শুধু স্বপ্নই নয় আদিবাসীরা বিশ্বাস করে মানুষের দেহের অতিরিক্ত আত্মা বলে যে আরেকটা পদার্থ আছে তার প্রমাণ মাটিতে পড়া মানুষের ছায়া আর জলে প্রতিবিম্বিত হওয়া তার প্রতিফলন। এখন এই ছায়াশরীর হলেও আদিবাসীদের বিশ্বাস মৃতের আত্মাও ক্ষুধা-তৃষ্ণা থেকে একেবারে মুক্ত নয়। অস্ট্রেলিয়ার দিয়েরি ট্রাইবের মানুষেরা মৃতের কবরের ওপরে খাবার রেখে আসে। মৃতব্যক্তি ক্ষুধার্ত হলে যেন খাবারটা কাছেই পায় সে কারণেই এই ব্যবস্থা। শুধু খাবারই নয় সময়টা শীতকাল হলে একটা অগ্নিকুন্ডও জ্বালিয়ে রাখা হয় কবরের পাশেই যাতে কবর থেকে মৃতের আত্মা বেরিয়ে এলে ঠান্ডায় কষ্ট না পায়। কবরের আশেপাশে পায়ের ছাপ কিংবা কোন ধরণের পরিবর্তনের চিহ্ন দেখতে পেলে দিয়েরিরা ভাবে মৃতের আত্মা অস্থির হয়ে আছে কোন কারণে এবং তখন মৃতের দেহাবশেষ সেই কবর থেকে তুলে অন্যত্র কবরস্থ করা হয়। এই ট্রাইবেরই আরেকটা শাখার লোকেরা আবার মৃতদেহ কবরস্থ করার সময় দু’পায়ের বুড়ো আঙুল আর দুই হাতের বুড়ো আঙুল একসাথে বেঁধে দেয় যাতে মৃতের আত্মা কবর থেকে উঠে অনর্থক বাইরে ঘোরাঘুরি না করতে পারে। কুকাটা ট্রাইব ও মারানোয়া নদীর পার্শ্ববর্তী আদিবাসীরাও মৃতের আত্মার তৃষ্ণার কথা ভেবেই কবরের ওপরই জলপূর্ণ পাত্র রেখে আসে। অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম ভিক্টোরিয়ার আদিবাসিরা এবং উইমবাইও ট্রাইবের লোকেরাও কবরের ওপর বা পাশেই অগ্নিকুন্ডের ব্যবস্থা রাখে যাতে শীতে মৃতের আত্মার কষ্ট না হয় (ফ্রেজার-ক: ১৪৪-৪৫)।
অস্ট্রেলিয়ায় পশ্চিম ভিক্টোরিয়ার আদিবাসীরাও পাথরের কুড়াল জাতীয় দু’একটা অতি প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান হাতিয়ার ছাড়া মৃতের ব্যবহারকৃত সব কিছুই মৃতের সাথেই কবরে রেখে দেয়। উরুনজেরি ট্রাইবের আদিবাসীরা মৃতের ব্যক্তিগত সম্পত্তি কবরের মধ্যে দেবার পাশাপাশিই মৃতের বর্শা ও গদা, মেয়ে হলে মাটি খোঁড়ার ছোট এক ধরণের লাঠি কবরের পাশেই মাটিতে গেঁথে রাখে। এটা এভাবে রাখা হয় যাতে মৃত আত্মা নিজেই নিজের শিকার সংগ্রহ করে নিতে পারে এজন্য। মেয়েরা তাদের মাটি খোঁড়ার ছোটলাঠি দিয়ে কচু ও বিভিন্ন মূল-কন্দ খুঁড়ে তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রয়োজনে, তাই মেয়েদের কবরের পাশে সেই ব্যবহার করা ছোট লাঠিটিই গেঁথে রাখা হয় । এই যে অস্ত্র কবরের পাশে গেঁথে রাখাটা যে শ্রেফ নাম ফলক হিসেবে ব্যহারের জন্য তা নয় আমরা বুঝতে পারি যখন কোন বদরাগী লোকের কবরের পাশে ইচ্ছে করেই তার অস্ত্র-শস্ত্র এভাবে গেঁথে রাখা হয়না। কেননা বিশ্বাস করা হয় বদরাগী আত্মাটা অস্ত্র পেলে আরো ভয়ঙ্কর কোন ক্ষতি করে বসতে পারে। টারবাল ট্রাইবের মানুষেরা মাটিতে মৃতদেহ কবর না দিয়ে লাশটা গাছের মোটা শাখার ওপরই রেখে দেয়। তারাও সেই গাছের নিচেই মৃতের অস্ত্র-শস্ত্র সেই একই প্রয়োজনের কথা ভেবেই রেখে দেয় (ফ্রেজার-ক: ১৪৬)।
মৃত্যুর পরও যে আত্মাকে খাবার খেতে হয় এ বিশ্বাসের সাথে সাথেই আরেকটা সমস্যা আদিবাসীদের শঙ্কিত করে তুলতো। তারা ভাবতো এই খাবারের লোভেই মৃতের আত্মাটা আবার যেন মৃত্যুর জগত থেকে ফিরে না আসে। মৃতের আত্মার বিশ্বাসের সাথেই জড়িয়ে ছিলো মৃতের আত্মা সম্পর্কে একটা প্রচণ্ড রকম ভীতি। হয়তো সব আদিবাসী সম্প্রদায়ে নয় তবে বেশির ভাগ সম্প্রদায়েই মৃতের আত্মাকে প্রচণ্ড ভয়ের চোখেই দেখা হতো। এই ভয়ের নেহাৎ মনোবৈজ্ঞানিক কারণ ছাড়াও আরো কিছু বাস্তব করাণও ছিলো।
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার নারিনিয়েরি ট্রাইবের লোকেরা মৃতের বিদেহী আত্মাকে ভীতির চোখে দেখে। তাদের বিশ্বাস এই বিদেহী আত্মারা যে কোন জীবিত মানুষেরই ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। জীবিতকালে হিংসাপরায়ণ, রুক্ষ স্বভাবের মানুষ গুলোর মৃত্যুর পর তাদের বিদেহী আত্মাকে আরো বেশি ভয়ের চোখে দেখা হয়। রাতের বেলায় শিস বাজাতে নিষেধ করা হয় কেননা এই শিস শুনে কোন বিদেহী আত্মা ভাবতে পারে তাকে আহ্বান করা হচ্ছে। অসুখ-বিসুখ সৃষ্টি করা তো আছেই, এছাড়াও এদের বিশ্বাস অনেক সময় ঘুমন্ত সুস্থ সবল মানুষকে পর্যন্ত এই আত্মারা ঘুমের মধ্যেই মেরে রেখে চলে যায়। এরা এতোভাবে মানুষের ক্ষতি করে তা বলে শেষ করা যাবেনা। প্রতিহিংসা বশত কুড়ে ঘরে আগুন লাগিয়ে সমস্ত ধ্বংস করে ফেলবার দৃষ্টান্তও নাকি আছে। ঝগড়া বিবাদের সময় বাদি-বিবাদি পক্ষকে শান্ত করার জন্য আশেপাশের সবাই তাদের ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতে বলে কেননা এই গোলমালের শব্দে বিদেহী আত্মারা বিরক্ত হলে বিনা কারণে অনেক মানুষের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। তাই নারিনিয়েরিরা বিদেহী আত্মাদের কোনক্রমেই চটাতে চায়না। মৃত্যুর পর থেকে মৃতদেহ পচে হাড় থেকে মাংস বিলীন না হওয়া পর্যন্ত পারতপক্ষে মৃতের নাম তারা উচ্চারণ করতে চায়না। বলা হয় নাম উচ্চারিত হতে শুনে মৃতের মনে হতেই পারে কেউ তাকে ডাকছে (ফ্রেজার-ক: ১৩৪-১৩৫)।
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সঙ্গে নৃতত্ত্ববিদ স্পেন্সার বল্ডউইন
নিউহেব্রাইডস ও সেন্ট্রাল মেলানেশিয়ার আদিবাসীদের বিশ্বাস মৃত মানুষের আত্মা বা ভুতরাই বিভিন্ন রোগ-বালাই বা অসুস্থতার জন্য দায়ী। অনেক সময় এর জন্য ওঝা বা শামানদেরও দায়ী করা হয় তবে মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মারা অনেক সময়ই পরিবারের জীবিত সদস্যদের অসুখ দিয়ে শাস্তি প্রদান করতে চায় বলে তাদের বিশ্বাস। বিশেষ করে সামাজিক প্রচলিত প্রথা বা আইন কানুনের শিথিলতার জন্য অথবা বিশেষ রীতি-নীতি অবহেলা করার জন্য মৃত আত্মারা জীবিতদের অসুস্থতা দিয়ে শায়েস্তা করতে চায়। অনেক সময় বিনা কারণেও এই বিদেহী আত্মারা রোগবালাইয়ের সৃষ্টি করে। এদের ধারণা শ্রেফ মৃত্যু হয়েছে বলেই অনেক আত্মা জীবিতদের প্রতি প্রতিহিংসা অনুভব করে আর তাই তাদের অশান্তিতে রাখতে চায় (ফ্রেজার-ক: ৫৪-৫৫)।
নিউগিনির দক্ষিণ-পূর্বাংশের আদিবাসীরা মৃত স্বজনদের আত্মাকে এতোখানিই ভয় করে চলে যে কারো মৃত্যুর পর তার নাম উচ্চারণ করতেই আতঙ্ক বোধ করে। নামের উচ্চারণই যে বিদেহী আত্মাকে আবার আহ্বান করে আনবে এই বিশ্বাসটা তাদের প্রবল। একারণে কোন পরিচিত পাখির নামে কারো নাম যদি হয় আর সে মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেই নাম যাতে আর উচ্চারণ করতে না হয় সেজন্য পাখিটার নামও পাল্টে দেয়। এই ভয়টা আরো প্রকটভাবে ধরা পড়ে যখন তারা যে বাড়িতে কারো মৃত্যু হয়েছে সেই বাড়িটাই হয় পরিত্যাক্ত ঘোষনা করে অথবা ভেঙ্গে ফেলে। এটা করা হয় যাতে দেহহীন আত্মা ঐ বাড়ির টানে আবার ফিরে না আসে। টিউবটিউব ও ওয়াগাওয়াগাতে এই প্রথা পালিত হতো (ফ্রেজার-ক: ২১০)।
ব্রিটিশ নিউগিনির এ্যারোমা জেলার আদিবাসীদের ধারণা অসুখ-বিসুখ, দুর্ভিক্ষ, কৃষিতে বিপর্যয়, মাছ বা শিকার দুস্প্রাপ্য হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করে বিদেহী আত্মাদের রোষ। এই আদিবাসীদের প্রত্যেক পরিবারের পুর্বপুরুষের বিদেহী আত্মাকে তাই তাদের তোয়াজ করে চলতে হয়। প্রতিটি বড় কাজেই এই আত্মাদের স্মরণ করা এবং তাদের কিছু উৎসর্গ করা ছাড়া কাজ আরম্ভের কথা এরা ভাবতেই পারেনা। কেননা তারা জানে এই আত্মারা রুষ্ট হলে অসুখ বিসুখ যেমন দেখা দেবে তেমনি জীবিকার ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি হবে। কেউ একটা বাড়ি তৈরী করার আগে কিছু ফল তাদের মৃত পূর্বপুরুষের নামে উৎসর্গ করে যাতে ভালোই ভালোই বাড়িটা তৈরী হয়ে যায় আর সে বাড়িতে বসবাস কালে যেন খাদ্যের অভাব না হয়। কৃষিকাজের শুরুতেও এমনিভাবেই আত্মাদের স্মরণ করা হয়। দৈনন্দিন দৈবদুর্বিপাকের প্রায় সমস্তটাই তারা এই সব আত্মার কারসাজি বলেই মনে করে (ফ্রেজার-ক: ২০১)।
এহেন আত্মারা যাতে জীবিতের লোকালয়ে এসে অনর্থক ঝামেলা না করে তার জন্য আদিবাসীদের চেষ্টার শেষ নেই। বিশেষত সদ্য মৃতের আত্মা একটা ঘোর লাগা অবস্থার মধ্যে থাকে। সম্ভবত এক জগত থেকে আরেক জগতে ভ্রমণের ধকলের কারণেই। আর তাই এই আত্মা গুলো উপলব্ধিই করতে পারেনা তারা মারা গেছে। আদিবাসীরা মনে করে বাড়িতে যখন রান্না হয় তখন যেমন সেই সুঘ্রাণে বাড়ির মানুষটা তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকে পড়ে সে খাবার খেতে তেমনি সদ্য মৃতের আত্মাও এই খাবারের লোভেই মৃত্যুর জগত থেকে ফিরে আসতে পারে। আর এটা ঠেকানোর জন্যই বিশেষ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়। তার মধ্যে একটা হলো বাড়িতে অন্তত মৃত্যুর দিনটিতে চুলো না জ্বালানো। ব্রিটিশ নিউগিনির মাফুলুদের মধ্যে দেখা যায় স্বামী মারা গেলে স্বামীর পছন্দের খাবার অনেকদিন যাবত স্ত্রী রান্না করেনা এবং খায়ওনা। স্ত্রী মারা গেলে স্বামীও স্ত্রীর প্রিয় খাবার গুলো খাওয়া থেকে অনেকদিন বিরত থাকে। মৃত আত্মা যেন প্রিয় খাবারের টানে নিজের প্রাক্তন আবাসে ফিরে না আসে সেজন্যই এই সতর্কতা। মাফুলুদের বিশ্বাস মৃত্যুতে দেহ পরিত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে বিদেহী আত্মা প্রচণ্ড বিদ্বেষ পূর্ণ ভুতে পরিনত হয় (ফ্রেজার-ক: ১৯৮)। আবার ব্রিটিশ নিউগিনির বার্টোলবের আদিবাসীরা মৃতের সাথে কবরে তার ব্যবহার করা জিনিসপত্র যেমন দিয়ে দেয় তেমনি মৃত্যুর আগে যে খাদ্যগুলো সে খেতো বা খাচ্ছিলো সেসবও মৃতদেহের সাথে দিয়ে দেয়। কিন্তু মৃতের স্ত্রীর জন্য আবার সেই নির্দিষ্ট খাদ্য গুলো গ্রহণ নিষিদ্ধ। অন্তত পুরো অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী সেই সব খাবার কিছুতেই খেতে পারবেনা (ফ্রেজার-ক: ২০৮)। এই খাদ্য সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাই আমাদের সময় পর্যন্ত চলে এসেছে। মরার বাড়িতে চুলো কেন ধরানো হয়না তার একটা হদিস হয়তো এখানেই পাওয়া যায়।
যাদুবিদ্যা আর তুকতাকে আদিবাসীদের বিশ্বাস অপরিসীম। আমরা এখন যেমন সব কিছুতেই বিজ্ঞানের ওপর ভরসা করি, বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চাই তেমনি আদিবাসীদের আদিম মানসিকতায় সেই জায়গাটা জুড়ে ছিলো যাদুবিশ্বাস। তাদের সীমিত জ্ঞানে যা কিছুই অব্যাখ্যাত থেকে যেতো তাকেই বিশ্বাস করা হতো যাদুবিদ্যা বা মন্ত্র-তন্ত্রের ফল হিসেবে। বিভিন্ন বাস্তব দুর্বিপাক, অসুখ বিসুখ সমস্তই একটা অলৌকিক প্রক্রিয়ার অংশ বলেই ধারণা করতো তারা। অস্ট্রেলিয়ার কুরনাই আদিবাসীদের মধ্যেও যাদুশক্তিতে বিশ্বাস এবং মন্ত্র-তন্ত্র দিয়ে যে দূর থেকেই মানুষের ক্ষতি করা যায় এ ধারণাটা প্রবল। রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিসের ব্যথায় কাতর এক আদিবাসীর ধারণা মাটিতে তার ফেলে আসা পায়ের ছাপের ওপর তার কোন শত্রু একটা ভাঙ্গা বোতলের ধারালো অংশটা মন্ত্র পড়ে গেঁথে দিয়েছে আর সে কারণেই তার পায়ে ব্যথা (ফ্রেজার-ক: ৪৫)।
প্যারাগুয়ের হর্স ইন্ডিয়ানদের একটা বিলুপ্ত শাখা এ্যাবিপোনিরা বিশ্বাস করে স্প্যানিয়ার্ডদের বন্দুক ছাড়া আর সব মৃত্যুর জন্যই দায়ী যাদুবিশ্বাস। মৃত্যু সাপের ছোবলে হোক, কিংবা দুর্ঘটনায় হাড়গোড় ভেঙ্গে এরা বিশ্বাস করে কেউ মন্ত্র যাদুবিশ্বাস সংক্রান্ত তুকতাক করেই এই হত্যাকাণ্ডটা ঘটিয়েছে। এমনকি বয়স জনিত কারণে অথর্ব হয়ে মৃত্যু হলেও এরা মনে করে কেউ না কেউ ষড়যন্ত্র করে ওঝা বা শামানের সাহায্যে এই মৃত্যুটা সম্ভব করে তুলেছে। ঘোড়া নিয়ে দু’জন এ্যাবিপোনি ইন্ডিয়ানের মধ্যে ঝগড়ার সময় আরেকজন তাদের শান্ত করতে গিয়ে তাদের বর্শার ফলায় দুর্ঘটনাবশত আহত হয়ে শেষে মারা গেলে তারা ধারণা করে নিশ্চয়ই কেউ তাকে মন্ত্রপড়ে তুকতাক করে হত্যা করেছে। খুঁজে খুঁজে তারা বের করে কিছু দিন আগে মৃত লোকটির কাছে এক বৃদ্ধা তরমুজ চেয়ে না পেয়েই প্রতিহিংসা বশত যাদুবিশ্বাসের সাহায্যে লোকটিকে মেরে ফেলেছে (ফ্রেজার-ক: ৩৪)।
চিলির অরোকেনিয়ানরাও প্রতিটি মৃত্যুকেই মনে করে যাদুবিশ্বাসে সংঘটিত। বয়সজনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাতেও তারা তাদের শামানকে দায়িত্ব দেয় কে মন্ত্রের সাহায্যে এই জঘন্য কাজটা করেছে তাকে খুঁজে বের করতে। এবং খুঁজে পাওয়া মাত্র মৃতের স্বজনরা ঝাপিয়ে পড়ে এই হত্যার (?) প্রতিশোধ নিতে (ফ্রেজার-ক: ৩৫)। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার নারিনিয়েরি ট্রাইবের লোকেরাও বিশ্বাস করে প্রায় মৃত্যুই ঘটে কোন না কোন শামানের যাদুশক্তির প্রয়োগেই। মৃত্যুর প্রথম রাতেই তাই মৃতের একজন পুরুষ আত্মীয় মৃতের পেটের ওপর মাথা রেখে শোয় যেন স্বপ্নের মাধমে মৃত আত্মা তার হত্যাকারী শামান বা ওঝার চেহারাটা তাকে দেখিয়ে দিতে পারে আর সে অনুযায়ী মৃতের আত্মীয়রা সেই শামানকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে পারে (ফ্রেজার-ক: ১৩৬)। ব্রিটিশ গায়ানার এ্যারাওয়াকদের মধ্যেও দেখা যায় তারা প্রায় মৃত্যুকেই যাদুবিশ্বাসের ফল বলে মনে করে। মৃত্যুর পর তাই শুরু হয়ে যায় সেই হত্যাকারী শামানের অনুসন্ধান যে কিনা মন্ত্র ও যাদু শক্তির বলে এই কান্ডটা ঘটিয়েছে। প্রায় সন্দেহ করা হয় কাছাকাছির কোন ভিন্ন ট্রাইবের শামানই এর জন্য দায়ী। এই অনুসন্ধানের জন্য বিচিত্র কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কারো মৃত্যুর পর পরই একটা পানির পাত্রে কিছু গাছের পাতা দিয়ে জ্বলন্ত চুলোয় চড়িয়ে দেওয়া হয়। পাতা সহ ফুটন্ত পানি বলক দিয়ে উপচে পাত্রের যে ধার দিয়ে প্রথম গড়িয়ে পড়ে ধারণা করা হয় সেই দিকটাতে অবস্থানরত ট্রাইবের কোন শামানই কাজটা করেছে (ফ্রেজার-ক: ৩৭-৩৮)।
মৃতদেহকে শেষ গোসল দেবার সময় আমরা পানি গরম করার সময় যে বড়ই গাছের কয়েকটা পাতাও সেই পানিতে ছেড়ে দিই সেটা কি এই ধরণেরই কোন আচারের অন্ধ অনুসরণের ফলে? মৃতের হত্যাকারী অনুসন্ধানে এই প্রক্রিয়াটা অনেক আদিবাসি সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত। এক এক সম্প্রদায় এক এক ধরণের গাছের পাতা, শেকড় বাকড় পানিতে দিয়ে সেদ্ধ করে। কোন কোন আদিবাসীরা আবার মৃতের হাতের ও পায়ের কয়েকটা আঙুল কেটেও এই ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দিতো। পানি ফুটে উঠে উপচে পড়ার সময় পাত্রের ঠিক যেদিক দিয়ে এই কাটা আঙুলের একটা বেরিয়ে পড়ে সেদিকেই হত্যাকারীর বাস বলে ধারণা করে ফেলা হয়।
এই হত্যাকারীর অনুসন্ধান করাটাও আদিবাসীদের জন্য খুব জরুরী ব্যাপার। কেননা হত্যাকারীকে হত্যা করা বা প্রতিশোধ না নেওয়া হলে মৃতের আত্মা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। আর রোষ বশে আত্মা কি ক্ষতিকর সব দুর্বিপাক নিয়ে আসে তা আমরা আগেই দেখেছি। প্রতিটি মৃত্যুর পর পরই তাই খুঁজে বের করতে হয় কে হত্যাকারী আর তাকে হত্যা করা বা কোন রকম শাস্তি দেওয়া ছাড়া মৃতের আত্মাকে শান্ত করা যাবেনা। অনেক সময় মৃতের আত্মীয়রা দায়সারা গোছের একটা আক্রমন চালায় হত্যাকারী বা তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এবং কিছুক্ষণ বর্শা ছোড়াছুড়ি করে ভাবে এতেই মৃতের আত্মা যথেষ্ট শান্তনা পাবে। এসব আক্রমনে কাউকেই খুব মারাত্মকভাবে জখম করা হয়না। কোন কোন ক্ষেত্রে কেবল ঝগড়া-ঝাটি বা গালিগালাজ করাটাই যথেষ্ট বলে মনে করা হয়।
(চলবে)
তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থাবলি:
ফ্রেজার-ক : The Belief in Immortality and the Worship of the Dead : J. G. Frazer
The Gifford Lectures, St Andrews (1911-1912)
Macmillan & Co., Limited, St Martin’s Street, London, 1913
মন্তব্য
পরিশ্রম করে চমৎকার একটি বিষয় তুলে ধরেছেন, ধন্যবাদ!
ধৈর্য নিয়ে পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ আব্দুল্লাহ ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আমাদের কাছে যা কুসংস্কার/আষাঢ়ে বিষয়, উল্লেখিত ট্রাইবদের কাছে সেগুলোই অন্ধভাবে বিশ্বাসের বিষয়। মৃত বদরাগী মানুষ যদি কবর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে চায় সেজন্য শাবল, কোদাল এগুলো থাকে, নাকি নিরাপত্তার কথা ভেবে সেগুলোও সরিয়ে রাখা হয়? শ্রমসাধ্য পোস্টের জন্য সাধুবাদ ভায়া।
অ:ট: Jog Art ইহা আপনার ফেবু আইডি না?
সময় নিয়ে লেখাটা পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার সাধুবাদে সব সময় অনুপ্রাণিত হই ।
না, ঐ নামে আমার কোন ফেবু আইডি নেই, আমার এখনকার এই নামেই একটা ফেবু আইডি আছে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আমার খুব পছন্দের একটি বইয়ের নাম রুশ দেশের উপকথা। শুধু পছন্দ বললে ভুল হবে, এটি আমার সবচে প্রিয় বই। এখনও সময় পেলেই পড়ি, কত হাজার বার পড়েছি কে জানে। একটা গল্প আছে তাঁর নাম সিভকা বুরকা। সেই যে মৃত্যুর আগে বুড়ো বাবা তাঁর তিন ছেলেকে ডেকে বললেনঃ আমার কবরে তিন রাত রুটি নিয়ে যাবি.........।
"তারা ভাবতো এই খাবারের লোভেই মৃতের আত্মাটা আবার যেন মৃত্যুর জগত থেকে ফিরে না আসে।"
ছোটো বেলায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে জুবুথুবু হয়ে শুয়ে শুয়ে পড়া অই গল্পটা মনে পড়ে গেলো।
-----মোখলেস হোসেন।
বইটা আমিও পড়বো। ধন্যবাদ মোখলেস ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন