মর্মর পাথরের মূর্তিটা অনেকদিন ছিল আমাদের শহরে। খুব বড়সড় কোন ভাস্কর্য নয়, একটা আবক্ষ মূর্তি। পথের ধারের এই মূর্তিটা রাজশাহী শহরে আসা যে কারো চোখে পড়েই যেত, কেননা এটা রাখা ছিল একেবারে রাজশাহীর হৃৎকেন্দ্র অর্থাৎ সাহেববাজারের ঠিক মোড়ের উপর।রাজশাহী শহরের নানা ভাঙ্গা গড়া, নানা পরিবর্তনের মধ্যে মূর্তিটা অনেক সময়ই বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু সব সময়ই মূর্তিটা ছিল সোনাদীঘির মোড়ের উপরেই। আমার মনে পড়ে এক সময় মূর্তিটা দেখতাম পশ্চিম দিকে মুখ করে অনেকগুলো দোকানের মাঝে। দোকান গুলো ছিল এখন যেখান থেকে মনিচত্বরের রাস্তাটা শুরু হয়েছে সেখানে। তখনও রাস্তাটা হয়নি। মনে পড়ে একবার মূর্তিটা স্থাপন করা হয়েছিল সোনাদীঘি মসজিদের পাশেই। মূর্তিটা তখন পূর্বমুখী ছিল। নিশ্চয় আরো কিছুবার স্থান পরিবর্তন হয়েছে যা আমার স্মৃতিতে নেই। শেষবার মূর্তিটাকে স্থাপন করা হয় সিটি কর্পোরেশন এর গেটের পাশেই তখন দক্ষিনের দিকে ছিল মূর্তিটার মুখ। প্রায় সময়ই দেখতাম মূর্তিটার সামনে একটা সিগারেট-বিড়ির দোকান মূর্তিটাকে ঢেকে রাস্তার ধারে ব্যবসা করছে। সন্ধ্যার সময় দোকানটা পেখম মেলে থাকতো বলে মূর্তিটাকে তখন দেখা যেতোনা, সকালে যখন দোকানটা গুটিয়ে বন্ধ করা থাকতো তখনই রাস্তা থেকেই চোখে পড়তো ওটা।
অবাক করার মত ব্যাপারটা ছিল মূর্তিটা বিখ্যাত কোন রাজনৈতিক নেতা, বা নামজাদা কোন লেখকের ছিলোনা। ছিলোনা কোন বিরাট ধর্মনেতা বা সাধু পুরুষেরও। মর্মর পাথর কুঁদে যাকে এই শহরের হৃৎকেন্দ্রে অমরত্ব দেওয়া হয়েছিল সে ছিল আমাদের মতই ছা-পোষা সাধারণ একটা মানুষ। কিন্তু আশ্চর্য বছরের পর বছর এই শহরের মানুষ মূর্তিটাকে কখনওই সরাতে চায়নি। বরং পুরাতন সিটি কর্পোরেশন ভবন ভেঙ্গে যখন বিরাট বহুতল ভবন নির্মাণের অছিলায় সিটি কর্পোরেশনের লোকজন যখন মূর্তিটা সরাতে আসে তখন আসেপাশের মানুষরাই রুখে দাঁড়িয়েছিলো। পরে গভীর রাতের কোন এক সময় তারা আবার আসে এবং মূর্তিটা সরিয়ে নিয়ে যায়। সকালে ভাঙ্গা বেদীটা শুধু পড়ে ছিলো সেখানে। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সে সময়। ২০১২ সালের সম্ভবত জুন মাসের দিকের ঘটনা এটা। সে সময় ফেসবুকে শহরে এবং শহরের বাইরে দূরে থাকা মানুষ গুলোও এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিচ্ছিলেন। সে সময়কার সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তখন বলেন মূর্তিটা ভালো ভাবেই সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং বহুতল ভবন নির্মাণ শেষ হলেই সোনদীঘির মোড়েই আবার মূর্তিটাকে প্রতিস্থাপিত করা হবে।
মূর্তিটা ছিলো কোন এক যতীন্দ্র নাথ বন্দোপাধ্যায়ের। মূর্তিটার নিচেই আরেকটা মর্মর ফলকে লেখা ছিলো :
যতীন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম-এ-বি-এল । পদ্মাগর্ভে নিমজ্জমানা নারীদ্বয়ের বিপন্ন অবস্থা দর্শনে তাঁহাদের প্রাণরক্ষার নিমিত্ত তদ্দণ্ডে আত্মপ্রাণ তুচ্ছ করিয়া পদ্মাবক্ষে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিলেন এবং তাঁহাদের উদ্ধার সাধন করিয়া স্বয়ং পদ্মাগর্ভে নিমজ্জিত ও অন্তর্হিত হইয়া অনন্তের ক্রোড়ে আশ্রয়লাভ করিয়াছেন। জন্ম - ১৬ই বৈশাখ ১২৯৫। মৃত্যু - ১২ই পৌষ ১৩২৩।
ইতিহাসতো এই মাত্র। একটা নিঃস্বার্থ আত্ম-ত্যাগ। সেদিনের প্রমত্ত পদ্মায় ডুবন্ত দুটো মানুষ দেখে স্থির থাকতে পারেননি যতীন্দ্রনাথ অকুতোভয় চিত্তে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন একেবারে সেই প্রমত্ত স্রোতধারার মধ্য। আজকের মুমুর্ষু পদ্মায় বালুর চরই প্রকট, এই চর দেখতে দেখতে যারা বড় হচ্ছেন তাদের কল্পনাতেও আসবেনা প্রমত্ত রাক্ষসী পদ্মার কী রূপ ছিল। জলমগ্ন কাউকে বাঁচানো যে কি কঠিন তা যিনি একাজ করেননি তাকে বোঝানো দুস্কর। বিশেষ করে মৃত্যু আসন্ন জেনে জলের ভেতর উন্মত্ত হয়ে ওঠা কাউকে জল থেকে টেনে ডাঙায় তোলা, এটা অনেক সময় রক্ষাকর্তারই প্রাণ সংশয় ঘটায়। যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় দু’জনকেই বাঁচিয়ে ছিলেন। কিন্তু পারলেননা নিজেকে বাঁচাতে। তিনি নিজে যেমন অন্যকে বিপদমুক্ত করতে এগিয়ে ছিলেন, তাঁকে বাঁচাতে কেউ ছিলনা। যে পরিবারের দু’জন মানুষকে জলমগ্ন হয়ে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন তাদের পরিবারের খরচেই কোলকাতার কোন এক ভাস্করকে দিয়ে এই মুর্তিটা গড়া হয়, স্থাপিত হয় একেবারে রাজশাহীর হৃৎকেন্দ্রে। শোনা যায় কোন এক সময় কিছু উগ্র ধর্মবাদী পৌত্তলিকতা ধ্বংসের নেশায় এই মূর্তিটাকে ভেঙ্গে ফেলবারও চেষ্টা করেছিল। সফল হয়নি কেননা রাজশাহীর মানুষ এই মূর্তিটাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলো।
মনে আছে সব সময় সোনাদীঘির পাড়েই মূর্তিটাকে দেখতে দেখতে আমাদেরও ধারণা ছিলো যতীন্দ্র নাথ বুঝি এই সোনাদীঘিতেই ডুবে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা পড়তে শেখার আগের সময়টায়। যখন পড়তে শিখলাম তখন ফলকের লেখা পড়ে ইতিহাসটা জানা হয়ে গেছে। শুধু জানাই নয় তখনই বুঝতাম এই যে সোনাদীঘির মোড়ের ওপর পাথরের মূর্তি গড়ে যে লোকটাকে সম্মান আর শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে তা তখনই অর্জন করা সম্ভব যখন অন্যের জন্য কেউ নিঃস্বার্থ ভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করে। সেই থেকে জানতাম একটা জীবনের সার্থকতা অন্যের জন্য জীবন উৎসর্গের মধ্যেই। জীবনের প্রকৃত সম্মানও সেখানেই। আর এটা শুধু আমার জানা নয় রাজশাহীর প্রায় সব শিশুই যারা এই মূর্তিটা দেখতে দেখতে বড় হয়েছে তাদের বুকেও স্পন্দিত হয়ে এসেছে।
সাধারন একটা মানুষের আত্ম-ত্যাগের কাহিনী বলে গেছে মুর্তিটা যুগের পর যুগ। এই মহৎ আত্ম উৎসর্গের প্রতি মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়েছেন সবাই। এটা শুধু একজন যতীন্দ্রনাথের গল্প নয়, নয় একটা মর্মর পাথরের নিস্প্রাণ মূর্তিরও, এটা আসলে একটা শহরের গল্প। রাজশাহী বিভাগীয় শহর অনেক দিন থেকেই কিন্তু আকারে প্রকারে মফস্বল শহরের আলো-আঁধারী আন্তরিকতা দিয়ে ঘেরা এই শহর। একটা সময় ছিল যখন প্রত্যেকে প্রত্যেককে চিনতো। শুধু চিনতোই না মুখ দেখলেই পূর্বতন চৌদ্দ পুরুষের নাম পর্যন্ত বলে দিতে পারতো সবাই। সেই শহরটায় জাঁকজমকের ইতিহাস আর রাজা-বাদশাহ এড়িয়ে একটা সাধারণ মানুষের আবক্ষ মূর্তিকে সংরক্ষণ করে এসেছে এতোটা কাল। আর এই নিস্প্রাণ পাথরের মূর্তিটাই বলেছে সার্থক জীবন তখনই যখন তা অন্যের জন্য উৎসর্গ করা যায়। শহরটা সেই আগের মত নেই। লোক বেড়েছে, ব্যস্ততাও বেড়েছে। বাইরে থেকে এখন প্রচুর লোক আসে। এখন চাইলেই আর মানুষের মুখ দেখে চিনে ফেলবার উপায় নেই। এখন তাই যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে। এখনকার শিশুদের শেখাতে হয় কিভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়, কিভাবে এর ওর মাথার ওপর পা দিয়ে উঠে পড়তে হবে আরো ওপরে। অন্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা দূরের কথা অন্যকে ছাড় দেবার কথাও এখন আর শিক্ষার পাঠ্যক্রমে নেই। সিটি কর্পোরেশন বোধহয় সেটা বুঝেই মূর্তিটা সরিয়ে নিয়েছে। তবু কিছু মানুষ এখনও স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মূর্তিটা কথা বলে। আশা করে সিটি কর্পোরেশনের বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হলেই আবার হয়তো মূর্তিটা দেখা যাবে। যাবে কি?
মন্তব্য
সাহসী মানুষদের প্রশংসা করতে বা তাঁদের সাহসের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে আমাদের সমাজে কুণ্ঠা কাজ করে। সাহসিকতার জন্যে নাগরিকদের রাষ্ট্র থেকে খেতাব দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলাম কয়েক বছর আগে, সেটা আবারও এ প্রসঙ্গে করি।
নগরপাল যদি যতীন্দ্রনাথকে চোখের আড়াল করেন, তাহলে প্রতি ১২ পৌষ তারিখে স্কুলে বা কলেজে ছোটো পরিসরে হলেও "বীর মেলা" নামে একটা মেলার আয়োজন করতে পারেন। রাজশাহী শহরের আরো যাঁরা বীর (নারীপুরুষ নির্বিশেষে), তাঁদের নিয়ে এ আয়োজন হতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে যারা কোনো বীরত্বসূচক কাজ করেছেন, তাদেরও সংবর্ধিত করা যেতে পারে। যেহেতু রাজশাহীকেন্দ্রিক উদ্যোগ, নাগরিকদের পক্ষ থেকে "রাজসাহসী" বা "রাজসাহসিনী" খেতাবও তাদের দেওয়া যেতে পারে। কিছুদিন চালিয়ে গেলে নগরকর্তৃপক্ষ লজ্জিত হয়ে উদ্যোগটাকে নিজেদের কাঁধে নেবে, এমন আশা করা যায় হয়তো।
সহমত হিমুদা
গুডরিডস
অসাধারণ একটা আইডিয়া দিলেন হিমুদা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আমি ভাই স্বার্থপর মানুষ। যেখানে যাই দেখি, গল্প খুঁজি। হিমুর পরামর্শ অনুযায়ী বীর মেলা করলে ভালোই হয়। তবে একটা গল্প লিখে ফেললেও কিন্তু মন্দ হয়না সোহেল ইমাম। লিখে ফেলুন, লেখা আপনার দারুণ আসে।
---মোখলেস হোসেন।
ভাই গল্পের যাদুকরতো আপনি। আপনি যেমনটা পারবেন আর কেউ হয়তো ওভাবে পারবেনা। যাদুর কলম সবার হাতে থাকেনা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
অনেক ধন্যবাদ ঈয়াসীন ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
চমৎকার একটা কাহিনী। মূর্তিটা আবার সোনাদীঘির মোড়ে শোভা পাক, শুভকামনা
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
অনেক ধন্যবাদ দ্যুতিদি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অন্তঃত দ্যাখা যাওয়া উচিৎ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন