আমাদের সভ্যতার প্রাচীন মিথ গুলোতেও মাতৃগর্ভে প্রত্যাবর্তনের আকুলতা নানান ব্যঞ্জনায় রঞ্জিত হয়ে আছে। এই ব্যঞ্জনাই পরবর্তীতে আমাদের বিচিত্র আধ্যাত্মিক জ্ঞানের নানান ভাষ্যে অনুরনন তুলে এসেছে যুগের পর যুগ। আনুমানিক ২০০০০০-৭৫০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের প্রাগৈতিহাসিক নিয়াণ্ডারথাল মানুষদের ক্ষেত্রেও দেখছি তারা যখন কোন মৃতদেহ কবরস্থ করতো তখন কবরে সেই দেহ শুইয়ে দিত হাঁটু ভাঁজ করে প্রায় বুকে ঠেকিয়ে অবিকল ভ্রূনের ভঙ্গীতে। সেই কবরে বলির পশুর হাড়ের সাথে শুকনো ফুলের মালার অস্তিত্ব জানায় মৃত্যুপরবর্তী একটা পারলৌকিক জীবনের বোধ সেই আদিম যুগের মানুষের মধ্যেও ছিল। জন্ম অভিজ্ঞতার স্মৃতির তাড়নাতেই কি তারা ভেবেছিল মাতৃগর্ভে যে ভঙ্গীতে শিশু অবস্থান করে মৃতদেহ কবরস্থ করার সময় ঠিক সেই ভঙ্গীটারই অনুকরন করতে হবে? ভারতীয় পুরাণে অনন্তনাগের ওপর শায়িত বিষ্ণুর নাভি থেকে উত্থিত পেঁচানো নালের শেষ প্রান্তে একটা বিকশিত পদ্ম। এই ছবিটার সাথে আম্বিলিকাল কর্ড ও প্লাসেন্টা সংযুক্ত গর্ভস্থ শিশুর সাদৃশ্যই সবার আগে মনে আসে। আর এই পদ্মের মধ্যে যখন দেখি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা আসন নিয়ে কল্প কল্পান্তর জুড়ে বিশ্বজগতের সৃষ্টি ও প্রলয় ঘটাতে থাকে তখন বোঝা যায় ভারতীয় চেতনায় গর্ভস্থ শিশু ও গর্ভ বিষয়টি সেই পৌরাণিক কাল থেকেই কেবল জীবনের উৎসকেন্দ্র নয় সমস্ত কিছুর সৃজনীশক্তির উৎসমুখ বলেই চিহ্নিত হয়ে আছে ।
প্রায় ৪০০০ বছর পূর্বের সুমেরীয় সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে পাওয়া দেবী ইনানার মৃত্যুর জগতে প্রবেশের যে কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে তাও এ প্রসঙ্গে যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। দেবী ইনানা স্বর্গ আর পৃথিবীর অধিশ্বরী আর এরিশকিগাল মৃত্যুর জগতের দেবী। এরিশকিগালের স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে দেবী ইনানা পাতালে অবতরন করতে গেলে মৃত্যুর জগতের সাতটি তোরন তাকে পার হতে হয়। মৃত্যুর জগতে প্রবেশ সহজ নয় বিশেষ করে যারা জীবিত তাদের জন্য। ইনানা স্বর্গের দেবী হলেও দেখি তার জন্যও কাজটা সহজ হয়নি। মৃত্যুর জগতে প্রবেশের সময় সেই জগতের অলঙ্ঘনীয় নিয়ম তাকেও মানতে হয়। প্রথম তোরনে তাকে খুলে রেখে যেতে বলা হয় তার মাথার মুকুট। ইনানার আপত্তিতে দ্বার রক্ষক বলে ওঠে,
Quiet, Inanna, the ways of the underworld are perfect
They may not be questioned.
একের পর এক তোরনে প্রবেশের সময় ইনানাকে তার অলঙ্কার, পরনের বর্ম, রাজদণ্ড এমনকি শেষ অবধি পোষাকটাও খুলে রেখে যেতে হয়। প্রতিবারই ইনানা আপত্তি করলে শুনতে হয় সেই একই সতর্কবাণী মৃত্যুর রাজ্যের অলঙ্ঘনীয় নিয়ম কোনক্রমেই লঙ্ঘন করা চলবেনা। এ যেন জন্মের পর শিশু যা কিছু অর্জন করতে করতে পূর্ণবয়স্কতায় পৌঁছেছিল উল্টো পথে তাই আবার পরিত্যাগ করতে করতে গর্ভের আশ্রয়ে এসে প্রবেশ করার মত। মৃত্যুর রাজ্য যেন মাতৃগর্ভ, এখানে প্রবেশ করতে হলে সবাইকেই সমস্ত আবরন-আভরন ত্যাগ করে শিশু হতে হবে নইলে প্রবেশের অনুমতি মিলবেনা। দেবী ইনানার জন্যও দেখি এই নিয়ম বিন্দু মাত্র শিথিল করা হয়নি। কিন্তু মৃত্যুর জগতে প্রবেশ করা মাত্রই মৃত্যুর দেবী এরিশকিগালের রোষে ইনানার মৃত্যু হলো আর তার দেহটা একটা আঁকশিতে ঝুলিয়ে রাখা হলো। এদিকে মৃত্যুর রাজ্যে প্রবেশের আগেই ইনানা নিনশুবারকে সতর্ক করে এসেছিল সে যদি তিনদিনের মধ্যে ফিরে না আসে তবে সে যেন অন্য পিতৃদেবতাদের সাহায্য প্রার্থণা করে। এনলিল দেবতা আর নানা দেবতা সাহায্য করলেননা, কিন্তু ঘটনা শুনে দেবতা এনকি দয়াপরবশ হলেন। এনকি দেবতা তার নখের ময়লা দিয়ে সৃষ্টি করলেন কুরগারা আর গালাতুরকে। এরা না মেয়ে না ছেলে। এনকি কুরগারাকে জীবন সঞ্জীবনী খাদ্য দান করলেন আর গালাতুরকে দিলেন জীবন সঞ্জীবনী জল। তাদের উপরই ভার দিলেন ইনানাকে উদ্ধার করবার। বললেন মাছির মত আকৃতি নিয়ে তারা যেন মৃত্যুর জগতে প্রবেশ করে। তারা সেখানে প্রবেশ করে দেখলো মৃত্যুর জগতের অধিশ্বরী যেন গর্ভ যন্ত্রনায় ছটফট করছে। এরিশকিগালের দেহ নগ্ন, চুল গুলো এলোমেলো ভাবে বিশ্রস্ত হয়ে আছে আর সে যাতনায় আর্তনাদ করছে,
‘Oh! Oh! my inside
She groaned:
‘Oh! Oh! my belly’
এরিশকিগালের সাথে সাথে কুরগারা আর গালাতুরও সেই যাতনার শব্দ গুলো উচ্চারন করে যেন তারাও দেবীর যাতনা অনুভব করছে। এরিশকিগাল তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে কিছু দিতে চাইলে তারা ইনানার শবদেহ প্রার্থনা করে। তারপর,
The kurgara sprinkled the food of life on the corpse
The galatur sprinkled the water of life on the corpse
Inanna rose...
দেবী ইনানা জীবন ফিরে পেল। মৃত্যুর এই জগত যেমন মাতৃগর্ভের অনুকরনে ইনানাকে সব আবরন-আভরন ত্যাগ করিয়ে তবেই সেখানে প্রবেশ করতে দিয়েছে তেমনি যে কিনা মৃত্যুর রাজ্যের অধিশ্বরী, যে নিজেই মৃত্যুর জগত তাকেই দেখি গর্ভ যন্ত্রনায় ছটফট করতে। আঁকশিতে ঝুলিয়ে রাখা ইনানার শব যেন মাতৃগর্ভে ভ্রূন। দেবতার আশীর্বাদে জীবনের জল আর পুষ্টি দিয়ে সেই ভ্রূনকেই কুরগারা আর গালাতুর গর্ভের বাইরের জীবনে নিয়ে আসে।
বাইবেলের অ্যাডাম ইভের ইডেনের বাগান থেকে নির্বাসনের কাহিনীও এক অর্থে গর্ভস্থ প্রশান্তির জগত থেকে বিচ্যুত হবারই কাহিনী। বাইবেলে আমরা দেখছি ঈশ্বর অ্যাডামকে ইডেনের বাগানের দায়িত্ব দিচ্ছে। অ্যাডাম এই বাগানের দেখভাল করবে, খুশিমত ফলও খাবে তবে বিশেষ একটা গাছের কাছে যাওয়া নিষেধ, সে গাছের ফলও কোন ক্রমেই খাওয়া চলবেনা।
And the lord God commanded the man, saying, Of every tree of the garden thou mayest freely eat. But of the tree of knowledge of good and evil, thou shalt not eat of it : for in the day that thou eatest thereof thou shalt surely die. (Genesis: ch2:16,17)
কিন্তু সাপ তাদের প্ররোচিত করলো সে ফল খেতে। অ্যাডাম-ইভ দ্বিধায় দুলতে থাকে, তারা বলে ঐ বিশেষ গাছের ফল খেলেই মৃত্যু হবে। ধুর্ত সাপ তাদের আস্বস্ত করে বলে তোমরা কিছুতেই মরবেনা। তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে এই জন্য যে ঈশ্বর জানেন যেদিন তোমরা সে ফল খাবে তোমাদের চোখ খুলে যাবে। তোমরা দেবতাদের মত ভালো-মন্দের বিচার করা শিখে যাবে। জ্ঞান বৃক্ষের ফল খেতে এই জন্যই নিষেধাজ্ঞা।
And the serpent said unto the woman, Ye shall not surely die. For God doth know that in the day ye eat thereof, then your eyes shall be opened, and ye shall be as gods, knowing good and evil. And when the woman saw that the tree was good for food, and that it was pleasant to the eyes, and a tree to be desired to make one wise, she took of the fruit thereof. (Genesis : ch 3: 4, 5, 6)
আর সত্যিই তাই হলো। ফল খাওয়া মাত্র অ্যাডাম-ইভ দু’জনেরই চোখ খুলে গেল। এই প্রথমবারের মত তারা উপলব্ধী করলো তারা নগ্ন। ডুমুর গাছের পাতা সেলাই করে পোষাক বানিয়ে তারা নিজেদের নগ্নতা ঢাকলো। ঈশ্বর যখন এলো তখন দু’জনেই তাদের নগ্নতা নিয়ে বিব্রত হয়ে লুকিয়ে গেল। ঈশ্বরের ডাকে অবশ্য তাদের বেরিয়ে আসতেই হলো আর ব্যাখ্যাও করতে হলো কেন তারা লুকিয়েছিল। ঈশ্বর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো কে বললো তোমরা নগ্ন, আর এই প্রশ্নের সাথে সাথেই ঈশ্বর বুঝলেন তারা সেই নিষিদ্ধ জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়েছে। অ্যাডাম-ইভ দু’জনকেই ইডেনের বাগান থেকে নির্বাসন দেওয়া হলো। ঈশ্বর বললো এখন তাদের পরিশ্রম করে, ঘাম ঝরিয়ে খাদ্য উৎপাদন করে খেতে হবে। ইডেনের বাগানে যেমন কোন পরিশ্রম ছাড়াই তারা সুখাদ্য পেয়ে এসেছে সেই সুবিধা তারা আর পাবেনা। শুধু তাই নয় তাদের বের করে দিয়েই ইডেন বাগানের দ্বারে সশস্ত্র প্রহরী নিযুক্ত করা হলো যাতে তারা আবার বাগানে প্রবেশ করে আরেকটি মূল্যবান অথচ নিষিদ্ধ গাছ জীবন বৃক্ষের ফল না খেতে পারে। বাইবেল বলছে,
So he drove out the man; and he placed at the east of the garden of Eden Cher’ubims, and a flaming sword which turned every way, to keep the way of the tree of life. (Genesis: ch 3:24)
অ্যাডাম ও ইভ স্বর্গীয় শান্তির জীবন থেকে নির্বাসিত হলো যখনই তারা জ্ঞান বৃক্ষের ফল খেলো আর তাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হলো। তাদের সৃষ্টিই হয়েছে ইডেন এর বাগানে সেখানে তারা শান্তির সাথেই বাস করছিল। খাদ্যের জন্য তাদের পরিশ্রম বা দুশ্চিন্তা কোনটাই করতে হয়নি। নিজেদের নগ্নতা নিয়ে বিচলিত হবার জ্ঞানও তখন তাদের হয়নি। কিন্তু যখনই জ্ঞানের উন্মেষ হলো তাদের বহিস্কার করা হলো সেই নিশ্চিন্ত শান্তির আশ্রয় থেকে। এ গর্ভস্থ ভ্রূন জীবনের রূপক ছাড়া আর কী। মাতৃগর্ভে ভ্রূনেরও এরকমই প্রশান্তির জীবন। কিন্তু জন্মের পরই শুরু হয় জীবন সংগ্রাম, খাদ্য আর আপনা আপনি আম্বিলিকাল কর্ড বেয়ে শরীরে পৌঁছে যায়না, ক্ষিধে পেলে কেঁদে উঠতে হয় খাবার পাবার জন্য। আরেকটু বড় হলে নিজেকেই ঘাম ঝরিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তবেই গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা হয়। বিভিন্ন সভ্যতার মিষ্টিক সাধু-সন্তদের কাছে আমরা জেনেছি পার্থিক জ্ঞানই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভের পথে বাধা। তাদের সাধনাচারে তাই এই পার্থিবতাকে পরিত্যাগ করার কথাই বারবার উচ্চারিত হয়েছে। ভারতীয় সাধু-সন্তদের সাধনা সংক্রান্ত আলোচনায় আমরা দেখেছি বৈষয়িকতা তথা পার্থিব জ্ঞান যার প্রকাশ হচ্ছে আকাঙ্খা আর কামনা-বাসনা তার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ। এসব উচ্ছেদ করেই পূর্ণবয়স্ক মানুষ শিশুর সারল্যে এবং ক্রমে গর্ভস্থ ভ্রূনের জীবনে উপনীত হতে পারে। আবার এর উল্টো ধারায় এই পার্থিব জ্ঞানই গর্ভস্থ জীবনের শান্তির আশ্রয় থেকে তাকে বিচ্যুত করে। একই ধারায় বাইবেলেও সেই একই কথা, অ্যাডাম-ইভের জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ হওয়া মাত্র তারা শান্তির আশ্রয় থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়লো, এসে উপস্থিত হলো রুক্ষ-রূঢ় পার্থিব জীবনে। সেই প্রশান্তির মাতৃগর্ভে পুনঃপ্রবেশের পথ যে কঠিন এটাই বাইবেলে এসেছে প্রজ্বলন্ত তরবারী হাতে চেরুবিমের ইডেন বাগানের দ্বারে পাহারার কথায়। এই প্রহরী পাহারা দিচ্ছে বাগানের আরেকটি গাছ “জীবনবৃক্ষ”। এই গাছের ফল খেতে পারলে ইডেন বাগানে অনন্ত জীবন অর্জন করা যায়। খ্রীষ্টীয় ধারনামতে যিশুখ্রীষ্টের মাধ্যমে কেবল বিশ্বাসে চেতনাকে আত্মনিমগ্ন করতে পারলেই এই জীবনবৃক্ষের ফল খাওয়ার সৌভাগ্য হবে। অর্থাৎ পার্থিবতাকে, বৈষয়িক চিন্তাকে এড়িয়ে বিশ্বাসে, নিখাদ বিশ্বাসে আত্মাকে আত্মমগ্ন করতে পারলেই সেই মাতৃগর্ভ বা শান্তিময় স্বর্গীয় উদ্যানে প্রবেশের এবং সেখানে অনন্তকাল অবস্থানের অনুমতি মিলবে যেখান থেকে একদিন নির্বাসিত করা হয়েছিল প্রথম মানব-মানবীকে। ভারতীয় সাধু-সন্তরাও জন্মচক্র রুদ্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন সেই একই অভিলাসে। মাতৃগর্ভের প্রশান্তিতে উপনীত হয়ে সেখানেই যাতে চিরকাল অবস্থান করতে পারেন, সেই শান্তির স্বর্গলোক থেকে পুনরায় জন্ম নিয়ে যেন বিচ্যুত হতে না হয় এই প্রয়াসেই মোক্ষ আর নির্বাণ তাদের আধ্যাত্মিক সাধনার আত্যন্তিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইবেলের জেনেসিসের অ্যাডাম-ইভের কাহিনীও সেই একই ধারার আধ্যাত্মিক উপলব্ধীকে ধারন করে আছে।
ধর্মের সমস্ত কিছুই যে মাতৃগর্ভকালীন জীবনের আর জন্মের অভিজ্ঞতা প্রসুত তা নয়। ধর্মের আত্মগত মিষ্টিক দিকটি ছাড়াও একটা বিপুল অংশ গোষ্ঠীবদ্ধ সামাজিক জীবনের শৃঙ্খলা ও যুথবদ্ধতার প্রয়োজন থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। কখনও আত্মগত মিষ্টিক উপাদান গুলো সামাজিক জীবনের প্রয়োজনে প্রযুক্ত হয়েছে আবার কখনও সামাজিক শৃঙ্খলার বিধি-নিষেধও আত্মগত মিষ্টিক ধারার সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। নৃতত্ত্বের গবেষনায় ধর্মের সামাজিক বিধি-বিধানের শিকড় সন্ধান যেমন জরুরী তেমনি এর মরমীবাদী দিকটিরও উৎস অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। Otto Rank এর মত খ্যাতিমান মনোবিজ্ঞানী যেমন মানবমনের এই আধ্যাত্মিক অভীপ্সার জটিল আবর্তে বিজ্ঞানের আলোক ফেলতে চেষ্টা করেছেন তেমনি মিথতত্ত্ব নিয়ে সেই একই প্রচেষ্টা আমরা দেখি জোসেফ ক্যাম্ববেলের বিভিন্ন রচনায়। আরেকজন মনোবিজ্ঞানী স্তানিস্লাভ গ্রফের এ সংক্রান্ত রচনায় উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন কার্ল সেগানও। কার্ল সেগান তার “ব্রোকা’জ ব্রেইন” বইয়ের একটা অধ্যায় এই আধ্যাত্মিক রহস্যের পার্থিব উৎস অনুসন্ধানের বিষয় দিয়েই সাজিয়েছিলেন। জিজ্ঞাসা যে এই লেখকদের লেখাতেই শেষ হয়ে গেছে তা নয়, আরো অনেকেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছেন অধ্যাত্মবাদের এই প্রবনতাটিকে।
প্রায় সব সংস্কৃতিতেই ঈশ্বরের সাথে মানুষের নাড়ীর যোগ ও সেই সম্পর্কে ছেদ এবং আবার সেই সম্পর্কে ফিরে যাবার আকুতিই আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার কেন্দ্রীয় হৃৎস্পন্দন। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে যেখানে সুস্পষ্ট ঈশ্বরের উল্লেখ নেই সেখানেও এই নির্বাণ ও মোক্ষের ধারনা এই আধ্যাত্মিক অনুভব থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গর্ভস্থকালীন জীবন ও জন্ম অভিজ্ঞতার স্মৃতিই আধ্যাত্মিক মরমীবাদের জন্ম দিয়েছে। এই বাস্তব, পার্থিব ঘটনার রেশই আধ্যাত্মিক অনুভব ও অভিজ্ঞতাকে ব্যক্তিমানসে নিছক কল্পনার বিপরীতে একটা বাস্তব ভিত্তির ধারনা যুগিয়ে দিয়েছে। কেননা এটা স্মৃতিই, একেবারে মূলহীন কল্পনামাত্র নয়। অস্পষ্ট হলেও বাস্তব একটা অভিজ্ঞতা প্রসুত স্মৃতিই এই অনুভবের পেছনে সক্রিয় ছিল। এ কারনেই প্রথম দিকে মনোবিজ্ঞানের বিচার বিশ্লেষনে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে নিছক কল্পনার স্তরে ফেলতে অনেকেই দ্বিধা করতেন। এই অভিজ্ঞতা বা অনুভব গুলো যে আন্তরিকতা আর নিষ্ঠার সাথে মানবমনে উদ্ভুত হচ্ছে তাতে এর বাস্তব ভিত্তি না থেকেই পারেনা। এখন বিজ্ঞানের আশীর্বাদে এবং আরো স্বচ্ছ বিশ্লেষনী দার্শনিক বিচারে আভাস পাওয়া যাচ্ছে এই অভিজ্ঞতা গুলোর বাস্তব ভিত্তি সত্যিই রয়েছে তবে তা কোন অতিলৌকিক বা পারলৌকিক জগতে নয় আমাদের অতিপরিচিত এই পার্থিব জগতেই। আমাদের সাধকদের আধ্যাত্মিক প্রয়াসের অনেকখানিই জুড়ে আছে এই হারিয়ে ফেলা মাতৃগর্ভে প্রত্যাবর্তনের পথের সন্ধান প্রচেষ্টা। মাতৃগর্ভের স্মৃতিকে আরো পরিনত মানসে রচনা করে তুলতে হয়েছে তাদের, তাকে স্থাপন করতে হয়েছে বাস্তব অতিক্রমী এমন দূরত্বে যাতে প্রাপ্ত বয়স্কের মানসিক জটিলতা নিয়েও আশ্রয় নেওয়া যায় এই নির্বাণের স্বর্গলোকে। এ প্রয়াসে পূর্ণ সফলতা হয়তো আসেনি, আসবার কথাও অবশ্য নয়, কিন্তু এই প্রচেষ্টাটিই একটা অনন্য ধারার ইতিহাস রচনা করেছে। আর সেই ইতিহাসের রুদ্ধ পথই বলে দেয় পরিশ্রমের স্বেদ ভিন্ন আমাদের আর কোন স্বর্গ নেই প্রত্যাবর্তনের। স্বর্গ নেই কিন্তু পৃথিবী রয়ে গেছে, রয়ে গেছে স্বর্গতুল্য পৃথিবী গড়ার অমিত সম্ভাবনা।
তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থঃ
১। The Descent Of Inanna : translated by Diane Wolkstein and Samuel Noah Kramer's book, "Inanna Queen of Heaven and Earth, Her Stories and Hymns from Sumer", Harper & Row, NY
২। Holy Bible : THE GIDEONS INTRNATIONAL
মোক্ষ, নির্বাণ ও মাতৃগর্ভ : প্রথম পর্ব
মোক্ষ, নির্বাণ ও মাতৃগর্ভ : দ্বিতীয় পর্ব
মোক্ষ, নির্বাণ ও মাতৃগর্ভ : তৃতীয় পর্ব
মন্তব্য
পড়তে গিয়ে একটা প্রশ্ন মাথায় এলো, আপনি আদম হাওয়ার পরিবর্তে এডাম ইভ লিখছেন কেন? সাংস্কৃতিক ভাবে আদম হাওয়া তো আমাদের লেখায় আসার সম্ভাবনা বেশি।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
যে বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিলাম তা ইংরেজি ভাষায় ছিল সম্ভবত সেই প্রভাবেই ওভাবে লেখা। পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
মনে পড়লো, পরম যুক্তিবাদী মিসির আলীও খুব ভয় পেলে নির্ভরতা লাভের মানসে শুয়ে পড়ে হাঁটু ভাঁজ করে থাকতেন, গর্ভস্থ শিশুরা যেমন ভঙ্গীতে গর্ভে অবস্থান করে থাকে। মিসির আলী কাল্পনিক চরিত্র, সুতরাং মিসির আলী বলে কেউ একজন যে এমনটা করতেন, এটা একটা মিথ্যাচার। মিসির আলী এমনটা করে ভীতি থেকে মুক্তি লাভ করতেন, সেটাও কি তবে মিথ্যাচার নয়? আমি নিজে করে দেখেছি, আমার ক্ষেত্রে ভীতির তেমন কোন রকমফের হয় নি।
লাভ অবশ্যই হয়না। ছোটবেলায় একা ঘুমোবার সময় ভয় পেলে গরমের সময়ও চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি মেরে ভ্রূণের ভঙ্গিতে পড়ে থাকতাম। লাভ হতোনা তবে আরো অনেকে এরকম করেছে বলেও শুনেছি। হয়তো ভয় তাড়াবার আশায়, মিশির আলী চরিত্র সৃষ্টির আগেও এটা দেখা গেছে। লাভ না হলেও মনের মধ্যে যে প্রবৃত্তি তাতেই হয়তো এমনটা অনেকে করে। আপনি যেমন বললেন “নির্ভরতা লাভের মানসে” এইটাই পয়েন্ট। কোথা থেকে এমনটা আশা জাগে যে ঐ ভঙ্গিটা নিলে লাভ হতে পারে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন