মোক্ষ, নির্বাণ ও মাতৃগর্ভ : তৃতীয় পর্ব

সোহেল ইমাম এর ছবি
লিখেছেন সোহেল ইমাম [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৬/০৮/২০১৬ - ৮:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনগ্রসর আদিম ধরনের সমাজের সংস্কৃতিতে আধ্যাত্মিকতার ধারক, বাহক, অভিভাবক থাকতো শামানরা। এদের কখনও ওঝা, মেডিসিন ম্যান বা শামান বলে অভিহিত করা হয়। কেননা এইসব সমাজে বিশ্বাস করা হয় এদের অলৌকিক যাদু শক্তি রয়েছে এবং এই শক্তি দিয়েই এরা যেমন মানুষের রোগ-বালাই দূর করতে পারে তেমনি গুন-যাদু বা বাণ ছুড়ে যে কারো অনিষ্ট এমনকি মৃত্যুও ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। এদের ঠিক পুরোহিত গোত্রে ফেলা যাবেনা, এদের সাথে বরং অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে আমাদের সন্ন্যাসী, কামেল ফকির, সাধন সিদ্ধ কাপালিক বা তান্ত্রিকদের। আদিম সমাজে এদেরই ভাবা হতো আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন মানুষ এবং সমাজের ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধায় এরাই হয়ে উঠতো অনেকখানি ক্ষমতাবান। অষ্ট্রেলিয়া, পলিনেশিয়া, মেলানেশিয়ার আদিবাসী, আফ্রিকা মহাদেশের অসংখ্য আদিবাসী, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার রেডইণ্ডিয়ানদের সমাজে শামানদের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা বিষয়। আমাদের সমাজেও তন্ত্রে-মন্ত্রে পারদর্শী ওঝাদের অস্তিত্ব দুর্লক্ষ্য নয়। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র আদিম ধরনের সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন গোষ্ঠীতে এধরনের অলৌকিক ক্ষমতাধর মানুষ সব সময়ই ছিল। নৃতত্ত্ববিদেরা এই সব সমাজের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষনার মাধ্যমে অত্যন্ত যৌক্তিক ভাবেই অনুমান করেছেন যে আমাদের সভ্য হয়ে ওঠার আগে সেই সময়কার শামানদের যাদুবিদ্যা বিষয়ক আচার ও বিভিন্ন উপাদান যুগ পরম্পরায় বাহিত হয়ে আমাদের এখনকার অনেক ধর্মীয় উপাদানেরই ভিত্তি তৈরী করে দিয়েছে। শামানদের সেই অর্থে আদিম সমাজের আধ্যাত্মিক সাধক বলা যায়। যদিও এখন ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা যে মার্জিত ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ আকার পেয়েছে আদিম অবস্থায় ঠিক সেরকম ছিলনা। এখনকার আদিবাসীদের সমাজের দিকে তাকালে তাই আমরা আমাদের এই সভ্য সমাজের আদিম স্তরের চেহারাটা অনুমান করতে পারি। আদিবাসীদের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও সেসব নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষনা এ কারনেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কুন্ড রাসমুসেন এর বর্ণনায় একজন তরুন ক্যারিবু এস্কিমোর শামান হয়ে ওঠার কাহিনীতে দেখি অবিকল আমাদের ভারতীয় মুনি-ঋষিদের তপস্যারই ছবি। উত্তর গোলার্ধের প্রচণ্ড শীতের মধ্যে লোকালয় থেকে দূরে একটা বরফের কুটির তৈরী করে সেখানেই বসিয়ে রাখা হলো তরুনটিকে। বসবার জন্যএকটা সাদামাটা চামড়ার টুকরো ছাড়া আর কিছুই সেখানে রাখা হয়নি, না আগুন না কোন খাদ্যদ্রব্য। এখানে বসেই তরুনকে দিনের পর দিন একাকী অশরীরি সেই মহান আত্মার ধ্যান করে যেতে হবে। পাঁচটি দিন অনাহারে অতিবাহিত করার পর দীক্ষাগুরু শামান সেখানে এসে তরুনকে সামান্য পানি মাত্র পান করায়। আরো পনের দিন এভাবে পার হবার পর আবার সেই শামান এলো সামন্য পানি আর গোস্তের একটা ছোট টুকরো নিয়ে। এই খাদ্য খেয়েই তরুনকে আরো দশটি দিন সেখানেই ধ্যানে অতিবাহিত করতে হবে। তিরিশ দিন ধরে প্রচণ্ড শীত আর অনাহারের কষ্ট সহ্য করেও তরুন মনকে নিবদ্ধ রাখে গ্রেট স্পিরিটের ধ্যানে। এ যেন আমাদের ভারতীয় তাপসদের ধ্যান নিমগ্ন সাধনার ছবি। এই আত্মনিমগ্ন ধ্যানেই বিস্মৃতপ্রায় ভ্রূনাবস্থার ও জন্মকালীন সময়ের স্মৃতি স্মরনের অতল থেকে বৈদেহী শরীর নিয়ে যোগীর চেতনায় ভেসে ওঠে। গ্রেট স্পিরিটের ধ্যান করতে করতে তরুন ক্যারিবু এস্কিমোরও একসময় মনে হয় তার মৃত্যু সন্নিকট। প্রায় শামানরাই তাদের শামান হয়ে ওঠার কঠোর সাধনায় বার বার মৃত্যুর স্বাদ নেবার কথা উল্লেখ করেন। বলা হয় অলৌকিক শক্তির হাতে মৃত্যুবরন করে আবার জীবিত হয়ে না উঠলে কেউ প্রকৃত শামান হতে পারেনা। শামানদের কাহিনী গুলোয় দেখা যায় অলৌকিক শক্তিরা এসে সাধনারত শামান হতে উৎসুক প্রার্থীকে হত্যা করে আবার বাঁচিয়ে তুলছে, তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে আবার একসাথে জুড়ে দিচ্ছে, কখনও হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলছে, কারো পেট থেকে নাড়িভুড়ি বের করে পেটের ভেতর ক্রিষ্টালের নাড়িভুড়ি পুরে দিচ্ছে। এই সব ঘটতে থাকে যখন শামান হতে উৎসুক সাধক গ্রেট স্পিরিটের ধ্যানে নিবিষ্ট থাকে। আমরা আগেই দেখেছি জন্মের মুহূর্তে মানুষের জন্ম অভিজ্ঞতা এক অর্থে মৃত্যুর আস্বাদ দেয় তাকে। পরবর্তী জীবনে এই জন্মের স্মৃতিই মৃত্যু ও মৃত্যু থেকে ফের জীবনে প্রত্যাবর্তনের স্মৃতি হয়ে মানুষের চেতনায় সঞ্চিত থেকে যায়। শামান বা যোগধ্যানীদের আত্মনিমগ্ন ধ্যানাবস্থায় এই স্মৃতিরই পুনরাবর্তন হয়। শুধু শামানরাই নয় বিশ্বের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র মিথে মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই আরো গহীন জীবনে উন্নীত হয়ে যাবার ধারনার স্ফুরন ঘটতে দেখি সভ্যতার ভিন্ন ভিন্ন পর্বে। ব্যাকাস, পারসিফোনি, যিশুখ্রীষ্টের পুনরুত্থান মূলক কাহিনী গুলোর অন্তস্তলে এই জন্মকালীন মৃত্যুর আস্বাদের স্মৃতি ক্রিয়াশীল ছিল বলেই হয়তো যুগে যুগে মানব মনে মিথ হিসেবে এগুলো বার বার অনুরনন তুলেছে, একটা বিচ্ছিন্ন অদ্ভুত কাহিনী মাত্র হিসেবে বিস্মৃতিতে তলিয়ে যায়নি। আমাদের ক্যারিবু এস্কিমো তরুনটি তিরিশ দিনের কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনার প্রায় অন্তিম পর্বে গ্রেট স্পিরিটের দেখা পেল। সেই আত্মা কিন্তু এলো এক মহিলার রূপ নিয়ে। মনের মধ্যে গর্ভস্থ স্মৃতি উজ্জীবিত হয়ে উঠলে একটি মাতৃসদৃশ আত্মার আর্বিভাবই স্বাভাবিক আর এই তরুনটির ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটতে দেখি। তরুনটি সেই মহিলাকে আর কখনওই দেখেনি কিন্তু অদৃশ্য থেকেই সেই মহান আত্মা তার অলৌকিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস হয়ে ওঠে। সাধনার এই প্রাথমিক পর্বের পরও বহুদিন যাবত তরুনটিকে যে কোন মহিলার সংশ্রব এড়িয়ে চলতে হয়েছে, অনাহারে থেকে ধ্যান মগ্নও হতে হয়েছে বারবার। আমাদের সভ্য হয়ে উঠবার পূর্বকালীন পর্বের এই আদিম শামানদের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার উত্তরাধিকারই পরবর্তীতে আমাদের প্রচলিত ধর্মের মধ্যে এসে সমন্বিত হয়েছে।

সেই প্রাচীন কাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির আধ্যাত্মিক সাধকদের সাধনাচারের মধ্যে অনশন বা অনাহারে থাকাটা ছিল বিশেষভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় পুরাণ-উপপুরাণ জুড়ে যার দৃষ্টান্ত সুপ্রচুর বললেও কম বলা হবে। “কেবল বায়ু মাত্র ভক্ষন করিয়া তপস্যা করিতে লাগিলেন” এরকম শব্দবন্ধে এজাতীয় কাহিনী এতবার পাঠকের গোচরে আসে যে তার হিসেব রাখাই কঠিন। ভারতীয় মিথে মুনি-ঋষিতো বটেই ক্ষত্রিয় রাজা-রাজড়া থেকে শুরু করে অসুররা অবধি কঠিন তপস্যায় বসে যায়, আর সে তপস্যার তেজ এমনই যে প্রায়ই প্রধান দেবতাদের কাউকে স্বর্গলোক থেকে নেমে এসে দৈববর দিয়ে তপস্যাকারীকে পুরস্কৃত করে যেতে হয়। প্রায়ই দেখি স্বয়ং ব্রহ্মা কাজটি করেন আর তার ফলে প্রায়শই নতুন উৎপাতেরই সৃষ্টি হয়। দেখা যায় দেবতাদের শত্রু অসুরদের কেউ এই সব তপস্যার ফলে এমনই দৈবশক্তি করায়ত্ব করে ফেলে যার ভোগান্তি শেষকালে দেবতাদেরই পোহাতে হয়। এই সব তপস্যার আচারের মধ্যে অনাহারে থাকাটা একটা বিশেষ ব্যাপার। যেন অনাহারে থাকার ফলেই তপস্যাটা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। শৈলরাজ হিমালয় ও তার স্ত্রী মেনকার কন্যাদের তপস্যার ধরন এ প্রসঙ্গে স্মরন করা যায়। এক কন্যা কেবল একটি পাতা মাত্র খেয়ে তপস্যা করতো বলে তার নাম হয় একপর্ণা, আরেক জন একটি মাত্র পটলা বা পারুল ফুল খেয়ে তপস্যা করতো বলে তার নাম হয় একপটলা। তৃতীয় কন্যা তপস্যার সময় একটা পচা পাতা অবধি মুখে দেয়নি বলে তার নাম হয় অপর্ণা। আবার রামায়নে বৈশ্রবনের তপস্যার যে বিবরণ পাই তাতে দেখি সে কখনও বায়ু, কখনও শুধু জল কখনও নিরেট অনাহারে থেকেই একহাজার বছর তপস্যায় অতিবাহিত করে দিল। স্বয়ং লঙ্কারাজ রাবনও দশ হাজার বছর অনাহারে থেকেই তার তপস্যা চালিয়ে গেছে। গৌতমবুদ্ধের অনাহারে থেকে কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনার কথা সর্বজন বিদিত। ভারতীয় অন্য সাধকদেরও তাই। সুফি সাধকদের ক্ষেত্রেও মাত্রাতিরিক্ত কঠোরভাবে ইফতার ছাড়াই টানা অনেকদিন যাবত রোযা রাখা বা অন্য কোন অছিলায় যেমন হালাল উপার্জনের নয় এরকমটা ভেবে অনাহারে থাকার কষ্ট স্বীকার করে নেয়ার দৃষ্টান্তও আমরা দেখেছি। একটু আগে আদিবাসী শামানদের সাধনার ক্ষেত্রেও উপবাসের উদাহরনও আমরা উল্লেখ করেছি। প্রায় সমস্ত ধর্মীয় আচারেই অনশন, উপবাস বিষয়টিকে এতটাই জরুরী বলে গন্য করা হয়, যে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কেন এই অনাহারে থাকা।
অনাহারে থাকাটা আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে এতটা গুরুত্ব পায় কেন ? খাদ্য গ্রহন না করে শরীরকে কষ্ট দিয়ে সাধকরা আসলে সত্যিকার অর্থে কি অর্জন করতে চান? অনশন, উপবাস এই সব সাধকদের সাধনায় মোক্ষ অর্জনের পথে কিভাবেই বা সাহায্য করে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা গবেষনার আয়োজন করা হয় যার নাম ছিল Minnesota Starvation Experiment যা পরে Starvation Study নামেই খ্যাত হয়েছিল। ৩৬জন শারীরিক ও মানসিকভাবে সবল, স্বাস্থ্যবান পুরুষদের নিয়ে এই গবেষনাটা চালানো হয়। যুদ্ধের সময় অনাহারে বা স্বল্পাহারে থাকা আর্ত মানুষদের খাদ্য ও ত্রাণ সহযোগিতা দানের জন্য জরুরী ছিল প্রচণ্ড খাদ্যাভাবে ক্ষুধার্ত মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানবার চেষ্টা করা। ১৯ নভেম্বর ১৯৪৪ সালে আরম্ভ হয়ে গবেষনাটা ১৯৪৫ সালের ২০ ডিসেম্বর অবধি চলে। এই গবেষনার গবেষকদের অন্যতম ছিলেন এ্যানসেল কিজ। ১৯৫০ সালে এ্যানসেল কিজ ও তার সহযোগী গবেষকরা মিলে Minnesota Starvation Experiment এর এই গবেষনা ও তার ফলাফল প্রকাশ করেন ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা প্রেস থেকে। The Biology of Human Starvation নামে দুই খণ্ডে প্রায় ১৩৮৫ পৃষ্ঠার এই গবেষনাপত্রটি পরবর্তীতে বহুলভাবে উদ্ধৃত ও ব্যবহৃত হয়ে আসছে যখনই ক্ষুধার্ত মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার প্রসঙ্গ এসেছে। গবেষনাপত্রটিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে এই ৩৬ জন স্বেচ্ছাসেবকের দৈনিক বরাদ্দ খাদ্যের পরিমান যখন অর্ধেক করে দেওয়া হলো এবং তা চালিয়ে যাওয়া হয়েছিল দিনের পর দিন তখন কি হয়েছিল তাদের মনো-দৈহিক প্রতিক্রিয়া। দেখা গেল এই ক্ষুধার্ত মানুষ গুলো যেন ক্রমেই একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বন্ধুত্ব বা সামাজিকভাবে পারস্পারিক সঙ্গ যেন আর তারা সেভাবে উপভোগ করছেনা। সাধারনভাবে উদারচেতা মনোভাবের হলেও স্বেচ্ছাসেবকদের মন পরস্পরের সুবিধার কথা বিবেচনার চেয়ে বরং নিজের ভেতরই বেশি গুটিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রধান আগ্রহের বিষয়টিই হয়ে উঠছে খাদ্য। সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে ওঠা ছাড়াও আর যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটি তাদের মধ্যে দেখা গেল তা হচ্ছে তাদের যৌন চেতনার ক্রমশঃ নিস্পৃহতা। মিনেসোটা স্টারভেশন স্টাডি নিয়ে একটা লেখায় বলা হচ্ছে, The extraordinary impact of semistarvation was reflected in the social changes experienced by most of the volunteers. Although originally quite gregarious, the men became progressively more withdrawn and isolated. Humor and the sense of comradeship diminished amidst growing feelings of social inadequacy. The volunteers’ social contacts with women also declined sharply during semistarvation. Those who continued to see women socially found that the relationships became strained.
ডায়রির পাতায় এই গবেষনার সাথে জড়িত একজন স্বেচ্ছাসেবক ক্ষুধার প্রকোপে নিজের পরিবর্তিত মনো-দৈহিক অবস্থার কথা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে লিখেছিল, I am one of about three or four who still go out with girls. I fell in love with a girl during the control period but I see her only occasionally now. It’s almost too much trouble to see her even when she visits me in the lab. It requires effort to hold her hand. Entertain must be tame. If we see a show, the most interesting part of it is contained in scenes where people are eating.
ক্ষুধার্ত অবস্থায় বেশি দিন অতিবহিত করলে আমরা দেখছি মানুষ সামাজিক সম্পর্ক গুলো থেকে ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করে। এই গবেষনার স্বেচ্ছাসেবকদের যেমন দেখা গেল ক্ষুধার পর্বটি শুরু হবার পর মিশুক প্রকৃতির হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই আর পারস্পারিক সঙ্গ আর সেভাবে উপভোগ করছেনা। সার্বক্ষণিক ক্ষুধার বোধ তাদের মধ্যের সামাজিক বোধকে দুর্বল করে দিচ্ছে আর তাতেই তাদের সামাজিক আচরন আর আগের মত থাকছেনা। সাধারনভাবে দৈনিক খাদ্যের যা বরাদ্দ ছিল সেই পরিমানটা অর্ধেক করে দিয়ে এই গবেষনাটা চালানো হয়েছিল আর তারই ফলে দেখা গেল পারস্পারিক সামাজিক ঘনিষ্টতা স্বাভাবিক উষ্ণতা হারাচ্ছে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকায় বহুদিন যাবত দৈনিক খাদ্য বরাদ্দ যেখানে স্বাভাবিক পরিমানের একচতুর্থাংশে বা আরো নিচে নেমে আসে সেখানে ক্ষুধার্ত মানুষদের সামাজিকবোধ এবং অনেকাংশেই মানবিক বোধও যে নিম্নগামী হয় তা বিভিন্ন সূত্রে এখন আর কারো অজানা নেই। এই ভারতীয় উপমহাদেশের দুর্ভিক্ষের ইতিহাসই আমাদের কাছে জ্বলজ্বলে প্রমান হয়ে আছে এ সত্যের। আমরা দেখেছি ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ সামাজিক মর্যাদা বোধকে ভূলুণ্ঠিত করতেও দ্বিধা করেনি, যে সন্তানের জন্য মানুষ প্রাণটুকুও বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেনা সেই সন্তানকে ক্ষুধার তাড়নায় বিক্রি করে দেবার মত ঘটনাও দুর্লভ নয়।

ক্ষুধা সেই অর্থে একটা শক্তি (একটা পর্বের পর) যা মানুষের সামাজিক সত্ত্বাকে নিস্ক্রিয় করে দেবার ক্ষমতা রাখে। আমাদের আধ্যাত্মিক সাধকরা অনেক আগে থেকেই এই সত্য অনুধাবন করেছিলেন। গর্ভস্থ শিশু ক্রমাগত আকাঙ্খা আর কামনা বাসনার বশিভূত হতে হতে শিশুর সারল্য অতিক্রম করে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে ওঠে, আর এই কামনা-বাসনার বস্তু অর্জনের লক্ষ্যে তাকে সামাজিক হয়ে উঠতেই হয়। এখন যদি গর্ভস্থ শিশুর সরল জীবনই লক্ষ্য হয় তাহলে এই কামনা-বাসনা আর তা অর্জনের জন্য যে সামাজিক সহায়তার প্রয়োজনে মানুষ সমাজের মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠে তাকেই সর্বাংশে ছেঁটে ফেলতে হয়। যেমন সুফি সাধক হযরত ওয়ায়েস কারনীকে বলতে শুনি “শান্তি রয়েছে নির্জনতার মধ্যে”। গৌতমবুদ্ধও সুত্তনিপাতের পবজ্জাসুত্ত ও তার ভিত্তি মহাসচ্চকসুত্তে বলেছেন, “ হে অগিবসসেন, আমি সম্বোধি লাভের আগে যখন বোধিসত্ত্ব ছিলাম তখন আমার মনে হয়েছিল গৃহস্থাশ্রম হচ্ছে সংকট ও আবর্জনার জায়গা, সন্ন্যাস হচ্ছে মুক্ত হাওয়া। গৃহস্থাশ্রমে থেকে পূর্ণ ও শুদ্ধ ব্রহ্মচর্য্য পালন করা সম্ভবপর নয়, তাই মস্তক মুণ্ডিত করে ঘর ছেড়ে সন্ন্যাসী হওয়াই সমীচীন।” জৈনসাধক মহাবীরও সামাজিক বন্ধন খণ্ডনের বিষয়ে অন্যদের চেয়ে কম উচ্চকিত ছিলেননা। শুধু এরাই নয় পৃথিবীর আধ্যাত্মিক ইতিহাসে প্রচুর সাধকই সামাজিক, সাংসারিক বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার বিষয়টিকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সাধারনভাবে এই কাজটি অত্যন্ত দুঃসাধ্য, কেননা আজন্ম মানুষ সমাজের উপর এত দিক দিয়েই নির্ভরশীল যে সামাজিক শরীর থেকে নিজের সত্ত্বা বা মনকে ছিঁড়ে আনা মোটেই সহজ কাজ নয়, এবং এক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য অর্জন একরকম অসম্ভবই বলতে হবে। কিন্তু সাধকদের লক্ষ্য যখন সেটাই তখন ক্ষুধাকেই সাধনাচারের অঙ্গীভূত করে সমাজের প্রবল আকর্ষন শক্তিকে প্রতিহত করার একটা প্রয়াস চালানো হয়। আর সে জন্যই অনাহার, অনশন, উপবাস, রোযা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সাধনাচারের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে ওঠে।

মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টারভেশন স্টাডি দেখাচ্ছে ক্ষুধা সামাজিক বন্ধন ছাড়াও আর যে অনুভূতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে তা হলো যৌনচেতনা। অর্ধভুক্ত মানুষদের নিয়ে এই গবেষনাটায় দেখা গেল, Sexual interests were likewise drastically reduced. Masturbation, sexual fantasies, and sexual impulses either ceased or became much less common. One subject graphically stated that he had "no more sexual feeling than a sick oyster." (Even this peculiar metaphor made reference to food.) Keys et al. observed that "many of the men welcomed the freedom from sexual tensions and frustrations normally present in young adult men" (p. 840). The fact that starvation perceptibly altered sexual urges and associated conflicts is of particular interest, since it has been hypothesized that this process is the driving force behind the dieting of many anorexia nervosa patients. According to Crisp (1980), anorexia nervosa is a adaptive disorder in the sense that it curtails sexual concerns for which the adolescent feels unprepared. During rehabilitation, sexual interest was slow to return. Even after 3 months, the men judged themselves to be far from normal in this area. However, after 8 months of renourishment, virtually all of the men had recovered their interest in sex.
যৌনচেতনা অনুভূতির দিক দিয়ে এতখানিই তীব্র শক্তির অধিকারী যে একে পারস্ত করা, জয় করা কোনক্রমেই সহজ নয়। আর তাই প্রায় সাধককেই দেখা যায় “কেবল বায়ু মাত্র ভক্ষন করিয়া তপস্যা করিতে লাগিলেন”। ভারতীয় পুরাণে এই জন্যই হয়তো তপস্যারত অসুরকে তপস্যা থেকে নিবৃত্ত করতে দেবতারা স্বর্গের অপ্সরাদের পাঠাচ্ছে যেন যৌনকামনার মোহে অসুরটি তপস্যা ভেঙ্গে ফেলে। বুদ্ধের ধ্যানকে ভেঙ্গে দিতে মার দেবতা তার তিন কন্যা রতি, প্রীতি আর তৃষ্ণাকে ব্যবহার করে। আবার এই অনুভূতির পরিতৃপ্তির জন্য সামাজিক মানুষকে সমাজেরই মুখাপেক্ষী হতে হয়, সামাজিক হয়ে ওঠা ভিন্ন যৌনতৃপ্তি সম্ভবপর নয়। যৌন কামনা তাই সামাজিক, বৈষয়িক সম্পর্কের নিগড়ে মানুষকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। অথচ যে সত্ত্বা গর্ভস্থ শিশুর পরম শান্তির মাতৃগর্ভতুল্য অবস্থাকে পেতে চাইছে তাকে সংসারের বৈষয়িক নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে গেলে কিছুতেই চলবেনা। আর সেইজন্যই প্রয়োজন এই বন্ধন কেটে সত্ত্বাকে মুক্ত করে আনা। সংযমের মাধ্যমে এই কামনা-বাসনার সাথেই সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া। মূলত এই চেতনার সাথে সংগ্রামের জন্যই ক্ষুধাকে আধ্যাত্মিক সাধনাচারে ব্যবহার করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থঃ
১। Across Arctic America – Kund Rasmussen. Putnam’s Sons. New York & London.
২। Starvation And Bahavior – David M. Garner Ph.D
http://joyproject.org/overcoming/starvation.html
৩। বাল্মীকি রামায়ণ – হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য। তুলি-কলম। কোলকাতা
৪। পৌরাণিক অভিধান – সুধীরচন্দ্র সরকার। এম.সি. সরকার এণ্ড সন্স প্রাঃ লিঃ। কোলকাতা।
৫। গৌতমবুদ্ধ : দেশকাল ও জীবন - রুবী বড়ুয়া ও বিপ্রদাশ বড়ুয়া। সাহিত্যসমবায়। ঢাকা।

মোক্ষ, নির্বাণ ও মাতৃগর্ভ : প্রথম পর্বের লিংক
http://www.sachalayatan.com/sohelimam/56067

মোক্ষ, নির্বাণ ও মাতৃগর্ভ : দ্বিতীয় পর্বের লিংক
http://www.sachalayatan.com/sohelimam/56095


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ক্যারিবু এস্কিমোর শামান হয়ে ওঠার বর্ণনাতে সোহেল ইমামকে খুঁজে পেয়েছি। আপনার এই স্টাইলটি আমার ভালো লাগে। স্পিরিটের একটা যুৎসই বাংলা কী হতে পারে? ঠিক পরমাত্মা টাইপের তৎসম নয়, আরামদায়ক কোন শব্দ।

পুরো লেখাটি থেকে ক্যারিবু শামানের অংশটুকুই উল্লেখ করলাম কেন? এখানে একটা কাকতালীয় ব্যাপার আছে। বছর দুয়েক আগে একটা গল্প লেখা শুরু করেছিলাম ক্যানাডার অন্টারিও প্রদেশের আদিবাসী হুরন দের নিয়ে। গল্পের নাম হুরন ক্যারল। একজন শামানের গল্প। আপনার ক্যারিবু এস্কিমো আমাকে মনে করিয়ে দিলো হুরন ক্যারল শেষ হয়নি।

------মোখলেস হোসেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

মনে যখন পড়লো দেরী করবেননা। গল্পটাকে সময় দেন আমরা আরো একটা নতুন গল্প পড়তে পাবো। ধৈর্য ধরে পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ মোখলেস ভাই।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

এই পর্বে কিন্তু মাতৃগর্ভ থেকে সরে গেছেন অনেকটাই।

সোহেল ইমাম এর ছবি

খুব কি সরে গেছে? জিজ্ঞাসাটা আসলে এ পথে এনে ফেলেছে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।