বয়স্করা ডাকতেন গুলুবুবু। আমরা জানতাম নানির নাম গুলনাহার সরকার। এ খাস বাপের বাড়ি থেকে আনা নাম। সে আমলেও স্বামীর নামের শেষাংশ স্ত্রীর কুমারী কালের পদবীকে নাকচ করে দোর্দণ্ড প্রতাপে বসে যেতো। কিন্তু নানা এ নামটা অবিকৃতই রেখে দিলেন। সম্ভবত “সরকার” টাইটেলটার জন্যই। সে আমলে বেশ পয়সাওয়ালা না হলে সরকার পদবী হতোনা। নানির বাবা একরাম উদ্দীন সরকার বিস্তর পয়সা করেছিলেন ব্যবসাপাতি করে। নানার বাবা নাদের হোসেন ছেলে আব্দুল জব্বারের জন্য মেয়ে দেখতে গেছেন একরাম উদ্দীন সরকারের বাড়ি, রাজশাহীর হেতমখাঁ পাড়ায়। নানি লজ্জায় ছাদে পালিয়েছেন। নিচ থেকে একটা আতাগাছ ছাদ পর্যন্ত উঠে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে ছাদের এক কোণেই ঝুঁকে আছে। নানি সেই আতাগাছের আড়ালে চুপটি করে বসে অপেক্ষা করছেন কখন এই মেয়ে দেখতে আসা মেহমানরা বিদায় হবে। নানির বয়স তখন কত হবে? সম্ভবত তোরো-চৌদ্দ। মেয়ে দেখতে এসে যখন শুনলেন মেয়ে লজ্জায় ছাদে গিয়ে লুকিয়েছে তখন নাদের হোসেন বললেন মেয়েটাকে জোর করে টেনে আনার দরকার নেই। নিজেই চুপিচুপি ছাদে উঠে আতাগাছের পাতার আড়ালের কিশোরী মেয়েটাকে দেখে আবার চুপিসাড়েই নেমে এলেন। নেমে এসে বললেন, “আতাগাছে তোতা পাখি দেখে এলাম”। ব্যাস নানির বিয়ে পাকা হয়ে গেলো।
গল্প চলতেই থাকতো। বিকেলে বা সন্ধ্যায় দোতলার সিঁড়ির মাথার কাছে তালপাখা নিয়ে বসতেন নানি। চোখ থাকতো আকাশের যে জায়গাটায় দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, জমাট লাল রঙের জেল্লাটা ফিকে হতে হতে সন্ধ্যা নামছে সেই দিকটায়। কিন্তু গল্প চলতো। আমরা নানির প্রায় পায়ের কাছে সিঁড়ির পরবর্তী ধাপ গুলোয় বসে তন্ময় হয়ে শুনছি। সাহেববাজারের দিক থেকে একটা ঘোড়ায় টানা টমটম ছুটে আসছে। কোচওয়ান বেচারা শুধু লাগামের দড়িটা ধরে কোন মতে বসে আছে কিন্তু ঘোড়াটা বা গাড়িটা থামাতে পারছেনা। ঘোড়া সনকেছে। ঘোড়া সনকানো মানে ঘোড়া চমকে গেছে। আরো ভালো করে বললে ঘোড়া কোন কারণে পাগলের মত ছুটতে শুরু করেছে আর তাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা। এখন এ হচ্ছে এক ভয়ানক ব্যাপার এ ঘোড়াকে থামানো না গেলে গাড়িটা পথচারীদের ঘাড়ের ওপর উঠে চাপা দিয়ে চলে যাবে। সে আমলেতো মোবাইল ফোন ছিলোনা কিন্তু চিৎকারে চিৎকারে চাউর হয়ে গিয়েছিলো টমটমটা দমকলের মোড়ের দিকেই আসছে। তো দমকলের মোড়ে রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন আমাদের নানা। ওদিকে ভয়ানক গতিতে ছুটে আসছে ঘোড়ার গাড়ি কোচওয়ান বেচারা চোখবুঁজে একরকম ভাগ্যের হাতেই নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে, লাগামের দড়িটা ধরে সে যে এখনও গাড়ির ওপর বসে আছে এটাই বিস্ময়ের। রাস্তার ওপর থেকে লোকজন সরে পড়েছে। সনকে যাওয়া ঘোড়ার গতি পথে থাকতে নেই, কেননা এ ঘোড়াকে থামানো অসম্ভব। কিন্তু নানার রোখ চেপে গেছে তিনি সরবেননা। রাস্তার উপর খটাখট শব্দ তুলে ছুটে আসছে সনকে যাওয়া পাগল ঘোড়া পেছনে ঝড়েরবেগে টেনে নিয়ে আসছে টমটমগাড়ি আর দুর্ভাগা কোচওয়ানকে। ঘোড়া যখন একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে তখন বিদ্যুতের গতিতে নানা সামান্য সরে গিয়েই ঘোড়ার লাগামটা ধরে ফেললেন। ঘোড়ার গতিবেগের সাথে তাল রেখে কয়েক পা দৌড়ালেনও কিন্তু সবাইকে অবাক করে ঘোড়াটা গাড়িসহ থামিয়ে দিলেন।
রূপকথার দত্যিদানোর গল্প কিন্তু নানির কাছে কখনও শোনা যেতোনা। আমরা খালাতো ভাইবোনরা (তখনও কোন মামাতো ভাইবোনের জন্ম হয়নি) নানির কাছে সে ধরণের গল্প কোনদিনই শুনিনি। যা শুনতাম সব ফেলে আসা দিনের স্মৃতি। নানি হয়তো আনমনে ফেলে আসা দিন গুলোয় ফিরে গেছেন আর তার পায়ের কাছে শুয়ে বসে আমরাও নানির সঙ্গে চেপে বসেছি টাইমমেশিনে। নানির ছিলো বইপড়ার নেশা। কাছেপিঠের কোন এক লাইব্রেরি থেকে আত্মীয় স্বজনরা বই এনে দিতো। নানি গোগ্রাসে গিলতেন সেসব বই। বই সরবারহকারীদের একজন ছিলেন আমার দাদা মোজাম্মেল হক। তিনি তখন কোলকাতা থেকে পরিবার নিয়ে ফিরে এসে শ্বশুর বাড়িতেই আছেন। কিছুদিন পরেই সিপাইপাড়ার একটা একতলা বাড়ি কিনে সেখানে উঠে যাবেন। কিন্তু সে সময়টা আরো পরে। সে সময় দাদাও ছিলেন বইয়ের পাগল। নিজেও কিছু কিছু উপন্যাস গোছের লেখা লিখতে শুরু করেছিলেন। দাদার একটা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আমার কাছেই ছিলো। পড়বো পড়বো করে সময় করে উঠতে পারিনি আর শেষকালে সেই প্যাকেটটা আমার হাতছাড়াও হয়ে যায়। সেই পাণ্ডুলিপির প্রথম পাতার উপরে এক কোণে লেখা ছিলো উপন্যাসটা কোন এক প্রকাশক পড়ে ফেরত পাঠিয়েছেন, প্রকাশের উপযুক্ত ভাবেননি।
আরেকজন ছিলেন আমার নানারই ছোট ভাই টুনু। ছোটখাটো মানুষ হলে কি হয় লম্বা বাহারি চুল আর গানবাজনা নিয়ে হৈহল্লা করে বেড়ানো লোক। বড় ভাবীর বইয়ের যোগানদার তিনিও ছিলেন। নানির কাছে শরৎচন্দ্রের কথা, পথেরদাবী উপন্যাসটার কথা শুনেছিলাম, শুনেছিলাম দস্যু মোহনের কথা, এমনকি রবিনহুডের কথাও। রবিনহুড কিভাবে বড়লোকদের টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতো সেই গল্প। এরও অনেকদিন পর বেরিয়ে ছিলো সেবাপ্রকাশনীর রবিনহুড। নানি তখনও বেঁচে ছিলেন। আমাদের দস্যুবনহুরের গল্প শুনে নানি বলতেন দস্যু মোহনের কাহিনি।
সেকালে আমরাও খুব বেশি বইটই পড়িনি ফলে নানির আমলের উপন্যাস আর গল্পের বইয়ের ইতিহাসটা আমরা ধরতে পারতামনা, স্মৃতির ফাঁক গলে হারিয়েও গেছে অনেক কিছু। কিন্তু নানির বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়ানো ছিটানো সেকালের পেপারব্যাক উপন্যাস আমাদের চোখের সামনেই পড়ে থাকতো। কয়েকটার কথা আবছা মনে আছে যেমন নিহাররঞ্জন গুপ্তের সেরকম একটা উপন্যাস খুব ছোটবেলায় আমিই পড়তে শুরু করেছিলাম। সেটা ছিলো কোন এক অভিশপ্ত হিরে নিয়ে। সে হিরে যার কাছে যাচ্ছে সেই খুন হয়ে যায়। জমজমাট ব্যাপার স্যাপার। কিরিটি রায়কে নিয়েও বেশ ক’টা উপন্যাস ছিলো। শরৎচন্দ্রের বেশ কিছু কাগজের মলাটের উপন্যাস এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিলো কিন্তু সেগুলোর সেলাই খুলে অনেক গুলো পাতাই খুঁজে পাওয়া যেতোনা। কোন কোনটার মলাটই রয়ে গিয়েছিলো কেবল। তবে যে বইটা আমি নিজে হাইজ্যাক করে নিয়েছিলাম সেটা হচ্ছে রবিঠাকুরের “গল্পগুচ্ছ”। এই বইটা এখনও আমার কাছে আছে। ঝিনুক প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিলো। সেকালে বিশেষ কিছু সাহিত্য বুঝতামনা কিন্তু বইটা আমার কাছে ছিলো সাতরাজার ধন। এখনও তাই আছে। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের “মধুরাতি”। বইটা উত্তম পুরুষে লেখা ছিলো। শুরু থেকে মাঝ পর্যন্ত গিয়ে উপন্যাসের “আমি”টা ছোট্ট একটা ছেলে থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে গেলো তখনই আমি আর আগ্রহ পাইনি। পড়াটা ওখানেই থেমে গিয়েছিলো। আরো একবার বোধহয় পড়তে শুরু করেছিলাম কিন্তু ঐ মাঝ বরাবর গিয়েই শেষ। কিন্তু এগুলো সম্ভবত ছিলো নানির শেষ দিকের সংগ্রহ। আরো অল্প বয়সে যা পড়তেন তার বেশিরভাগই ছিলো লাইব্রেরি বা কারো কাছে চেয়ে নিয়ে আসা। এখন আফসোস হয় আরো বইয়ের কথা নানিকে জিজ্ঞেস করিনি কেন। আসলে তখনও বুঝিনি বইয়ের নেশা কখনও আমাদেরও পেয়ে বসবে।
নানা মারা যাবার পর নানার ব্যবসাপাতি প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে। ছেলেরা তখনও এতোখানি বড় হয়নি যে সেসব সামাল দেবে। চার চারটা মেয়ের বিয়ে দিয়ে তিন ছেলেকে নিয়ে নানি কোন রকমে সংসারটা টেনে নিয়ে এসেছেন। কিছু ধানের জমি ছিলো আর বৃটিশ আমলের বাড়ির কয়েকটা ছোট্ট বাড়তি ঘর ভাড়া দিতেন ছাত্রদের। সেও কখনও দু’জনের বেশি দেখিনি। এই সাংসারিক চাপেই নানির বইয়ের নেশা স্তিমিত হয়ে পড়েছিলো। আমাদের সময়ে তাই নানিরবাড়িতে বই বলতে ছিলো কয়েকটা উল্টোরথের ঢাউস পুজো সংখ্যা আর খান কতক কাগজের মলাটের উপন্যাস। কিন্তু গল্প উপন্যাসের চেয়ে গল্পের ভঙ্গিতে বলা পুরনো দিনের স্মৃতি কথাই ছিলো নানির গল্পের ঝুলির সিংহভাগ। হয়তো লেখার অভ্যাস আর অবসর থাকলে নানিও সেসব স্মৃতিচারণ লিখে ফেলতে পারতেন।
কিন্তু এই পারিবারিক স্মৃতি চারণের ফাঁকে ফাঁকেই নানি হয়তো বলতে শুরু করলেন সুভাস বোসের কথা। কেমন করে বৃটিশদের নাকানিচুাবানী খাইয়ে দেশটা স্বাধীনই করে ফেলেছিলেন শ্রেফ বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুটা তাকে থমকে দিলো। নানি অবশ্য বিশ্বাস করতেননা সুভাসবোস মারা গেছেন। সেকালের সাধারণ মানুষ যেমন ভাবতো নানিও ভাবতেন সুভাস বোস কেবল গা-ঢাকা দিয়েছেন বৃটিশদের চোখে ধুলো দিতে। ঠিক সময়ে তিনি আবার বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু তখন বৃটিশরা চলে গেছে, পাকিস্তানিরাও। নানির সেসব খেয়াল থাকতোনা। ভাওয়ালগড়ের সন্ন্যাসীর কথাও বোধহয় নানির কাছেই শোনা, তবে নানি হয়তো সরাসরি গল্পটা আমাদের বলছিলেন না অন্যকারো সাথে সে প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করছিলেন। তাই সে স্মৃতিটা আধ-খ্যাঁচড়াই থেকে গেছে।
নানির বাড়িতে আমাদের দারুন মজার সময় কাটতো। সব সময় খালাতো ভাইবোনেরা মিলে হৈ-হল্লা আর হাসিঠাট্টা চলছেই। নানি মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে বলতেন এতো হাসি ভালোনা, “যত হাসি তত কান্না বলে গেছেন রামশন্না”। এখন রামশন্না লোকটা কে তার হদিস আমরা জানিনা। জানিনা কেনই বা তিনি বাটখারায় ওজন করে প্রত্যেকটা জীবনে এভাবে হাসি-কান্না বরাদ্দ করেছেন। এই সতর্কবার্তা আমাদের উপর ঠিক কাজ করতোনা কেননা এটা আমাদের হাসি থামাতে পারতোনা। আর আমাদের নানি মানুষটিও রাশভারি গোছের ছিলেননা, তিনিও হাসিঠাট্টা আর গল্প গুজবের সুযোগ পেলে আর কান্না মেপে রেশন করে হাসতেননা।
অনেক কিছুই আমাদের শেখা নানির কাছেই। এই যেমন সন্ধ্যার দিকে বাদুড় উড়ে যেতে দেখলেই মন্ত্র পড়তে হবে “বাদুড় বাদুড় মিত্ত, যা খাবি তাই তিত্ত”। এই মিত্ত মানে হলো মিত্র অর্থাৎ বন্ধু, নানিই ব্যাখ্যা করে দেন আর এই মন্ত্র পড়ার ফল হবে বাদুড় মহাশয় যাই মুখে দেবেন তাই পাবেন ভিষণ তেতো। সুতরাং বাদুড়ের অবস্থা হবে বেগতিক এক কামড় ফল খাবে আর থু করে ফেলে দেবে তিতো লাগছে বলে কিছুই খেতে পারবেনা। ছোটবেলায় এই মন্ত্রের কার্যকারিতায় আমাদের বিশ্বাস ছিলো পুরোমাত্রায়। বাদুড়কে মিত্র ডেকে এরকম সর্বনাশ করার বিষয়টা যে রীতিমত নিষ্ঠুরতা সেটা আর মনে থাকতোনা।
নানির বাবা একরাম উদ্দীন সরকার দু’টো বিয়ে করেছিলেন। বড়বউকে সাংঘাতিক ভালোবাসলেও দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন ছেলে-পুলের আশায়। বড়বউয়ের কোন সন্তানই ছিলোনা। এই দ্বিতীয় বউটাই ছিলো নানির মা। নানিরা অনেক ক’জন ভাইবোন ছিলেন, আর সবাই ছিলেন এই ছোটবউয়ের সন্তান। সতীনের সন্তান বলে বড়বউ কিন্তু কাউকেই আলাদা করে দেখেননি, সবাইকে পরম যত্নে তিনিই মানুষ করে তুলেছিলেন। ছোটবউ অর্থাৎ আমার নানির আসল মা প্রায় সব সময়ই অসুস্থ থাকতেন সুতরাং ছেলে-পুলে মানুষ করা থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় দায়িত্বই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বড়বউ। নানির কাছে শুনেছি মা বলতে এই সৎমাকেই বুঝতেন নানিরা। সব দাবী আবদারও ছিলো এই বড়মার কাছেই। নানির কাছে এই বড়মার অনেক গল্প শুনেছি সে তুলনায় তার নিজের মায়ের গল্প সামান্যই বলেছেন। নানির নিজের মা অনেক দিন বেঁচে ছিলেন। খুব ছোট বেলায় তাকে অনেকবারই দেখেছি। ছোট্ট রোগা-সোগা মানুষ, মাথার চুল গুলো কোঁকড়ানো। অশ্চর্যের ব্যাপার হলো সে চুলের মধ্যে একটাতেও পাক ধরেনি তখনও। খুব ছোটবেলায় হেতম খাঁর নানির বাপেরবড়ি বেড়াতে গেলে অবাক বিস্ময় নিয়ে নানির মায়ের দিকে চেয়ে থাকতাম।
সেই একরাম উদ্দীন সরকারের সাথে আমার দেখা হলো অনেকদিন পরে যখন নানিও আর বেঁচে নেই। নানির বাড়িটা রাস্তার উপরই। হোসেনিগঞ্জ পাড়ার মসজিদটার ঠিক উল্টো দিকে। নানিরবাড়ির জানলা খুললেই রাস্তার ওপারে মসজিদের পাশেই একটা টালির ঢালু ছাদওয়ালা একটা লম্বাটে বারান্দা দেখা যেতো। অনেক পরে জেনেছি ওটা ছিলো বাগধানী জমিদারের কাচারি বাড়ি। ওই বাড়িতেই এক সময় রাজশাহীর কিছু সাহিত্যপ্রেমী গড়ে তোলেন রাজশাহী মুসলিম ক্লাব। সময়টা সম্ভবত ১৯২৮ কিংবা ২৯। এই ক্লাবের উদ্বোধনের সময় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমন্ত্রন করে এনেছিলেন সদস্যরা। এই আমন্ত্রনের আয়োজক কমিটির মধ্যে নানির বাবা একরাম উদ্দীন সরকারও ছিলেন। একটা ছবিও পাওয়া গেলো কবির সঙ্গে মুসলিম ক্লাবের সদস্যদের। ছবিতে কবির পেছনে দাঁড়ানো মুসলিম ক্লাবের সদস্যদের সবচেয়ে ডানের দাঁড়ানো মানুষটি ছিলেন একরাম উদ্দীন সরকার। নানির কাছে অনেক গল্প শুনেছি যখন দেখলাম তখন নানি নিজেই গল্প হয়ে গেছেন। এই পুরনো ছবিটা নানিকে দেখাতে পারলে বেশ হতো। শোনা যায় সে সময় রাজশাহীর মুসলমান সমাজে গান-বাজনাকে ভালো চোখে দেখা হতোনা। কাজী নজরুল ইসলাম মুসলিম ক্লাবে কয়েকটা গানও গেয়েছিলেন। এই গান গাইবার সময় রক্ষণশীল মুসলমানের দল ক্লাব লক্ষ্য করে কয়েকটা ঢিলও নাকি ছুড়েছিলো।
এই রক্ষণশীল মুসলমানদের বিপরীতে সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রেমী মুসলমানও কম ছিলেননা। শোনা যায় রাজশাহী মুসলিম ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ছিলো দুশোরও বেশি। এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ওবায়দুল সোবহান আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুল হাকিম। পরে এই ক্লাবটা বাগধানী জমিদারের কাচারি বাড়ি ছেড়ে উঠে আসে সদর হাসপাতালের মোড়ে এখন যেখানে বরেন্দ্র মিউজিয়ম তারই দক্ষিণের বাড়িটায়। ১৯৪৯ সালে ঐ বাড়িতেই রাজশাহীর প্রথম মেডিকেল স্কুলের প্রতিষ্ঠা হলে মুসলিম ক্লাব স্থানান্তরিত হয় মাদ্রাসা স্কুলের পিছে জিন্নাহলে। জিন্নাহ হলে মুসলিম ক্লাব ও অফিসার্স ক্লাব সম্মিলিত হয়ে জন্ম নেয় জিন্নাহ ইসলামিক ইনস্টিটিউট ৷ এই জিন্নাহ ইসলামিক ইনস্টিটিউটই এখন শাহ মখদুম ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরী ৷ মাদ্রাসা ময়দানের পেছনে একতলা বিশিষ্ট বাড়ীতে এই পাঠাগারটি এখনো আছে ৷ জিন্নাহ হল এখন মাদার বখস হল এবং ব্যবহৃত হচ্ছে উত্তরা কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ৷ সেই সময়ের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল মজিদের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় জিন্নাহ ইসলামিক ইনস্টিটিউট। জিন্নাহল নামের এই বাড়িটায় একটা সুপরিসর হলরুম ছিলো যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সহ বিভিন্ন সেমিনারেরও আয়োজন করা হতো। এছাড়া ছিলো একটা সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারও।
জানিনা একরাম উদ্দীন সরকারের প্রভাবে না এই সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠার দরুণ নানির এই পড়ার নেশাটা জন্মে ছিলো। আফসোস হয় কাজী নজরুল ইসলামের রাজশাহী আসাটা নিয়ে নানির স্মৃতি কথাটা আমরা আরো ভালো করে শুনিনি বলে। আফসোস হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়টার গল্পও কেন আরো বেশি করে শুনিনি। যুদ্ধের সময় বাড়ির ছোট ছেলেপুলেরা সব পদ্মা পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। কয়েকজন বয়স্ক মানুষের সাথে বাড়ির মেয়েরা রয়ে গিয়েছিলো। আর রয়ে গিয়েছিলাম আমি, আমার বয়স তখন কয়েকমাস। সে সময়ই আমার হাতে বা ঘাড়ে কি একটা সমস্যায় অপারেশনও করাতে হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের সময়টা এলেই আমাকে নিয়ে তাদের কি সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো সেই গল্পটাই বেশি আসতো। রাস্তা দিয়ে কোন গাড়ি গেলেই নাকি আমি জয়বাংলা বলে চেঁচিয়ে উঠতাম এটাও শোনা আমার নানির কাছেই। যেদিন দেশ স্বাধীন হলো মুক্তিযোদ্ধারা এই নানিরবাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই বিজয় মিছিল করে যাচ্ছিলেন। নানির কাছে শুনেছি বাড়ির সবাই ছাদ থেকে টবের ফুলপাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাদের উপর ছুড়ে দিচ্ছিলো। কিন্তু গল্প সম্ভবত আরো ছিলো। কিন্তু সময়ে সেসব শোনা হয়নি। গল্প বলিয়ে থেমে গেছেন ক্লান্ত হয়ে। নানি যখন মারা যান তখন আমরা আর নানিরবাড়ি থাকতামনা তার কয়েকবছর আগেই নিজেদের বাড়ি উঠে এসেছি। খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলাম নানিরবাড়ি। সেদিন আশ্চর্য চুপচাপ সে বাড়ি, গল্পবলার মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে। নানিরবাড়ি বলতে যে জগতটা এক সময় একটা বিশাল আনন্দের, মজার আর হুল্লোড়ের আখড়া ছিলো সেটা সেদিনই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো।
ছবির সবচেয়ে ডানে দাঁড়ানো মানুষটি ছিলেন নানির বাবা একরাম উদ্দীন সরকার
মন্তব্য
বেশ খানিকটা বিরতি দিয়ে লিখলেন সোহেল ইমাম। দারুণ লাগলো। কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে কঠিন কঠিন লেখার পর মাঝে মাঝে এরকম এক দুটো পড়তে দিয়েন।
--মোখলেস হোসেন।
অনেক ধন্যবাদ মোখলেসভাই। কঠিন কঠিন লেখা কই লিখলাম ভাই। বন্ধুদের সঙ্গে বই পড়ে পাওয়া তথ্য নিয়ে যা গল্প করি আড্ডায়, তাই লিখি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
চমৎকার লাগল পড়তে। (Y)
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অনেক ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ছবিটার জন্য ধন্যবাদ! আপনার স্মৃতিকথা উপভোগ করলাম প্রাণ ভরে। ইয়ে....
আপনি জয়বাংলা বলে চেঁচিয়ে উঠতেন কি অনেকটা বড় হওয়ার পর?
আমার জন্ম ৭০এ এজন্যই কয়েকমাস বলেছি। চেঁচিয়ে ওঠার ব্যাপারটা আমার স্মৃতিতে নেই, হতেই পারে অনেকটা বড় হয়েই হয়তো। যুদ্ধের সময় নিশ্চয়ই নয়। লেখাটা পড়ার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
দারুণ তো!
চমৎকার লাগলো পড়তে।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
পড়বার এবং মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন