জিপিএ-৫ পাওয়াদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটার কথা ভাবছিলাম। ঘুরে ফিরেই মনের মধ্যে আসছিল আই অ্যাম জিপিএ-ফাইভ। সস্তার বারো অবস্থা না শিক্ষা ব্যবস্থা, কি বলবো একে? এভাবে বলা যায়না, কারন শিক্ষা কোন অবস্থাতেই আজ আর সস্তা নেই। কিন্তু দাম দিয়ে কিনলেইকি ভালো পাওয়া যায়? বিশেষ করে ভালো মন্দের বোধ যেখানে থাকে ধোঁয়াটে? সরকারকে, সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তুলো ধুনো করবার পরও জনতার দায়টা থাকেই। বোধ-বুদ্ধির সবটা সরকারী হেফাজতে ছেড়ে রাখলে কি হয় তার নমুনা বাংলাদেশে বিস্তর।
ছেলে-মেয়েরা পড়ছে, ভালো রেজাল্ট করছে। উল্লাসে ফেটে পড়া কিশোর-কিশোরীদের গ্রুপ ছবিতে উঁচিয়ে রাখা হাতগুলোয় আঙ্গুলে ভি চিহ্ন দেখে ভালো লাগে। মনে আশা জাগে এই বিজয় এখানেই থেমে যাবেনা। এই হাস্যোজ্জ্বল মুখ গুলোর দিকে তাকালে হার স্বীকার করতে থাকা, মার খেতে থাকা জাতিটাও আবার শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবে এই আশা দুরাশা মনে হয়না । কিন্তু সত্যিই কি তাই? ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওটা বাদেও কিছুদিন আগে আরেকটা ভিডিও দেখেছিলাম যাতে তরুণ-তরুণীরা বলতে পারছেনা কোন দিনটা আমাদের স্বাধীনতা দিবস, আর কোনটা বিজয় দিবস। সে না বলতে পারুক। বিশেষ করে দিবস ধুয়ে পানি খাবার মানে হয়না। কিন্তু কিছু জিনিস থাকে যা আত্ম পরিচয়ের সাথে সংলগ্ন, জাতীয় সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত সেখান থেকে যখন পরবর্তী প্রজন্ম বিচ্ছিন্ন হতে থাকে তখন এটাও বোঝা যায় পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা থেকেও এরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে ক্রমশঃ। শিক্ষা যদি এই বিচ্ছিন্ন হওয়াটায় সেতু বেঁধে দিতে না পারে তবে শিক্ষা কি শেখাচ্ছে?
আমাদের সময়টা ছিল একটু পিছিয়ে যাওয়া সময়। আমরা কি পড়ছি না পড়ছি তা প্রায় সময়ই অভিভাবক মহলে পৌঁছাতোনা। খবরদারীটা ছিল কিন্তু সেটা কি, বা কতখানি পড়লাম সেসব নিয়ে নয়। ঠিক সময় মত বই নিয়ে বসছি কিনা, আর তারপর বই ধরেই বসে আছি কিনা সেটা কড়া ভাবেই দেখা হতো। আর যেটা দেখা হতো তা হচ্ছে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের আগে কখনও পড়ালেখা নিয়ে বিশেষ বিচলিত হয়েছি বলে মনে পড়েনা। রেজাল্ট বেরিয়ে গেলে অভিভাবকের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হতো। তর্জন-গর্জনের সাথে পিঠেও যথাসম্ভব খবরদারীর ফলাফল চাপিয়ে জারি করা হতো নতুন আইন যাতে দেখা যেত খেলার সময় কমিয়ে পড়ার সময় বেহুদা বাড়িয়ে কিছু সামরিক আইন জারীর ঘোষনাও থাকতো। তারপর অবশ্য সেই থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়। আগামী বার্ষিক পরীক্ষার আগে অবধি এই বিশেষ ট্রাইবুনালের আর দেখা পাওয়া যাবেনা। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় কি হলো, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায়ই বা কি এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য ছিলনা। আবার সেই বার্ষিক পরীক্ষা পর্যন্ত যা ইচ্ছে করার অফুরন্ত স্বাধীনতা।
এখনকার ছবিটা কিন্তু ভিন্ন। অভিভাবক অর্থাৎ মা-বাবা বিশেষ খেয়াল রাখেন সন্তানদের পড়াশোনায়। কোন বিষয়টায় দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে, কোন বিষয়ে বারে বারেই ক্লাস টেস্টে নম্বর কম আসছে তার চুলচেরা মনিটরিং এখন কখনওই থামেনা। শ্রেফ বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের সময় নয় এখন প্রতিদিনই সন্তানের শিক্ষার অগ্রগতির মূল্যায়ণ জরুরী হয়ে পড়েছে। পড়াশোনার ব্যাপারে এখনকার বাবা-মা শুধু সজাগ বললেও কম বলা হবে। কারন এরা পড়াশোনার মূল্যটা বোঝেন। বোঝেন পড়ালেখাটা কতখানি জরুরী। আগে যেমন পারিবারিক জমি-জিরাত ভাঙ্গিয়ে বসে খাওয়া চলতো এখন সে উপায় নেই। অন্যের জমিতে কামলা খেটেও জীবন পার করবার উদাহরন এক সময়ে যথেষ্টই ছিল। কিন্তু এখন প্রতিযোগিতার যুগ। ম্যারাথন দৌড়ের প্রতিযোগিতায় এক ইঞ্চিও পিছিয়ে গেলে চলবেনা। আর এখানেই মা-বাবাদের সক্রিয়তা চোখে পড়বার মত। লাঠি উঁচিয়ে নাছোড়বান্দা ছাগলের পালকে নদী পার করাবার মত অনেকটা। আর এর ফলেই বোধহয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপচিয়ে পড়ছে জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের দল। এত বেশি হারে ভালো রেজাল্টের বন্যায় চারপাশ এখন সত্যিকার অর্থেই ভেসে যাচ্ছে।
আমাদের সময় দেখতাম শিক্ষাবোর্ডে স্ট্যাণ্ড করতো জনাবিশেক মত ছাত্র। এরাই ছিল সে সময়ের সেরা ছাত্র। এটাকে ছাত্র-জীবনের পরম সাফল্য হিসেবেই দেখা হতো। তারপরও দেখতাম এরা লেটার মার্কস অর্থাৎ আশির উপরে নম্বর পেয়েছে কেউ ছয়টি বিষয়ে, কেউ সাত, কেউবা আবার আটটি বিষয়েই। এখন যারা জিপিএ-৫ পাচ্ছে তারা আশির উপরে নম্বর পাচ্ছে সব গুলো বিষয়েই। এবং এদের সংখ্যা বিশ বা চল্লিশেই থামছেনা, গিয়ে উঠছে কয়েক হাজারের কোঠায়। এতগুলো প্রতিভাবান ছাত্র-ছাত্রী এত ভালোভাবে শিক্ষা পেয়ে উঠে আসছে এতে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশংসা করতেই হয়। কিন্তু এই ভালো শিক্ষার নমুনা যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৌতুক রস সৃষ্টির মোক্ষম আকর হয়ে ওঠে তখন প্রশ্ন ওঠেই।
কি শিখছে এরা? সত্যিই কি কিছু শিখছে? এই শেখাটা বাস্তবতার মাঠে এসে তাদের বা সমাজের কতখানি উন্নতি না বিপদ ডেকে আনবে। সন্তানের পড়ালেখা নিয়ে মা-বাবার অতিরিক্ত উদ্বেগ উৎকণ্ঠা এখন খালি চোখেই দেখা যায়। সন্তানের পড়ালেখাটা তাদেরও ব্যক্তিগত যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। প্রতিদিনকার ক্লাস টেস্টও সে কারনে ছোট করে দেখার যো নেই। সাধারনত বাবা অফিস বা জীবিকায় ব্যস্ত থাকবার কারনে মাকেই তার সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হয়। ইদানীং পৌঁছে দিয়ে চলে আসলেই হয়না সেখানেই স্কুলের সারাটা সময় অবস্থান করে ছুটি হলে সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। প্রায় স্কুলের সামনেই মাঠে বা গাছের ছায়ায় বা পাশের অন্য কোন বিল্ডিঙের বারান্দা ধরে এই অভিভাবকদের প্রাত্যহিক বসে থাকার আড্ডাটা একটা অভিনব কিন্তু আবশ্যিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে দিনে পর দিন এক সাথে অনেক গুলো অভিভাবকের বসে থাকায় এক ধরনের অন্তরঙ্গতাও গড়ে ওঠে। এই অন্তরঙ্গতা শুধু স্কুল প্রাঙ্গনেই আটকে থাকেনা একধরনের সামাজিক বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে। দেখা যায় স্কুল প্রাঙ্গনে আলাপের সূত্র ধরেই অভিভাবকরা পরস্পরের সেলফোন নাম্বার জানেন, বাসার ঠিকানাও জানেন। অনেকে পরস্পরের বাসায় বেড়াতে যাওয়া বা অন্য কোথাও দু’টো বা তিনটে পরিবার মিলে একত্র হয়ে বেড়াবার মত আন্তরিক সম্পর্কও তৈরী হয়ে যায়। সেই সাথেই চলে আসে প্রতিযোগিতাও। একজনের সন্তান আরেকজনের সন্তানের চেয়ে কম নম্বর পেলে, ক্লাসে খারাপ করলে এই সমাজে তা অভিভাবকের সম্মান হানিকর ঘটনা হয়ে ওঠে। কম নম্বর পাওয়া ছাত্রের অভিভাবক, বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্রের অভিভাবকের মুখের দিকে তাকাতে পারেননা। সামাজিক সম্মান উদ্ধারের প্রকল্পে তাই সন্তান বা ছাত্রের উপর সচেতন ভাবেই চাপ সৃষ্টি করা হয়। তার খেলার সময় কমিয়ে আরো ভালো কোন কোচিংএ অথবা আরো ভালো কোন প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পাঠানো হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত ছাত্র বা ছাত্রীটি অভিভাবকের সম্মান উদ্ধার করতে না পারছে অভিভাবকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। শিশুটির ওপর অস্বাভাবিক মানসিক চাপ সৃষ্টি করে হলেও তারা এই অর্জন আদায় করে ছাড়বেনই ছাড়বেন।
একটা সময় ছিল সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার আগে অভিভাবকরা শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি রকম চাপ দিতেননা। এখন প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণী কিংবা তার আগের পর্বের ধাপেও শিশুদের রেহায় নেই। শিক্ষার একেবারে শুরু থেকেই এই অভিভাবকদের সম্মান রক্ষার প্রতিযোগিতায় শিশুটিকে করে তোলা হচ্ছে দাবার ছকের ঘুটি। ক্লাস ওয়ানের শিশুটি কেন আরো বেশি নম্বর পচ্ছেনা এই ভাবনাতেই শিশুর অভিভাবক দিশেহারা। এই প্রতিযোগিতার আগুনে ঘি ঢালতে থাকে স্কুলও সেই সাথে বিভিন্ন কোচিং প্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট শিক্ষকরাও। শিশুর বয়োসচিত ধারন ক্ষমতা, বোঝার ক্ষমতার দিকে না তাকিয়েই সবাই মরীয়া হয়ে ওঠে তাকে দিয়ে বিশ্বজয় করাবার পরিকল্পনায়। শিশুর স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বিকাশের জন্য অবসরের প্রয়োজন আছে, খেলার প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন আছে প্রকৃতির সাথে সময় কাটানোরও। কিন্তু এই দিক গুলোকে অভিভাবকের সমাজে মুখ রক্ষার প্রচেষ্টায় প্রতিদিনই শিশুর জীবন থেকে ছেঁটে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। স্কুলের পাঠ্যটা হয়তো মস্তিস্কে কুঁদে দেওয়া যাচ্ছে কিন্তু শিক্ষাটা হচ্ছে কি? শিশু বিশেষ বিশেষ নিয়মের অঙ্ক শিখছে কিন্তু একটু ভিন্ন ভাবে উপস্থাপিত হলে সেই নিয়ম গুলো দিয়ে কি সমস্যাটার সমাধান করতে পারছে? মুখস্ত করার সময় যে শব্দ গুলোর সঠিক বানান শিখছে সেই শব্দ গুলোর অর্থ কি হৃদয়ঙ্গম করছে। যতখানি মুখস্ত করছে, কৌতুহল সে হারে ছাত্রের মনে জন্মাচ্ছেকি? ঠিক কাকে শিক্ষা বলে এ সম্পর্কে মনে হয় অভিভাবক এবং শিক্ষকদেরও শিক্ষার প্রয়োজন আছে। নম্বরের পেছনে ছুটতে ছুটতে শিক্ষাকে পেছনে ফেলে নম্বরটাই যদি সামনে এগিয়ে যায় তবে ছাত্র এক সময় নম্বরই হয়ে পড়বে মানুষ হবেনা।
অভিভাবকরা যখনই দেখেন তাদের সন্তান আশানুরূপ নম্বর পেতে শুরু করেছে তখনই সন্তানের বিশ্বজয়ী প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে কঠোর সামরিক রুটিন বেঁধে দেন। সেই সামরিক আইনে স্কুলের বাইরের বই পড়া নিষিদ্ধ হয়ে যায়। টিভি দেখার সময়ও কোচিং আর প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ার চাপেই খাটো হয়ে আসে। সব ধরনের অনুষ্ঠান দেখার বদলে গানের চ্যানেলে সময় কাটিয়েই পড়তে ফিরে যায় কিশোর-কিশোরীরা। কেউ আবার এই অবসরটা কাটায় ভিডিও গেম খেলে। মাঠে খেলার সময় সুযোগ দুস্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। পড়ালেখার বাইরের পৃথিবীটা এরা দেখবে সে সুযোগ আর হয়ে ওঠেনা। এরা যন্ত্রের মত স্কুল পাঠ্যটাই আত্মস্থ করে সাহিত্য শেখেনা, বিজ্ঞান শেখেনা, অঙ্ক শিখলেও তার প্রয়োগ শেখেনা। ফলে শেষ পর্যন্ত এরা বিশ্বজয় করে জিপিএ-৫ পেয়ে। কিন্তু তারপর। তারপর শুধু কবিই নয় অভিভাবকরাও নীরব হয়ে যান, খালি বেচারা ছাত্রটাই বলতে থাকে আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও এই নম্বর প্রপাগাণ্ডায় ভাসছে। সরকারী প্রপাগাণ্ডাতেও এই নম্বরটাই কেবল কাজে লাগে। আর তাই শিক্ষাব্যবস্থাটাও গড়ে উঠেছে সেই অনুসারেই।
শিক্ষানীতি নিয়ে যথেষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা আর যথেষ্ট কুট-কচালের পরও তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে গিয়ে দেখা যায় শিক্ষা নীতি কাউকে কিছু শেখাতে পারছেনা। মনে হচ্ছে ব্যবস্থাটাই এমন করে রাখা আছে যাতে কেউই কিছু না শেখে। আর তাই অশেষ গবেষনার পরও স্কুল কলেজের পড়ানোটা পাল্টায়নি। স্কুলের দশ বছর ইংরেজি পড়েছি, কিছুই শিখতে পারিনি। কলেজেও প্রায় ইংরেজি পরীক্ষায় ফেল করতে করতে বেরিয়ে এসেছি। একপাতা ইংরেজি লেখা কি ভয়ঙ্কর রকম দুর্বোধ্য লাগতো এখনও অবাক হয়ে ভাবি। শেষে বাংলা সাহিত্য নিয়ে অনার্স পড়বার সময় মনে হলো ইংরেজিটা শেখা দরকার। একটা ডিকশনারী আর কয়েকটা ইংরেজি উপন্যাস নিয়ে নিজেই শেখার চেষ্টা শুরু করলাম। আশাতীত ভাবেই দেখলাম ইংরেজি পড়তে পারছি। তখন মনে হলো আরে এটাতো একটা ভাষা অথচ স্কুলে মনে হয়েছিল এটা একটা সাবজেক্ট। স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে ইংরেজি শেখাতে পারেননি। স্কুলে অঙ্কে ভিষন কাঁচা ছিলাম। আর ঠিক বুঝে উঠতে পারতামনা অংক জিনিসটা কি কাজে লাগে। বড় হবার পর বুঝেছি অঙ্কটা এই বিশ্বজগতের কাঠামো, অঙ্কের মধ্যে দিয়েই এই বিশ্বজগতকে আরো স্বচ্ছভাবে বোঝা যায়, জানা যায়। মুদির দোকানে জিনিস পত্র কেনবার চেয়ে অঙ্কের গুরুতর আর কোন প্রয়োজনীয়তার কথা কোন শিক্ষকই আমাকে বলেননি। ভালো ছাত্র ছিলামনা চট করে বুঝে ওঠার ক্ষমতা তখন ছিলনা আর সেকারনেই শিক্ষকের সহায়তার বিশেষ প্রয়োজন ছিল স্কুলে। কিন্তু পিছিয়ে পড়া ছাত্রের দিকে নজর দেবার অবসর কয়জন শিক্ষকের থাকে। আর এখন এগিয়ে যাওয়া ছাত্রদের দিকে তাকালেও ভাবি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোয় এদেরই বা কি শেখানো হয়েছে। আমাদের মেডিকেল কলেজ গুলোয় বেছে বেছে সেরা ছাত্র গুলোকে ভর্তি করা হয়। এই সেদিনও ডারউইনের বিবর্তনবাদের কথায় মেডিকেল কলেজের এক সহকারী অধ্যাপক হাসতে শুরু করলেন। হাসতে হাসতেই বললেন বাঁদর থেকে মানুষ আসছে এইটা কি বিশ্বাস করার মত কথা। আমি যখন তাকে বললাম আমাকে একটু বিবর্তবাদটা বুঝিয়ে দেন তখন তিনি উত্তর করলেন এ্যানথ্রোপলজীর বিষয় আমি কি করে জানবো। আরেকজন সহকারী অধ্যাপক ডারউইনের বিবর্তবাদ নিয়ে কথা বলাতে হাসলেননা বটে কিন্তু বড় বড় চোখ করে বলে উঠলেন আপনি জানেননা ডারউইনের থিয়োরী ভুল প্রমানিত হয়েছে। আমি ডারউইনের বিবর্তনবাদটা আমাকে ব্যাখ্যা করে ভুলটা বুঝিয়ে দেবার অনুরোধ করাতে তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন। পরে এক সময় স্বীকার করেছেন তিনি ডারউইনের বিবর্তনবাদ ব্যাপারটা ভালো জানেননা। অথচ এরা সবাই কিন্তু জীববিজ্ঞান প্রাণীবিজ্ঞান পড়েই এসে ডাক্তার হয়েছেন এবং নবীন ডাক্তারদের ক্লাসও নেন। বাবার হাড়ের ব্যথায় ব্যথানাশক আয়ুর্বেদিক তেলের অর্ডার করতেও দেখেছি এক অর্থোপেডিক্স এর ডাক্তারকে। তিনি ভালো করেই জানেন তার বাবার হাঁটুর হাড় ক্ষয় হয়েই এই ব্যথাটা হচ্ছে, ত্বকের ওপর কোন তেল বা অয়েন্টমেন্ট প্রয়োগে ক্ষয়ে যাওয়া হাড় নতুন হয়ে উঠবে এটা তার চিকিৎসাবিজ্ঞান বলেনা। তবু তার বিশ্বাস তেলটায় হয়তো কিছু আছে। বিজ্ঞান নিয়েই কারবার করেন আমাদের চিকিৎসক আর প্রকৌশলীরা অথচ বিজ্ঞানকে বিপুলভাবেই অস্বীকার করেন তাদের নিজস্ব চিন্তায়, বিচারে। বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্ররা ছাত্রজীবনের পুরোটাই বিজ্ঞান শিখেই কাটান তারপরও এরা জ্বীনে বিশ্বাস করেন, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় বিশ্বাস করেন, পড়া পানিতে বিশ্বাস করেন।বাজার চলতি অবৈজ্ঞানিক আধিভৌতিক বিষয় গুলোর অন্তত দশ বারোটায় এদের অন্ধ বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে থাকতে দেখা যাবে। এ থেকেই বোঝা যায় আমরা আমাদের বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান গুলোয় কেমন বিজ্ঞান শেখাই।
শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কথা বলি আমরা। কেন? না, যাতে যথাযথ শিক্ষাটা ছাত্ররা পায় সে কারনেই। কিন্তু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, যথাযথ শিক্ষার কি দরকার আছে? আমাদের দেশে যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত করে একজন প্রকৌশলী তৈরী করা হলো কিন্তু তার কাজের ক্ষেত্র নেই বলে সে ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরী নেয়। একজন প্রকৌশলী তৈরীর খরচ আর মেধা ক্ষয় করে ম্যাজিস্ট্রেট তৈরী হচ্ছে। এই চাকরী করবার জন্য তার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার দরকার ছিলনা। পদার্থবিজ্ঞান পড়ে ব্যাংকে চাকরী করছেন। এটা অবশ্য তারা করছেন এই জন্য যে তাদের কাজের ক্ষেত্র নেই। আর ঠিক একারনেই সরকার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও দায় থাকেনা যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করবার। শিক্ষাটা বিশেষ করে উচ্চশিক্ষাটা আমাদের দেশে এক ধরনের আলঙ্কারিক মূল্যের বেশি কিছু হয়ে ওঠেনা। যে শিক্ষাটা মানুষ বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারবেনা, তার জীবিকা হিসেবেও কাজে আসবেনা সেই শিক্ষাটা মেকি হতে বাধা কোথায়। গালভরা নাম থাকবে কোন উপযোগিতা থাকবেনা। সন্তান জিপিএ-৫ পেয়েছে বলে মিষ্টি বিলাবো কিন্তু আমার সন্তানকে নেপালের রাজধানীর নাম জিজ্ঞেস করলে বলবে নেপচুন। জিপিএ-৫ টাই লক্ষ্য ছিল শিক্ষাটা নয়। আমার মনে হয় জাতি হিসেবে এটাই আমাদের উচিত শিক্ষা।
শিক্ষা কাজে লাগেনা, শিক্ষার ব্যবস্থাকেও তাই সুসামঞ্জস্য করে তোলার তাগিদ নেই। বেশি বেশি নম্বর পাওয়া আর গালভরা কিছু শব্দ যেমন গোল্ডেন জিপিএ, প্লাটিনাম জিপিএর উল্লাস। সরকারের অর্জনের খাতায় হাজার হাজার জিপিএ-৫ এর তকমার ঝকমকানি। অভিভাবকরা আহ্লাদে আটখানা, অভিভাবকদের অভিভাবক সরকারের নেতৃবৃন্দও খুশি। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কারো যখন এতটুকু অসুবিধা হচ্ছেনা তখন কেনইবা এত কথা খরচ করা। কথা খরচ করার কারন শিক্ষার দরকার আছেই। উপার্জনের প্রয়োজনও ফুরিয়ে যায়নি। দেশে সরকারী দলের মন খুশি করে নির্বিঘ্নে উপার্জন করা যায় শিক্ষার দরকার হয়না। কিন্তু দেশের যে উপার্জন বাইরে থেকে আসে সেখানে ফাঁকি চলেনা। ছোট দেশে সকলের কর্মসংস্থান করা সম্ভব নয়। ছোট দেশের নাগরিকদের বাইরে ছড়িয়ে পড়তেই হবে। আর বাইরে এই শিক্ষাটাই শেষ ভরসা। দেশে সোনার খনি নেই যে পায়ের উপর পা তুলে বসে খাওয়া যায়। শিক্ষা, যথার্থ শিক্ষা থাকলেই দেশের বাইরে গিয়ে ভালো উপার্জন সম্ভব। আর এ জন্যই শিক্ষার মধ্যে ফাঁকি চলেনা। দেশের জনশক্তিকে অদক্ষ জনশক্তি হিসেবে দেশের বাইরে রপ্তানী করবার দিন প্রায় শেষ হয়ে এলো বলে। শিক্ষার মাধ্যমে দেশের বাইরে আমাদেরই কর্মসংস্থান খুঁজে নিতে হবে। দেশের অবস্থা হিসেব করে নয়, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাকে আলঙ্কারিক অভিধা মাত্র রেখে দিলে খাওয়ার মুখই শুধু তৈরী হবে উপার্জনের হাত নয়। অভিভাবক আর সরকারের সামাজিক সম্মান রক্ষার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রজন্মের পর প্রজন্মকে যথার্থ অর্থেই শিক্ষিত করে গড়ে তোলা।
