সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফর করছেন। তার সফরে আবারো উঠে এসেছে তিস্তা চুক্তির প্রসংগ। শুধু তিস্তা নয়, গঙ্গা, বারাক, ব্রহ্মপুত্র, সারি, ফেনী সহ সব অভিন্ন নদ-নদীর ক্ষেত্রে উজানের দেশের যেকোন উন্নয়ন অবকাঠামোর পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়শঃই এই গবেষণায় মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে উপাত্ত। এমনকি আলোচিত টিপাইমুখ প্রকল্প বা ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে যেয়ে একমাত্র উপাত্তের অভাবেই তা বিসর্জন দিতে হয়েছে। অথচ আমাদের যুক্ত নদী কমিশন বাংলাদেশ ভারত অভিন্ন নদীগুলোর উপাত্তের একটি ভান্ডার হতে পারে। কিন্তু উপাত্ত যুক্ত নদী কমিশনের কাছে থাকলেই কি সেটা সবার কাছে উন্মুক্ত হবে? এই প্রসংগে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে এই লেখা। দেশের এই মূহুর্তে এই নিবন্ধ হাস্যকর মনে হতে পারে কারো কারো কাছে কিন্তু সিংহভাগ পাঠক লেখাটির গুরুত্ত্ব অনুধাবন করবেন আশা করি।
বছরখানেক আগের কথা, গঙ্গা চুক্তির অন্তর্বর্তীকালীন সফলতা ও ব্যার্থতা নিতে একটি গবেষণা প্রবন্ধের কাজ করছিলাম। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৯৯৬ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার সময়কাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই প্রায় পনের বছরে ঠিক কতটা সফল ছিল গঙ্গা চুক্তির বাস্তবায়ন। আমাদের গবেষণার জন্য প্রয়োজন ছিল ১৯৯৭ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারতের ফারাক্কাতে গঙ্গার প্রবাহ (ফারাক্কা ব্যারেজের উজানে), সেই সাথে বাংলাদেশে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে গঙ্গার প্রবাহ। বাংলাদেশের পানিসম্পদ নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা জানেন সেখানে উপাত্ত পাওয়াটা কতটা কঠিন ও দুরুহ একটা বিষয়। আর তা যদি হয় গঙ্গা চুক্তির মত আন্তসীমান্ত বিষয়ক কোনকিছুর উপাত্ত সেক্ষেত্রে তা আরো বেশি দুরুহ কারন স্বভাবতই এই বিষয়গুলিতে সরকার পর্যায়ে কিছু গোপনীয়তা থাকে। যদিও নদীর প্রবাহের উপাত্তের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা ঠিক কতটা যৌক্তিক তা বিতর্কের দাবী রাখে। যাই হোক, এই যখন উপাত্তের অবস্থা ঠিক সেই সময়ে লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশ সরকারের যৌথ নদী কমিশন, যা কিনা জে আর সি নামে পরিচিত, তার ওয়েবসাইটে গঙ্গা চুক্তির কার্যকর সময়ের জন্য (জানুয়ারী-মে) দশ দিন ভিত্তিক উপাত্ত প্রেস নোট আকারে দেয়া আছে। বিষয়টি খুব ইতিবাচক মনে হলো আমার কাছে, তবে সমস্যা হলো উপাত্তের সময়ের ব্যাপ্তি দেখে। শুধুমাত্র ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত উপাত্ত দেয়া আছে। এর পরেও খুব বেশি আশাহত হইনি সেইসময়, ধারণা করেছিলাম যেহেতু এই চার-পাঁচ বছরের উপাত্ত সবার কাছে উন্মুক্ত স্বভাবতই বাকী বছরগুলোর উপাত্তও যোগাযোগ করতে পাওয়া যাবে। সেই অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইটটি JRC (http://www.jrcb.gov.bd/) ঘেটে যোগাযোগের ইমেইল এড্ড্রেসে (jrcombd@gmail.com)সব কিছু ব্যাখ্যা করে ইমেইল করলাম, সাথে জুড়ে দিয়েছিলাম একটি রিড রিসিপ্ট রিকোয়েষ্ট। রিড রিসিপ্ট এক ধরনের ইমেইল রিপ্লাই যাতে আপনার পাঠানো ইমেইলটি প্রাপক পড়ে থাকলে তা জানা যায়।দূঃখজনক হলেও সত্য, ইমেইলটি পড়া হয়ে থাকলেও এর কোন উত্তর পেলামনা। পরবর্তীতে আবার একটি ইমেইল করলাম এবং সেখানে উল্লেখও করলাম যে আমার আগের ইমেইলটি পড়া হয়ে থাকলেও কোন রিপ্লাই পাইনি। যথারীতি আজ পর্যন্ত কোন প্রতিক্রিয়া পাইনি। এখানে দুটি প্রশ্ন আসেঃ এক, ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত উপাত্ত সবার সামনে উন্মুক্ত করা হলেও কেন তার আগের উপাত্ত উন্মুক্ত করা হচ্ছেনা এবং, দুই, যথযথ কতৃপক্ষের কাছে অনুরোধ পাঠানোর পরেও কেন সেই উপাত্ত দেয়া হচ্ছেনা বা নিদেনপক্ষে না দেবার ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছেনা? এর উত্তর আমার জানা নেই!
উপরে যে অভিজ্ঞতার কথা লিখলাম, সেটা হয়ত নতুন কিছু নয়। পাঠকের মধ্যে অনেকেরই হয়ত এরকম অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। তবে এই অভিজ্ঞতা শেয়ার করার একমাত্র কারণ একটি পুরোনো বিষয়কে আবারো সামনে নিয়ে আসা, আর তা হলো পানিসম্পদ বিষয়ক তথ্য বা উপাত্ত সবার কাছে উন্মুক্ত করা। আর শুধু পানিসম্পদ নয়, গবেষণার অবাধ প্রবাহ নিশ্চিৎ করতে যথাযথ উপাত্তের উন্মুক্তকরণ জরুরী। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাইরে একেবারে বিপরীত কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমার পিএইচডি গবেষণার জন্য উপাত্তের প্রয়োজনে এখানকার অনেক সরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করতে হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপাত্ত ইন্টারনেটে উন্মুক্ত, যেসব উপাত্ত উন্মুক্ত নয় সেগুলোর জন্য ইমেইলে বা ফোনে অনুরোধ করলেই উপাত্ত পাওয়া যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপকের অনুরোধ সহ ইমেইল প্রয়োজন হয়। এর চেয়ে বড় কোন কাঠখড় পোহাতে হয়নি। এমনকি আমার গবেষণার প্রয়োজনে আমি এমন অনেক উপাত্ত বা মডেল ব্যবহার করেছি যা কিনা সবার কাছে উন্মক্ত করাও হয়না, কিন্তু গবেষণার গুরুত্ত্ব অনুধাবন করে এখানকার সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সেটা আমাকে দিয়েছেন। শুধু একটি সম্মতিতে আসতে হয়েছে, তাদের অনুমতি ছাড়া এই উপাত্ত আমি অন্য কাউকে দিতে পারবনা। অনেক ক্ষেত্রেই যে সব তথ্য সবার কাছে উন্মুক্ত নয় সেটি উল্লেখ করতে আমার থিসিসে বা গবেষণা প্রবন্ধে তাদের নাম রেফারেন্স হিসেবে দিয়েছি, এবং অবশ্যই তাদের অনুমতি নিয়ে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে গবেষণার কোন বিষয়ে, সেটা উপাত্তই হোক বা মডেল হোক না কোন সাধারণ তথ্যই হোক, ইমেইল করার পরপরই তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।
একই প্রেক্ষাপটে দুটো বিপরীত উদাহরণ দেখানো হলো। একই প্রেক্ষাপট বলছি কারন দুটো ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য একটাইঃ গবেষণা। একটি দেশের সরকারের পক্ষে একাই সবকিছু নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশের পক্ষে সেটা হয়ত সম্ভবও নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতো রয়েছেই, এছাড়াও অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছে যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। এই মানুষগুলো দেশে থেকে দূরে থাকলেও দেশের বিভিন্ন সমস্যে নিয়ে তাদের গবেষণা করার সুযোগ ও ইচ্ছে দুটোই রয়েছে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে যদি বাংলাদেশের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্ত উন্মুক্ত করা হয়। উপরুন্ত, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত অনেক বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীরা শুধুমাত্র উপাত্তের এই জটিলতার কারনেই বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। আমার মনে আছে আমার অধ্যাপককে একবার বলেছিলাম আমি তোমার সাথে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কিছু ফ্রিল্যান্স গবেষণা করতে চাই। উত্তরে ও জানিয়েছিল দেখ, বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে গবেষণার মূল প্রতিবন্ধকতা একটাই-উপাত্ত। যদি উপাত্ত সংগ্রহ করতে পার সেক্ষেত্রে এইখানকার কিছু গবেষণা আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও পরীক্ষা করে দেখতে পারি। আমার অধ্যাপকের বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী বাংলাদেশের তাই বাংলাদেশের উপাত্ত সমস্যা নিয়ে তার ধারনাও অজানা নয়।
আরেকটি বিষয়, উপাত্ত উন্মুক্ত করণের ক্ষেত্রে শুধু কিন্তু অনুরোধের বিষয়ই আসেনা, আসে অধিকারের প্রসংগও। বাংলাদেশ সরকার এই উপাত্তগুলো সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষদের কর থেকে অর্জিত অর্থ থেকেই। অথবা, বিদেশী দাতা সংস্থার অনুদান থেকে অর্থ সংগৃহীত হলেও সেটার ভার কিন্তু সাধারণ জনগণকেই পোহাতে হয়। সেক্ষেত্রে এই উপাত্তের উপর মানুষের অধিকারও রয়েছে। প্রসংগত একটি অভিজ্ঞতা মনে পড়ল। আমার পিএইচডির প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রকল্পটির উদ্যোক্তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওসেনিক এন্ড এটমসফেরিক এডমিনিষ্ট্রেশন বা NOAA। আমরা সেই প্রকল্পের ওয়েবসাইট থেকে বিনামূল্যে উপাত্ত সংগ্রহ করতাম এবং সেসময় আমাদেরকে প্রতীজ্ঞা করতে হতো যে আমরা এই উপাত্ত দিয়ে গবেষণা করে সে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখব সেখানে উল্লেখ করবো যেঃ ‘এই উপাত্ত গুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ওকলাহোমার সাধারণ মানুষদের কর থেকে অর্জিত অর্থ থেকে’।
পরিশেষে বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, অনুরোধ বা অধিকার যেটাকেই আপনারা বিবেচনা করেননা কেন, প্রয়োজনীয় সব উপাত্ত সবার কাছে উন্মুক্ত করুন, অথবা, নিদেনপক্ষে এমন ব্যবস্থা রাখুন যেন ন্যুনতম প্রশাসনিক জটিলতা ছাড়াই গবেষকরা পানিসম্পদ বিষয়ক উপাত্ত ও তথ্য সহজেই পেতে পারে।
মন্তব্য
না, আমার কাছে অন্তত হাস্যকর মনে হয়নি, কারণ খুব প্রয়োজনীয় একটা বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে খুব সম্ভবত হিমু ভাইয়ের একটা লেখা পড়েছিলাম, তা ছিল সুরতহাল রিপোর্ট নিয়ে।
তথ্য-উপাত্ত হয়ত উন্মোচন করা হয় না সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনা থেকে, কারণ তাতে সরকারের অনেক আকাশ-কুসুম প্রতিশ্রতির মূলোও উন্মোচিত হয়ে যায়। কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য অবারিত হলে, অবশ্যই দূর করতে সক্ষম হবে অসংখ্য অনুমান নির্ভর সন্দেহ-অবিশ্বাস এবং দীর্ঘমেয়াদে তা সরকারকে হয়ত সহযোগিতা করবে। সরকারও দায়িত্বশীল হবে। সর্বোপরি দেশে একটা স্বচ্ছ শাসনের পথ উন্মুক্ত হবে।
ধন্যবাদ।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
দুই হাজার আট সাল থেকে এ পর্যন্ত সময়কালের পানিপ্রবাহের একটা সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষন কি দেয়া যায়?
আব্দুল্লাহ এ.এম.
২০০৮ থেকে ২০১১ ও পরে ২০১২ পর্যন্ত বিশ্লেষণ নিয়ে লেখাটার বেশ কয়েকটা ভার্শন আছে, ইংরেজী ও বাংলাতে। নিচে দিচ্ছিঃ
১) জানুয়ারী ২০১১- সচলায়তনঃ গঙ্গার পানিবন্টনের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি
২) জানুয়ারী ২০১২- বিডিনিউজ২৪ মতামত-বিশ্লেষণ
৩) জুলাই ২০১২- দৈনিক যুগান্তর ( সহ লেখক ডঃ খালেকুজ্জামান)
৪) June 2012- Op-Ed bdnews24.com: Ganges water treaty: Dead or just dying? ( With Dr. Khalequzzaman)
সর্বশেষে এই জানুয়ারীতে ( ২০১৩) লেখাটির একটি সায়েন্টিফিক ভার্শন (আমার, ডঃ মোঃ খালেকুজ্জামান ও সারফরাজ আলমের যৌথ প্রয়াসে লেখা) বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল নেটওয়ার্ক (বেন) এর যৌথ আয়োজনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক একটি কনফারেন্স উপস্থাপিত হয়েছে।
প্রর্যাপ্ত উপাত্তের জন্য সায়েন্টিফিক জার্নালে লেখাটি দিতে পারছিনা। লেখাটি প্রকাশিত হলে এটি একটি ভাল রেফারেন্স হবে বলে আশা রাখি।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
লেখাটির সিংহভাগ বিডিনিউজ২৪ ডট কমে মতামত বিশ্লেষণে প্রকাশিত হওয়াতে প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে নিজের ব্লগে নিয়ে আসলাম।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
নতুন মন্তব্য করুন