দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল যখন পরিনতির দিকে ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছে তখনই খবর পাওয়া যাচ্ছিল ইউরোপের জামার্নি অধিকৃত এলাকা গুলোয় অসংখ্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বহু ক্ষুধার্ত, বুভুক্ষু মানুষ বন্দি অবস্থায় মৃত্যুর দিন গুনছে, অনাহারে তখনই মৃত্যুর কোলে যারা ঢলে পড়েছে সেই সংখ্যাটিও কম নয়। নেদারল্যাণ্ডস, গ্রিস, পূর্ব ইউরোপ, সোভিয়েত রাশিয়ায় অসংখ্য মানুষ অনহারে মৃত্যু বরন করছিল। ড. এ্যানসেল কীজ ভাবছিলেন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও এই বন্দি অনাহারী মানুষ গুলোকে ডাক্তাররাও বিশেষ কোন সাহায্য করতে পারবেনা কেননা এখনও এ সম্পর্কিত যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগৃহীত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সময়ই ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর একটা অনুসন্ধান মূলক পরীক্ষার পরিকল্পনা করেন তিনি। কি হয় যখন মানুষ ক্ষুধার্ত হয় এবং অনাহারে থাকে। অনাহারী মানুষের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক চরিত্রে কি কি পরিবর্তন আসে এবং কেন। এসব অনুসন্ধানের জন্যই মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির ফুটবল ষ্টেডিয়ামের নিচের ঘর গুলোয় স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে এ্যানসেল কীজের নেতৃত্বে ১৩ মাসের একটা দীর্ঘ পরীক্ষামূলক অনুসন্ধান শুরু হয়। ক্ষুধার্ত অনাহারে থাকা মানুষ গুলোকে ত্রাণ সহায়তা সঠিকভাবে দেবার প্রয়োজনেই তথ্য গুলো জানা অবশ্যম্ভাবী অথচ তখন পর্যন্ত এ ধরনের বিশেষ তথ্য কোথাও ছিলনা। যুদ্ধে হিংসাত্মক কাজ করতে অনিচ্ছুক কনসেনসাশ অবজেক্টরদের মধ্যে থেকেই ৩৬ জন স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে এই কাজটি শুরু হয়। প্রায় ৪০০ আবেদনের মধ্যে থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে স্বাস্থ্যবান ও কঠোর পরিবেশ সহ্য করতে সক্ষম এমন ৩৬ জন স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়েই এই অনুসন্ধান অভিযান শুরু করেন এ্যানসেল কীজ এবং তার সহকর্মীরা। ১৯৪৪ সালের ১৯ নভেম্বর এই অনুসন্ধানমূলক পরীক্ষা শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৪৫ সালের ২০ অক্টোবর। ১৯৪৬ সালেই প্রকাশিত হয় Men and Hunger : A Psychological Manual For Relief Wokers. ১৯৫০ সালে এই গবেষনার পূর্ণাঙ্গ ফলাফল নিয়ে প্রকাশিত হয় দুই খণ্ডে ১৩৮৫ পৃষ্ঠার The Biology of Human Starvation. যেখানেই ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মৃত্যু, ক্ষুধার্ত মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আনুষাঙ্গিক বিষয় গুলোর বিভিন্ন পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা হয়েছে এই গবেষনার তথ্যাবলী বহুলভাবে ব্যবহৃত ও উদ্ধৃত হয়ে এসেছে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের মানসিকতা ও আচরন অনুধাবনেও এই তথ্যা গুলো অপরিসীম মূল্যবান বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
এই গবেষনামূলক অনুসন্ধান কার্যক্রমটিকে তিনটি পর্বে ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল। প্রথম পর্ব যাকে বলা হচ্ছিল কন্ট্রোল পিরিয়ড, এই পর্বের তিন মাস স্বেচ্ছসেবীদের ৩২০০ ক্যালোরীর খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্ব স্টারভেশন পিরিয়ডে সেই পরিমানটা নামিয়ে আনা হলো ১৫৭০ ক্যালোরীতে। খাদ্যদ্রব্য বলতে দেওয়া হতো গমের রুটি, ম্যাকারনি, শালগম, বাঁধাকপি, আলু। খাদ্য তালিকায় কার্বোহাইড্রেটের আধিক্য আর প্রোটিনের অনুপস্থিতি ইচ্ছে করেই রাখা হয়েছিল কেননা ইউরোপের বিভিন্ন স্থানের অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত মানুষরা এধরনের খাদ্যই খেতে পাচ্ছিল, যদিও আশঙ্কাজনক ভাবে কম হারে।
স্টারভেশন পিরিয়ড বা অর্ধভুক্ত অবস্থার ছয় মাস শেষ হবার পর শেষ পর্ব তিনমাসের রিহ্যাবিলিটেশন ফেজ এর মধ্যে দিয়ে পরীক্ষাটির সমাপ্তি হয়। রিহ্যাবিলিটেশন পর্বেও খাদ্য গ্রহনের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবীদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি। সেমি স্টারভেশন পর্বে যে পরিমান খাদ্য বরাদ্দ ছিল রিহ্যাবিলিটেশন পর্বে তার সাথে কাউকে ৪০০, কাউকে ৮০০, কাউকে ১২০০ বা ১৬০০ ক্যালোরী যোগ করে চারটি গুচ্ছে স্বেচ্ছাসেবীদের ভাগ করে খাদ্য দেওয়া হচ্ছিল স্বাভাবিক স্বাস্থ্যে প্রত্যাবর্তনের আনুপাতিক হারের ভিন্নতা পর্যবেক্ষণ করবার জন্য। এই পুরো সময়টায় রক্তের পরিমান, হৃৎস্পন্দন, দৃষ্টি ও শ্রবন শক্তির পরিমাপ, বৃদ্ধিবৃত্তিগত মাত্রা সহ সংখ্য তথ্য সংগ্রহ করা চলছিল। সেই সাথে স্বেচ্ছাসেবীদের দৈনিক কাজের রুটিন অনুসরন করার পাশাপাশি কন্ট্রোল পিরিয়ড আর স্টারভেশন পিরিয়ডে সাপ্তাহিক ২২ মাইল হাঁটাও বাধ্যতা মূলক করা হয়েছিল।
সেমি স্টারভেশন পিরিয়ড শুরু হবার পর থেকেই স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যম, কার্যক্ষমতা, শক্তি আশঙ্কাজনক ভাবেই কমে যেতে শুরু করলো। দেখা গেল তাদের দৈহিক শক্তি ২১% হ্রাস পেয়েছে। তারা এ সময়ের পুরোটায়ই দুর্বল বোধ করছিল। তাদের চলাফেরা অনেকটাই বার্ধক্যগ্রস্তদের মত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবীরা ছাড়া রিসার্চের কাজে জড়িত অন্যরা যখন এক এক ধাপে দুটো করে সিঁড়ি টপকে যেত তখন এই স্বাভাবিক ক্ষিপ্রতার দৃষ্টান্তও স্বেচ্ছাসেবীদের মনে চরম বিরক্তির জন্ম দিচ্ছিল। হৃৎস্পন্দনের গড় হারও ৫৫ থেকে ৩৫ এ নেমে এসেছিল। এটা ঘটছিল কেননা তাদের শরীর মেটাবোলিক ক্রিয়াকে ধীর করে অপর্যাপ্ত ক্যালোরীকে রক্ষা করতে চাইছিল। রক্তের পরিমান ১০% হ্রাস পেয়ে ছিল, হৃৎপিণ্ডের আকারও ছোট হয়ে এসেছিল। এই পর্বে শরীরে মেদের পরিমান এতখানিই কমে গিয়েছিল যে তারা কোথাও বেশিক্ষণ বসে থাকতো পারতোনা কেননা কিছুক্ষণ বসে থাকার পরই মেদের আবরন না থাকায় চেয়ারে বসাটা তাদের জন্য আর আরামদায়ক ছিলনা। তাছাড়া শীতবোধের মাত্রাও এই একই কারনে বেড়ে গিয়েছিল। এই পর্বের শেষ দিকে স্বেচ্ছাসেবীদের গড় ওজন ১৫২.৭ পাউণ্ড থেকে ১১৫.৬ পাউণ্ডে নেমে গিয়েছিল। আরো যে সমস্ত শারীরিক অসাচ্ছন্দ্য দেখা দিচ্ছিল সে সম্পর্কে একটা লেখায় বলা হচ্ছে,
As the 6 months of semistarvation progressed, the volunteers exhibited many physical changes, including gastrointestinal discomfort; decreased need for sleep; dizziness; headaches; hypersensitivity to noise and light; reduced strength; poor motor control; edema (an excess of fluid causing swelling); hair loss; decreased tolerance for cold temperatures (cold hands and feet); visual disturbances (i.e., inability to focus, eye aches, "spots" in the visual fields); auditory disturbances (i.e., ringing noise in the ears); and paresthesias (i.e., abnormal tingling or prickling sensations, especially in the hands or feet).
বরাদ্দ খাদ্যের পরিমান অর্ধেক হয়ে যাবার পর পরই শরীরিক শক্তি ও উদ্যম যেন হারিয়ে যেতে শুরু করলো। সব কিছুতেই একটা উদাসীনতা দেখা দিতে থাকলো। এ সময় তাদের মেজাজ মর্জির অবস্থাও বিশেষ ভালো ছিলনা। ল্যাবরেটরীর রান্না ঘরের সামনে খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে তা আরো বেশি প্রকট হচ্ছিল। খাবার দিতে দেরী হলে তা প্রায়ই তাদের সহ্য হতোনা। মানসিক অস্থিরতা প্রায়ই ক্রোধের রূপ নিয়ে বিস্ফোরিত হচ্ছিল। সামাজিকতা, পারস্পারিক সৌহার্দ্য জীবনের অন্যান্য উপাদান গুলো যেন সরে যাচ্ছিল আরো পেছনের সারিতে। কোন পার্টিতে গেলে দেখা যেত তাদের জন্য সামাজিক মেলামেশা কঠিনতর হয়ে উঠছে, গল্প-গুজবে আগ্রহও বিশেষ অবশিষ্ট নেই। অথচ এই মানুষ গুলোই এক সময় পরস্পরের সাথে বন্ধুত্বময় উষ্ণতায় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। সবাই যেন পরস্পরের থেকে ক্রমেই দূরে সরে যেতে শুরু করছিল। একসাথে সময় কাটাবার বদলে তারা বরং পছন্দ করছিল একাকী সিনেমায় গিয়ে সময় কাটাতে। ছবিটি কমেডি হলেও হাসির দৃশ্য গুলোও তারা ঠিক আগের মত উপভোগ করতে পারছিলনা। কেবল খাওয়া দাওয়ার দৃশ্য গুলোই তাদের আগ্রহী করে তুলতো। খাবার দাবারের বিষয়টিই তাদের মনের সবটা জুড়ে থাকতো। যারা এক সময় বিশ্বের রাজনীতির নানান বিষয়ে অত্যন্ত উৎসাহী ছিল তারাও আর এ সব বিষয়ে কোন আলোচনা করতোনা। তারা যেন স্বাভাবিক ভাবে বাঁচাটাকেই মুলতবি রেখে দিয়েছিল একটা সময় পর্যন্ত। নারী সঙ্গ উপভোগও থমকে গিয়েছিল প্রায় সবারই। যে সামান্য খাবার তাদের পরিবেশন করা হতো তাতেই তাদের মন নিবদ্ধ থাকতো সবচেয়ে বেশি। তারা চেষ্টা করতো সেই সামান্য খাবারই অনেকটা সময় ধরে খেতে। কেউ কেউ আবার পানি মিশিয়ে বরাদ্দ খাবারকে আরো বেশি করতে চেষ্টা করতো। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে যে জিনিসটা তাদের মনে জেঁকে বসছিল তা সব বিষয়ে একটা সার্বজনীণ উদাসীনতা আর নিস্ক্রিয়তা। সুপারমার্কেটে ভিড়ের ভেতর বা কিউতে দাঁড়ানোয় তাদের ঠেলে সরিয়ে দেওয়া অনেক সহজ ছিল। জঠরাগ্নির দহনই যেন তাদের মধ্যে থেকে সমস্ত সক্রিয় উদ্যোগ আর সামাজিকতা মুছে দিচ্ছিল। মনের জোর খাটিয়ে তারা গবেষনায় সহায়তা অবশ্য দিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু প্রাণের ছোঁয়া যেন স্তিমিত হয়ে আসছিল। ক্রমে কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবী মানসিকভাবে অস্বাভাবিক আচরন শুরু করে, কেউ কেউ চুরি করে খাবার খেতেও শুরু করে। রিসার্চ টিমের রিপোর্টে বলা অনেক কথার শেষে বলা হয়েছিল, "Their usual reaction was resignation." রিহ্যাবিলিটেশন পিরিয়ডে আবার খাবারের বরাদ্দ স্বাভাবিক মাত্রায় গ্রহনের পরও অনেকদিন যাবত তাদের এই মানসিক অবস্থার অবনতির কোন উন্নয়ন দেখা যায়নি। অথচ এ সময় স্বাভাবিক খাদ্য পেয়ে তাদের শারীরিক দুর্বলাতা তারা কাটিয়ে উঠছিল। কিন্তু মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হতে আরো অনেক সময় নিয়েছিল।
কিন্তু কেন মানুষ অনাহারে থাকার একটা পর্যায়ে বদমেজাজী হয়ে ওঠে। আবার কেনইবা ক্রমেই উদাসীন হয়ে যায় জীবনের প্রতি। হারিয়ে ফেলে উদ্যম, জড়তায় আচ্ছন্ন হয়। সব রকম উদ্যোগ, সক্রিয়তা পরিত্যাগ করে গুটিয়ে যেতে থাকে নিজের ভেতর, হারিয়ে ফেলে সামাজিকতার প্রতি আগ্রহও। ১৯৪৪-৪৫ সালের মিনেসোটা স্টারভেশন এক্সপেরিমেন্টের স্বেচ্ছাসেবীদের অর্ধভুক্ত অবস্থায় যে পরিস্থিতিতে উপনীত হতে দেখি ঠিক একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দেখেছি আমরা ১৯৪৩-৪৪ সালের অখণ্ড বাংলার দুর্ভিক্ষের অনাহারী মানুষদেরও।
দেখা যাক ক্ষুধার্ত মানুষের শরীরে কি ঘটতে থাকে আর কিভাবেই বা এই ঘটনা গুলো তার আচরনে প্রভাব ফেলে। আমরা যা খাবার খাই তার কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন আর ফ্যাট সব ভেঙ্গে গিয়ে রূপান্তরিত হয় গ্লুকোজ, এ্যামাইনো এ্যাসিড আর ফ্রি-ফ্যাটি এ্যসিডে। এই জিনিস গুলিই শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর কোষ কলায় পৌঁছে তাদের পুষ্টি যোগায়, পরিনত হয় শক্তিতে। খাবার গ্রহনের পর যতই সময় অতিবাহিত হয় শরীরের প্রবাহিত রক্তধারায় এই পুষ্টি বা ব্লাড-গ্লুকোজের মাত্রা কমতেই থাকে। এই মাত্রা আরো হ্রাস পেতে থাকলে মস্তিস্ক বিশেষভাবেই সচেতন হয়ে ওঠে। পরিস্থিতিটাকে একটা স্বাস্থ্যগত হুমকি হিসেবেই দেখতে থাকে মস্তিস্ক, কারন অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর কোষ-কলার চেয়ে মস্তিস্কের জন্যই রক্তধারার এই গ্লুকোজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। আর তাই আমরা তখন কোন কাজে মনোযোগ ঠিকমত দিতে পারিনা, কাজে ভুল হওয়া শুরু হয়। অর্থাৎ মস্তিস্কের স্বাভাবিক কাজের ছন্দে একটা ছন্দপতন দেখা দিতে থাকে। এসময় যে কাজটা দুরূহ হয়ে ওঠে তা হলো সভ্য-ভব্যতার নিয়ম গুলো মেনে সামাজিক আচরনকে অক্ষুন্ন রাখা। এ সময় প্রায় আমরা মেজাজা ঠিক রাখতে পারিনা। আশেপাশের মানুষ, সহকর্মীদের সাথে আচরন একটু হলেও রূঢ় হয়ে ওঠে।
রক্তধারায় গ্লুকোজের মাত্রা হ্রাস পাবার ঘটনাটি ছাড়াও আরেকটি শারীরিক প্রতিক্রিয়াও ঘটে যাকে বলা যায় গ্লুকোজ কাউন্টার রেগুলেটরি রেসপন্স। রক্তধারায় গ্লুকোজের মাত্রা কমতে থাকার একটা পর্বে মস্তিস্ক বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে খবর পাঠাতে থাকে যাতে এই গ্লুকোজের মাত্রাকে স্বাভাবিক রাখতে তারা বিভিন্ন হরমোন নিঃসরন শুরু করে। এ সময় চার ধরনের গ্লুকোজ কাউন্টার রেগুলেটরি হরমোন গুলো নিঃসৃত হতে থাকে। মস্তিস্কের ভেতরেই পিটুউটরি গ্ল্যাণ্ড থেকে নিঃসৃত হয় গ্রোথ হরমোন, গ্লুক্যাগন আসে প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় থেকে, এ্যাড্রিনাল গ্ল্যাণ্ড থেকে আসে এ্যাড্রিনালিন, যাকে কখনও এপিনেফ্রিনও বলা হয়, আর কর্টিসোল। গ্লুকোজ কাউন্টার রেগুলেটরি হরমোন গুলোর শেষোক্ত দু’টিকে স্ট্রেস হরমোনও বলা হয়। সংকটময় বা চাপের পরিস্থিতিতেই এই হরমোন গুলো কাজ করতে শুরু করে। বিপদের সময় বা আকস্মিকভাবে শরীরকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্রিয় করে তুলাবার জন্যই এই হরমোন গুলো কাজ করে। হঠাৎ ভয় পওয়া এবং সেই সাথেই বিপদ থেকে দ্রুত দূরে সরে যাওয়া অথবা প্রতিরোধ করতে এগিয়ে যাওয়া এসবেই এই হরমোনগুলো কাজে আসে। ভয় বা ক্রোধ সৃষ্টির মাধ্যমে “ফাইট অর ফ্লাইট” রেসপন্স তৈরী করতে এদের জুড়ি নেই। গ্লুকোজ কাউন্টার রেগুলেটরি রেসপন্সে নিঃসৃত এ্যাড্রিনালিন হরমোনও একই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সে কারনে অল্পতেই বা অকারনেই রেগে ওঠে ক্ষুধার্ত মানুষ। ক্ষুধার সাথেই ক্রোধের সম্পর্কের পেছনে কমন জিন গুলোই উৎপাদন করে নিউরোপেপটাইড ওয়াই (neuropeptide Y) নামের একটা রাসায়নিক বস্তু। ক্ষুধা অনুভবের এক পর্যায়েই এই রাসায়নিকটি মস্তিস্কের মধ্যে নিঃসৃত হতে শুরু করে। এই নিউরোপেপটাইড ওয়াই মস্তিস্কের ওয়াই ওয়ান (Y1) রিসেপটর সহ আরো কতগুলো রিসেপটরে ক্রিয়া করে মানুষকে গোগ্রাসে খাবার জন্য উত্তেজিত করে তোলে। ক্ষুধা নিয়ন্ত্রনে মস্তিস্কে নিউরোপেপটাইড ওয়াই এবং ওয়াই ওয়ান রিসেপটর কাজ করতে থাকলে এরা মানুষের মনে ক্রোধ ও আগ্রাসনের মনোভাবেরও জন্ম দেয়। সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডের মধ্যে উচ্চমাত্রার নিউরোপেপটাইড ওয়াই মানুষকে অতিমাত্রায় আগ্রাসী করে তোলে। এই আগ্রাসী মনোভাবের কারনেই আদিম কাল থেকেই মানুষ ক্ষুধা নিবৃত্তিতে মরীয়া হয়ে উঠতো এবং এভাবেই বিবর্তন ধারায় এই রসায়ন সহায়তা দিয়ে এসেছে। টিকে থাকার লড়াইয়ে ক্রোধ আর আগ্রাসী মনোভাব ছাড়া মানুষ নিজের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে পারতোনা। অন্যকে খাবার সুযোগ করে দিয়ে মানুষ যদি নিস্পৃহ ভাবে অপেক্ষা করতো তবে দেখা যেত প্রায়ই তার ভাগে কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই ভাবেই ক্ষুধার সাথে রাগ বা ক্রোধ শারীরিকভাবেই জন্ম নেয়।
মিনেসোটা স্টারভেশন এক্সপেরিমেন্টের স্বেচ্ছাসেবীদের আচরনেও আমরা এর প্রমান পাই। অনুসন্ধানমূলক পরীক্ষার দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ সেমিস্টারভেশন পিরিয়ডে দেখি স্বেচ্ছাসেবীরা অল্পতেই রেগে উঠছে। খাবার সময় ল্যাবরেটরীর কিচেনের সামনে লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় খাদ্য পরিবেশনে একটু দেরী বা সামান্যতম অব্যবস্থাই তাদের বদমেজাজী করে তুলছে। যেমন,
Keys and his fellow researchers noted an overwhelming apathy among the subjects, punctuated by paradoxical periods of irrational irritability. "Standing in line at the diet kitchen before being served was the source of explosive conduct," they write in Men and Hunger. At the table, they often turned on one another, annoyed by each other's voices.
স্বেচ্ছাসেবীরা জানতেন এই খাদ্যসংকট একটা পরীক্ষা মাত্র। তারা এও জানতেন ঠিক কোন তারিখ থেকে তাদের এই “দুর্ভিক্ষ” শেষও হয়ে যাবে। আর তাই টিকে থাকবার বা বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে খাদ্যের জন্য মরীয়া আগ্রাসন তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। তারপরও তাদেরও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ক্রোধের অনুভূতি, মানসকি বৈকল্যের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।স্বেচ্ছাসেবীদের কেউ কেউ ক্ষুধা নিয়ে এই পরীক্ষামূলক গবেষনার নিয়ম অগ্রাহ্য করে চুরি করে খাবার পর্যন্ত খেয়েছেন। কিন্তু ১৯৪৩-৪৪ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষেরা প্রায়শই এই ক্রোধ ও আগ্রাসনকে দমন করেছিল তাদের প্রথাগত সামাজিক শিক্ষার প্রভাবে। যে শিক্ষায় সমাজের প্রভাবশালী বা সামন্ত শাসকদের প্রতি বিরুদ্ধতা বা বিষোদ্গার প্রকাশের পরিবর্তে আনুগত্য ও শান্তি বজায় রেখে অনুগ্রহের জন্য অপেক্ষা করবার বিষয়টিকেই সব সময় গুরুত্ব দেওয়া হতো। Prosperity and Misery in Modern Bengal বইটির উপসংহারে পল গ্রিনো বলছেন,
Bengali “fatalism” was no empty surrender to death. It represented instead the continued acceptance in a crisis of the very values which hitherto had sustained the victims : that submission to authority is the essence of order.
অনাহারে থাকা মানব শরীরের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আরো একটু খবর নেওয়া যাক। খাবার ছাড়া মানুষ কতদিন বেঁচে থাকতে পারে? মহাত্মা গান্ধী ৭৪ বছর বয়সে ২১ দিন ধরে অনশন করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন খাবার ছাড়াও মানুষের পক্ষে প্রায় ৭০ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকা সম্ভব। অবশ্য এক্ষেত্রে পানি গ্রহনের ব্যাপারটাও জরুরী। মহাত্মা গান্ধী তার অনশন চলাকালীন সময়ে সামান্য পরিমানে হলেও পানি পান করতেন। ১৯৯৭ সালের ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ধারনা করা হয় খাবার গ্রহন ছাড়াও মানুষ অন্ততঃ ৩০ থেকে ৪০ দিন প্রাণ ধারন করতে সক্ষম। তবে এক্ষেত্রেও পানি গ্রহনের বিষয়টি আবশ্যিক। ৩৫ থেকে ৪০ দিনেই অনাহারের চরম অবস্থায় পৌঁছায় মানব শরীর। ১৯৮০ সালের বেলফাস্টের মেজ কারাগারে অনশনরত ধর্মঘটকারীদের দৃষ্টান্তে এই বিষয়টি আরো সামনে আসে। বলা হয় মোটামুটি ৪৫ থেকে ৬১ দিনের অনাহারে থাকাটাই যথেষ্ট মৃত্যুর জন্য। জিনগত বৈশিষ্ট্য, স্বাস্থ্যগত অবস্থা, শরীরের ওজন ও আরো কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে খাদ্য ছাড়া মানব শরীর কতদিন টিকে থাকতে সক্ষম। এর সাথেই অবশ্য পানির ব্যাপারটা ভুলে গেলে চলবেনা। খাদ্য ছাড়া কিভাবে মানব দেহ বেঁচে থাকে।
আমরা আগেই দেখেছি খাদ্যের উপাদান থেকেই গ্লুকোজ সংগ্রহ করে মস্তিস্ক। এই গ্লুকোজকেই শক্তির প্রাথমিক উৎস হিসেবে ব্যবহার করে মানব দেহ। খাদ্যের গ্লুকোজ আমাদের যকৃতে আর মাংস পেশিতে যায় আর ফ্যাটি এ্যসিড পরবর্তীতে ব্যবহার হবে বলে সঞ্চিত থাকে। একবার স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহনে যতখানি গ্লুকোজ শরীরে আসে তা মানব দেহের ছয় ঘন্টার জ্বালানী হিসেবে কাজ করে। ছয় ঘন্টাতেই খরচ হয়ে গেলেও মোটামুটি ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা শরীরে গ্লুকোজের সঞ্চয় থাকেই। অনাহারের তৃতীয় দিনে শরীর কেটোসিস অবস্থায় প্রবেশ করে। লিভার বা যকৃতের গ্লাইকোজেন পুরোটা খরচ হয়ে গেলে ফ্যাটি এ্যসিড থেকে তৈরী হয় কেটোন। দেহে মস্তিস্কের জন্য গ্লুকোজ সঞ্চয় আর না থাকলে এই কেটোনের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে মস্তিস্ক। কেটোন থেকে মোটামুটি ৩০% শক্তি সংগ্রহ করতে থাকে মস্তিস্ক। অনাহারের চতুর্থ দিন এই পরিমানটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০%। মস্তিস্কের জন্য দৈনিক ১২০ গ্রাম গ্লুকোজের প্রয়োজন। সেই পরিমানটা এ সময় নেমে আসে ৩০ গ্রামে। শরীরের চর্বির সঞ্চয় ফুরিয়ে গেলে শক্তির জন্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায় মাংস পেশির প্রোটিন। এই প্রোটিন ভেঙ্গে রক্তধারায় এ্যামাইনো এ্যাসিড নিঃসরনের মাধ্যমে মস্তিস্কের জন্য তৈরী করা হয় প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ। এই প্রক্রিয়াটা ঘটে লিভারে। এই সময় প্রয়োজনীয় প্রোটিন যাতে বেশি খরচ না হয়ে যায় একারনে মেটাবোলিক ক্রিয়া বা বিপাক ক্রিয়া ধীর লয়ে ঘটতে থাকে।দেহের তাপমাত্রা আর ধরে রাখতে না পারায় শীত অনুভব হয়। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোয় এই সামান্য শক্তি আর পাঠানো সম্ভব হয়না বলে হৃদপিণ্ড, ফুসফুসের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ গুলো সংকুচিত হতে শুরু করে। মাংস পেশি ছাড়া শক্তি উৎপাদনের আর কোন পথ থাকেনা দেহের জন্য। সেই মাংস পেশির প্রোটিনও ভেঙ্গে গ্লুকোজে রূপান্তরের ফলে মাংস পেশি গুলোও ক্ষয় হতে শুরু করে। শরীর তখন নিজেকেই খেতে শুরু করে। একবার প্রোটিন ভাঙ্গা আরম্ভ হলে বুঝতে হবে মৃত্যু আর দূরে নয়। এই প্রক্রিয়ার আরম্ভ থেকেই মানুষের মনে অস্বাভাবিক অস্থিরতা দেখা দিতে শুরু করে। কোনক্রমেই কোন কাজে মনো সংযোগ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। ক্রমে হ্যালুসিনেশন ও দেহের অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোর কাজে বিপর্যয় দেখা দেয়। হৃদপিণ্ডের পেশি ক্ষয় হতে হতে একসময় আর তা কার্যকর থাকেনা।
অনাহারে থাকার এই পর্বের শুরু থেকেই শরীর নিজেকে খাদ্য যোগাতে এতই ব্যাস্ত হয়ে পড়ে এবং খাদ্যের সঞ্চয় এতই সামান্য থাকে যে দেহের সর্বত্র পুষ্টি সরবরাহ দুরূহ হয়ে ওঠে। দেহ তাই একের পর এক কলকব্জা বন্ধ করে কোন ক্রমে জীবন ধারনের প্রয়াস চালিয়ে যায়। এ সময়টায় তাই অনাহরে থাকা মানুষ নিজের মধ্যেই গুটিয়ে যেতে শুরু করে। বাইরের ঘটনাবলী বা জীবনের অন্যান্য উপাদানে আর আগ্রহী হয়না। প্রায় সব কিছু সম্পর্কেই সে উদাসীন হয়ে ওঠে। একটা সর্বগ্রাসী নিস্ক্রিয়তা আর উদ্যমের অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। মিনেসোটা স্টারভেশন এক্সপেরিমেন্টের স্বেচ্ছাসেবকদের অনাহার অবস্থাকে অবশ্য নিয়ন্ত্রিত অবস্থার মধ্যেই রাখা হয়েছিল। পরীক্ষাটা এমন ভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে প্রায়-অনাহার অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করা যায়। যার ফলে এই স্বেচ্ছাসেবকদের স্বাস্থ্যের কোন স্থায়ী ক্ষতি হতে পারেনি। অর্ধভুক্ত অবস্থার ছয়মাস পর থেকেই তাদের পূর্ণ পুষ্টি দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবুও স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যেও আমরা এই নিস্ক্রিয়তা, উদ্যমহীনতা, জড়তার কাছে আত্মসমর্পন প্রবনতা লক্ষ্য করেছি। সেমিস্টারভেশন পর্বে তাদের মানসিক অবস্থার যে অবনয়ন হয়েছিল তা আবার স্বাভাবিক খাদ্যগ্রহনের সাথে সাথেই ফিরে আসেনি। দৈহিক স্বাস্থ্যের উন্নতি দ্রুতই ঘটছিল কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য পূর্ণাঙ্গ স্বাভাবিক হতে অনেক সময় নিয়েছিল। পঞ্চাশের মন্বন্তরের দুর্ভিক্ষ পীড়তরা এতখানি সৌভাগ্যবান ছিলেননা। দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের ত্রাণ ব্যবস্থাও এতখানি সুচারু ও যত্নের সাথে পরিচালিত করা সম্ভব হয়নি ফলে অনাহারে এবং সেই সূত্রেই আসা মহামারীতে অসংখ্য প্রাণ ঝরে গিয়েছিল।
বুভুক্ষু মানুষ তার বুভুক্ষার শেষ পর্বে দৈহিক কারনেই জড়ত্ব লাভ করে এবং নিজের জীবন রক্ষার কোন উদ্যোগ গ্রহন করার অবস্থায় থাকেনা তা আমরা দেখেছি। কিন্তু আমরা এও দেখেছি বিবর্তন ধারায় টিকে থাকবার জন্য মানুষের মধ্যে আগ্রাসনের, ক্রোধের মনোদৈহিক প্রবনতাও ছিল। এই প্রবনতা, প্রবৃত্তি গুলোয় মানব জাতিকে নানান বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে আজকের সময়ে এনে দাঁড় করিয়েছে, বিলুপ্ত হয়ে যেতে দেয়নি। কিন্তু সেই স্বাভাবিক প্রবনতা ও প্রবৃত্তিও ১৯৪৩-৪৪ সালে আমাদের সামন্তবাদী ও সুবিধাধাভোগী শ্রেণীর সৃষ্ট সামাজিক প্রথাবদ্ধ বিধি বিধান ব্যর্থ করে দিয়েছিল। নিজেকে রক্ষার বিবর্তনীয় ধারায় প্রাপ্ত হাতিয়ারও দুর্ভিক্ষের সামনে কাজে লাগাতে পারেনি বাংলার মানুষ। অলীক অনুগ্রহের আশায় অপরিসীম আনুগত্য নিয়ে তারা নিস্ক্রিয় ভাবে অপেক্ষা করছিল। এ প্রসঙ্গে নিরুপায় হয়েই জেমস স্কটের বই থেকে কিছু লাইন উদ্ধৃত না করে পারছিনা। তিনি বলছেন,
There is a naive notion, current among social scientists, that really hungry people do not rebel because they lack energy... ... At some point in the process of starvation, it is undoubtedly true that lassitude sets in. Well before that point is reached, however, one may expect reasonable men to do whatever they can to lay their hands on food. In anything less than a concentration camp context, the coincidence of severe hunger with available stocks of food in the possession of landlords or the state is a call to action. There are instances, to be sure, where a collective famine exhausts the food resources of the society as a whole and in which the issue of hunger is thus not joined with the issue of injustice and the right of the poor to a subsistence from the means of the relatively well-to-do. But the onset of hunger in most societies, whether in Annam (in the 20th century) or the 17th century England, leads not to listlessness but to rage.
কথা হচ্ছে দুর্ভিক্ষের সময় ব্যাপক হারে লুঠতরাজ করেই কি দুর্ভিক্ষের প্রকোপকে থামিয়ে দেওয়া যেত? হয়তো যেত কিংবা নয়। হয়তো এতগুলো মানুষ এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাতোনা। ইতিহাসের পাতায় কি হতে পারতো এ নিয়ে বিতণ্ডা করে লাভ নেই। কারন ঘটনাটা ঘটে গেছে। কিন্তু তারপরও আলোচনাটা ওঠে, ওঠে কেননা ইতিহাসও পুনরাবৃত্ত হয়। ঠিক অবিকল আগের চেহারায় হয়তো নয়, কিন্তু হয়। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবার প্রয়োজনটা তাই কখনওই ফুরিয়ে যায়না। কখনও কখনও আরো যে কারনটার জন্য ইতিহাসের ধ্বংসস্তুপটা ঘাটতে হয় তা হলো নিজের সময়টাও যখন এই ধ্বংসস্তুপটার সদৃশ হয়ে ওঠে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও এই যে নিস্ক্রিয়, উদ্যোগহীন হয়ে থাকা, মুখ বুঁজে অন্যায়ের সমস্তই সহ্য করতে থাকা এ সমস্ততেই মনে হয় ১৯৪৩-৪৪ সালের সামন্তবাদী গ্রাম সমাজের সেই স্যোসাল কণ্ডিশনিং এখনও প্রাসঙ্গিক। সত্যজিৎ রায়ের ছবির সেই যন্তর-মন্তর ঘরটা এখনও আছে। মগজ ধোলাইটাও চলছে। সেই সামন্ত শাসকরা আর নেই। সেদিনের গ্রাম সমাজ তার গ্রামীন সংস্কৃতি নিয়ে বিলুপ্তির দিকে চলেছে। আজকের যুগে গ্রাম পর্যন্ত শহুরে হয়ে উঠতে চাইছে। বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক আবিস্কার মানুষ পকেটে নিয়ে ঘুরছে। কিন্তু এখনও সিংহভাগ মানুষই সেই দুর্ভিক্ষের মানুষই থেকে গেছে। বিজ্ঞান এত এত বিস্ময়কর আবিস্কারে তাদের মুগ্ধ করে দিলেও বিজ্ঞানের পরিবর্তে অন্ধবিশ্বাসের ছেঁড়া চাদরটা দিয়েই চেতনার আপাদমস্তক মুড়ে রাখে। অচলায়তনের প্রতি ঐকান্তিক আনুগত্যের বশে সত্যকে পর্যন্ত অস্বীকার করে। একের পর এক হত্যাকাণ্ড দেখেও প্রতিবাদের স্বর জাগিয়ে তোলেনা। অপেক্ষা করে কোন এক অন্নদাতার কিংবা ত্রাতার। নিজেদের শক্তি সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসটুকুও পাপ জ্ঞানে পরিহার করে চলে। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময়কালটার সামাজিক শিক্ষাই এখনও অনুগ্রহ আর আনুগত্যের সূত্রটাকে সজীব করে রেখেছে। আমাদের সমাজের সেই আনুগত্যের সামাজিক শিক্ষাটা, সেই মগজ ধোলাইয়ের যন্তর-মন্তর ঘরটার খবর আমাদেরই বের করতে হবে। আর একারণেই পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে এই বিশেষ ফিরে দেখা।
তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থ :
1. The Starvation Study That Changed The World
http://www.refinery29.com/minnesota-starvation-experiment
2. The Great Starvation Experiment, 1944-1945
http://www.madsciencemuseum.com/msm/pl/great_starvation_experiment
3. STARVATION AND BEHAVIOR
http://joyproject.org/overcoming/starvation.html
4. The Science Of ‘Hangry’, Or Why Some People Get Grumpy When They’re Hungry
http://www.iflscience.com/health-and-medicine/science-hangry-or-why-some-people-get-grumpy-when-they-re-hungry
5. Now Entering Starvation Mode: What Happens To Your Metabolic Processes When You Stop Feeding Your Body
http://www.medicaldaily.com/now-entering-starvation-mode-what-happens-your-metabolic-processes-when-you-stop-feeding-280666
6. What Happens To The Body And Mind When Starvation Sets In?
http://www.npr.org/sections/goatsandsoda/2016/01/20/463710330/what-happens-to-the-body-and-mind-when-starvation-sets-in
7. The Science of Starvation: How long can humans survive without food or water?
http://blogs.plos.org/obesitypanacea/2011/05/13/the-science-of-starvation-how-long-can-humans-survive-without-food-or-water/
8. James C. Scott: The Moral Economy of The Peasants. p191
9. Prosperity And Misery in Modern Bengal : The Famine of 1943-1944
Paul R. Greenough. Oxford University Press. 1982. New York, Oxford
মন্তব্য
পঞ্চাশের মন্বন্তর সম্পর্কে আলোচনা কম মনে হলো। পরের পর্বগুলোতে হয়তো আসবে।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
লেখাটা আপাতত দ্বিতীয় পর্ব পর্যন্তই। পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটা বিশেষ অংশ নিয়েই ভাবতে চেয়েছিলাম, মন্বন্তরের বিশদ আলোচনা উদ্দেশ্য ছিলনা। জিজ্ঞাসাটার ভবিষ্যতে আরো কোনদিক আলোকিত হয়ে উঠলে হয়তো আরো বিশদ কোন লেখা আসতেও পারে। অথবা এমন হতে পারে অন্য কেউও এদিকটা নিয়ে আরো ভালোভাবে লিখতে পারেন। লেখাটা পড়ার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আগের পর্বের ইটা সরায়া তারপর পরুম, আপাতত এখানে রাইখা যাই।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ভয় হচ্ছে শেষকালে লেখা পড়ে ঐ ইটটা দিয়েই মাথা ফাটিয়ে না দেন।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
খানিকটা ধান ভানতে শিবের গীত টাইপের হয়ে গেছে বোধ হয়, মানে- শরীরে অনাহারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনাটা একটু বেশীই দীর্ঘ হয়ে গেছে। তবে শিবের গীতও প্রয়োজনীয়, এটাও জানার দরকার ছিল।
হ্যাঁ ব্যাপারটা সেরকমই হয়ে গেল। ধন্যবাদ আব্দুল্লাহ ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন