এবার ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করবে চীন

সচল জাহিদ এর ছবি
লিখেছেন সচল জাহিদ (তারিখ: বুধ, ২৭/০১/২০১০ - ৩:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চীনের ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি অপসারন নিয়ে আমার এই লেখাটি ২৭ জানুয়ারী ২০১০ এ দৈনিক কালের কন্ঠের রাজকূট ফিচার পাতায় প্রকাশিত হয়। লেখাটি সচলায়তনে পাঁচ পর্বে প্রকাশিত আমার 'দক্ষিণ এশিয়ার পানিবিরোধঃ চীনের ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি প্রত্যাহার প্রকল্প' শীর্ষক সিরিজের সংক্ষেপিত রূপ বা সারমর্ম। পরবর্তীতে তথ্যসুত্র হিসেবে কাজে লাগতে পারে বলে এটিকে নিজের ব্লগে রেখে দিলাম। যেহেতু সচলায়তনের নীতিমালা মেনে লেখাটিকে প্রথম পাতায় প্রকাশ করিনি তাই পোষ্টে রেটিং বা মন্তব্য নিরুৎসাহিত করছি।
=========================================================
বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাগেলডিন একবার বলেছিলেন, 'পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ হবে পানির জন্য।' তাঁর এই উক্তির মর্মার্থ আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। 'টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প' নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক ও বিশেষজ্ঞ মহলে যখন আলোচনার ঝড় বইছে, সেখানে স্বয়ং ভারতই চিন্তিত হয়ে পড়েছে চীনের ইয়ারলুং সাংপু প্রকল্প নিয়ে। বাংলাদেশেরও ভবিষ্যৎও এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, কারণ, চীন অধ্যুষিত তিব্বতে যে নদের নাম ইয়ারলুং সাংপু তারই ভারতীয় সংস্করণ ব্রহ্মপুত্র আর বাংলাদেশে তার মূল প্রবাহ যমুনা। ভারত উজানে নদীগুলোতে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করায় এমনিতেই বাংলাদেশ তার নায্য হিস্যা পাচ্ছে না। এর উপর যদি চীনের ইয়ারলুং সাংপু পানি প্রত্যাহার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়বে। এই প্রকল্প ভারত-চীন কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরো নাজুক করে ফেলবে, যার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের উপরই পড়বে। যদিও চীন আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক মাধ্যমে ভারতকে আশ্বাস দিয়েছে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না, তবে এ রকম আশ্বাসের মূল্য যে আসলে কতটুকু সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

কেন এই প্রকল্প :

চীনের প্রধান নদীগুলো মূলত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত যার মধ্যে রয়েছে ইয়াংজি, হোয়াংহো ও আমুর। এছাড়া চীনের দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মেকং, পার্ল আর ইয়ারলুং সাংপু (ব্রহ্মপুত্র)। এই নদীগুলোর মধ্যে একমাত্র পার্ল বাদে বাকি সব কয়টির উৎস তিব্বতের মালভূমি।

চীনের প্রধান দুই অববাহিকা ইয়াংজি ও হোয়াংহো। চৈনিক সভ্যতার সূচনা হয়েছিল মূলত এই হোয়াংহো নদীকে কেন্দ্র করে। এই নদী অববাহিকায় যেমন শস্যের আবাদ হতো তেমনি প্রবল বন্যায় প্রতিবছরই মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। হোয়াংহো তাই যেমন চীনের আশীর্বাদ তেমনি চীনের দুঃখও বটে। অথচ আজ এই নদীর অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। হোয়াংহোর প্রবাহ এতই কমে গেছে যে, ১৯৭২ সালে চীনের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো এই নদী সমুদ্রে পেঁৗছার আগেই শুকিয়ে যায়। ১৯৮৫ সাল থেকে এটি প্রায় প্রতি বছরই কিছু সময়ের জন্য শুকিয়ে যেতে থাকে। ১৯৯৬ ও '৯৭ সালে এই নদীর প্রবাহ যথাক্রমে ১৩৩ ও ২২৬ দিন সমুদ্রে পৌঁছতে ব্যর্থ হয় এবং এর চলার পথে সর্বশেষ শ্যান্ডং প্রদেশ পুরোপুরি শুষ্ক থাকে।

পানিবিজ্ঞানের ভাষায় চীনকে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। আর্দ্র দক্ষিণ চীন আর শুষ্ক উত্তর চীন, আর এই দুই ভাগকে আলাদা করেছে ইয়াংজী নদী অববাহিকা। চীনের ১.২ বিলিয়ন জনসংখ্যার সিংহ ভাগ, প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন লোক বাস করে দক্ষিণ চীনে আর বাকি ৫৫০ মিলিয়ন বাস করে উত্তর চীনে। দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে চীনের এক-তৃতীয়াংশ আবাদি জমি আর মোট পানিসম্পদের চার-পঞ্চমাংশ। অন্যদিকে উত্তর চীনে রয়েছে মোট আবাদি জমির দুই-তৃতীয়াংশ; অথচ পানিসম্পদ আছে মাত্র এক-পঞ্চমাংশ। অর্থাৎ, দক্ষিণ চীনে একক পরিমাণ জমি চাষ করতে যে পরিমাণ পানি সরবরাহ আছে উত্তর চীনে রয়েছে তার মাত্র আট ভাগের এক ভাগ।

কৃষিজমির জন্য পানির চাহিদা আর জোগানের দ্বৈরথে পড়ে চীনের উত্তরাঞ্চলের নদী ও হ্রদগুলো ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিল্পায়ন আর নগরায়নের ফলে সৃষ্ট পানির চাহিদা ও তার জোগান। চীনের দ্রুত বর্ধমান শিল্পায়নের সঙ্গে পানিসম্পদের চাহিদা আর জোগানের এই বৈষম্য দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য চীন উত্তরাঞ্চলের পানিকে দক্ষিণে নিয়ে যাওয়ার এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কূটনীতির দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে 'দক্ষিণ-উত্তর পানি প্রত্যাহার প্রকল্প।'
দক্ষিণ-উত্তর পানি প্রত্যাহার প্রকল্প: মাও সে তুংয়ের মস্তিষ্কজাত এই প্রকল্পের গবেষণা শুরু পঞ্চাশের দশকে। পরিকল্পনায় তিনটি পানি স্থানান্তর প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়_পশ্চিম-পথ প্রকল্প, মধ্য-পথ প্রকল্প এবং পূর্ব-পথ প্রকল্প। এই তিনটি পথে ইয়াংজী নদী থেকে পানি কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে উত্তর চীনে নিয়ে যাওয়াই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। বাস্তবায়িত হলে এটি হবে বিশ্বের বৃহত্তম পানি স্থানান্তর প্রকল্প।

প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পূর্ব-পথটি তুলনামূলকভাবে সহজ। কারণ এই পথে রয়েছে চীনের গ্র্যান্ড ক্যানাল, মানুষের তৈরি প্রায় ১৭৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ পানিপথ, যা কিনা চীনের প্রাচীরের মতোই আরেক বিস্ময়। এই পথ দিয়ে বছরে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ঘনমিটার পানিকে জিয়াংসু প্রদেশ থেকে তিয়াঞ্জিম মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যাওয়া হবে।

মধ্য-পথ দিয়ে বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানিকে হ্যান নদী (যা কিনা মূলত ইয়াংজি নদীর উপনদী) থেকে ১২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল দিয়ে বেইজিং নিয়ে যাওয়া হবে। এই খালকে নিয়ে যেতে হবে হোয়াংহো নদীর তলদেশ দিয়ে এবং এ জন্য প্রায় ২৫ লাখ মানুষকে তাদের বাসস্থান থেকে সরিয়ে নিতে হবে।

পশ্চিম-পথে তিব্বত মালভূমি থেকে পানি উত্তর ও উত্তরপশ্চিম চীনে নিয়ে যাওয়া হবে। মূলত ইয়াংজির উপনদী তংতিয়ানহি, ইয়ালুং ও ডাডুহি থেকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পথে পানি সর্বশেষে হোয়াংহো নদীতে নিয়ে যাওয়া হবে। মজার বিষয় হচ্ছে, ইয়াংজির এই উপনদীগুলোর তলদেশ হোয়াংহো নদীর তলদেশ থেকে নিচে অবস্থিত। যার ফলে এই সংযোগ খালগুলোতে পানি পাম্প করে প্রথমে উপরে তুলতে হবে। এই পানির স্তর ঠিক করার কাজটি করতে তিনটি বৃহৎ বাঁধও নির্মাণ করতে হবে। চীনের দক্ষিণ-উত্তর পানি প্রত্যাহার প্রকল্পের এই পশ্চিম-পথেরই বিতর্কিত সম্প্রসারণ প্রকল্প হিসেবে ধরা হয় 'ইয়ারলুং সাংপু প্রকল্প' বা আমাদের চোখে 'চীনের ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি প্রত্যাহার প্রকল্প'।

ইয়ারলুং সাংপু থেকে ব্রহ্মপুত্র :

হিমালয়ের তিব্বত অংশের জিমা ইয়াংজং হিমবাহের গলিত বরফ থেকেই ইয়ারলুং সাংপু নদের উৎপত্তি। উৎস থেকে যাত্রা শুরু করে তিব্বত মালভূমির উপর দিয়ে প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার পূর্বদিকে চলার পর এটি 'নামছা বড়া' পর্বতকে ঘিরে অশ্বখুরাকৃতি বা ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো আকৃতি ধারণ করে গঠন করে 'ইয়ারলুং সাংপু গিরিখাত'। এটি বিশ্বের সবচাইতে গভীর গিরিখাত। এই স্থানে ইয়ারলুং সাংপু নদী ২০০ কিলোমিটার পথ চলতে প্রায় ৩০০০ মিটার নিচে নামে, ফলে এই গিরিখাতে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভাবনা। পরবর্তীতে এটি দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে এটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়, মূলধারাটি যমুনা নাম নিয়ে পরবর্তীতে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে আর আরেকটি ধারা ব্রহ্মপুত্র নামেই ময়মনসিংহ দিয়ে ভৈরবে গিয়ে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়। এই দুই ধারাই আবার পরবর্তীতে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।

কী থাকছে ইয়ারলুং সাংপু প্রকল্পে :

এই প্রকল্পের দুটি প্রধান অংশ।

১. ইয়ারলুং সাংপু গিরিখাতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন।
২. পানিকে ইয়ারলুং সাংপু নদী থেকে স্থানান্তর করে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়া ও গানসু প্রদেশে নিয়ে যাওয়া।

প্রথমেই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রসঙ্গে আসি। গোড়ার দিকে পরিকল্পনা ছিল এই গিরিখাতে ১১টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হবে, যা থেকে মোট ৭০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। ১৯৮৬ সালে গ্লোবাল ইনফাস্ট্রাকচার ফান্ডের আওতায় এই প্রকল্পটি আলাস্কায় একটি সভায় আলোচিত হয়। পরিকল্পনাটি যথেষ্ট সমর্থন না পাওয়ায় পরবর্তীতে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি একক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিকল্পনা করা হয়। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে বেইজিংয়ে চীনা প্রকৌশল পদার্থবিদ্যা একাডেমিতে আলোচিত হয়। প্রকল্পের মূল পরিকল্পনাকারী অধ্যাপক চ্যান চুয়ান্যু'র সাক্ষাৎকার অনুযায়ী এই প্রকল্পে হিমালয়ের ভেতর দিয়ে শান্তিপূর্ণ নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের সাহায্যে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে পানিকে গিরিখাতের বাঁকের এক পাশ থেকে অন্য পাশে নেওয়া হবে। এই ১৫ কিলোমিটার পথ যেতে পানি ৩ হাজার মিটার নিচে নামবে, যা অতিক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ বিভব তৈরি করবে। অধ্যাপক চুয়ান্যু'র মতে এই ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি দিয়ে ইয়ারলুং সাংপু থেকে পানিকে পাম্প করে এখান থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

প্রকল্পের প্রভাব :

উজানে ক্ষতিগ্রস্ত তিব্বত, ভাটিতে বাংলাদেশ: ৪০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে যে বিশাল জলাধার সৃষ্টি হবে, তা মূলত বিস্তৃত হবে ইয়ারলুং সাংপু গিরিখাতসহ তিব্বত মালভূমির এই নদী সংলগ্ন অববাহিকাজুড়ে। তিব্বত মালভূমির মোট জীবের শতকরা ৬০ ভাগ বাস করে এই গিরিখাত এলাকায়। বাঁধ নির্মিত হলে এই বিপুল পরিমাণ স্থলজ বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট হবে, সেই সঙ্গে বিপন্ন হবে পরিবেশ।

এই বাঁধের কারণে আশপাশের তিব্বতিদের স্থানান্তর করতে হবে। তাদের কাছে এই স্থান ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিব্বতিরা বিশ্বাস করে, এই গিরিখাত তাদের রাদেবী ভাজরাওগিনীর তীর্থস্থান। সুতরাং তিব্বতিদের কাছে এই স্থান ত্যাগ কোনো কিছু দিয়েই পূরণ করা সম্ভব নয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশ এই প্রকল্পের ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত। চীন ঠিক কতটুকু পানি অপসারণ করবে, সেই তথ্য পরিষ্কার করে না জানানো পর্যন্ত এই প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে নিজের অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে ভাটিতে এই প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে একটি সাধারণ আলোচনা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ বা এর আশপাশের এলাকার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই অঞ্চলে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বছরের ৮০ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আর বাকি আট মাসে মাত্র শতকরা ২০ ভাগ বৃষ্টিপাত হয়। তাই এই অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট সবসময়ই প্রকট। বাঁধের মূল কাজ হচ্ছে আর্দ্র মৌসুমে পানি জলাধারে জমিয়ে রেখে শুষ্ক মৌসুমে সেটি ব্যবহার করা। এখন বাঁধ হলে আর্দ্র মৌসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) জলাধারে পানি আটকে রাখা হবে। সুতরাং সেই সময় আসাম ও বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রে পানি প্রবাহ কমে যাবে। আবার যেহেতু পানি চীনের উত্তরাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে তাই শুষ্ক মৌসুমেও এই নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ বছরের সব সময়ই ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ কমে যাবে। ফলে এই নদীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্যসম্পদ, শিল্প, নৌচলাচল সর্বোপরি মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার শাখা নদীগুলো অদূর ভবিষ্যতে শুকিয়ে যাবে। গঙ্গার পানি কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার যে উপক্রম হয়েছে, একই অবস্থা হবে দেশের উত্তর মধ্যাঞ্চলের।

বাঁধ-সৃষ্ট বা বাঁধ-ভাঙা দুর্যোগের ঝুঁকি :

একটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, উজানে বাঁধ দিলে ভাটিতে বন্যা নিয়ন্ত্রিত হয়। কথাটি তাত্তি্বকভাবে সঠিক হতে পারে; কিন্তু অনেক সময় বাস্তবতা অন্য রকম হয়। বাঁধ উজানে বিশাল জলাধার তৈরি করে এবং এই জলাধারের পানি দুই দিক থেকে চাপ দেয়, আনুভূমিকভাবে বাঁধের উপর আর উলম্বভাবে জলাধারের তলদেশের উপর।

আনুভূমিক চাপ মূলত বাঁধকে উপড়ে ফেলতে অথবা বাঁধের ফাটল ধরাতে চেষ্টা করে। যদিও সব বাঁধ এই সব চাপের প্রভাব হিসাব করেই তৈরি করা হয়, তবে ঝুঁকির বিষয় হলো, এসব বাঁধের একটি নিরাপদ পানির স্তর থাকে, পানির স্তর যার উপরে গেলে বাঁধ ভেঙে যায়। যদি কোনো কারণে বাঁধের উজানে অতিবৃষ্টিপাত হয় সেক্ষেত্রে বাঁধের নিরাপত্তার জন্য বিকল্প পথ দিয়ে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। হঠাৎ করে ছেড়ে দেওয়া এই বিপুল পরিমাণ পানি ভাটি অঞ্চলে ব্যাপক বন্যার কারণ ঘটায়।

বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে বাঁধের কারণে সৃষ্ট জলাধার দ্বারা ভূমিকম্প সংঘটনের বা ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা বৃদ্ধির পক্ষে তাদের গবেষণা লব্ধ যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। এমনিতেই ইয়ারলুং সাংপুর এই গিরিখাতের অঞ্চলটি ভূমিকম্পপ্রবণ আর তার সঙ্গে এই বাড়তি পানির চাপ বাঁধ ভাঙার ঝুঁকিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ১৯৫০ সালে এই অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। রিখটার স্কেলে ৮.৬ মাত্রার এই ভূমিকম্পে ইয়ারলুং সাংপুর গতিপথ অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। আসামে এর উপনদী সুবাঁশিরীতে পাথর জমে এর গতিপথ বন্ধ হয়ে যায়, যা আট দিন পর ভেঙে ৭ মিটার উঁচু ঢেউ উৎপন্ন করে ভাটিতে অনেক গ্রাম আর মানুষ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ রকম একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় এই বাঁধ নির্মিত হলে ভাটিতে ভারত ও বাংলাদেশে সবসময়ই বড় বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়ে যায়।

শান্তিপূর্ণ নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ:

যুদ্ধ নয় বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে যে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, তাকে বলা হচ্ছে শান্তিপূর্ণ নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ বা পিএনই। ষাট ও সত্তর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশ কিছু পিএনই সংঘটন করে। বাঁধ নির্মাণের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬৫ সালে শ্যাগন নদীর তলদেশে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটায়। সেই বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়তার ফলাফল আজো সারঝালবাসী বয়ে বেড়াচ্ছে। শ্যাগন লেকের পানি থেকে তেজস্ক্রিয়তা ভূগর্ভস্থ পানিতে ছড়িয়ে পড়েছে বলে সেখানকার অধিবাসীরা অভিযোগ করেছে। সুতরাং তথাকথিত এই পিএনই নামে শান্তিপূর্ণ শোনালেই আসলে কাজে নয়। ইরায়লুং সাংপুর গিরিখাতে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের মাধ্যমে সুড়ংগ করে পানিকে স্থানান্তর করার এই পরিকল্পনা কতটা শান্তিপূর্ণ সেটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েই যায়। এর দীর্ঘমেয়াদি তেজস্ক্রিয়তা ভাটিতে ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ ও ভারতের জনজীবনে সুদূরপ্রসারি প্রভাবের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

রাজনীতি ও ইয়ারলুং সাংপু প্রকল্প :

স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে 'অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ' স্লোগানের মুখোশে যুক্তরাষ্ট্রের 'অপারেশন প্লাউশেয়ার' ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের 'প্রোগ্রাম-৭' (জাতির অর্থনৈতিক স্বার্থে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ প্রকল্প) পৃথিবীকে যতটা শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিতে পেরেছে তার থেকে অনেক অনেক গুণ তেজস্ক্রিয়তার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। এক হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন প্লাউশেয়ারের মাধ্যমে ১৯৬১ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে ২৮টি নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ চালায়; অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন 'প্রোগ্রাম-৭'-এর আওতায় ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে ১১৫টি নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটায়। যদিও এই প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য দেখানো হয় উন্নয়নের জন্য নিউক্লিয়ার গবেষণা। কিন্তু আসলে এটি ছিল মূলত দুই পরাশক্তির একের অন্যকে শক্তি প্রদর্শন।
১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে চীনের পিএনই'র মাধ্যমে হিমালয়ের মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ করে ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা যখন সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়, তখন রথী-মহিরথীদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভয়, এই প্রকল্পের নাম করে চীন আবার তাদের নিউক্লিয়ার গবেষণা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাবে। যদিও আমেরিকার ১০৩০টি আর রাশিয়ার ৭১৫টি নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের সঙ্গে চীনের ৪৩টি বিস্ফোরণ তুলনীয় নয়, তবুও ইয়ারলুং সাংপু প্রকল্প বাস্তবায়নের নেপথ্যে তাদের নিউক্লিয়ার গবেষণা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার যুক্তি অমূলক নয়।

এ তো গেল বিশ্ব রাজনীতির খবর, এবারে চোখ ফেরাই এশিয়ার দিকে। একুশ শতকের বিশ্বে সুপারপাওয়ার হিসেবে যাদের উত্থান হওয়ার কথা তার তিনটি দেশই এশিয়াতে_রশিয়া, চীন ও ভারত। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এই দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা আছে।একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে রাশিয়ার সাইবেরীয় নদীগুলোর পানি স্থানান্তর প্রকল্প, চীনের দক্ষিণ-উত্তর পানি স্থানান্তর প্রকল্প আর ভারতের রিভার লিঙ্কিং প্রকল্পকে কি এক সুতায় বাঁধা যায় না? এই তিনটি দেশের একটি সাধারণ সমস্যা হচ্ছে, এক অংশে পানির প্রতুলতা আর অন্য অংশে অপ্রতুলতা। এই দেশগুলোর উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে শক্তি উৎপাদন, শিল্পায়ন আর সেইসঙ্গে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। যার জন্য এদের প্রয়োজন পানির সমবণ্টন।চীন খুব ভালো করে জানে, ভারতের রিভার লিঙ্কিং প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনেকাংশে নির্ভর করবে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের উপর। কারণ এই প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র থেকে পানিকে গঙ্গায় নিয়ে আসা। সুতরাং চীন ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ কমিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেলে ভারতকে বেকায়দায় ফেলার একটা সুযোগ নিতেই পারে। আর সেইসঙ্গে রাশিয়ার প্রকল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য চীনের এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি :

২০০৯-এর নভেম্বরের শুরুর দিকে ভারতের জাতীয় রিমোট সেন্সিং এজেন্সি নিশ্চিত হয়েছে যে, চীন ব্রহ্মপুত্র নদীতে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে দিয়েছে। এজেন্সির প্রতিনিধিরা সচিব কমিটির সামনে এই নির্মাণ কাজের বিভিন্ন প্রমাণ, নির্মাণ এলাকায় ট্রাকের চলাচল ও মাটি খননের কাজের ছবি প্রদর্শন করেন। এই প্রসঙ্গে চীনের ব্যাখ্যা চাওয়া হলে চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র এক সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন,

'চীন একটি দায়িত্বশীল দেশ এবং চীন এমন কিছু করবে না, যাতে অন্যদের ক্ষতি হবে।'

কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, কয়েকদিন আগেই ইন্দাস নদীর ভাটিতে থাকা পাকিস্তানকে কোনো কিছু না জানিয়েই চীন সেই নদীতে বাঁধ দিয়েছে। সুতরাং কূটনৈতিক ভাষায় দায়িত্বশীলতার কথা উচ্চারণ করলেও, শেষপর্যন্ত সেটি কতটুকু মেনে চলা হবে সেটা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

zahidripon@gmail.com

লেখক পরিচিতি : তরুণ পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ জাহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। তিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টাতে পিএইচডি গবেষণা করছেন।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।