প্রকল্পের প্রভাবঃ
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে উজানে বাঁধ দিলে ভাটিতে বন্যা নিয়ন্ত্রিত হয়। কথাটি তাত্ত্বিক ভাবে সঠিক হতে পারে কিন্তু অনেক সময় বাস্তবিকভাবে এর ব্যাতিক্রম ঘটতে পারে।একটু বিশদে গেলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। একটি বাঁধ উজানে বিশাল জলাধার তৈরী করে এবং এই জলাধারের পানি দুই দিকে চাপ প্রদান করে, এক আনুভূমিক ভাবে বাঁধের উপর আর উলম্ব ভাবে জলাধারের তলদেশের উপর।
আনুভূমিক চাপ মূলত বাঁধকে উপড়ে ফেলতে অথবা বাঁধের ফাটল ধরাতে চেষ্টা করে। যদিও সব বাঁধ এই সকল চাপের জন্য ডিজাইন করা থাকে তবে ঝুকির বিষয় হলো এই সকল বাঁধের একটি নিরাপদ পানির স্তর থাকে যার উপরে গেলে বাঁধ ভেঙে যায়। যদি কোন কারনে বাঁধের উজানে অতিবৃষ্টিপাত হয় সেক্ষেত্রে বাঁধের নিরাপত্তার জন্য বিকল্প পথ যেমন স্পিলওয়ে দিয়ে অতরিক্ত পানিকে ছেড়ে দেয়া হয়। আকষ্মত এই পানি ছেড়ে দেওয়া ভাটিতে ব্যাপক বন্যার কারণ ঘটাতে পারে কারন বাঁধ হলে স্বাভাবিক ভাবেই আগে যে অঞ্চলগুলি বন্যা প্রবণ ছিল সেই অঞ্চল গুলতে মানুষের অভিযোজন বাড়বে আর তাই ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও আগের থেকে বেড়ে যেতে পারে।
অনেক বিশেষজ্ঞগন ইতিমধ্যে বাঁধের কারনে সৃষ্ট জলাধার দ্বারা ভূমিকম্প সংঘটনের বা ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা বৃদ্ধির স্বপক্ষে তাদের গবেষণা লব্ধ যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। এমনিতেই ইয়ারলুং সাংপুর এই গিরিখাতের অঞ্চলটি ভূমিকম্প প্রবণ আর তার সাথে এই বাড়তি চাপ বাঁধ ভাঙ্গার ঝুকিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। নিকট অতীতের কথা বললে ১৯৫০ সালে এই অঞ্চলে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। রিক্টার স্কেলে ৮.৬ মাত্রার [১১] এই ভূমিকম্পে ইয়ারলুং সাংপুর গতিপথ অনেক পরিবর্তিত হয়।আসামে এর উপনদী সুবাঁশিরীতে পাথর জমে এর গতিপথ বন্ধ হয়ে যার যা আট দিন পরে ভেঙ্গে গিয়ে ৭ মিটার উচু ঠেউ উৎপন্ন করে ভাটিতে অনেক গ্রাম আর মানুষ ভাসিয়ে নিয়ে যায়।এইবার ভাবুন এইরকম একটি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় এই বাঁধ নির্মান করলে এরকম আরো একটি ভুমিকম্প হলে এর ভাটিতে মানুষের অস্তিত্ত্ব কতটা হুমকীর সম্মুখীন হবে।
পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে বাংলাদেশে তার প্রভাব কি হতে পারে? একটি উদাহরণ দিলেই এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যাবে।২০০০ সালের জুন মাসে ভারতের হিমাচল প্রদেশে এক আকষ্মাত বন্যা সংঘটিত হত। সুত্রমতে ৫০ ফূট উচ্চতার ঢেউ সম্পন্ন পানির স্রোত মূহুর্তের মধ্যে প্রায় ১০০ মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায় ১২০ কিমি দীর্ঘ হাইওয়ে আর ভেঙে যায় ৮০ টির মত সেতু [১০]। এই রহস্যজনক বন্যার কারন খুঁজ়তে গিয়ে অবশেষে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( Indian Space Research Organization , ISRO) এর বিজ্ঞানীরা এই মর্মে নিশ্চিত হন যে সাটলেজ নদীতে উজানে প্রাকৃতিক বাঁধের ফাটল থেকেই এই আকষ্মাত বন্যার সৃষ্টি হয়। স্যাটেলাইট দ্বারা তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বন্যার আগে উজানে তিব্বতে সাটলেজ নদীতে বিশাল জলাধারের অবস্থান ছিল অথচ বন্যার পর পরের ছবিতে তা আর দেখা যায়নি। পাঠক এইবার আন্দাজ করুন ৪০,০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জলাধারে কি পরিমান পানি থাকবে আর সেই বাঁধে যদি কখনো ফাটল ধরে তার পরিনাম আসাম ও বাংলাদেশে কি হবে? আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই ঝুকি নিয়ে কেন বসবাস করবে ?
Peaceful Nuclear Explosions বা শান্তিপূর্ণ নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ হচ্ছে বেসামরিক কাজে বা মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে ধরনের নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ব্যবহার করা হয় [২]। উইকিপিডিয়াতে প্রাপ্ত তথ্য মতে ষাট এর দশক থেকে সত্তর এর দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশ কিছু পিএনই সংঘটন করে। বাঁধ নির্মানের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬৫ সালে শ্যাগন নদীর তলদেশে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটায় যা ফলশ্রুতিতে শ্যাগন হ্রদ সৃষ্টি করে। এই বিস্ফোরণের ছবি উপরে দিলাম এবং ভিডিওর লিঙ্ক দিলাম। প্রাপ্ত তথ্যমতে সেই বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়তার ফলাফল আজও সারঝাল বাসী ( কাজাকাস্থান, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এর একটি গ্রাম )। গ্রামবাসীদের ভাষ্যমতে আনবিক হ্রদ ( শ্যাগন লেককে তারা আনবিক লেক নামকরণ করেছে) এর পানি থেকে তেজস্ক্রিয়তা ভূগর্ভস্থ পানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশদ জানতে নিচের এই ভিডিওটা দেখুনঃ
সুতরাং তথাকথিত এই পিএনই নামে শান্তিপূর্ণ শোনালেই আসলে কাজে নয়। ইরায়লুং সাংপুর গিরিখাতে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের মাধ্যমে সুড়ংগ করে পানিকে স্থানান্তর করার এই পরিকল্পনা কতটা শান্তিপূর্ণ সেটা নিয়ে গবেষণার অবকাশ রয়েই যায়।নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ দিয়ে টানেল করলে তার তেজস্ক্রিয়তা যে ভাটিতে প্রবাহিত হয়ে আসবেনা তার নিশ্চয়তা কে দিয়ে পারে?
তার থেকেও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে ইয়ারলুং সাংপু গিতিখাত এলাকা এমনিতেই ভূমিকম্প প্রবণ এবং নিকট অতীতে ১৯৫০ সালে সেখানে রিক্টার স্কেলে ৮.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে সেকথা আমি উপরের আলোচনায় উল্লেখ করেছি। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরনের মাধ্যমে হিমালয়ের মধ্য দিয়ে সুরংগ করার সময় ভূতাত্ত্বিক ভাবে যে কোন বিপর্যয় ঘটবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
আমি এই প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে আলোচনা শুরু করার পূর্বেই বলেছিলাম যে এখনো এই প্রকল্পের কোনরূপ বিস্তারিত তথ্য আমাদের হাতে নেই যেমনটা ছিল টিপাইমুখের ক্ষেত্রে। তাই আমি আমার আলোচনায় চেষ্টা করেছি বাহ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে এর সম্ভাব্য প্রভাব সমুহ আলোচনা করতে। পাঠকদের জ্ঞান ক্ষুধা কতটা মেটাতে পেরেছি তার ভার তাই তাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম।
তবে একটি জিনিস বলে রাখি, চীনে এই প্রকল্প শুধু পানিসম্পদ প্রকল্প নয় এর সাথে জড়িয়ে আছে বিশ্ব রাজনীতি। আগামী পর্বে এর উপর আলোকপাত করেই এই সিরিজের ইতি টানব।
তথ্যসুত্রঃ
কিছু ফাইল আমি আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে রেখে দিয়েছি যার লিঙ্ক নিচে দিলামঃ
[১] ‘Dams and Development: A New Framework for Decision Making’, World Commission on Large Dams.
[২] উইকিপিডিয়া
[৪] দক্ষিণ-উত্তর পানি প্রত্যাহার প্রকল্পের ওয়েবসাইট
[৬] ‘No Chinese dam over Brahmaputra: PM assures Arunachal’, Hindustan Times 21 October 2009.
[৭] Ashis K. Biswas, 'A River Runs Through It', Outluk, 18 June 1997
[৮] John Horgan, 'Peaceful Nuclear Explosions (PNE)', Scientific Americans, June 1996.
[১০] Water War in South Asia? Brahmaputra: Dam & Diversion, October 2003
মন্তব্য
পুরোটা শেষ হবার অপেক্ষায় আছি। একটি পিডিফ লিঙ্ক দিয়ে দিও। পর্বগুলো একটু ছোট ছোট দিচ্ছ মনে হচ্ছে?
ধন্যবাদ স্বাধীন ভাই। আগামী পর্বে শেষ করে পুরো সিরিজের পিডিএফও দিয়ে দেব। আসলে পড়তে ও লিখতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে আবার বেশি দিন পরে দিলে পাঠকদের আগ্রহ কমে যেতে পারে তাই একটু ছোট করেই দিচ্ছি।আর একটা পর্ব দিয়েই সিরিজ শেষ করে দিব।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
আমিও পিডিএফের অপেক্ষায়।
চমৎকার হচ্ছে রিপন। ছোট একটা সংশোধনী, নদীটির নাম সাটলেজ হবে, সুটলেজ নয়। এই নদী আর তার বাকী চার বোনের সংস্কৃত নামগুলি দিয়ে দিলাম, তোমার চেনা চেনা লাগার কথা।
বিয়াস = বিপাশা
সাটলেজ = শতদ্রু
রাভী = ইরাবতী
চেনাব = চন্দ্রভাগ
ঝেলাম = বিতস্তা
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ পান্ডবদা, সংশোধন করে দিলাম।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
আহারে, কতদিন পরে নামগুলো আবার মনে পড়ল। আমার মনে আছে, আমাদের বইয়ে চন্দ্রভাগা লেখা ছিল। কোনটা ঠিক পাণ্ডবদা?
আমাদের বইগুলো সম্ভবতঃ কোন ইংরেজী বইয়ের অনুকরণে লেখা তাই (Chandrabhaga) হিসেব করে "গ-এ আ-কার" দেয়া হয়েছে । এখানে সংস্কৃত নামটা খেয়াল করুন, গ-এ কিন্তু আ-কার নেই। নামের অর্থ (চন্দ্রের ন্যায় মুখ) বিচার করলেও চন্দ্রভাগ-ই হবার কথা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সিরিজটা ভালো হচ্ছে জাহিদ।
ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।
ধন্যবাদ ফিরোজ ভাই।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
আগের পর্বগুলো পড়া হয় নাই... শেষপর্ব আসুক একবারে পড়বো। পিডিএফ পড়ার একটা বিপদ হলো সেখানে মন্তব্য থাকে না। কিন্তু কিছু মন্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নজু ভাই শেষ পর্ব দুই এক দিনের মধ্যেই দিব। পিডিএফ এর মন্তব্যে সহমত তবে শেষ পিডিএফ ফাইলে পুরোটা একসাথে থাকে বলে অনেকে তথ্যসুত্র হিসেবে পছন্দ করে।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
ধন্যবাদ জাহিদ স্যার আমাদেরকে এই গুরূত্বপূর্ণ তথ্যগুলো জানানোর জন্য ।
ধন্যবাদ মামুন।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
স্যার উইলিয়াম উইলকক্সের লেকচারস অন দা এইন্শান্ট্ সিস্টেম অব ইরিগেশান ইন বেঙ্গল বইটা আজকে লাইব্রেরি থেকে আনছি। তোমার অবশ্যই অনুবাদ করা লাগবে। যদি কথা দাও এটার অনুবাদ করবা, তায়লে আমি স্ক্যান করে তোমারে পাঠাবো।
বস কত পৃষ্ঠা !! যাউকগা পাঠাইয়া দাও, কথা দিলাম অনুবাদ করব। হয়ত সময় লাগবে কিন্তু অবশ্যই করব। এই বইটার অনুবাদের দরকার আছে।
----------------------------------------------------------------------------
zahidripon এট gmail ডট কম
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২৮; ফন্ট বড় বড়। প্রতি পৃষ্ঠায় শব্দসংখ্যা প্রায় ২২০ করে। বেশি বড় কাজ না। তয় ভাষা মাশাল্লা। আমি একবার করতে গিয়া ক্ষেমা দিছিলাম।
জাহিদ,
ছফাগিরি নিয়ে বেশ ক্যাঁচালে ছিলাম। আজ একটু অবসর পাওয়ায় অধ্যায় এক স্ক্যান করে দিলাম। অনুবাদ আরম্ভ করে দাও। বাকি অধ্যায়গুলো স্ক্যান করে পাঠাবো একটা একটা করে।
জাহিদ ,
কোন পৃষ্ঠা পড়তে অসুবিধা হলে জানাইয়ো।
নতুন মন্তব্য করুন