কিন্তু এই বিষয়টায় আমাদের শাসক সম্প্রদায়ের সায় নেই। আমাদের শাসকরা যে রাজনীতি করে শাসক হয়ে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে সে রাজনীতির ইচ্ছে নয় দেশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক। যে রাজনৈতিক কর্মীদের নিয়ে তাদের ব্যবসাটা চলে তাদের স্বাধীন আয়-উপার্জন নেই। দলের অনুগ্রহেই তাদের চলতে হয় আর সে কারনেই দলের আনুগত্যই তাদের কাছে সব কিছুর চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। তারাই তাদের দলের জন্য ভোট যোগাড় করে দলকে জেতায়, শাসক বানায়। এদের যদি এমন উপার্জন পথ থাকতো যাতে দলের অনুগ্রহের আর প্রয়োজন নেই তবে দলের প্রতি অন্ধভাবে অনুগত থাকবার দায়ও থাকবেনা। তখনই এই রাজনীতি শক্তি হারিয়ে ফেলবে। সর্ব স্তরে দূর্নীতির মাধ্যমে লুটপাটের সহজ সুযোগটাই এই রাজনীতির মূল লক্ষ্য। এই পথটা নিস্কন্টক রাখার জন্য চাই এমন শিক্ষাব্যবস্থা যাতে একটা জাতির প্রজন্মের পর প্রজন্ম পঙ্গু হয়ে বেড়ে ওঠে, অশিক্ষিত হয়ে বেড়ে ওঠে। তবেই এই সব দলের কর্মী বাহিনীতে কর্মী সরবরাহ অটুট থাকবে আর রাজনীতির এই ধারাটাও সচল থাকবে। এর জনই শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন করতে হয় যাতে ছাত্র প্রশ্ন করা না শেখে, তাদের মনে কৌতুহল জন্মাতে না পারে। তারা যেন যথার্থ অর্থে শিক্ষা পেয়ে নিজেরা সক্ষম ও স্বাধীন জীবিকার উপযুক্ত না হয়ে ওঠে। আর একারনেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞানের পথ দেখানোর চেয়ে, জ্ঞান অর্জনের কৌতুহলটা জাগিয়ে তোলার বদলে স্থবিরতা আর অচলায়তন প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রকেই সক্রিয় রাখতে হয়। মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীদের চেয়ে ধর্মীয় মতবাদ, ধর্মীয় অন্ধত্বকেই ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষার নামে মাথায় তুলে রাখতে হয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এই কাজটাই অত্যন্ত সাফল্যের সাথে করে যাচ্ছে। এটাই হয়তো উচিত শিক্ষা।
মন্তব্য
"সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতি" মোতাবেক শিক্ষাব্যাবস্থা লাইনেই আছে। পেশাগত কারণে প্রচুর অভিভাবকের সাথে মিথস্ক্রিয়া হয়েছে। তন্মধ্যে 'সংখ্যাগরিষ্ঠ' অভিভাবকের মতামত এক ও অভিন্ন। তাঁদের দাবি শিকেটা ছেঁড়াই থাক। আমার সোনার টুকরা পুলা-মাইয়া পার হইয়া যাক। হুদাই আমরা নীতি-টিতির কথা বলে কোকের গ্লাসে ঝড় তুলি। নীতি সহজে বদলাবে না, কেননা এটা 'জনপ্রিয়'।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ঠিকই বলেছেন। পড়ার জন্য ধন্যবাদ
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ফেইসবুকে এখন নেই বলে ভিডিওটা দেখা হয়নি। তবে দেখারও ইচ্ছে নেই। লেখা চমৎকার হয়েছে।
ইয়ে আপনি আপনার আগের লেখাগুলোও প্রোফাইলে যুক্ত করুন না। পোস্টগুলোর লিঙ্ক সহ সচলকে মেইল করলে তারাই এ কাজটা করে দিবে।
লেখাটা পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ। লেখা গুলো প্রোফাইলে যুক্ত করা যায় এটা জানতামনা। পরামর্শটার জন্য কৃতজ্ঞতা রইলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য চাপ দিয়ে পিষ্ট করে ফেলছেন এমন অভিভাবক শহরে অসংখ্য আছেন। তবে, শহরের বাইরেও (মফস্বলে বা গ্রামে) কি বাচ্চাদের উপর এবং কিশোর বয়সের শিক্ষার্থীদের উপর পড়ার/ভালো করার চাপ বেড়েছে আগের চেয়ে?
(জানি না তাই জানতে চাইছি)
অনেকে বলেন, এখনকার যুগে আগের চেয়ে বেশি নম্বর সহজেই পাওয়া যায়, তাই আগেকার (২০-২৫ আগের) দ্বিতীয় বিভাগ পেতে যে পরিমাণ পড়াশোনা করতে হত, অনেকটা সেটা দিয়েই নাকি জিপিএ ৫ পাওয়া যাচ্ছে। এই বক্তব্য কি ঠিক?
কৈফিয়ত: আমি নিজে দেশছাড়া অনেকদিন, পরিবারে শিক্ষার্থী নেই এ মুহূর্তে কেউ। তাই জানতে চাইছিলাম; প্রশ্লগুলো আন্তরিক কৌতুহল। অনলাইনে নানারকম লেখা পরে কিছুটা বিভ্রান্তিতে আছি। দেশের পড়াশোনার মান বেড়েছে নাকি ঠিক বুঝতে পারছি না। দু'রকম লেখাই দেখছি।
[s]দেখেশুনে[/s] শুনেশুনে আমার মনে হয়েছে:
১। লেখাপড়ায় একটা বড় রকমের মেরুকরণ ঘটেছে। আগে ২% শিক্ষার্থী অনেক বেশি পরিমাণে পড়াশোনা করতে, সেটা এখন (অভিভাবকের চাপে বা অন্য কারণে) ৩০% এর কাছাকাছি।
২। মাঝামাঝি রকমের পরাশোনা করা শিক্ষার্থীর শতকরা অংশ কমেছে। কম প্রচেষ্টাতেই ভালো ফল পাওয়া যাবে (এবং হয়ত প্রশ্ন আউট হবে) এরকম ধারণার বশবর্তী হয়ে এরা পড়াশোনা কমিয়ে ফেলেছে।
৩। ফলাফল 'বেল কার্ভ' -এর মত নেই। শিক্ষার্থীদের মান ও বেল কার্ভ এর মত নেই।
৪। সৃজনশীল পদ্ধতিও শিক্ষক আর কোচিং সেন্টারের দ্বারস্ত হওয়া থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে পারে নি।
আবারও, বলছি এটা আমার ধারণামাত্র, আমি সরাসরি কোন অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না, শোনা কথাগুলোর সারমর্ম বললাম মাত্র।
শুভেচ্ছা
আমার মনে হয় এখনকার শিক্ষা পদ্ধতি, তার বাস্তবায়নের সময় যে চেহারাটা দাঁড়ায় আর শিক্ষার্থীদের ওপর এসবের প্রভাব (সঙ্গে অভিভাবকদের শিক্ষা প্রসঙ্গে বাড়তি চাপ) এই সমস্তটার ওপরই একটা ভালো রকম গবেষনাধর্মী অনুসন্ধান চালানোর প্রয়োজন। আপনার পর্যবেক্ষন গুলোও মূল্যবান। আমরা প্রায় ক্ষেত্রেই হয়তো উপর উপর অনেক কিছু দেখছি বলে অনেক কিছু দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। লেখাটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ আব্দুল্লাহ ভাই
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ লেখা
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
সোহেল ভাই,ভাল লাগছে ।
ধন্যবাদ আলেক সাই, আপনি পড়েছেন দেখে ভালো লাগলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন