আফ্রিকার জুলুদের দেবতা উনকুলুনকুলু গিরগিটিকে ডেকে বললেন, গিরগিটি তুমি মানুষের কাছে গিয়ে তাদের বলো তারা মরবেনা, তারা চিরকাল বেঁচে থাকবে কিন্তু মৃত্যু হবেনা তাদের। কিন্তু অলস গিরগিটি চললো ঢিমে তালে পা ফেলে, তার উপর পথের মধ্যেই উবুকুয়েবেজানি গাছের পাকা বেগুনি রঙের ফল দেখে তাই খেতে শুরু করলো পেট ভরে। শুধু তাই নয় গাছের মগডালে চড়ে বসে নরম রোদে শরীর মেলে দিয়ে পড়লো ঘুমিয়ে। এদিকে দেবতা উনকুলুনকুলু ব্যাপারটা নিয়ে আবার ভাবতে গিয়ে মত বদলে ফেললেন আর টিকটিকিকে ডেকে বললেন, ওহে টিকটিকি মানুষের কাছে গিয়ে তাদের বলো তারা বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকার পর মরে যাবে আর সেটাই তাদের জীবনের শেষ। টিকটিকি কিন্তু দেরী করলোনা সে দ্রুত ছুটতে ছুটতে অলস গিরগিটিকে পর্যন্ত পাশ কাটিয়ে আগেই মানুষের কাছে পৌঁছে দেবতা উনকুলুনকুলুর আদেশটা জানিয়ে দিলো। এদিকে হেলতে দুলতে গিরগিটি মানুষের কাছে এসে যখন তাদের অমরত্বের সংবাদ জানালো তখন সবাই বলতে লাগলো এ কি করে হয় দেবতা টিকটিকিকে দিয়ে জানিয়েছেন মানুষ হবে মরনশীল। মানুষেরা বলতে লাগলো আমরা আসল দৈববাণীটি পেয়ে গেছি এখন আর গিরগিটির কথা শুনে লাভ নেই। শোনা যায় সেই থেকে মানুষের জীবনে মৃত্যু দেখা দিয়েছিলো। জুলুরা ভাবে টিকটিকিটা অত জোরে ছুটে এসে যদি না জানাতো তাহলে মানুষ আর কখনওই মরতোনা, সব দোষ এই টিকটিকির। তারা টিকটিকি দেখলেই তাই মারতে যায়। জুলুদের কেউ কেউ অবশ্য ভাবে টিকটিকির চেয়ে দোষ বেশি গিরগিটির এই অলস অপদার্থটা যদি পথে অযথা সময় নষ্ট না করে ঠিক সময়ে টিকটিকির আগে এসে অমরত্বের খবরটা দিতে পারতো তবে আর কাউকেই কোনদিন মরতে হতোনা। বান্টু গোত্রের বেচুয়ানা, বাসুটোস, বারোঙ্গাদের মধ্যেও এই কাহিনি প্রচলিত আছে। বারোঙ্গার শিশুরা তাই গিরগিটি ধরতে পারলেই তার মুখ জোর করে খুলে এক চিমটি তামাক ঠুসে দেয়। গিরগিটি তখন যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে কেবলই শরীরের রঙ পাল্টাতে থাকে। এই হলো মানুষকে অমরত্ব থেকে বঞ্চিত করবার শাস্তি।
কিভাবে যে মানুষের জীবনে মৃত্যু এলো এনিয়ে কাহিনির শেষ নেই। এই আফ্রিকারই বান্টু জাতির আকাম্বাদের একটা গল্পে পাচ্ছি সৃষ্টিকর্তা গিরগিটি আর থ্রাস পাখিকে বার্তাবাহক করে মানুষের সমাজে পাঠালেন একটা সুখবর জানিয়ে। সুখবরটা হলো মানুষ মারা গেলেও মৃত্যুর পরদিনই তারা আবার জীবন ফিরে পাবে। গিরগিটি তাই কয়েকটা মৃত মানুষের কাছে গিয়ে তাদের ডাকতে শুরু করলো। কিন্তু তার স্বরকে ডুবিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো পাখিটি বললো, কি সব আবোল তাবোল বকছো। গিরগিটি বললো যারা মৃত্যুর পথে এগিয়ে গেছে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্যই ডাকছি। এই কথায় লাশ গুলো চোখ খুলে পিট পিট করে তাকাতে লাগলো আর কান খাড়া করলো সবটা শোনার জন্য। কিন্তু সে মুহূর্তেই থ্রাস পাখিটি চেঁচিয়ে উঠলো, যারা মরে গেছে তারা মৃতই থাকবে তারা আর কখনওই জীবন ফিরে পাবেনা। এই কথায় লাশ গুলো ফের চোখ বুঁজে লাশ হয়েই পড়ে থাকলো গিরগিটির শত ডাকেও আর কেউ সাড়া দিয়ে জীবিত হয়ে উঠলোনা। হতাশ গিরগিটি দেবতার কাছে ফিরে তার ব্যর্থতার কথা জানালে দেবতা জিজ্ঞেস করলেন কেমন করে এটা হলো। গিরগিটি তখন উত্তর দিলো সে দেবতার বার্তাই বলতে শুরু করেছিলো কিন্তু পাখিটি এতো চেঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করলো যে তার বানী আর লাশ গুলো শুনতেই পায়নি। পাখিটি কিন্তু ভালো মানুষের মত জবাব দিলো গিরগিটি দৈববাণীর সবটাই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলো তাই সে শুধু তাকে শুধরে দেবার জন্যই মুখ খুলেছিলো। সরল দেবতা পাখির চালাকি ধরতে পারলোনা কিন্তু সেই থেকে মানুষের জীবনে মৃত্যু স্থায়ী হয়ে দাঁড়ালো। পাখিটা বাগড়া না দিলে মারা যাবার পরদিনই ঠিক আবার আমরা জেগে উঠতাম।
আফ্রিকার টোগোল্যান্ডের উপজাতির মধ্যে প্রচলিত আছে মানুষ একবার কুকুরকে পাঠালো দেবতার কাছে একটা আর্জি নিয়ে। আর্জিটা হলো মানুষেরা চায় মৃত্যুর পর আবার যেন সবাই বেঁচে উঠতে পারে। পথে যেতে যেতে কুকুর দেখলো একটা বাড়িতে চুলোর ওপর একটা হাঁড়ি চড়ানো হয়েছে। সে ভাবলো ভালো কিছুই নিশ্চয় রান্না হচ্ছে, তাহলে এখানে খাওয়া দাওয়া করেই যাওয়া যাক এই মনে করে সে সেখানেই বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। এদিকে ব্যাংও কিন্তু দেবতার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। তাকে কিন্তু কেউই দেবতার কাছে পাঠায়নি কোন আর্জি নিয়ে। সে নিজে নিজেই নিজের কুট বুদ্ধির বশে কুকুরের আগে দেবতার কাছে গিয়ে বলতে শুরু করলো মানুষেরা মৃত্যুর পর জীবন ফিরে পেতে চায়না, তারা চায় তারা মৃত হয়েই থাকবে। ঠিক এই সময় কুকুরও সেখানে পৌঁছে মানুষের আর্জিটা দেবতাকে জানালো। দেবতা এই দু’রকম আর্জি শুনে ভিরমি খেলেন। শেষটায় ভাবলেন ব্যাঙের আর্জিটা যেহেতু প্রথম শুনেছেন সেটাই তিনি মঞ্জুর করবেন আর করলেনও তাই। আর সেই থেকে মানুষ একবার মারা গেলে আর কিছুতেই জীবন ফিরে পায়না।
মৃত্যু নিয়ে হটেনটটদের মধ্যেও একটা গল্প আছে। সে গল্প চাঁদ আর খরগোসের গল্প। একবার চাঁদ খরগোসকে মানুষের কাছে পাঠালো এই সংবাদ দিয়ে, যেমন আমি চাঁদ মৃত্যুর পরও আবার জীবিত হয়ে ফিরে আসি মানুষও মৃত্যুর পর আবার জীবিত হয়ে উঠবে। এখন খরগোস লোকটা যে ভালো ছিলোনা তা বেশ বোঝা গেলো যখন দেবী চাঁদের আশীষবাণীটা পাল্টে সে মানুষকে জানালো যে দেবী জানিয়েছে, যেমন আমি চাঁদ মৃত্যুর পর আর জীবিত হইনা কোন মানুষই আর মৃত্যুর পর জীবন ফিরে পাবেনা। দেবীর কাছে যখন খরগোস ফিরে গেলো তখন দেবী এই শয়তানী করে উল্টো বাণী দেবার জন্য রেগে আগুন হয়ে উঠলো আর একটা লাঠি খরগোসের দিকে ছুড়ে মারলো। সেই আঘাতে খরগোসের উপরের ঠোট কেটে গেলো। সেই থেকে সব খরগোসেরই ওপরের ঠোটটা কাটা। আর খরগোসও কম যায়না সেও দেবী চাঁদের মুখ খামচে দিয়ে পালালো। সেই থেকে চাঁদের গালে আজও খরগোসের খামচে দেবার দাগ রয়েই গেছে। এখন খরগোসের কাটা ঠোঁট আর চাঁদের গালের খামচির দাগের চেয়েও বড় ক্ষতিটা কিন্তু মানুষেরই হলো মৃত্যুর পর জীবন ফিরে পাবার সম্ভাবনার পুরোটাই মাটি হয়ে গেলো।
আফ্রিকার মাসাইদের মধ্যে প্রচলিত গল্পে দেবতা নাইতেরুকপ লি-ইও নামের একজন মানুষকে ডেকে বললেন তাদের কোন সন্তান মারা গেলে লাশটা ফেলে দেবার আগে মন্ত্রের মত বলতে হবে মানুষ মারা যায় এবং আবার ফিরে আসে কিন্তু চাঁদ মৃত্যুর পর আর ফিরে আসেনা। এই মন্ত্রটা বললে সেই মৃত সন্তান আবার বেঁচে উঠবে। কিছুদিন পরই একটা শিশু মারা গেলো কিন্তু তা লি-ইওর সন্তান ছিলোনা বলেই লি-ইও মন্ত্র পড়ার সময় বললো, মানুষ মরে গেলে মৃতই থেকে যায় কিন্তু চাঁদ মৃত্যুর পর আবার ফিরে আসে। কিছুদিন পর কিন্তু লি-ইওর নিজের সন্তানই মারা গেলো। এবার লি-ইও মন্ত্র পড়তে লাগলো এই বলে যে, মানুষ মারা যায় এবং আবার ফিরে আসে কিন্তু চাঁদ মৃত্যুর পর আর ফিরে আসেনা। বোঝাই যায় নিজের সন্তান আবার জীবিত হয়ে উঠুক এইটাই তার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু দেবতা সব দেখছিলেন তাই তিনি বললেন, উঁহু এটা হবেনা অন্য মানুষের ছেলেটার বেলায় তুমি যে মন্ত্র পড়েছিলে সেটাই এখন নিয়ম হয়ে গেছে। এখন আর তোমার নিজের ছেলে জীবিত হয়ে ফিরে আসবেনা। সেই থেকে মানুষ মৃত্যুর পর আর ফিরে আসেনা কিন্তু চাঁদ ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়েও জীবন পেয়ে আবার ফিরে আসে।
ফিজির অধিবাসীদেরা বলে চন্দ্র দেবতার ইচ্ছে ছিলো মানুষ হবে তারই মত, যেমন চাঁদ ক্ষয় পেতে পেতে নিঃশেষ হয়েও আবার ফিরে আসে মানুষও মৃত্যুর পর আবার ফিরে আসবে। কিন্তু সে সময় ইঁদুরও ছিলো একজন দেবতা সে কোনক্রমেই এটা মানতে চাইলোনা। সে হেঁকে বললো মানুষও ইঁদুরের মতই মারা যাবে এবং আর ফিরে আসবেনা। তার জন্যই মানুষের আর অমর হওয়া হলোনা। অস্ট্রেলিয়ার উওটজোবালুক উপজাতির লোকেরাও বলে, অনেক আগে কোন মানুষ মারা গেলে চাঁদ তাদের ডেকে বলতো আবার উঠে দাঁড়াও। ব্যাস তারা আবার জীবন ফিরে পেতো। কিন্তু একবার এক বৃদ্ধ বলে উঠলো তারা মৃতই থাকুক। সেই দিন থেকে আর কেউই মৃত্যুর পর আর জীবন ফিরে পায়নি।
এই অস্ট্রেলিয়ারই উনমাতিয়েরা ও কাইটিস গোত্রের মধ্যে প্রচলিত আছে অনেক অনেক কাল আগে কেউ মারা গেলে লাশটা গাছের খোঁড়লে বা মাটিতে কবর দিয়ে আসার তিন দিন পরই সে আবার জীবিত হয়ে উঠতো। এমনটাই চলছিলো কিন্তু একদিন কার্লিউ টোটেমের একজন যখন দেখলো ওয়ালাবি টোটেমের লোকেরা তাদের একজনকে কবরস্থ করছে তখন সে লাথি মেরে লাশটা সাগরে ফেলে দিলো। এমনটা করায় আর কোন লাশই তিন দিন পর জীবন ফিরে পায়নি। চাঁদ যেমন ক্ষয় হতে হতে শেষ হয়ে যাবার পরও তিনদিনের মাথায় আবার ফিরে আসে এখানেও হয়তো সেই ধারণার বশেই তিন দিনের উল্লেখটা রয়েছে যদিও চাঁদের কোন উল্লেখ নেই। চাঁদের এই যে পুনরায় জীবিত হয়ে ওঠার বা জীবিত করে তোলার ক্ষমতা আছে এ বিশ্বাসটা অন্যত্রও দেখি। যেমন ক্যলিফোর্নিয়ার সান-জুয়ান-ক্যাপিস্ত্রানোর ইন্ডিয়ানরা নতুন চাঁদ উঠলেই ছেলে বুড়ো সকলে মিলে বৃত্তাকারে নাচতে শুরু করে আর গেয়ে ওঠে চাঁদ যেমন মৃত্যুর পরও জীবন পেয়ে ফিরে আসে আমরাও মৃত্যুর পর তেমনি জীবিত হয়ে উঠবো আবার। কঙ্গোর আদিবাসীরাও নতুন চাঁদ উঠলে হাঁটু গেড়ে বসে তালি দিয়ে গেয়ে ওঠে হে চাঁদ তুমি যেমন আবার নতুন হয়ে উঠলে আমাদের জীবনেও তেমনি করে নতুন প্রাণশক্তি পুরে দাও।
মেলানেসিয়ার গ্যাজেল উপদ্বীপের অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত মিথেও মৃত্যুর আবির্ভাব নিয়ে একটা কাহিনি আছে। টো-কাম্বিয়ানা মঙ্গলময় দেবতা মানব সন্তানদের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা আর তাই তিনি চান তারা অমর হয়ে উঠুক, মৃত্যু যেন তাদের জীবনে ছেদ না আনে। আর অন্য দিকে সাপ তার দু’চক্ষের বিষ, তিনি তাদের মোটেই পছন্দ করেননা। ভাই টো-করভুভুকে ডেকে একদিন বললেন সে যেন মানুষদের কাছে গিয়ে তাদের অমরত্বের গোপন সূত্র দিয়ে আসে। আর এর ফলে মানুষ প্রতি বছর তাদের চামড়ার পুরনো খোলস ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করবে আর এভাবেই তারা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। আর সাপেদের জন্য রইলো মৃত্যু যার পর আর তারা জীবন ফিরে পাবেনা। কিন্তু টো-করভুভুর অভিপ্রায় ছিলো ভিন্ন সে অমরত্বের সূত্রটা পৌঁছে দিলো সাপেদের কাছেই আর মানুষের ভাগে দিল মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যাবার নিয়তি। আর তাই সাপরা প্রতি বছর খোলস ত্যাগ করে নতুন দেহ, নতুন জীবন পায় আর এভাবেই মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে অনন্তকাল অমর হয়ে আছে, কিন্তু মানুষ হয়ে দাঁড়ালো মরনশীল এক প্রাণি।
আনাম এর অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনিটা আগের কাহিনির মতই তবে দেবতার কাছ থেকে আসা সংবাদ বাহক কোন ছল-চাতুরির আশ্রয় না নিয়েই দেবতার আদেশ হুবহু বর্ণনা করে কিন্তু দুর্ভাগ্য তার একদল সাপ কাছে পিঠেই ছিলো তারা শোনা মাত্র ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সংবাদ বাহককে হুমকি দেয় তারা তাদের বিষাক্ত ছোবলে তাকে মেরেই ফেলবে যদিনা সে দৈববাণীটি উল্টো করে ঘোষনা করে যাতে সাপ খোলস ত্যাগ করে প্রতি বছর নতুন করে জীবন পায় আর মানুষের অস্তিত্ব মৃত্যুতেই শেষ হয়ে যায়।
সুমাত্রার নিয়াসের অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত গল্পে দেখি সৃষ্টিকর্তা যখন বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করছিলেন তখন একজনকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন সৃষ্টিকর্মের একেবারে অন্তিম পর্বের কিছু সামান্য কাজ করে সৃষ্টির কাজটাকে সম্পূর্ণ রূপ দেবার জন্য। এই কাজটা করবার সময় একমাস ধরে তার উপোষ থাকার কথা কিন্তু সে বেচারা ক্ষিধের জ্বালায় কয়েকটা কলা খেয়ে ফেললো। ফল যা হবার তাই হলো, মানুষের আয়ু হয়ে দাঁড়ালো সেই কলা গাছের মত। কলা গাছে ফল আসার পরই যেমন কলা গাছ মারা যায় তেমনি নিয়তি হয়ে দাঁড়ালো মানুষের। মানুষেরও সন্তান সন্ততি জন্মের পর থেকেই সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কলা না খেয়ে ভাবার হিসেবে কাঁকড়া নির্বাচন করলে কিন্তু মানুষের এ দুর্গতি হয়না। মানুষ তখন কাঁকড়ার মতই খোলস পাল্টে পাল্টে প্রতিবার নতুন করে বেঁচে উঠতো তাকে আর মরতে হতোনা।
নিউহেব্রাইডস এর ব্যাঙ্কস দ্বীপের অধিবাসীদের বিশ্বাস একেবারে প্রথম দিকে কোন মানুষকেই মৃত্যুর মুখে পড়তে হতোনা। বয়সে বুড়িয়ে আসতে শুরু করলেই সাপের মত চামড়ার খোলসটা খুলে ফেলে মানুষ আবার নব যৌবন ফিরে পেতো, সুতরাং বৃদ্ধ হয়ে মারা যাবার কোন ব্যাপারই ছিলোনা। কিন্তু একদিন এক মহিলা তার বুড়িয়ে যাওয়া চামড়ার খোলসটা খুলে নদীতে ফেলে কম বয়সী চেহারায় বাড়িতে ফিরতেই বিপত্তি ঘটলো। দেখা গেলো তার বাচ্চাটা তাকে চিনতে না পেরে ভয়ানক কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। মহিলা কি আর করে অগত্য আবার নদীর পাড়ে গিয়ে নিজের ফেলে আসা চামড়ার খোলসটা খুঁজতে শুরু করলো। দেখা গেলো ফেলে দেওয়া খোলসটা স্রোতে ভেসে দূরে চলে যায়নি একটা কাঠিতে বেঁধে কাছেই নদীর জলের মধ্যে আটকে আছে। সে সেই খোলসটা তুলে ফের গায়ে পরে বাড়ি ফিরলো তার বাচ্চাটা এবার তাকে চিনতে পারলো। কিন্তু তার পর থেকেই মানুষ আর চাইলেই চামড়ার খোলস খুলে নতুন শরীর পাবার সুযোগ আর পেলোনা। বুড়ো হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর উপায় রইলোনা।
এ্যাডমিরালটি দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনিতেও দেখা যাচ্ছে মানুষ খোলস পাল্টে নতুন শরীর পেয়ে যেতো। এক মহিলার দুই ছেলে ছিলো। তার ছেলেরা গিয়েছিলো মাছ ধরতে আর মহিলা নদীতে গোসল করতে গিয়ে তার পুরনো বার্ধক্য জীর্ণ চামড়ার খোলসটা নদী পাড়ে ফেলে অল্প বয়সে সে যেমন রূপসী ছিলো ঠিক সেই চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরলো। তার ছেলেরা বাড়ি ফিরে কিন্তু অবাক হলো। এক ছেলে বললো একেতো আমাদের মায়ের মত লাগছে। অন্য ছেলেটা বললো মা হবে তোর এই মেয়ে হবে আমার বউ। তাদের মা যখন জিজ্ঞেস করলো তারা কি নিয়ে কথা বলছে তখন দু’জনেই ভালো মানুষের মত বললো আমরা বলছিলাম তুমিই আমাদের মা। কিন্তু মা অত সহজে ভোলবার পাত্রি নয় অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে সে জবাব দিলো তোমরা কি বলাবলি করছিলে আমি শুনেছি। আমাদের আসলে বুড়ো হয়ে মরে যাওয়াই ভালো এই বলতে বলতে সে আবার নদীর পাড়ে গিয়ে তার ফেলে দেওয়া খোলসটা পরে বৃদ্ধা হয়েই বাড়ি ফিরলো। আর সেই থেকেই খোলস পাল্টে মৃত্যুকে এড়িয়ে যাবার সুযোগটা আর মানুষের হাতে থাকলোনা।
সেন্ট্রাল সেলেব এর পোসোর অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত আছে পৃথিবীতে যখন কেবল এক মানব আর মানবী ছিলো, যারা ছিলো আমাদের প্রথম পিতামাতা। সৃষ্টিকর্তা তাদের কিছু দিতে চাইলে দড়িতে বেঁধে আকাশ থেকে তা তাদের নাগালের সীমায় নামিয়ে দিতেন। একদিন এভাবেই দড়িতে বাঁধা একটা পাথর নেমে এলো। পাথরটা দেখে বিরক্ত হয়ে তারা বললো, এই পাথর দিয়ে কি হবে আমাদের অন্য কিছু দাও। সৃষ্টিকর্তা অমনি দড়িতে বাঁধা পাথারটা তুলে নিলেন। দেখতে দেখতে পাথরটা উপরে উঠতে উঠতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই দড়িটা যখন আবার নেমে এলো তখন দেখা গেলো দড়িতে বাঁধা আছে কলা। তা দেখে প্রথম মানব-মানবী দৌড়ে গিয়ে দড়ি থেকে তা খুলে খেতে শুরু করলো। এবার আকাশ থেকে সৃষ্টিকর্তার কণ্ঠ ভেসে এলো, তোমরা যেহেতু কলা পছন্দ করেছো তোমাদের জীবন হবে কলা গাছের মতই। একবার ফল দিয়েই যেমন কলা গাছের মৃত্যু হয় তেমনি সন্তানের জন্ম দিয়ে তোমরাও মৃত্যুর কবলে পড়বে। আর তোমরা যদি পাথরটা গ্রহন করতে তবে তোমাদের আয়ু হতো পাথরটার মতই অক্ষয়, অনন্ত, অমর। কিন্তু মানব সম্প্রদায়ের পিতামাতা কলা পছন্দ করাতেই মানুষ আর অমর হতে পারলোনা।
কিভাবে জগতে বা আরো ভালো করে বলতে গেলে মানুষের জীবনে মৃত্যু দেখা দিয়েছিলো এই নিয়েই গল্প গুলো। স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজার তাঁর “অমরত্বে বিশ্বাস ও মৃতদের উপাসনা” বইটিতে এমনি আরো বহু মিথের উল্লেখ করেছেন। এই কাহিনি গুলো সেই বইয়েরই অজস্র কাহিনিরই কয়েকটা। আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতি, অস্ট্রেলিয়া আর তার আশে পাশের দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের, কখনও উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত এক গুচ্ছ মৃত্যুর জন্ম কথা নিয়েই ফ্রেজারের বইটির একটা অধ্যায় রচিত হয়েছে। গল্প গুলোর আকৃতি প্রকৃতিই বলে দেয় এগুলো লোকবিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছে। আর এই লোক বিশ্বাসের মধ্যে সেই আদিম পৃথিবীর গন্ধ। যে মানব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে নৃবিজ্ঞানীরা এই সব কাহিনি সংগ্রহ করেছিলেন তারা কিন্তু সে অর্থে আদিমকালের লোক নন। প্রায় আধুনিক যুগের প্রথম পর্বের দিকেই এই লোক গুলো বেঁচে বর্তে ছিলো। ইউরোপের জাহাজ গুলো যখন পৃথিবী পর্যটনে বেরিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলময় মহাদেশে, আমেরিকার নতুন মহাদেশে, অস্ট্রেলিয়া আর আশপাশের দ্বীপপুঞ্জগুলোয় পা রাখছিলো তখন এমন সব মানব সম্প্রদায়ের দেখা তারা পেয়েছিলো যাদের সাথে সভ্যতার কোন সংস্রবই ছিলোনা। সভ্য সমাজ থেকে তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, তার সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো এই মানব সম্প্রদায় গুলো। কেউ কেউ তখনও পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করতো, তাদের জীবিকার মূল অবলম্বনই ছিলো শিকার আর ফলমূল আহরন। কোথাও কোথাও কিছুটা কৃষি বা পশুপালন হয়তো দেখা দিয়েছে কিন্তু মোটের ওপর তাদের জীবন যাত্রার ধরনটাই ছিলো আদিম ধাঁচের। এই মানুষ গুলোকে তাদের আদিম সংস্কৃতি সহ দেখতে পাওয়াটা ছিলো খুবা ভাগ্যের কথা। ভাগ্যের কথা এজন্য যে আমরা আমাদের আদিম পূর্ব পুরুষদের সম্পর্কে যা জানি তা প্রত্নতত্ত্বের সাহায্যে উদ্ধার করা এলোমেলো, ছেঁড়াখোড়া বিভিন্ন তথ্য থেকেই। এই প্রথম আমাদের সৌভাগ্য হলো আদিম মানুষকে আমাদের এই আধুনিক কালেই সচক্ষে দেখতে পাওয়া। সে সময়ের নৃবিজ্ঞানীরাও জানতেন সভ্যতার সংস্পর্শে এই আদিম সংস্কৃতি আর আদিম থাকবেনা সুতরাং মানুষের আদিম জীবন ধারা সম্পর্কে যা তথ্য সম্ভব সমস্তটাই খুব দ্রুত সংগ্রহ করে নেওয়া চাই। স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের সংগ্রহটা এই নৃতাত্ত্বিকদের সংগ্রহেরই একটা ক্ষুদ্র অংশ।
এই গল্প গুলোর মধ্যে তাই সেই আদিম সারল্যের দেখা পাওয়া যায়। শিশুসুলভ আদিম মানুষের চিন্তাধারা থেকেই গল্প গুলোর জন্ম। আদিম পৃথিবীতে মানুষ যেমন তখনও অন্যান্য জীব-জন্তুকে নিজের চেয়ে হেয় ভাবতে শেখেনি বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের অলৌকিক শক্তির অধিকারী বলেও মেনে এসেছে সে দৃষ্টান্তও গল্প গুলোর মধ্যে ছড়িয়ে আছে। ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা যখন মানুষের কাছে দেবদূত পাঠাচ্ছেন তখন এই দেবদূতেরা প্রায়শই হচ্ছে বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ার। কোন অতিমানবিক কাল্পনিক রাক্ষস বা ফেরেস্তা নয় আশেপাশের চলে ফিরে বেড়ানো গিরগিটি, কুকুর, খরগোসই হয়েছে সৃষ্টিকর্তার পাঠানো দেবদূত। আদিম মানুষের সীমিত জ্ঞানে জগতের এটা ওটা কিভাবে এলো, কিভাবে কেন সৃষ্টি করা হয়েছিলো এনিয়ে তাদের ভাবনা থেকেই গল্প গুলোর জন্ম। তাই মূলত সাদৃশ্যের ভিত্তিতেই তারা কারণ খুঁজেছেন কেন তাদের জীবন এমন হলো। কল্পনা করেছেন হয়তোবা আরো আগে মানুষের জীবনে এতো কষ্ট পরিশ্রমের বালাই ছিলোনা কোন একটা ভুল বা বিপত্তির দরুণই সংসারে নানান সমস্যা আর ঝামেলা দেখা দিয়েছিলো। তারা এমনটাও ভেবেছে মৃত্যু জিনিসটাও হয়তো ছিলোনা কিন্তু বর্তমানে যখন মৃত্যু অবশ্যম্ভাবি চেহারায় দেখা দিচ্ছে তখন নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছিলো যার ফলেই তারা নিশ্চিন্ত অমরত্বের জীবনটা হারিয়ে বসেছে। এখন কল্পনার সাহায্যে এই কারণ গুলোকে তৈরী করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিলোনা।
আদিম এই মানুষ গুলো তাই কলা গাছের নশ্বরতার সাথে তাদের জীবনের মিল খুঁজে পেয়েছে। কলা গাছ যেমন একবার ফল দিয়েই মারা যায়, মানুষও তেমনি সন্তান সন্ততির জন্ম দিয়ে ক্রমে বুড়ো হতে শুরু করে আর শেষে মারাও যায়। অথচ নশ্বর কলা গাছ ছাড়াও এমন কিছুও ছিলো যা নশ্বর ছিলোনা। রাতের আকাশে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তারা উপলব্ধি করেছে চাঁদ ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়েও আবার আকাশে ফিরে আসে আর ফের বাড়তে শুরু করে। তাদের নিজের জীবনের নশ্বরতার বিপরীতে এই অমরত্বের প্রমাণটা তাদের চোখের সামনেই জ্বলজ্বল করছিলো। এই অমরত্বের অনুষঙ্গেই তাদের কাহিনিতে এসেছে মানুষও এমন চাঁদের মত ছিলো একসময়। চাঁদ যেমন ক্ষয়ে ক্ষয়ে একেবারে আকাশ থেকে হারিয়ে গেলেও তিন দিন পর ঠিক যেমন রাতের আকাশে আবার জন্ম নেয় আর বাড়তে শুরু করে তেমনি মানুষও মারা যাবার তিন দিন পর আবার জীবিত হয়ে উঠতো। পরবর্তী কালে কোন এক ভুল বুঝাবুঝি বা কারো শত্রুতায় এই অমরত্ব মানুষ হয়তো হারিয়ে বসেছিলো কিন্তু চাঁদের এই যে নিজেকে বারবার নবীন করে তোলার অলৌকিক ক্ষমতা এ সংক্রান্ত বিশ্বাসটা তাদের মেনে দৃঢ় ভাবে আসন গেড়ে নিয়েছিলো।
আমাদের এই আধুনিক যুগের আদিবাসীদের মধ্যেই নয় শুধু নয় এই আদিম বিশ্বাসটা যে আমাদের আদিম পূর্ব পুরুষদের মধ্যেও ছিলো তারও প্রমাণ আমাদের ইতিহাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মহাভারতে দেখি অমৃতের ভান্ডটিকে চাঁদেই রাখা হচ্ছে, আবার এই অমৃত চুরি করে খেতে এসে রাক্ষস রাহু আবার এই চাঁদের হাতেই ধরা পড়ে যাচ্ছে। চাঁদের সাথে এই যে অমরত্বের ঘনিষ্ট অনুষঙ্গ তা কিন্তু সেই আদিম বিশ্বাস থেকেই উঠে এসেছে। চাঁদের মত মৃত্যুর তিন পর আবার জীবিত হয়ে ওঠার অনুষঙ্গটিও পৃথিবীর আনাচে কানাচে অনেক মিথেই বারবারই চোখে পড়ে।
চাঁদের মতই আদিম মানুষ সাপদেরও অমর ভেবে এসেছে। সাপ যেমন খোলস ছেড়ে নতুন শরীর পেয়ে যায় তাই সাপদের কখনও বার্ধক্য গ্রস্ত হতে হয়না, মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হয়না। আর সাপ যেহেতু মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে জানে সুতরাং সাপের মধ্যে এমন কিছু অমরত্ব বিষয়ক গোপন সূত্র আছে যা মরনশীল মানুষকেও বিভিন্ন মারন রোগবালাই থেকেও মুক্তি দিতে পারে। আর এই ভাবনা থেকেই সাপ তাদের চিন্তা চেতনায় প্রাণি হিসেবে শুধু রহস্যময়ই হয়ে ওঠেনা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীও হয়ে ওঠে। সাপের মত মানুষের খোলস ছেড়ে নবীন দেহ পাবার কল্পনাও দেখি নিউহেব্রাইডস আর এ্যাডমিরালটি দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের গল্পে। এই গল্প গুলোয় কিন্তু সাপের উল্লেখ নেই শুধু খোলস বা চামড়া পাল্টানোর অনুষঙ্গটাই এসেছে। অন্য গল্প গুলোয় কিন্তু কারণ দেখানো হয়েছে কিভাবে সাপেরা এই অমরত্ব মানুষকে ফাঁকি দিয়ে নিজেরাই বাগিয়ে নিয়েছিলো তার গল্প। বোঝাই যায় নিউহেব্রাইডস আর এ্যাডমিরালটি দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের গল্পে সাপের অনুষঙ্গটি একধাপ এগিয়ে গিয়েছে। সাপের অমরত্ব সম্পর্কে বিশ্বাসটি এই গল্প দুইটির পেছনেও প্রচ্ছন্ন ভাবে বর্তমান ছিলো।
আমাদের আদিম পূর্ব পুরুষদের চেতনাতেও যে সাপের অমরত্ব নিয়ে এধেরনেরই বিশ্বাস ছিলো এবং তা প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত হয়েছিলো লিখিত ইতিহাসের সময় কাল পর্যন্ত তার যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক দৃষ্টান্ত প্রচুর। মহাভারতের প্রসঙ্গেই আবার ফিরে আসি কেননা এখানেও আমরা পাচ্ছি গরুড় সাপেদের জন্যই অমৃত চুরি করে আনছে। আবার গ্রিক দেবতা হার্মিস, রোমানদের কাছে যে হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মার্কিউরি তার ছিলো একটা ডানাওয়ালা যাদুদণ্ড যাতে এক জোড়া সাপ পেঁচিয়ে থাকে। এই হার্মিসকেই দেখি পাঠানো হয়েছে মৃত্যুর রাজ্যে কাউকে উদ্ধার করে আনতে, আবার গ্রিক বীর ইউলিসিসকে গাছগাছড়ার ভেষজ ওষুধ পৌঁছে দিতে দেখি যার সাহায্যে ইউলিসিস সার্সির যাদুকেও প্রতিহত করতে পেরেছিলো। গ্রিক মিথে এস্কুলাপিয়াসকে বলা হয় এ্যাপোলোর পুত্র আর তিনি ছিলেন এক অসাধারণ চিকিৎসক। কেউ কেউ মনে করেন মিথের চরিত্র হলেও হয়তো এক সময় এই নামে সত্যিই একজন মরণশীল মানুষ ছিলো ইতিহাসে। মিথে আছে একবার এক সাপকে সুস্থ করে তুলেছিলেন এস্কুলাপিয়াস আর সাপও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রহস্যময় গুপ্ত জ্ঞান দান করেছিলো তাকে। আর এই ক্ষমতার দরুণই এস্কুলাপিয়াস নাকি মৃত মানুষকেও জীবিত করে তুলতে পারতেন। এই চিকিৎসকের মূর্তিতে তাই দেখি তার সঙ্গের লাঠির সাথেই একটা সাপ সব সময় পেঁচিয়ে আছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতীক হিসেবে এই জন্যই এস্কুলাপিয়াস আর হার্মিস দু’জনের যাদুদণ্ডই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এস্কুলাপিয়াসের আগেও সুমেরীয়, মিশরীয়,মিনোয়ান সভ্যতাতেও সাপের এই অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস প্রচলিত ছিলো। আর এই বিশ্বাস প্রায়শই মানুষের লৌকিক ও অলৌকিক রোগ বালাইয়ের চিকিৎসায় বারবারই প্রয়োগ করা হয়েছে। মুসা নবীর ব্রোঞ্জের সাপের ধারণাটির পেছনেও এরকম বিশ্বাস সক্রিয় থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না। আমার মনে হয় বিশ্বের বিভিন্ন মিথকথায় খুঁজলে সাপ সংক্রান্ত উপাদান প্রচুর পাওয়া যাবে এবং তার বিশাল অংশই কোন না কোন ভাবে অমরত্বের অনুষঙ্গেই উপস্থাপিত হয়েছে।
সাপ নিয়ে এই জটিল রহস্যময় মিথ কথার কচকচির মূলে কিন্তু ছিলো সাপের খোলস ছেড়ে নতুন দেহ পাবার ঘটনার প্রেক্ষিতে সাপকে অমর ভেবে নেওয়ার একটা ভুল বিশ্বাস। আর এই ভুল বিশ্বাসটার জন্ম আদিম যুগে, আদিম মানুষের মনে। আদিম একটা বিশ্বাস কিভাবে যুগ পরম্পরায় রূপ পাল্টাতে পাল্টাতে আধুনিক যুগ অবধি এসে পৌঁছায় এটাই একটা চমৎকৃত হবার মত বিষয়। আমাদের এখনকার ধর্মীয় অনেক অলৌকিক বিশ্বাসের জড় তাই খুঁজে পাওয়া যায় আদিম সংস্কৃতির নানান উপাদানের মধ্যে। নৃবিজ্ঞানের গবেষনায় এ জন্যই পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর মানুষের বিভিন্ন প্রথা, অনুষ্ঠান, বিশ্বাস সহ তাদের আদিম সাংস্কৃতিক চরিত্রটার আলোচনা এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সাহায্য নেওয়া হয়েছে যে বই থেকে :
THE BELIEF IN IMMORTALITY AND THE WORSHIP OF THE DEAD : J. G. Frazer. MACMILIAN AND CO LIMITED 1913
মন্তব্য
এটা পড়তে গিয়ে অট্টহাসি দিলেম এবং ভাবলেম এই বুদ্ধি নিয়ে কেম্নে দেবতা হইল বাপ!
*
'জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে' জানবার পরও মানুষ যেভাবে মারামারি, কাটাকাটি, চুলাচুলি করে অমরত্ব পেলে কী হতো ভাবেন!
*
সচলের লেখককূলের আয়ুও মনে হচ্ছে কলাগাছের অবস্হায় চলে যায় এক সময়ে। এমন জমজমাট সচলের এই ঝিমধরা অবস্হা কেম্নে কাটানো যায় বলেন তো? সেভাবে একটা 'লাড়া' দেয়া গেলে ভালু হতো। হায়! আমাদের কেনু কোনো দেবতা নাই যার কাছে 'একখানা লাড়া দেন্' যেন ঝিমধরা সচলেরা পিলপিল করে এমুখো হন বলে আর্জি পেশ করা যেতো।
*
বিশাল লেখা হলেও পড়ে মজা পেয়েছি। আরো লিখুন ভায়া।
কাটা কলাগাছের কারণে রাস্তা হারাইবার ইতিহাস কিন্তুক আছে;
শাজলালের আক্রমণে রাজা গৌড় গোবিন্দ পলাইবার সময় তার লোকজনরে বলে গেছিল- আমি যেদিকে যাব বনকলা গাছ কেটে কেটে যাব। পরে সেই কাটা কলা গাছ দেখে তোমরা এসে আমার সাথে মিলিত হবে
তো লোকজন ভাবলো নিজের মাইর নিজে খাইয়া রাজা ভাগছে; আমরা একটু গোছাইয়া তারপর যাই; আমাদের তো আর এখন মারতে আসবে না...
তো তারা ফল ফসল গরু বাছুর সামলায়া গদাই লস্করি চালে বনে ঢুকে দেখে অত দিনে আবার পাতা বের হয়ে কলা গাছের কাটা দাগ নিশ্চহ্ন হয়ে গেছে...
এখন তারা না পারে পিছনে ফিরতে শাজলালের ডরে; না পারে গিয়ে নিজের রাজার সাথে মিলতে
অবশেষে তারা বনেই থেকে গেলো; এবং তারা হলো পাত্র আদিবাসী
বাহ্ দারুণ একটা ইতিহাস জানলাম।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অজানা দারুণ ইতিহাস জানলেম।
লেখাটা পড়বার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
পড়ে আনন্দ পেয়েছেন জেনে ভালো লাগলো, মন্তব্যের জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
'জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ' এই তিন চিন্তা দেখছি মানুষকে কতভাবেই না আলোড়িত করেছে। লেখাটিতে একই বিষয়ে বহুচিন্তা সংকলিত করবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
লেখাটা পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
মানুষ আর দেবতার মাঝে প্রধান বার্তাবাহক তাইলে পশুপাখিই?
একেবারে আদি কালে হয়তো পশুপাখিই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলো। দেবতা মানুষ হয়ে ওঠার আর দেবতার জন্মের সাথে মনে হয় সমাজের ধাঁচটাই পাল্টে যাবার একটা ব্যাপার আছে। যে পর্বে এই কাহিনি গুলোর জন্ম তখনও মনে হয় পশু-পাখি অন্তত কথা বলার ক্ষমতা একেবারে হারিয়ে বসেনি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
বিষয়টা মজার। উপস্থাপনাও খুব ভালো। আপনার ব্লগের উপকথাগুলির উসিলায় একটা পুরান জ্ঞান আবার নতুন বোতলে লাভ করলাম, "নিজের কাজ নিজেরেই করতে হয়। অন্যেরে করতে দিলেই ক্যাঁচাল"। নিজের আবদার ভগবানের কাছে সাপ,ব্যাঙ, শিয়াল মারফত না পাঠায়া নিজেই ভগবানের দরবারের দিকে হাঁটা দিলে এত ঝামেলা মনে হয় বাধতো না। তবে একটা কথা, জন্ম-মৃত্যু একবারই দিয়া কিন্তু আল্লাহ বাঁচাইসে। এক জনমের যন্ত্রনাতেই অস্থির। বারবার জন্মমৃত্যুর চক্করে পরলে মনে হয় তৃতীয় বা চতুর্থবারের বারের বার পিস্তল হাতে নিয়া মরতাম। নতুন কইরা জন্মের সাথে সাথেই নিজে নিজেই যাতে সুইসাইড খাইতে পারি।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী
লেখাটা পড়ার জন্য আর মন্তব্যের জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
মৃত্যু নিয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী গোত্রগুলোর কোন মিথ নেই, কিন্তু মৃত্যু নিয়ে তাঁদের ভাবনাটা বেশ প্রণিধানযোগ্য, কারন তাঁরা প্রায় ত্রিশ হাজার বছর ধরে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছিল। তাঁরা মনে করে মৃত্যুর মাধ্যমে একজন মানুষ একটি অশুভ সত্ত্বায় পরিণত হয় এবং এই অশুভ সত্ত্বা মৃত মানুষদের মাংশ খেয়ে বেঁচে থাকে। মানুষের জরা-ব্যাধি আপদ বিপদ দুর্যোগ, এসবের জন্য এইসব অশুভ সত্ত্বাই দায়ী। মানুষ কোন কারনে মূর্ছা গেলে তাঁরা সেই মানুষটির মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করে, তবে পরবর্তীতে তার জ্ঞান ফিরে এলে ভাবে মানুষটি মৃত্যুর অশুভ জগত থেকে ফিরে এসেছে। এরকম মানুষ কিছু অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা লাভ করে বলে তাঁরা মনে করে, সুতরাং এঁরা সমাজে ওঝা, গুণীন, এই জাতীয় দায়িত্ব পালনের অধিকার লাভ করে।
মৃত্যু নিয়ে এই আদিম ভাবনা গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই তথ্য গুলোই পরবর্তীতে বিকাশ পেয়ে রং চং পেয়ে যে রূপে দাঁড়িয়ে গেছে তা দেখলে কেউ বলবেনা এগুলো আদিম ভাবনা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অনেক দেরিতে এই লেখাটি পড়লাম। একবার বিটিভিতে একটি নাটক প্রচারিত হয়েছিলো। প্রাচীন এক সম্প্রদায়ের মৃত্যু চিন্তা নিয়ে গড়ে উঠা এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রওশন জামিল। চরিত্রটি একজন অতিবৃদ্ধ মাতামহের। তাঁর পরিবারে দারুণ একটি সংকট চলছে, প্রথা অনুযায়ী তাঁকে যেতে হবে পাহাড়ে, সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু। কিন্তু তিনি যেতে চাইছেন না। নাটকের নাম ভুলে গিয়েছি, ভুলে গিয়েছি গল্পটাই। কেবল মনে আছে, স্টুডিয়োর ভেতরেই পাহাড় আর জঙ্গলের অপূর্ব একটি সেট তৈরি করেছিলেন শিল্প নির্দেশক। সেই সেটে সেই অতিবৃদ্ধাকে পাঁজাকোলা করে ছুটোছুটি করছে একজন তরুণ, সম্ভবত আফজাল। দুর্দান্ত একটি মুহূর্ত, আর ভুলে যাওয়া কিছু সংলাপ।
সব কিছু হারিয়ে গিয়েছে, মৃত্যুর মতোই। আরেকবার যদি দেখতে পেতাম! নিদেন পক্ষে যদি সুযোগ হতো চিত্রনাট্যটি পড়বার!
তথ্যবহুল একটি লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ সোহেল ইমাম।
---মোখলেস হোসেন।
সেই সাদা কালো যুগের টেলিভিশনে সম্ভবত নাটকটা হয়ে ছিলো। রওশন জামিলের কথা মনে আছে। এই নাটকটা সম্পর্কে বানপ্রস্থ শব্দটার কোন সম্পর্ক আছে কি? এই নাটকের দৃশ্য মনে পড়লে ঐ শব্দটাই মনে আসে। নাটকটার কি নাম আমারও মনে আসছেনা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন