টিনক্যানভাসের ছবির জন্য বছরটা ভালো যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহীর রিকশার ছবির বিস্ফোরনের সময়কাল বলতে ২০১৪ সাল এবং ২০১৫র কিছুটা। ২০১৩ থেকে মোটামুটি ভাবে নতুন করে আঁকা শুরু হলেও তার পরের বছরই নজরকাড়ার মত সংখ্যায় এবং বৈচিত্র্যে উচ্ছসিত হয়ে উঠেছিল রিকশায় ছবি, আর তা ২০১৫ সালের কিছু অংশে উপচেও পড়েছিল। কিন্তু সেই সঙ্গেই বলতে হয় সে বছরেরই শেষের দিকে নতুন রিকশা নামানোর উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আর নতুন রিকশার লাইসেন্স সংক্রান্ত জটিলতার প্রেক্ষিতে অনেকটা সময়ই রিকশায় নতুন ছবি আর আঁকানো হয়নি। অন্তত ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ অবস্থাটাই অপরিবর্তিত ছিল। এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই রাজশাহীর রাস্তায় নতুন রিকশা যেমন চোখে পড়ছে তেমনি নতুন করে ছবি আঁকাও শুরু হয়ে গেছে। এই নতুন রিকশা গুলোয় পেছনের টিনক্যানভাসের ছবি সহ সামগ্রিক রিকশার অলঙ্করনে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারই বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে। প্রায়শই উজ্জ্বল হলুদ রঙের উপর টকটকে লাল রং ব্যবহার করেই নতুন রিকশা গুলো অলঙ্কৃত হচ্ছে। অন্য রং কচিৎ ব্যবহার হলেও তা চোখে পড়বার মত জেল্লা নিয়েই আসছে। রিকশার ছবিতেও এই উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার প্রায় আবশ্যিক হয়ে উঠেছে।
এর প্রধান কারণটা সম্ভবত শিল্পী জামাল। অন্যান্য শিল্পীর চেয়ে শিল্পী জামালের ছবিই বেশি হারে রিকশায় চোখে পড়ছে। বোঝাই যায় শিল্পী জামাল রিকশার ছবি আঁকায় এখন প্রধানতম শিল্পী হয়ে উঠেছেন, আর তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্যই এই উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো রঙের উৎসব। তাঁর নিকটাত্মীয় বা সহকারী যারা ছবি আঁকছেন তাদের ছবিতেও এই বিশিষ্টতা দেখা যায়। বিশেষ করে শিল্পী শামীমের ছবিতে। দু’পাশে গাছের সারির মাঝ দিয়ে দিগন্তে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া হাইওয়ের ছবি গুলোই প্রথমটা বেশি এসেছে। তারপর ক্রমান্বয়ে জোড়া ময়ুর বা জোড়া দোয়েলের ছবিগুলোও ক্রমে সংখ্যায় বেড়েছে। এই ছবি গুলো প্রায়ই গত দু’বছরের ছবি গুলোরই পুনরাবৃত্তি। কিন্তু অনেক সময়ই এই পুনরাবৃত্তি কিছুটা যান্ত্রিক আড়ষ্টতায় আক্রান্ত। শিল্পী সেরাজুল, যিনি প্রাকৃতিক ও গ্রামদৃশ্যের ছবি আঁকায় বিশেষ ভাবেই সিদ্ধহস্ত তাঁরও খুব বেশি ছবি চোখে পড়ছেনা। অল্প যে দু’একটা নতুন ছবি এঁকেছেন তা ধর্মীয় মোটিফ নিয়েই। সেই চিরাচরিত কাবা শরীফ আর মসজিদে নববীকে পাশাপাশি রেখে আঁকা। শিল্পী আরিফুল ইসলাম রুনু এখনও ছবি এঁকে চলেছেন তবে অনন্য প্রতিভাধর হলেও সাদামাটা গ্রাম দৃশ্যের বেশি এখনও কিছু আঁকছেননা। সেই কুড়ে ঘরের পাশ দিয়ে নদী ও নদীতে একটা দু’টো পাল তোলা নৌকা। শিল্পী সেরাজুলের ছবিতে এই গ্রামদৃশ্যেই বিগত বছর গুলোয় যেমন বৈচিত্র্য দেখা যেত রুনুর ছবিতে সেই প্রয়াসটাও নেই। অথচ ক্ষমতার দিক দিয়ে আরিফুল ইসলাম রুনু কারো চেয়েই কম যাননা। এক সময়ের ব্যস্ততম টিনক্যানভাসের শিল্পী রোবুর মতে আরিফুল ইসলাম রুনু নিঃসন্দেহেই প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীদের মধ্যে অগ্রগন্য। কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণেই রুনু ছাঁচে ঢালা একটা ধরণেরই অনুসরন করে যাচ্ছেন এখনও।
আশ্চর্যভাবেই নীরব হয়ে আছেন শিল্পী মুজাহিদ। রাজশাহীর টিনক্যানভাসের শিল্পীদের মধ্যে যার নামটা সবার আগে চলে আসতো তার প্রায় কোন নতুন ছবিই চোখে পড়েনা। গত বছর থেকেই শিল্পী মুজাহিদের নতুন আঁকা ছবি রাজশাহীর রিকশায় অনুপস্থিত। তাঁর পুরনো ছবি গুলো এখনও রিকশায় রিকশায় দেখা যায় কিন্তু নতুন করে সাম্প্রতিক সময়ে তুলি ধরেছেন বলে মনে হয়না। প্যাডেল রিকশায় মোটর সংযোজন ও সেই সঙ্গে কাঠ-বাঁশের রিকশার কাঠামোকে ধাতব আধুনিক রূপদানকারী শিল্পী মুজাহিদুল ইসলাম সেই নতুন রিকশার অলঙ্করনেরও প্রথম ও প্রধান শিল্পী ছিলেন। সেই সময় রিকশার ছবি আঁকানো যখন প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে এবং পুরনো শিল্পীরা যখন রিকশা অলঙ্করণের বিষয়ে আর আগ্রহীও ছিলেননা তখন মুজাহিদ একাই এই নতুন মোটর সংযোজিত রিকশায় ছবি আঁকতে শুরু করেন। তাঁর দেখাদেখিই আবার অনেকেই রিকশার ছবি আঁকতে শুরু করেন। কিন্তু তখনই মুজাহিদের ছবি গুলোই সবার অনুকরণ-অনুসরণের আদর্শ হয়ে পড়েছিল। এখনও রাজশাহীর রিকশায় যে ছবি গুলো আঁকা হচ্ছে তার প্রায় সবগুলোই শিল্পী মুজাহিদের ছবিরই অনুকরণ। তাঁর আঁকা রেলগাড়ি, ঈগল, জোড়া ময়ুর এখনও অন্যান্য শিল্পীদের হাতে আঁকা হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবেই তাঁর আঁকা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ছবি গুলো আঁকতে কেউই আর সাহসী হলেননা। বাঘের ছবি তার পরেও এসেছে কিন্তু শিল্পী মুজাহিদের বাঘের রাজকীয় হুঙ্কার দেওয়া বাঘের ছবি আর কেউই আঁকলেননা।
মোটের উপর এবছরটা চিরাচরিত পুরনো ছাঁচের পুনরাবৃত্তিতেই কেটেছে। অনেক ক্ষেত্রে আগের ছবির তুলনায় এই অনুকৃতি গুলো অনেকাংশেই দুর্বল এবং প্রানহীন। নতুন ছবির মধ্যে নজর কাড়ে কার্টুন চরিত্র মোটু-পাতলু। জনপ্রিয় শিশুতোষ কার্টুন চরিত্র দু’টোর রিকশার ছবিতে উঠে আসাটা একটা ঘটনা। এর আগে কোন কোন রিকশায় কিছু কার্টুন চরিত্রের স্টিকার লাগানো হলেও রং দিয়ে বিশেষভাবে আঁকা বোধহয় এই প্রথম। শিল্পী মুজাহিদের রেলগাড়ির ছবির বহুল অনুকরণের পাশাপাশিই আঁকা হচ্ছে অত্যাধুনিক বুলেট ট্রেনের ছবি। এ ধরণের ট্রেনের প্রচলনের কথা শোনা গেলেও এখনও আমাদের দেশে বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু রিকশার ছবিতে অত্যাধুনিক এই ট্রেনের ছবি যেন সাধারণ মানুষের আকাঙ্খাটাকেই প্রকাশ করছে। একেবারে ছা-পোষা মানুষের মনের সাথে রিকশার ছবির সংযোগটা যে এখনও রয়েছে সম্ভবত এটাই আশার কথা। আগামী বছরে হয়তো আরো নতুন ছবি আঁকা হবে, বৈচিত্র্য আসবে, আসবে নতুন কোন ভঙ্গী।
যান্ত্রিক ভাবে ছবি ছাপানোর ও সেই ছাপানো ছবির আত্যন্তিক সহজলভ্যতায় একটা আশঙ্কা ছিল রিকশার ছবিতে ছাপানো ছবিই বেশি হারে ব্যবহার হতে শুরু হবে এবং ফলশ্রতিতে হাতে আঁকা রিকশার ছবি হয়তো একবারেই হারিয়ে যাবে। এই আশঙ্কার মধ্যেই গত তিন বছরে রাজশাহীতে হাতে আঁকা রিকশার ছবিই এখনও পর্যন্ত সংখ্যায় আশাতীত ভাবেই বেশি। কিন্তু রিকশার ছবির শিল্পটির জন্য যা হুমকি হয়ে উঠছে তা বিভিন্ন কোম্পানির পন্যের বিজ্ঞাপনের স্টিকার। এগুলো প্রায়ই রিকশার পেছনের টিন ক্যনভাসে আটকানোর জন্য প্রায় সেই মাপেই বানানো হচ্ছে। অনেক সময় রিকশার মালিক বা রিকশার চালকের অজ্ঞাতেই এই স্টিকার গুলো রিকশার পেছনে আটকে দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় যারা এ কাজ গুলো করছেন তারা রিকশার টিনক্যানভাসের নতুন ছবির ওপরেই এই স্টিকার গুলো সেঁটে দিচ্ছেন। কেউ কেউ যখন স্টিকার গুলো তুলে ফেলার চেষ্টা করেন তখন স্টিকারের সাথেই ছবির রংটাও উঠে আসে। এ বছর এই বিজ্ঞাপনী স্টিকারের আগ্রাসন আগের তুলনায় আরো বেড়েছে। এই বিজ্ঞাপনের আগ্রাসনে রিকশার ছবি কতখানি টিকে থাকতে পারে সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
রিকশার ছবি নিয়ে আরো কিছু পুরনো লেখা
টিনের ক্যানভাস
মুজাহিদের টিনের ক্যানভাস
রাজশাহীর রিকশার ছবিতে ধর্মীয় মোটিফ
রাজশাহীর রিকশার ছবিতে চিত্রতারকারা
রিকশার ছবি : ঐতিহ্যে ফেরা, না ফেরা
টিনক্যানভাসের এক বিস্মৃতপ্রায় শিল্প
হোয়াট শর্ট অব আর্ট ইজ রিকশা আর্ট
মন্তব্য
আবারও মুগ্ধ করলেন সোহেল ইমাম। একটা সময় অনেক প্রুফ দেখেছি বলেই বোধহয় নজরটা আমার খারাপ হয়ে গিয়েছে। "এ বছরেরই সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই" প্রথম ই টা বাদ দিয়ে দেন যদি চান।
---মোখলেস হোসেন
অনেক ধন্যবাদ মোখলেস ভাই। একটা ই এখনই বাদ দিচ্ছি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
চমৎকার।
ছবিগুলো রিসাইজ করলে আরো ভাল হয়।
বিশেষ করে নীড়পাতার ছবিটি বেশি বড় হয়ে গেছে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
নীড়পাতার ছবিটা রিসাইজ করেছি, ওটা কি এখনও বড় দেখাচ্ছে? মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ঈয়াসীন ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
বরাবরের মতই চমৎকার। দীর্ঘদিন রাজশাহী থাকলেও রিকশার ছবিগুলোর দিকে নজর দেই নি। কিন্তু আপনার পোস্টগুলো পড়বার পর থেকে রাজশাহী গেলেই রিক্সার পিছনে তাকানোর অভ্যেস হয়ে গেছে। চলতে থাকুক আপনার লেখালেখি।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
অনেক ধন্যবাদ রূপক ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
এইপর্ব-ও ভালো লাগলো।
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
ধন্যবাদ আশরাফ ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ভালো লাগলো, আপনার এই সিরিজটি পড়ছি
গুডরিডস
অনেক ধন্যবাদ জীবনযুদ্ধ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আপনার এই ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ দুর্দান্ত।
আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করতে চাই। রিকশাচিত্র নিয়ে আমিও হালকা কিছু কাজ করেছিলাম।
তাপসদা, মেইলটা একবার চেক করেন। রিকশার ছবির বিষয়ে আপনার কাজের কথা শুনেছি। ভালো থাকবেন।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন