যসুত্র ৮ এর সাহায্য নিতে পার।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
ভালো কাজ হচ্ছে জাহিদ ভাই। এ পর্ব ততটা দীর্ঘ করেননি দেখছি। চালিয়ে যান।
পিপিদা ধন্যবাদ। আসলে এই পর্বটাতে আমি প্রকল্পের ইতিহাসটাকেই নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম তাই বেশী বড় হয়নি। আগামী পর্বে প্রকল্পের বর্ণনা আর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেই শেষ করে দিব ভাবছি।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
নিন্ম অববাহিকায় এই প্রকল্পের প্রভাব এবং সেই সাথে চীনে এই প্রকল্পের প্রভাব আশা করি পরবর্তী পর্ব গুলোতে উঠে আসবে। জাহিদ ভাই আপনার কাছে আরেকটা প্রশ্ন আছে এই ব্যাপারে, চীন কি আগেও এরকম কোন পানি প্রত্যাহার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে? করলে কোন কোন দেশ এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? সেখানে তাদের পদক্ষেপ কি ছিল?
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ নিবিড়। আগামী পর্বেই প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে।
আমার জানামতে চীন নিজের দেশের মধ্যে পানি প্রত্যাহার অসংখ্যবার করেছে। আন্তঃসীমান্ত নদীতে বাঁধ দিয়েছে অনেক, বিশেষ করে মেকং নদীতে অনেক বাঁধ আছে এবং এখনো প্রস্তাবিত আছে আরো কয়েকটি কিন্তু মেকং নদী কমিশন থাকায় ভাটির দেশগুলোর সাথে এটি নিয়ে জটিলতা কম।তবে আন্তঃসীমান্ত নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের কথা এখনো শুনিনি।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
জাহিদ ভাই আপনার উত্তর দেখে আরেকটা প্রশ্ন মাথায় আসল, একটা দেশ যখন নিজ দেশের ভিতর পানি প্রত্যাহার করে তখন এর ক্ষতিকর প্রভাব নিশ্চয় দেশের একটা এলাকায় পরে তখন সেই এলাকার সাধারণ জনসাধারণ কি সেই প্রকল্পের বিরোধিতা করে না? চীনে এরকম কোন বিরধিতার মুখে প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে এমন কোন নজির কি আপনার জানা আছে?
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
চমৎকার প্রশ্ন নিবিড়। প্রদেশ ভিত্তিক দেশগুলিতে যখন একটি নদী একাধিক প্রদেশে বয়ে চলে তখন এই সমস্যা হয় বৈকি।
চীনে খ্রীষ্টের জন্মেরো আগে গ্র্যান্ড ক্যানেল দিয়ে পানি দেশের দক্ষিনাঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়, সুতরাং চীনের এই পানি প্রত্যাহারের ইতিহাস অনেক পুরোনো। সম্প্রতি বেইজিং অলিম্পিকের সময়ও হোয়াংহো নদী থেকে খাল কেটে পানি প্রত্যাহার করা হয়েছে। চীনে থ্রি গর্জ ড্যামের ফলে সৃষ্ট জলাধারের কারনে মোট ১.২৪ মিলিয়ন মানুষকে নতুন আবাসস্থল জোগাড় করতে হয়েছে। এর মধ্যে হুবেই প্রদেশ যেখানে জলাধারটি অবস্থিত সেখান থেকেই প্রায় ১৪০,০০০ মানুষকে অন্যত্র যেতে হয়েছে। চীনের কমিউনিষ্ট সরকার জনগণের আন্দোলনের তোয়াক্কা কখনই করেনি তাই এইসব মানুষদের প্রতিবাদের খবর আমরা জানতে পারিনা কখনো।
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিপক্ষে খোদ ভারতেই অধিক প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত হয় সবসময়।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
উত্তরের জন্য ধন্যবাদ জাহিদ ভাই। সিরিজের পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
অনেক কিছু জানছি। সিরিজ চলুক।
ধন্যবাদ ধর্মপুত্র।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
শিক্ষামূলক, অনেক কিছু সহজে জানতে পারছি।
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ সাফি।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
নতুন মন্তব্য করুন