সদর হাসপাতাল থেকে যে রাস্তাটা দরগাপাড়ার দিকে যায় সেই রাস্তাটায় মোড় থেকে দু’একটা দোকানের পরই পুরনো ধাঁচের এক কামরার একটা পাকা বাড়ি। বাড়িটা ছোটই আর ঠিক এটাই খুঁজছিলাম। ছোট্ট দরজার কাছেই যে লোকটা নীল রঙের একটা টি-শার্ট পরে পা ছড়িয়ে বসে আছে এই লোকটাই আরিফুল ইসলাম রুনু। আর এই প্রায় ভেঙ্গে পড়া ছোট্ট বাড়িটাই তার কর্মশালা, “রুনু আর্ট”। বয়স বেশি নয়। অসম্ভব লাজুক আর স্বল্পভাষী শিল্পী রুনু ছবি তোলার সময়ও মুখ তোলেননি। কথা বার্তা যা চলছিলো তাও অত্যন্ত মৃদু স্বরে। রুনুর কর্মশালার ভেতরটায় আলো বিশেষ নেই তবে হরেক রকম বাতিল জিনিসে ঠাসা। রিকশা আর সাইকেলের ভাঙ্গাচোরা অংশ প্রায় স্তুপ করে রাখা। তবে সেই সাথেই একেবারে ভেতরের দিকে একটা টেবিল আর তার উপর রং আর তুলি ছড়িয়ে আছে। দেয়ালময় রবি ঠাকুর থেকে শুরু করে আরো অনেক ছবি। টেবিলটার ওপারে দেয়ালে রুনুর আঁকা একটা নারীর ছবি যার দু’টো হাত গাছের শাখায় পরিনত হয়েছে। বোঝাই যায় ছবি আঁকানোটা শ্রেফ পেশাই নয় আরিফুল ইসলাম রুনুর নেশাও।
এখানে আসতেই হতো। রাজশাহীর রিকশা অলঙ্করণের এক সময়ের ব্যাস্ততম এবং মেধাবী শিল্পী রোবু পরবর্তী শিল্পীদের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন রুনুর আঁকার হাত অসম্ভব ভালো। শিল্পী রোবু অবশ্য এখন আর আঁকেননা, কিন্তু স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে রুনুর নামটা উঠে এসেছিলো। সাম্প্রতিক সময়ের আরেক জন রিকশার ছবির নামকরা শিল্পী মুজাহিদও রুনুর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। ১৯৯১ সালে রিকশার ছবি আঁকাতে শুরু করেন রুনু। রুনুর ছবি আঁকার নেশা সেই ছোটবেলা প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। দরগাপাড়ায় “রংধনু আর্ট” নামে একটা দোকানে শিল্পী আসাদ ছবি আঁকতেন। সম্ভবত সাইনবোর্ড বা এরকম বিজ্ঞাপন চিত্র। স্কুলে যাবার পথে আর ফেরার পথে এই দোকানটার সামনে এলেই তার পা থেমে যেতো। তন্ময় হয়ে দেখতেন শিল্পী আসাদের তুলি ধরা হাতের নাচন, আর সেই সঙ্গে রঙের খেলা। শিল্পী আসাদ রিকশার ছবিও আঁকতেন। ঠিক কবে থেকে ছবি আঁকা শুরু করেন তা রুনুর স্মৃতিতে নেই। যা কিছু হাতের কাছে পেতেন তাতেই কিছু একটা আঁকার চেষ্টা করতেন। আর শিল্পী আসাদের দোকানের সামনে একবার দাঁড়ালে আর নড়তে পারতেননা অনেক ক্ষণ।
পড়াশোনা কিন্তু বেশিদিন চলেনি। রাজশাহীর লোকনাথ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু অষ্টম শ্রেণীতেই পড়াশোনা থমকে যায়। কারণ সেই চিরাচরিত সাংসারিক দায়িত্বভার। বাবার মৃত্যুর পর তার ঘাড়েই এসে পড়ে সংসারের জোয়াল। এড়াতে পারেননি, হয়তো সম্ভবও নয়। কিন্তু নেশাটা যাবে কোথায়, ওটাই পেশা হয়ে দাঁড়ালো। রিকশার অলঙ্করণের পাশাপাশি কয়েকটা রিকশারও মালিক এখন। খুব ভালো প্রতিকৃতি আঁকতেন রুনু। রাজশাহীর প্যাডেল রিকশার যুগটাতে যখন বাংলাদেশী সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের স্থান ক্রমশ দখল করে ফেলছিলো ভারতীয় তারকারা তখন তিনিও এঁকেছেন সেসব ছবি। পুরনো প্যাডেল রিকশার পেছনে অনেক দিন সেসব ছবি দেখা যেতো। ক্যাট্রিনা কাইফ, রাণীমুখার্জী, সঞ্জয়দত্ত এক সময় প্রচুর এঁকেছেন। কিন্তু ২০১০ সালের দিকে ব্যাটারিতে চলা ইজিবাইকের প্রচলনের ফলে রিকশার ব্যবসাটা ঝিমিয়ে এলে নতুন রিকশা আর নামেনি। সেই সঙ্গেই রিকশার ছবি আঁকানোও গিয়েছিলো থমকে। সে সময়ে দু’একটা নতুন রিকশা রাস্তায় নামলেও কেউ ছবি আঁকানোর কথা, তা অলঙ্করণের কথা মোটেও ভাবতোনা। নিদেন পক্ষে মালিকের নাম লেখা হতো মাত্র, আর তা না হলে রিকশার টিনের ক্যানভাসটা খালিই পড়ে থাকতো। রুনুর হাতও থেমে যায় এ সময়। অন্য কিছু কিছু বাণিজ্যিক কাজের ছবি ছাড়া তিনিও আর বিশেষ আঁকেননি এসময়, রিকশার ছবিতো নয়ই।
২০১৩-১৪ সালের দিকে কিন্তু অবস্থাটা পাল্টে গেলো। প্রথমটা পুরনো কাঠ-বাঁশের রিকশার কাঠামোতেই মোটর সংযোজন হলো তারপর বিশেষ ভাবেই তৈরী হওয়া শুরু হলো হালকা ধাতব কাঠামোর নতুন রিকশা। এই নতুন রিকশা রাস্তায় নামতে থাকলে শিল্পী মুজাহিদই প্রথম আবার রিকশার ছবি আঁকানো শুরু করেন। অন্য আঁকিয়েরা অতোটা আশাবাদী ছিলেননা। তারা অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তখন। কেউ ট্রাক-বাসের অলঙ্করণে, কেউ বানিজ্যিক বিজ্ঞাপন চিত্রে আবার কেউ কেউ একেবারেই আঁকাআঁকির বাইরেই চলে গিয়েছিলেন। শিল্পী মুজাহিদ এ সময়ের একমাত্র এবং প্রধান শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। মোটর লাগানো রিকশা গুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠলে ব্যাপক ভাবেই রিকশা মালিকরা এই নতুন রিকশা কিনতে শুরু করলেন। সেই সাথেই ফিরে আসতে শুরু করলেন রিকশার ছবির শিল্পীরা। শিল্পী জামাল, সেরাজুল দেদারসে আঁকতে থাকলেন, সেই সাথে অন্যরাও। শিল্পী রুনু কিন্তু জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি অনেকদিন। এর কারণও ছিলো।
এই নতুন করে ছবি আঁকানোর সময়টাতে সামাজিক ভাবে ধর্মীয় প্রভাবের ফলেই শিল্পী মুজাহিদ সহ আরো অনেকেই ভাবতেন মানুষের ছবি, প্রাণীর ছবি আঁকানো উচিত নয়। অথচ এরাই এক সময় সিনেমার তারকাদের ছবি প্রচুর এঁকেছেন রিকশায়। মুজাহিদ নিজেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন নায়ক নায়িকার প্রতিকৃতি আঁকায়। কিন্তু তখন দেশে নতুন করে তরুণরা দাড়ি রাখতে শুরু করেছে, তরুণীরা বোরখায় নিজেদের মুড়ে নিতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গেই শুরু হয়ে ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধপরাধীদের বাঁচানোর হেফাজতি প্রয়াস। এর ফলে শুরুটায় কেবল গ্রামদৃশ্যের ছবিই আঁকা হচ্ছিলো রিকশায়। আরিফুল ইসলাম রুনুর হৃদয়ের ঝোঁকটা ছিলো মানুষের প্রতিকৃতি আঁকায় গ্রামদৃশ্যে তিনি স্পষ্টতই বিশেষ উৎসাহ পাচ্ছিলেননা। সে সময় এই মানুষের ছবি না আঁকানোর ব্যাপারটা তার সামনে তুললে কেবল হেঁসে নীরব হয়েই ছিলেন। ২০১৫ সালের দিকে আরিফুল ইসলাম রুনু হয়তো আঁকার নেশাতেই শ্রেফ আবার রংতুলি হাতে নেন। তিনিও আঁকলেন গ্রামদৃশ্য। অত্যন্ত দায়সারা গোছের সে ছবি। রাস্তায় যখনই দেখতাম তখন অবাক হয়ে ভাবতাম কি আঁকছেন এই মেধাবী শিল্পী। কিন্তু ঐ ধাঁচেই ঐ একই ছবি আঁকা চললো তার।
কিন্তু শিল্প উঠে আসে প্রাণ থেকে আর সেই প্রাণকে কে বেঁধে রাখবে। যে মুজাহিদ ভাবতেন প্রাণীর ছবি আঁকা ঠিক হচ্ছেনা তিনিও বাঘের ছবি আঁকলেন, ময়ুরের ছবি আঁকলেন। গ্রামদৃশ্যে নৌকায়, গরুর গাড়িতে যে ক্ষুদে মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছিলো তাই দিনকে দিন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করলো। অন্যরাও এ ঝোঁক এড়াতে পারেননি। সিনেমার দিন আর নেই। বাংলাদেশের সিনেমার তারকারা আর মানুষের মনে তাদের সেই একচ্ছত্র রাজত্ব নিয়ে থাকতে পারেননি, তাই তারকারা এলেননা কিন্তু সজীব প্রাণ চলেই এলো। বাঘ, হরিণ, ময়ুর, দোয়েল, পায়রা, ঈগলতো বটেই মানুষও চলে এলো।
বাজপাখির পাশেই নারীমুখের এক সময়ের জনপ্রিয় একটা পোস্টারের ছবিটাই রুনু আঁকলেন তার নিজের রিকশায়। হুডের কাজেও আঁকলেন জোড়া বাজ পাখি। এই আঁকাটা কিন্তু শুরু করলেন অনেক দেরিতে। এখনও তার ছবি খুব বেশি দেখা যায়না। তবে শৃঙ্খল আর জড়তাটা যে খসে পড়ছে তা বোঝা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে মোটর লাগানো রিকশার কাঠামোতেও আরেকবার পরিবর্তন এসেছে। এই নতুন রিকশা গুলোর চাকা ছোট এবং স্কুটারের চাকার মত, শক এ্যাবজরবারও আছে। এবং লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বলতে হয় এই রিকশা গুলো কিছুটা নিচু ফলে যাত্রীদের যেমন চড়তে সুবিধা হচ্ছে তেমন বেমক্কা উল্টে যাবার ভয়টাও কম। এগুলোও খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং শোনা যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ভেতরে আগের রিকশার সংস্করণটা জায়গা এই নতুন রিকশা গুলোই দখল করে নেবে। এই নতুন ধাঁচের রিকশার আগমনের সাথেই বেশি করে আঁকা হচ্ছে নতুন নতুন সব ছবি।
এরকমই কিছু নতুন ধাঁচের রিকশার পেছনে বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করলাম একটা প্রতিকৃতি। মানুষের প্রতিকৃতি। আমাদের সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের ছবি।
ঐতিহাসিক জেলহত্যার চার নেতার একজন রাজশাহীর প্রানপ্রিয় নেতা শহীদ কামারুজ্জামানের সুযোগ্য পুত্র এই খায়রুজ্জামান লিটন। তার মেয়র থাকাকালীন সময়ে রাজশাহীর চেহারাই পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি। অনেক অনেক দিন ধরেই রাজশাহী শহরের রাস্তা ঘাট গুলো অবহেলিত ছিলো, অবৈধ দখলদারদের দখলে সরু হয়ে পড়েছিলো। এই সাহসী নেতার সময়েই প্রধান প্রধান সড়ক গুলো প্রশস্ত করে তোলা হয়। আবর্জনা পরিস্কারের ব্যবস্থাতেও অভিনব ব্যবস্থা এনে শহরটাকে করে তোলেন আরো ঝকঝকে। রাজশাহীর উন্নয়নের ধারায় সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামানের অবদানের কথা তার বিরোধী পক্ষও স্বীকার করেন। এ হেন নেতার ছবি রিকশায় আঁকা হবে এটাই স্বাভাবিক। রিকশায় রাজনৈতিক নেতার ছবি আসাটাও একটা খবর বটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছাড়া আর কোন নেতার ছবি এভাবে রিকশায় এসেছে কি? হতে পারে কোন জেলায়, কোন অঞ্চলে আঁকা হয়েও থাকবে তাদের নিজস্ব নেতার ছবি কিন্তু এখন পর্যন্ত সে খবর আমাদের জানা নেই। তবে বলার কথাটা হলো এই সাবেক মেয়রের প্রতিকৃতির নিচেই যে স্বাক্ষরটা দেখা যায় তা আরিফুল ইসলাম রুনুর। রুনুর সব ছবির নিচেই স্বাক্ষর থাকে “রুনু আর্ট”। রুনুর এই ছবিটা দেখেই উৎসাহ জাগে। শিল্পীর ঘুম কি তবে ভাঙ্গলো? এই মেধাবী শিল্পী কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজের যোগ্যতা তৈরী করে নিয়েছে। শিল্পী আরিফুল ইসলাম রুনুর শৈল্পি ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু মাধ্যমটা ফোক আর্ট এখানে শিল্পীর সাথে সাথে সমাজের অংশ গ্রহণও অনেকটা অংশ জুড়ে থাকে। সমাজ নিজে নিজেকে মেলে ধরতে অক্ষম হলে, প্রতিবন্ধী হয়ে পড়লে শিল্পীর হাতও নিশ্চল হয়ে পড়ে। শিল্পী রুনুর তুলি ধরা হাতটা যেন আবার নিশ্চল না হয়ে পড়ে। শিল্পী আরিফুল ইসলাম রুনু আরো ছবি এঁকে চলুন, আগের জড়তা, স্থবিরতা কাটিয়ে ফিনিক্স পাখির মত জেগে উঠুক তার শিল্পী সত্ত্বা।
রিকশার ছবি নিয়ে আরো কিছু লেখা
রিকশার ছবি : ঐতিহ্যে ফেরা, না ফেরা
রাজশাহীর রিকশার ছবিতে ধর্মীয় মোটিফ
রাজশাহীর রিকশার ছবিতে চিত্রতারকারা (ছবি)
মুজাহিদের টিনের ক্যানভাস
টিনের ক্যানভাস
টিনক্যানভাসের এক বিস্মৃতপ্রায় শিল্প
হোয়াট শর্ট অব আর্ট ইজ রিকশা আর্ট
মন্তব্য
অনেক সুন্দর পোস্ট। এখনকার যুগে এসব লেখা খুব কমই পাওয়া যায়।
অনেক ধন্যবাদ আগ্রহ নিয়ে পড়ার জন্য।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আপনার এই লেখাটায় একটা মমতা টের পেলাম। পিতাসুলভ মমতা, হে হে হে।
---মোখলেস হোসেন।
ধন্যবাদ মোখলেসভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
ধন্যবাদ ঈয়াসীনভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
বাহ, চমৎকার পোস্ট তো।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য আর মন্তব্যের জন্য।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন