লোকে বলে আসমান জমিনের ফারাক। আদিম লোকেরা কিন্তু বলে এই ফারাকটা সব সময় ছিলোনা। এমন একটা সময় ছিলো যখন আসমান জমিন এক হয়ে পরস্পরের সাথে সেঁটে ছিলো। এই সময়টা প্রায় ক্ষেত্রেই ছিলো সৃষ্টির সময়। এই বিশ্বজগত কিভাবে সৃষ্টি হলো তার কাহিনিরই একটা অংশ। পৃথিবী জুড়ে অজস্র মানব সম্প্রদায় নিজের নিজের মত সৃষ্টিকাহিনি রচনা করে নিয়েছে।
আদিম কাল থেকে মাটিতেই ছিলো মানুষের বিচরণ। কিন্তু “মাটির মানুষ” হলেও আকাশ সব সময়ই তাকে আলোড়িত করেছে। কৃষিকাজের শুরু হলে এই আকাশই বলে দিয়েছে বর্ষার ঋতুটা কখন আসবে। আবার এই আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, চাঁদের এক একটা কলা তাকে শিখিয়েছে সময়টা কিভাবে মাপতে হবে। মানুষ শিখেছে শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষের মধ্যের সময়ের মাপটা আর সেই মাপ থেকেই নিজের কাজটা ক্রমশ সুচারু ভাবে গুছিয়ে নিয়েছে। যখন কৃষিকাজটাও শেখেনি মানুষ তখনও নিশ্চয়ই রাতের নক্ষত্ররাজিতে পরিপূর্ণ আকাশের দিকে প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিলো। সূর্যের আলো তাপের প্রয়োজনীয়তা, বৃষ্টি ভর্তি মেঘের প্রতীক্ষা মানুষের জীবনের সাথে মিশে আছে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই।
আকাশ মানুষের জীবনের সাথে এতোভাবে জড়িয়ে থাকলেও অনেক কাল পর্যন্তই তা ছিলো তার নাগালের বাইরে। দূরের পর্বত শ্রেণির দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে হলেই মানুষ সেখানে একদিন পৌঁছাতে পেরেছে কিন্তু আকাশের সেই আশ্চর্য জগতে মানুষ পা রাখতে পারতোনা। তাই আকাশকে নিয়ে কাহিনি রচনা করে চলেছিলো মানুষ বহুদিন ধরে। এইসব কাহিনির মধ্যে ধরা ছোঁয়ার বাইরের আকাশটাকে নিজেদের করে নেবার প্রয়াসটা প্রকট ভাবেই চোখে পড়ে। মানুষ আসলে আকাশকে এতোখানি আত্মীয়তার অনুভবে জড়িয়েছে যে সে চিরকাল অনাত্মীয়ের মত নাগালের বাইরের কেউ ছিলো এটা ভাবতে পারেনি। তাই মিথ রচনা করে তুলেছে সেই সময়ের ছবি যে সময় আকাশ মানুষের মতই এই ধরণীর সাথেই লগ্ন হয়ে ছিলো।
নুট আর গেবকে বিচ্ছিন্ন করছে বাতাসের দেবতা শু
মিশরীয় সৃষ্টিকথায় আছে দেবতা আটুম ছিলো একা। একাই সে জন্ম দিলো দেবতা শু আর দেবী টেফনুটকে। শু ছিলো বাতাসের দেবতা আর টেফনুট ছিলো কুয়াশা আর আর্দ্রতার দেবী। এদের উপরই দায়িত্ব ছিলো প্রাগৈতিহাসিক সেই বিশৃঙ্খলাকে সুশৃঙ্খল স্থিতিশীল আইন আর বিধিবিধানে পরিনত করার। শু আর টেফনুট জন্ম দিলো গেব আর নুটকে। গেব ছিলো পৃথিবী আর নুট ছিলো আকাশ। কিন্তু এই গেব আর নুট কিন্তু জন্মের সময় থেকেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গনে আবদ্ধ ছিলো। শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠার জন্যই শু’কে এগিয়ে আসতে হলো এদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য। বাতাসের দেবতা শু নুটকে দু’হাতে গেব এর কাছথেকে বিচ্ছিন্ন করে উপরে তুলে ধরলো। আকাশ পৃথিবীর আলিঙ্গন থেকে ছিন্ন হয়ে উপরে রয়ে গেলো। এই বিচ্ছেদের পরও কিন্তু তাদের পারস্পারিক আকর্ষণ রয়েই গেলো। আকাশ নুট তার প্রিয়তম গেব এর উপর ঝুঁকেই রইলো। নুট গেব এর জন্য বৃষ্টি ঝরিয়ে দেয় আর গেব তার মাটিতে সবুজ ফসল ফলিয়ে তোলে।
তানে আকাশকে ঠেলে দিচ্ছে ওপরে
মাওরি সৃষ্টি কাহিনিতেও একেবারে শুরুতে আকাশ আর পৃথিবী পরস্পরকে জড়ে জাপ্টে ছিলো। আকাশের নাম ছিলো রাঙ্গি আর ধরনীর নাম ছিলো পাপা, এরাই ছিলো পরবর্তী দেবতাদের বাবা ও মা। এখন বাবা আকাশ আর মা ধরণী যেহেতু পরস্পরকে এতোটাই গভীর ভাবে ভালোবাসতো যে তারা কখনওই একে অপরকে ছেড়ে থাকবার কথা ভাবতেই পারতোনা। এই অবস্থাতেই তাদের ছয় ছয়টি সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু এই অবস্থায় যে সন্তানরা জন্ম নিয়েছিলো তারা কিন্তু বাবা রাঙ্গি আর মা পাপার দেহের মধ্যেখানেই চাপা পড়ে রইলো। এদিকে তারাও দেবতা, তারা আর এই অন্ধকারে বন্দি হয়ে থাকতে চাইলোনা। বাতাসের দেবতা তাওহিরিমাগতিয়া, অরণ্যের দেবতা তানে, যুদ্ধের দেবতা তু, সমুদ্রের দেবতা তাঙ্গারোয়া, শান্তির দেবতা রঙ্গো আর খাদ্যের দেবতা রু। এরা সবাই ভাবতে শুরু করলো কিভাবে মা আর বাবাকে বিচ্ছিন্ন করে তারা মুক্ত হবে। বাতাসের দেবতা তাওহিরিমাগতিয়া কিন্তু বাবা-মাকে বিচ্ছিন্ন করতে রাজি হলোনা, সে চাইলো সব যেমন আছে তাই থাকুক। কিন্তু অন্য দেবতারা অধীর হয়ে উঠলো। শেষে অরণ্যের দেবতা তানে মাটিতে পিঠ দিয়ে দু’পায়ে প্রচণ্ড শক্তিতে আকাশকে ঠেলে দিলো আরো উপরে। ঠিক যেমন অরণ্যের বৃক্ষ মাটিতে শিকড় গেঁথে উপরের দিকে শাখা মেলতে মেলতে বড় হয়ে ওঠে তানে ঠিক সেভাবেই রাঙ্গি আর পাপাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। সেই থেকে ধরণী নিচে পড়ে রইলো আর আকাশ থাকলো অনেক অনেক উপরে। এই বিচ্ছেদের পরও রাঙ্গি পাপার জন্য আকুল হয়ে থাকতো। সকালের শিশিরকে মাওরিরা বলে রাঙ্গি দেবতার অশ্রু আর মাটির ওপর জমে থাকা কুয়াশার স্তরের জন্ম পাপার চোখের জল থেকে।
মিশরীয় মিথটির সাথে নিউজিল্যাণ্ডের মাওরি আদিবাসীদের মিথটির সাদৃশ্য দেখিয়ে দেয় মিশরীয়দের এই মিথটির জন্ম হয়েছিলো তাদের আদিম পূর্বপুরুষদের মন থেকেই। আমার মনে হয় যে কোন সভ্যতার মিথ কথার অনেক উপাদানই সেই সভ্যতার আদিম পূর্বপুরুষদেরই রচনা। গেব আর নুটের কাহিনি মিশরীয় ধর্মতত্ত্বে পরবর্তীতে জটিল সব তত্ত্বকথার প্রতীক হয়ে উঠলেও যে আদিম মিশরীয়রা এ কাহিনির জন্ম দিয়েছিলো তারা নিঃসন্দেহেই মানব-মানবীর মিলনকেই সৃষ্টির উৎস বলে ধারণা করেছিলো। মাওরিদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টা আরো প্রকট। মানব-মানবীর যৌনসংসর্গ থেকেই যে সৃষ্টি হচ্ছে বা হয় এই ধারণাই ছিলো বিশ্বজগত সৃষ্টির জন্য আকাশ পৃথিবীর মিলনের এই মিথকথার অন্তরে। ইতিহাসের যত পেছন দিকে হেঁটে যাওয়া যায় ততই দেখা যাবে যৌনসংসর্গকে কেবল দৈহিক আনন্দ ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম মাত্র ভাবা হচ্ছেনা। ভাবা হচ্ছে প্রকৃতির বিশাল সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সাথে এক করে।
লোকায়ত দর্শন বইতে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “আদিম চিন্তা অনুসারে, মেয়েরা যে সার্থকভাবে কৃষিকাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে তার কারণ মেয়েদের মধ্যে একটি অদ্ভুত শক্তি লুকোনো আছে। এই শক্তির দরুনই মেয়েরা সন্তানবতী হয় এবং এই শক্তির প্রভাবে তারা পৃথিবীকেও ফলপ্রসূ করে।” এর পরেই দেবীপ্রসাদ ওরিনোকো ইন্ডিয়ানদের কথা বলেছেন। কৃষিকাজটা এই ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়টি মেয়েদের উপরই ছেড়ে রেখেছিলো। এক খ্রিস্টান পাদ্রি মেয়েদের রোদের মধ্যে এভাবে কাজ করতে দেখে তাদের তিরস্কার করলে তারা বলে এসব ব্যাপার আমাদের চেয়ে ওরা ঢের ভালো জানে। সন্তান সম্ভবা নারীকে গাছের ফল খাওয়ালে সে গাছের ফলন পরের বছর অনেক বেড়ে যায় এরকম বিশ্বাসও প্রায় সর্বত্রই প্রচলিত ছিলো। ওই একই বইতে আরেক জায়গায় দেবীপ্রসাদ বলছেন,“শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করবার বদলে জমিতে চাষ দিয়ে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু হবার পর থেকে খাদ্য-উৎপাদন সংক্রান্ত জাদু অনুষ্ঠানের মূল কামনা হলো পৃথিবীর উর্বরা-শক্তির বৃদ্ধি এবং সে-অনুষ্ঠানের মূল অঙ্গ হলো মৈথুন।” লোকায়ত দর্শন বইটিতে তন্ত্রধর্মের শেকড় সন্ধানে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আদিবাসীদের আর সেই সূত্রে আদিম মানুষের জীবনবিশ্বাসের থলি হাতড়ে একটা সুন্দর বিশ্লেষণ মূলক আলোচনা করেছেন। আদিম মানুষের জীবনে জাদুবিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত যে যৌনতা তা যে নিছক দৈহিক কামনার আগুনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে তা নয় বরং মৈথুন হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্বচরাচরের সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার মূল কেন্দ্রবিন্দু একটা রহস্যময় আচার অনুষ্ঠান।
এখনকার মত এ প্রসঙ্গের আর গভীরে যাবার সুযোগ নেই। কিন্তু যে কথাটা না বললেই নয় তা হলো সমাজে সম্পত্তির আর শ্রেণিবিভেদের উদ্ভবের সময় থেকেই যখন নারী আর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রইলো না তখন সৃষ্টি প্রক্রিয়া থেকেও নারী ক্রমশই দূরে সরে যেতে শুরু করলো। এবার কয়েকটা সৃষ্টিকথা যেখানে পুরুষই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান নিয়ন্তা।
পাঙ্গু আকাশকে ঠেলে তুলছে আরো ওপরে
চৈনিক মিথোলজিতে একটি সৃষ্টি কাহিনি আছে পাংগুকে নিয়ে। তখন বিশ্বচরাচরের সৃষ্টিও হয়নি অন্ধকারের রাজত্ব চলছিলো। অন্ধকার আর তুমুল বিশৃঙ্খলা। সেই অন্ধকারের মধ্যেই একটা ডিমের উদ্ভব হলো। আর সেই ডিমের মধ্যে জন্ম হলো পাংগুর। হাজার বছর পাংগু সেই ডিমের মধ্যেই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলো। পাংগু যখন জেগে উঠলো সেই ডিমের মধ্যে দেখলো চারদিকেই অন্ধকার। ডিমের মধ্যে অনেকদিন গুটিশুটি হয়ে থাকার কারণে পাংগু চাইলো তার হাত-পা টান টান করে আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠতে আর তাতেই ডিমের খোলসটা গেলো ভেঙ্গে। ডিমের খোলার যে অংশটা পাংগুর পায়ের নিচে ছিলো তাই হয়ে গেলো পৃথিবী আর যে অংশ মাথার উপর ছিলো সেটাই হলো আকাশ। দিনে দিনে পাংগু যতই লম্বা হতে থাকে ততই আকাশটাকে ঠেলে আরো উপরে তুলে দেয়। এভাবে হাজার বছর কেটে গেলে একটা সময় এলো যখন আকাশ এতো বেশি উপরে উঠে গেছে যে আর বেশি উপরে ওঠাই সম্ভবনা। উপরে আকাশ আর পায়ের তলে ধরণীকে ধরে রেখে দানবীয় শরীর নিয়ে পাংগু দাঁড়িয়ে রইলো। সৃষ্টির প্রথমে যে বিশৃঙ্খলা ছিলো তার অবসান হলো। আকাশ আর পৃথিবীকে বিচ্ছিন্ন করে পাংগু একটা সুশৃঙ্খল বিশ্ব রচনা করলো। বলা হয় পাংগুর মনের ভাবের সাথে সাথেই আবহাওয়ার বদল ঘটে। পাংগু খুশিতে থাকলে আকাশ থাকে ঝকঝকে পরিস্কার। পাংগুর মন খারাপ থাকলে সেই আকাশটাই যায় মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে। পাংগুর কান্নাই আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে পৃথিবীতে।
দেবতা মারদুক তিয়ামাতকে হত্য করতে উদ্যত
এনুমা এলিস হচ্ছে ব্যাবিলনের সৃষ্টি কাহিনি। আপসু মিষ্টি পানির দেবতা আর তিয়ামাত নোনা পানির দেবী। তাদের দুই পানির ধারার মিশ্রণেই একে একে আর সব দেবতাদের সৃষ্টি। কিন্তু কোন কারণে আপসু ভাবে এই দেবতারা বড্ড বিশৃঙ্খল আচরণ করছে, এদের সে ধ্বংস করে ফেলবে। দেবতা ইয়া এ খবর জানতে পেরে যাদুর সাহায্যে আপসুকে প্রথম ঘুম পাড়িয়ে দেয় তারপর হত্যা করে। থাকে কেবল তিয়ামাত। ইয়া আর দামকিনার সন্তান দেবতা মারদুককে তিয়ামাতকে পরাস্ত করবার দায়িত্ব দেওয়া হলো। শুধু দায়িত্বই নয় তাকে সব দেবতার সম্মিলিত শক্তি আর অস্ত্র-শস্ত্রও দেওয়া হলো। মারদুকের সাথে তিয়ামাতের ভীষণ লড়াই শুরু হলো। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে মারদুককে গিলে খাবার জন্য তিয়ামাত মুখ খোলা মাত্র মারদুক তার মুখের মধ্যে বাতাস প্রবাহিত করে দেয়। তিয়ামাত মুখ বন্ধও করতে পারেনা। বাতাসের প্রকোপে তার শরীর ফুলে উঠতে শুরু করে। ঠিক সেই সময় মারদুকের একটা তীর গিয়ে বিদীর্ণ হয় তিয়ামাতের শরীরে আর তার শরীর ছিঁড়ে দু’টুকরো হয়ে যায়। তিয়ামাতের মৃতদেহের অর্ধেক দিয়ে মারদুক আকাশ তৈরী করলো আর বাকি অর্ধেক দিয়ে তৈরী করলো বিশ্বজগত।
নর্স দেবতা ওডিন তার দু’ভাইয়ের সঙ্গে ইমিরের মাথার খুলিকে তুলে ধরছে আকাশ তৈরীর জন্য
নর্স মিথের সৃষ্টিকাহিনির শুরুতে দেখি সবচেয়ে উত্তরের নিফলহেইম বরফ আর অন্ধকারে আচ্ছন্ন একটা স্থান। ঠিক তার বিপরীতে সর্বদক্ষিণের মাসপেলহেইম গনগনে আগুনের কুণ্ড। যখন নিফলহেইমের বরফ আর মাসপেলহেইমের আগুনের মিলন হলো তখন একটা পানির ফোটার ভেতর জন্ম হলো ইমিরের। প্রকাণ্ড দানবীয় আকৃতির দেহের অধিকারী ইমির হয়ে দাঁড়ালো তুষার-দানবদের পূর্বপুরুষ। নর্স দেবতাদের প্রধান ওডিন তার দুই ভাইয়ের সঙ্গে মিলে এই ইমিরকে হত্যা করলো। ইমিরের মাথার খুলি দিয়ে তারা তৈরী করলো আকাশ। ইমিরের রক্ত-মাংস আর অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে তারা গড়ে তুললো বিশ্বজগতের বাকি সব অংশ।
ভারতীয় মিথে দেখি সৃষ্টির কাজটা করছেন ব্রহ্মা। হিরন্ময় একটা ডিমের মধ্যে ছিলেন ব্রহ্মা। মনুসংহিতার সৃষ্টিতত্ত্বে বলা হচ্ছে, “ভগবান ব্রহ্মা সেই অণ্ডে ব্রাহ্ম পরিমিত একবৎসর কাল অবস্থান করে অবশেষে ধ্যানবলে সেই অণ্ডকে দু-ভাগে ভাগ করলেন। তারপর তিনি সেই দু-খণ্ডের ঊর্ধ খণ্ডে স্বর্গ ও নিম্ন খণ্ডে পৃথিবী নির্মাণ করে মধ্যভাগে আকাশ, দিকসমূহ ও সমুদ্র প্রভৃতি শাশ্বত জলস্থান সৃষ্টি করলেন।”
এই সৃষ্টিতত্ত্ব গুলোয় নারী-পুরুষের সঙ্গমরত ছবিটা আর নেই। নারী আর পুরুষের আকাশ আর ধরণীতে পরিনত হবার বিষয়টার জায়গায় আমরা দেখছি মূলতঃ পুরুষ একাই আকাশ আর পৃথিবী সৃষ্টি করছে। নারীর অনুষঙ্গ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত সম্পত্তির উদ্ভব আর শ্রেণিবৈষম্য বেড়ে ওঠার সময় থেকে সমাজে নারীর অবস্থানও আগের অবস্থায় আর ছিলোনা। ফলে সৃষ্টি কাহিনিতে পুরুষই সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। আগে যে আদিম সাম্যতায় নারী আর পুরুষ প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সমান সম্মানের অধিকারী ছিলোসেখানে পুরুষ ক্রমেই প্রধান হয়ে উঠতে শুরু করে। তারপরও আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির মিথে দেখি যৌনসঙ্গমরত নারীপুরুষের পরস্পর লগ্ন এক হয়ে থাকা শরীরের অস্পষ্ট ছায়া রয়েই গেছে। যেমন মারদুক তিয়ামাতের শরীর দু’ভাগে বিদীর্ণ করে এবং পাঙ্গু ও ব্রহ্মা যে ডিমের খোলস ভেঙ্গে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করে। এসবের মধ্যে লক্ষ্য করার বিষয় হলো আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির উপাদান একটা অখণ্ড বস্তু থেকেই আসছে যেমন একই ডিমের খোলসের ভাঙ্গা দু’টো অংশ, অথবা তিয়ামাতের বা ইমিরের শরীর। মিথ কথার পরিবর্তন হলেও আকাশ আর পৃথিবী বা তাদের উপাদান যে একত্রেই ছিলো এই তথ্যটা রয়েই গেছে। নারী-পুরুষের সঙ্গমরত যুগ্ম শরীরকে জোর করে বিচ্ছিন্ন করে যে সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো পরিবর্তিত সময়ের সমাজের মিথে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে দানবী তিয়ামাতের শরীর ছিঁড়ে দু’ভাগ করে, বা ডিমের খোলস ভেঙ্গে দু’টুকরো করে আকাশ পৃথিবীর রচনা। সপ্তম শতাব্দীর কোন এক ঈশ্বরও যখন বলেন আকাশ আর পৃথিবীর এক সাথে আবদ্ধ থাকার কথা তখন বোঝাই যায় এ সেই প্রাচীন মিথেরই উত্তরাধিকার। এর পেছনে বিগ ব্যাং থিয়োরি বা ক্রমপ্রসারমান বিশ্বের ছবির চেয়ে আদিম বিশ্বাস আর কল্পনার ছায়াটাই স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। একটা হেয়ালির একশো এক রকম অর্থ খুঁজে বের করা যায় কিন্তু সেই আদিম সময়কালটা থেকে মানুষ ধারাবাহিক ভাবে যে পায়ের ছাপ ফেলতে ফেলতে এখনকার সময়ে এসে পৌঁছেছে তার ইতিহাসটা নৈর্ব্যক্তিক ভাবে দেখলে ছবিটাও আর খুব বেশি হেয়ালি থাকেনা।
তথ্যসূত্র:
১। মিশরীয় মিথ
২। মাওরি মিথ
৩। চৈনিক মিথ
৪। ব্যাবিলনীয় মিথ
৫। নর্স মিথ
৬। লোকায়ত দর্শন : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।৩৭২পৃঃ, ৪২৮পৃঃ।
৭। মনুসংহিতা: ১২/১৩ : অধ্যায় এক; পৃঃ ৪৬। সম্পাদনা ও ভাষান্তর চৈতালী দত্ত। নবপত্র প্রকাশন; কলকাতা-৭৩।২০০৮
মন্তব্য
আগ্রহোদ্দীপক লেখা।
উপকথায় নারীর ভূমিকার লঘুকরণ বা তার বিপরীতে পুরুষের ভূমিকার মুখ্যীকরণ নিয়ে একটা বিচিত্র অনুমানের কথা পড়েছিলাম পিটার ওয়াটসনের একটা বইতে। সম্ভবত এক ফরাসি নৃতাত্ত্বিকের প্রকল্প সেটা, এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে না। তাঁর মতে, শিকারী-টোকাই সমাজের মানুষের কাছে নারীর কদর বেশি ছিলো, কারণ জন্মরহস্য তখনও সমাজে অজানা ছিলো। নারী তখন রহস্যময়ী, কারণ তার মাধ্যমেই দলের শক্তি বাড়ে। শিশুর জন্ম যে মৈথুনের ফল, সেটা তখনও লোকে ধরতে পারেনি। ধরতে না পারার পেছনে তাদের জঙ্গম জীবনরীতিকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন। শিশুর জন্ম যেহেতু নয়মাসব্যাপী প্রক্রিয়া, এবং এর লক্ষণও মৈথুনের সাথে সাথেই প্রস্ফূট হয় না, শিকারী-টোকাই জীবনে "দৌড়ের ওপর" থাকার কারণে সন্তানের সাথে মৈথুনের কার্যকারণ সম্পর্ক নাকি সে সমাজে তখনও অলক্ষিত ছিলো। জঙ্গম জীবন ছেড়ে মানুষ যখন কৃষিতে থিতু হলো, তখন মানবজন্মের কার্যকারণ তার কাছে স্পষ্ট হয়, এবং নারীর সাথে প্রকৃতির রহস্যের যোগ ছিন্ন হয়। কৃষি মানবসমাজকে মাতৃতান্ত্রিক থেকে পিতৃতান্ত্রিক করে তোলে, এবং উপকথাগুলোও একইভাবে মোড় নেয়। যেসব সমাজ এখনও জঙ্গম রয়ে গেছে (দক্ষিণ আফ্রিকা বা আমাজন অববাহিকায়), সেগুলোর উপকথাগুলো বিশ্লেষণ করলে হয়তো এ প্রকল্পের সমর্থনে কিছু পাওয়া যেতে পারে।
ঠিক তাই হিমু ভাই। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরাও মৈথুনকে সন্তান জন্মের সাথে সম্পর্কিত করে ভাবতোনা। তারা ভাবতো জন্মান্তর নেবার প্রতীক্ষায় থাকা আত্মারা তরুণী নারী পেলেই গর্ভে ঢুকে পড়ে। মৈথুনকে জন্মের সাথে সম্পর্কিত বলে মানুষ হয়তো আরো একটু পরে বুঝতে পেরেছিলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন