ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা বা সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তার সৃষ্টিও একটা চিত্তাকর্ষক বিষয়। প্রথমত সমাজের অস্ত্রধারী যোদ্ধা শ্রেণিই ক্ষমতাবান ও সম্পদশালী হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু তাদের সহায় হয়ে দাঁড়ালো পুরোহিত শ্রেণি যারা শুধু পুজো-আচ্চাই করতোনা সেই সাথে সমাজের বিপুল বঞ্চিত শ্রেণিটিকে সংযত রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করতো। তাদের এই কাজটা যোদ্ধা শাসক শ্রেণির জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠতে শুরু করলে এই পুরোহিত শ্রেণিটি নিজেদের সুবিধার আসন সেই শাসক শ্রেণির কাছ থেকেই আদায় করে নেয়। ব্রাহ্মণ্যধর্মের যে ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হলো তার সাথেই যুক্ত করে নেওয়া হলো বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাটাকে। ধর্মীয় বিশ্বাসটাকে অবলম্বন করে ব্রাহ্মণরা এমন একটা ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে সমর্থ হলো যেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষকে শাসক ও পুরোহিত শ্রেণির সম্পদ বৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত করা যায় কিন্তু বঞ্চিতদের বিত্তহীনতার জন্য যাতে বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ না ওঠে। অন্য দেশে কৃষিতে যেমন দাসশ্রমের ব্যাপক যোগান নিশ্চিত করতে হতো ভারতবর্ষে সে সমস্যা ছিলোনা। এখানে সমাজের বিশাল একটা অংশকে শূদ্র নাম দিয়ে অন্ত্যজ নাম দিয়ে নির্বিঘ্নে খাটিয়ে নেওয়া চলতো। বলা হতো যোদ্ধা ক্ষত্রিয় আর পুরোহিত ব্রাহ্মণদের সেবা করাটাই ঈশ্বরের আদেশ। এই আদেশ মেনে না চললে অমান্যকারীর ইহকালে এবং পরকালে কোনক্রমেই ভালো হবেনা।
জন্মান্তরবাদ বা কর্মফলের ধারণার বিস্তৃত প্রচার ও জনমনে এর প্রতিষ্ঠাই শূদ্র ও অন্যান্য অন্ত্যজ শ্রেণিকে বশে রাখার মোক্ষম হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এই জন্মান্তরবাদ অনুসারে মানুষ মৃত্যুর পর আবার এ পৃথিবীতেই জন্ম নেয়। পরের জীবনটায় সে পশুপাখি হয়ে জন্ম নিতে পারে অথবা মানুষ। আবার মানুষ জন্ম হলে সে ফের শূদ্র বা অন্ত্যজ শ্রেণিতেই জন্মাতে পারে অথবা ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়। তবে এটা নির্ধারিত হবে তার নিজের কর্মফলে। যে শূদ্র পর পর কয়েকটি জন্মে মুখ বুঁজে, নিষ্ঠার সাথে ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের সেবা করে গেছে কখনও তাদের বিরুদ্ধতা করেনি সে-ই কোন এক সময় ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় হয়ে জন্ম নিতে পারে। আর যে শূদ্র তা করেনি তাদের জন্ম নিতে হবে পশু যোনিতে আর এভাবেই সমাজের উচ্চবর্গের সেবার গাফিলতির প্রায়শ্চিত্ত তাকে করে যেতে হবে। ব্রাহ্মণ্য শ্রেণির রচিত ধর্মগ্রন্থ গুলিতে এই কথাই নানাভাবে নানা সময়ে প্রচার করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণ্য সমাজ আরেকটা লক্ষ্যে সফল হয়ে ওঠে আর তা হলো নারীর অবনয়ন। নারীকে তার আদিম শ্রদ্ধার আসন থেকে নামিয়ে তাকে অশক্ত, অবলা চরিত্রে রূপান্তরিত করা। ব্রাহ্মণ্য সমাজে নারীর অবস্থান কেমন ছিলো তার ছবিটা ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রেই উল্লেখ করা হয়েছে। সুকুমারী ভট্টাচার্য বলছেন, আমরা দেখেছি, সাধারণ ভাবে নারীর উপার্জন বা সম্পত্তির অধিকার ছিলনা। প্রাচীন গ্রন্থ শতপথ ব্রাহ্মণে (সম্ভববত ৮ম-৭ম খ্রীষ্টপূর্ব শতক) বলা হয়েছে পত্নীর সম্পত্তির উপরে কোন অধিকার নেই, এমন কি নিজের শরীরের উপরেও নয় (৪/৪/২/১৩)। শতপথ ব্রাহ্মণেই এর আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যজ্ঞে হবিকে পেটানো হয় লাঠি দিয়ে “তেমনি স্বামীও স্ত্রীকে পেটাবে, যাতে তার নিজের শরীর বা সম্পত্তির উপর অধিকার না থাকে” (সুকুমারী ভট্টাচার্য :২০১০; পৃ: ৫০)। এটাই সব নয়, নারীকে কি চোখে দেখা হতো আর দেখতে হবে তারও বর্ণনা বিরল নয়। নারীমাত্রই অশুভ প্রতীক গণ্য হতেন, যেমনটা ছিল কুকুর, শকুনির মতো অশুভ পাখি, বেজি, ইঁদুর ও শূদ্রের বেলায়। এদের মধ্যে যে কোন একটিকে হত্যাজনিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত ছিল সমান। তৈত্তিরীয় সংহিতা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছে, নারী কেবল মাত্র যৌন সম্ভোগের বিষয়; গোরু, জমি এবং নারীকে অতিমাত্রায় ব্যবহার করা ঠিক নয় – অন্যথায় তারা হয় মরবে নয়তো রুগ্ন হয়ে পড়বে (সুকুমারী ভট্টাচার্য :২০১০; পৃ: ১২৪)। শরশয্যায় মৃত্যু মুখে পতিত ভীস্ম, যুধিষ্ঠিরকে দুবার বলেন, নারীর চেয়ে পাপিষ্ঠ কেউ নয়। তিনি বলেন- অন্তক, শমন, মৃত্যু, পাতাল, বাঢ়বানল, ক্ষুরের ধার, বিষ, সর্প, অগ্নি – এই সব কিছু একত্রে একটি নারীর সমান (সুকুমারী ভট্টাচার্য :২০১০; পৃ: ৯৪)।
প্রাগৈতিহাসিক আদিম সমাজটায় মাতার যে কেন্দ্রীয় চরিত্রটা ছিলো, যে প্রভাবটুকু ছিলো এখনকার এই ব্রাহ্মণ্য সমাজে তার অবস্থাটা কেমন দাঁড়ালো সে সম্পর্কে সুকুমারী ভট্টাচার্য তথ্য দিচ্ছেন, শিশুর আবির্ভাবের জন্য সে (মাতা) অত্যাবশ্যক, কিন্তু শিশু তার পিতার, যার একটি প্রার্থনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য : “ আমার থেকে জন্ম, অঙ্গ থেকে অঙ্গ, তুমি আমার হৃদয় থেকে জন্মেছ, পুত্র, তুমি আমারই স্বরূপ।” এখানে ভ্রূণের বৃদ্ধির ব্যাপারে মায়ের অবদান সম্পূর্ণ অবজ্ঞাত, এবং শিশুর মানসিক বৃদ্ধির বিষয়ে তার ভূমিকার কোন স্থানই নেই। এতে তার সঙ্গে শিশুর মানসিক যোগসূত্রও ছিন্ন করা হয়, অন্তত ভাবগত ভাবে, নবজাতকের হৃদয় শুধু তার পিতার এ কথা দাবী করে। মা সম্পূর্ণরূপে অবহেলিত। ক্ষেত্র যেমন ফসল উৎপাদন করে, কিন্তু তার উপর তার অধিকার নেই, তা ভোগ করতেও পারেনা, তেমনি মাকে দেখা হতো তেমনি অসার, ভাষাহীন ভাবে, তাই ফসল তোলার পর অনায়াসে তাকে ভুলে যাওয়া যেত (সুকুমারী ভট্টাচার্য :২০১০; পৃ: ৩১)।
কিন্তু মাতার যে সম্মান ইতিহাসের আগের পর্যায়টিতে ছিলো তাতো একেবারে ভুলে যাওয়া বা ভুলিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই দেখি বলা হচ্ছে পুত্রের কাছ থেকে সম্মান মাতার প্রাপ্য। “অধ্যাপক দশ শিক্ষকের সমান, পিতা হতো অধ্যাপকের সমান এবং মাতা সম্মানে সহস্র পিতার অধিক।” “ মাতাকে শ্রদ্ধা করলে পৃথিবী জয় করা যায়, পিতাকে শ্রদ্ধা করলে অন্তরীক্ষ জয় করা যায় এবং গুরুকে শ্রদ্ধা করলে ব্রহ্মলোক জয় করা যায়।” “পুত্র মাতার সেবা করবে, যদি মাতা সমাজ পরিত্যক্তা হয় তাহলেও, কারণ তারই জন্য মাতা বহু কষ্ট সহ্য করে।” “পুত্র মাতাকে ভরনপোষণ করবে, মাতা সমাজ পরিত্যক্তা হলেও, তবে তার সঙ্গে কথা বলবে না।” “সমাজ পরিত্যক্ত পিতাকে ত্যাগ করা যায়, কিন্তু মাতাকে নয়। মাতা কখনও পুত্রের পরিত্যাজ্য নয়।” এখানেই শঙ্খ ও লিখিত বলেছেন, “পুত্র পিতামাতার বিবাদে কোন পক্ষ অবলম্বন করবেনা, যদি করে, তবে মাতার পক্ষই নেবে, কারণ মাতাই তাকে গর্ভে ধারণ প্রসব ও লালন পালন করেছে।” পুত্র মাতার ঋণ থেকে কখনোই মুক্তি পায়না, একমাত্র মুক্তি পায় যদি সে (জটিল ও প্রচুর অর্থ সাপেক্ষ) সৌত্রামণি যাগ করে। “কোন গুরুই মাতার চেয়ে উচ্চ নয়।” পাণ্ডবেরা বলেন, “অন্য সব অভিশাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়, মাতার অভিশাপের থেকে মুক্তি নেই।” “তখনই কেবল তার বার্ধক্য আসে, তখনই কেবল তার শোক হয়, তখনই কেবল তার জগৎ শূন্য হয়ে যায়, যখন কেউ তার মাকে হারায়।” অজাতশত্রু তাঁর পিতাকে তাঁর আদেশ অমান্য করে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তার মাতাকে হত্যা করতে চাইলে তাঁর মন্ত্রীরা তাঁকে বলেন : “১৮,০০০ মন্দ রাজার বিবরণ পাওয়া যায় যাঁরা পিতৃহন্তা। কিন্তু মাতৃহন্তার কোন বিবরণ মেলেনা।” কিন্তু পরশুরাম তাঁর পিতার আদেশে মাতাকে হত্যা করেছিলেন, যদিও পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রথম বরে তিনি মাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন” (সুকুমারী ভট্টাচার্য :২০১০; পৃ:২০-২১)।
এখানে অবশ্য কেবল পুত্রের কাছে মাতার গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হচ্ছে সার্বিক অর্থে সামাজিক ভাবে মাতার অবস্থানটি সম্পর্কে তেমন ইতিবাচক কিছু নেই। সুকুমারী ভাট্টাচার্যও বলছেন, দুটি ভাবগত অসাধারণ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে। প্রথমটা হলো “মাতা সহস্র পিতার সমান” এই ধরনের বক্তব্য। যে শারীরিক জনন ছাড়া পিতা তাঁর সম্পত্তি হিসেবে পুত্রকে পান না, এ সেই তথ্যেরই উদ্দেশ্যে স্তুতি। কতকটা ক্ষতিপূরণও বটে, কারণ আরও উক্তি আছে, “মাতৃভক্তির দ্বারা পুত্র পৃথিবী লাভ করে, পিতৃভক্তির দ্বারা স্বর্গলাভ করে”। এর মধ্যে পিতা-মাতার ভিতরে সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য পরিস্ফুট হয় (সুকুমারী ভট্টাচার্য :২০১০; পৃ: ৩১)। সুকুমারী ভট্টাচার্য বলছেন স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রেরা ধর্মগত ভাবে মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিত। কিন্তু তার স্বামীর জীবদ্দশাতেও যেহেতু সে সামাজিক সম্মান অল্পই পেত, তাই পুত্রেরা যে তাকে সম্মান দেখাতে বাধ্য ছিলনা, এমন অনুমান কিছু উদ্ভট নয়। এটাই প্রাচীন ভারতের মাতৃত্বের প্রধান ব্যাঙ্গাত্মক দিক। (সুকুমারী ভট্টাচার্য :২০১০; পৃ: ৩০)
ইতিহাসে এ পর্ব পর্যন্ত এসে আপাত দৃষ্টিতে পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বিজয় সম্পূর্ণ হয়েছে বলেই ধরতে হয়। কিন্তু তারপরও ব্রাহ্মণ্য শাসনে শাসিত সমাজের ভিতরেই দেখা যাচ্ছে এমন সব উপাদান যাকে পদানত করেই নাকি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অতুল সুর বলছেন, ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশের পূর্বে বাঙলাদেশে বাঙলার আদিম অধিবাসীদের ধর্মই অনুসৃত হত। মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, বিবিধ ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া ও মন্ত্রাদি, প্রকৃতির সৃজনশক্তিকে মাতৃরূপে পূজা, লিঙ্গ পূজা, কুমারী পূজা, ‘টটেম’-এর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং গ্রাম, নদী, বৃক্ষ, অরণ্য, পর্বত ও ভূমির মধ্যে নিহিত শক্তির পূজা, মানুষের ব্যাধি ও দুর্ঘটনা সমূহ দুষ্ট শক্তি বা ভুতপ্রেত দ্বারা সংঘটিত হয় বলে বিশ্বাস ও বিবিধ নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপক অনুশাসন ইত্যাদি নিয়েই বাঙলার আদিম অধিবাসীদের ধর্ম গঠিত ছিলো। কালের বিবর্তনে এই সকল বিশ্বাস ও আরাধনা-পদ্ধতি ক্রমশ বৈদিক আর্যগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিলো, এবং সেগুলি হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্মে পরিণত হয়েছিল (অতুল সুর;২০০৮;পৃ:৮৪)। এ না হয় গেলো আর্যদের প্রাক-আর্য যে আদিবাসী সমাজ গুলোকে বিজিত করে, পদানত করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়টার কথা যখন প্রাক-আর্য সংস্কৃতির কিছু কিছু নিদর্শন ব্রাহ্মণ্য সমাজে থেকে যেতেই পারে। কিন্তু এই আর্য বিজয়ের পর কয়েকশো বছর পরও যখন দেখি সাধারন মানুষের সমাজে, সংস্কৃতিতে আদিবাসী সংস্কৃতির প্রভাব তখন তাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যাঁতা তলে সে সংস্কৃতিতো বিলীন হয়ে যাবার কথা। কিন্তু আমরা দেখি তা হয়নি।
কার্যত ব্রাহ্মণ্য পুরুষ দেবতাদের আধিপত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বিষ্ণুর উপাসনা ক্রমেই প্রাধান্য লাভ করেছে দেখি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহাদেব একাধারে সৃষ্টি স্থিতি আর প্রলয়ের দেবতা বলে পরিচিত হয়ে উঠলো। দেবীদের মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে রইলেন কেবল মহাদেব পত্নী উমা-পার্বতী। পুরান আর শাস্ত্র গ্রন্থ গুলোতেও পুরুষ দেবতাদের কথাই অনেক খানি স্থান অধিকার করে নিয়েছিলো। এই ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির জয়যাত্রায় ক্রমান্বয়ে নারীদেবতাদের কিন্তু বিলীন হয়ে যাবারই কথা। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম প্রচুর নারী দেবতা সমাজে পুজো পাচ্ছে। তাদের নিয়ে পাঁচালি রচিত হচ্ছে। সেই পাঁচালি সাত দিন ধরে উৎসব অনুষ্ঠানের সহযোগে ভক্তরা শুনছে। বিপদে আপদেতো বটেই সৌভাগ্য কামনায়, জীবিকায় দৈব সহযোগিতার কামনায় এই দেবীদের পায়েই ফুল চড়াচ্ছে। নারী দেবতা মানেই যে আদিবাসীদের দেবতা তা নয় কিন্তু পূজা আচারের মধ্যে যাদুবিশ্বাস মূলক চরিত্র, বরদানের দৃঢ়তা এবং পুরুষ বা স্বামী সঙ্গিবিহীন একাকিনী থাকা এই উপদান গুলো মোটের উপর নির্দেশ করে এই দেবীদের আবির্ভাব হয়েছে আদিবাসীদের সমাজ থেকেই। যেমন মনসা, চণ্ডী, ষষ্ঠী, শীতলা সহ আরো গ্রাম্য সব দেবী। অতুল সুর ষষ্টী পূজা সম্পর্কে বলছেন, অরণ্য ষষ্ঠী যে একসময় অরণ্যেই পূজিত হতেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এ সম্বন্ধে যে উপাখ্যান আছে, তা থেকেও তাই প্রমাণ হয়। বাঙলার দুটি জনপ্রিয় লৌকিক উৎসব হচ্ছে জামাই ষষ্ঠী ও ভাইফোঁটা। অরণ্য ষষ্ঠীর দিনই জামাই ষষ্ঠী। বলাই বাহুল্য, এই দুই অনুষ্ঠানেই পুরোহিতের কোন ভূমিকা নেই। মেয়েরাই এতে অংশ গ্রহণ করে। অগ্রহায়ণ মাসে প্রতি রবিবারে মেয়েরা যে ইতুপূজা করে, তাও পুরোহিত ব্যতিরেকে মেয়েরাই করে থাকে। এটাও যে আদিম সমাজ থেকে গৃহীত হয়েছে তা ইতুপূজা সম্পর্কে যে উপাখ্যান আছে, তাতে উমনো-ঝুমনো, এই নাম দুটি থেকেই প্রকাশ পায় (অতুল সুর;২০০৮;পৃ:৯০)। বোঝা যাচ্ছে এই ষষ্ঠী কোনক্রমেই ব্রাহ্মণ্য বলয়ের দেবী নন। কিন্তু তাতে করে এই দেবীর পূজার বিস্তার ঘটতে বাধা হয়নি। একুশ বা ত্রিশ দিনে ষষ্ঠীপূজা করার প্রথা প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত। অন্নপ্রাশন প্রভৃতি শুভকাজে, সকল কাজের আগে ষষ্ঠীর পূজা করা হয়। তাছাড়া, বছরের বিভিন্ন মাসে নানা নামে ষষ্ঠী ঠাকরুনের পূজা করা হয়। যেমন, বৈশাখ মাসে চন্দন ষষ্ঠী, জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী, আষাঢ় মাসে কার্দমী ষষ্ঠী, শ্রাবণ মাসে নোটন ষষ্ঠী, ভাদ্র মাসে চাপড়া ষষ্ঠী, আশ্বিন মাসে দুর্গা ষষ্ঠী, কার্তিক মাসে নাড়ি ষষ্ঠী, অগ্রহায়ণ মাসে মূলা ষষ্ঠী, পৌষ মাসে গুহ ষষ্ঠী, মাঘ মাসে শীতলা ষষ্ঠী, ফাল্গুন মাসে গো ষষ্ঠী ও চৈত্র মাসে অশোক ষষ্ঠী (অতুল সুর;২০০৮;পৃ:৮৯-৯০)। এছাড়াও ষষ্ঠী তিথি ছাড়া অন্য কোন দিনেও ষষ্ঠী পূজার প্রচলন আছে। যেমন অগ্রহায়ণ মাসের শুক্ল প্রতিপদে হরি ষষ্ঠী, চৈত্র মাসে সংক্রান্তির পূর্বদিনে নীল ষষ্ঠী। নদীয়া জেলায় হরি ষষ্ঠীতে কাঁচাঘট পূজা করা হয়। নীল ষষ্ঠীতে মেয়েরা উপবাস করে ও সন্ধ্যায় শিবের পূজা দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করে (অতুল সুর;২০০৮;পৃ:৯০)।
খাঁটি ব্রাহ্মণ্য সমাজের দেবী না হয়েও সমাজে ষষ্ঠী দেবীর প্রভাব কম ছিলোনা। পল্লব সেনগুপ্ত এধরণের দেবীদের সম্পর্কে বলছেন, ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে ঐ প্রাগৈতিহাসিক মাতৃকা-উপাসনার ধারা শুধু বহমান নেই, শতাব্দীর পর শতাব্দী সেই ধারা হিন্দু ধর্মের অন্তর্লীন মাতৃকাতন্ত্রের বহুতোয়া স্রোতস্বিনীকে পরিপুষ্ট করে আসছে। এই আদিবাসীদের উপাস্যা মাতৃকা-দেবীরা বহু সময়েই হিন্দু ধর্মের মণ্ডপে সমাসীনা হয়েছেন; যেমন প্রাচীন দ্রাবিড় সর্পদেবী মনচাম্মা এবং বৃক্ষদেবী চেম্মুডু সমন্বিত হয়ে আর্য-প্রাধান্য-পরবর্তীকালে সৃষ্ট হিন্দু ধর্মের লোকায়ত ধারায় এসে মনসা হয়েছেন। পরে তার ওপরে একটা পৌরাণিক প্রলেপ বুলিয়ে শিবের কন্যা বলে প্রচার করা হয়েছে। ওরাওঁদের গোধিকাসনা চান্দী এইভাবে পরিণতি লাভ করেছেন মঙ্গলচণ্ডীতে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে বর্ণিত চণ্ডীর সঙ্গে তাকে মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং নিগ্রোয়েড নৃ-গোষ্ঠীর উপাসিতা এই সব দেবীরা নানা নামে অজস্র সংখ্যায় ছড়িয়ে রয়েছেন ভারতবর্ষের অরণ্য, পর্বতে: বুড়ুবুড়কি, ডোম্ব, গাড়াবা, বিলি মাগগা, দারজি, গঙ্গাডিকারা, ওককলু, গোল্লা, হান্দি, হালিকার, ওককালিগা, হেলেভা, হোলেইআ, ইড়িগা – অসংখ্য নামে (পল্লব সেনগুপ্ত, ২০০১;পৃ:৭১)। অতুল সুরও সেই একই কথা বলেছেন মনসা পূজা সম্পর্কে। তিনি বলছেন, লৌকিক পূজা হিসাবে এঁর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য বাঙলাদেশে যে মঙ্গলকাব্য সমূহ রচিত হয়েছিল, তা থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে মনসাপূজা আদিবাসী সমাজ থেকেই গৃহীত হয়েছিল। কেননা, মনসামঙ্গল কাহিনীতে লখীন্দরের জন্য যে বাসগৃহ নির্মিত হয়েছিল, তা সান্তালী পাহাড়ের ওপর। এর দ্বারা বীরভূমের পশ্চিম অঞ্চলে সাঁওতাল পরগনাই সূচিত হচ্ছে (অতুল সুর;২০০৮;পৃ:১৩৭)। বজ্রযানী বৌদ্ধ সমাজেও জাঙ্গুলী নামে এক সর্প দেবীর পূজা, সাধনা, মন্ত্রাদি বহুল পরিমাণে প্রচলিত ছিল। সর্পদংশন হতে রক্ষা করতে এবং সর্পদংশন করলে তার বিষ নষ্ট করতে জাঙ্গুলী ছিল অদ্বিতীয়া। জাঙ্গুলীর নাম শুনলে সাপ পালিয়ে যায়, এ বিশ্বাস সেকালের বৌদ্ধদের ছিল। তাঁর নাম করলে সাপের বিষ শরীরে সঞ্চারিত হয়না বলেও তাদের বিশ্বাস ছিল। জাঙ্গুলীর মূর্তি নানা রূপে করা হয়েছিল। তাঁর রঙ কখনও সাদা, কখনও হরিৎ, আবার কখনও পীত হত। বৌদ্ধদের মন্ত্র থেকে বুঝতে পারা যায় যে, জাঙ্গুলীর উপাসনা আদিবাসী সমাজ থেকে গৃহীত হয়েছিল। কেননা, নিম্নস্তরের সমাজে সাপের ‘রোজা’রা যে সকল মন্ত্র উচ্চারণ করে, এ মন্ত্র তার অনুরূপ (অতুল সুর;২০০৮;পৃ:১৩৭)।
হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় শবরোৎসব সম্পর্কে তথ্য দিতে গিয়ে বলছেন, কালিকা পুরাণে বিজয়ার অন্য নাম শবরোৎসব। শবর জাতি প্রতিমা বিসর্জ্জন দিয়া নৃত্যগীত করিয়াছিল, উৎসবে মাতিয়াছিল। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য তাহাই প্রধান্য লাভ করায় হয়তো বিজয়ার নাম নাম শবরোৎসব হইয়াছে। কালিকা পুরাণ – আসাম-কামরূপের পুরাণ। প্রাচীনকালে আসামেরই একাংশ মহাচীন নামে অভিহিত হইত। শবর, পুলিন্দ, কবচ (কোচ) প্রভৃতি জাতি আসামের অধিবাসী ছিল। তাহাদের কোন আচার-অনুষ্ঠান বিজয়ার সঙ্গে জড়িত থাকা অসম্ভব নহে। কালিকা পুরাণে দেবীর বিসর্জ্জন সময়ে অশ্লীল শব্দোচ্চারণের সুস্পষ্ট বিধি আছে। নৃত্য-গীত জলক্রীড়াদিও উৎসবের অঙ্গ। যৌবনে বহু পল্লীগ্রামে দেখিয়াছি – কোথাও মহাষ্টমী মহানবমী সন্ধি বলিদানের পর, কোথাও নবমী পূজার দিন বলিদান শেষ হইয়া গেলে তথাকথিত ইতর-ভদ্র সকলে মিলিয়া একটি নির্দ্দিষ্ট রাস্তা দিয়া বা কোন নির্দিষ্ট পাড়ায় গিয়া অশ্লীল গান গাহিয়া নাচিয়া বেড়াইতেছে। প্রকাশ্য দিবালোকেও এ জন্য কাহাকেও লজ্জিত হইতে দেখি নাই। বহুদিন হইল এসব নাচ-গান বন্ধ হইয়া গিয়াছে। তবে দূর পল্লীগ্রামে কোথাও এখনো এই প্রথা চলিত আছে কিনা জানিনা (হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ১৯৯৯; পৃ: ৮৫-৮৬)।
যার নাম দুর্গা তাঁরই নাম শাকম্ভরী। ফলে দুর্গোৎসবের সঙ্গে ফসলের সময়টা যোগাযোগ থাকাই স্বাভাবিক এবং তা আছেও। দুর্গোৎসব হলো শারদীয় উৎসব – ডালা যখন পাকা ফসলে ভরে ওঠবার সময় ঘনিয়ে আসে। দুর্গাপূজার একটি প্রধান অঙ্গ হলো নবপত্রিকা পূজা। এবং শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করছেন, এই অনুষ্ঠানটি দুর্গাপূজার কৃষি-পর্যায়েরই স্মারক। কেননা, নবপত্রিকার ঘটের উপর রম্ভা, কচ্চি, হরিদ্রা, জয়ন্তী,বেল, ডালিম, অশোক, মান ও ধান্যের পাতা সাজানো হয়। এবং যেটা বিশেষ করে লক্ষ্য করার বিষয়, এই ন’টি উদ্ভিদের প্রত্যেকটিরই অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয় এক একটি দেবী। এখানেও উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে দেবীমাহাত্ম্যের একটা যোগাযোগ চোখে পড়ে। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ আরো দেখাচ্ছেন, শাকম্ভরী বলেই দুর্গা হলেন অন্নদা বা অন্নদাতা। অন্নপূর্ণা নামটির তাৎপর্যও নিশ্চয়ই এই দিক থেকেই বুঝতে পারা যায় (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ: ৩৫৭-৩৫৮)। দেবী রহস্যের সঙ্গে উদ্ভিদ জগতের সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ ইতিপূর্বেই কিছু কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছেন; সেগুলি থেকেই আলোচনা শুরু করা যায়। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী নিজেই বলছেন: অনন্তর বর্ষাকালে নিজদেহ সমুদ্ভূত প্রাণধারক শাকের সাহায্যে আমি সারা জগতের পুষ্টি সরবরাহ করবো। তখন আমি শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হবো। দেবীর এই শাকম্ভরী নামটা নিশ্চয়ই চিত্তাকর্ষক। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ তর্জমা করেছেন, herb bearing বা herb nourishing। কিন্তু তার চেয়েও চিত্তাকর্ষক হলো ‘আত্মদেহসমুদ্ভবৈঃ’ বিশেষণটি। এই বিশেষণের মূলে এক অতি প্রাচীন বিশ্বাস চাপা পড়ে আছে এবং হরপ্পার ধুলো সরিয়ে সে বিশ্বাসের এমন কি একটি মূর্ত নিদর্শন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।সে নিদর্শন সম্পর্কে স্যার জন মার্সাল বলছেন, হরপ্পায় একটি পরমাশ্চর্য সিল আবিস্কার হয়েছে। তার এক পিঠে দেখা যায় একটি নগ্ন নারীমূর্তি। এই নারীর দুটি পা দু’পাশে সরানো এবং তার গর্ভের ভিতর থেকে একটি লতা গজিয়েছে (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩; পৃ: ৩৫৬-৩৫৭)।
হরপ্পার প্রত্ন নিদর্শন
নীরদচন্দ্র চৌধুরীও বলেছেন, এই বৃহত্তর সমাজের যে চিত্র আমরা সমসাময়িক ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হইতে পাই, উহা একটা শিশুসুলভ, “প্রিমিটিভ” সমাজের চিত্র।… উহা একটি ‘ফোক সিভিলাইজেশ্যন,’ গ্রাম্য সংস্কৃতিমাত্র, উহাকে পুরাতন হিন্দু সভ্যতার অপরিণত তদভব রূপ বলা যাইতে পারে, কিন্তু অনুবৃত্তি কিছুতেই বলা চলেনা (নীরদ চৌধুরী: ১৯৯০; পৃ:২৮-২৯)। এই ‘প্রিমিটিভ’ সমাজের সাংস্কৃতিক উপাদান গুলো ব্রাহ্মণ্য সমাজের মধ্যে ঢুকে পড়লো কি করে। প্রথম যখন ব্রাহ্মণ্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তখন যাদের শূদ্র ও অন্ত্যজ শেণি নাম দিয়ে কায়িকশ্রমের দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তাদের যে সংস্কৃতি এবং ‘প্রিমিটিভ’ আচার অনুষ্ঠান তা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের শক্তিশালী প্রভাবে মুছে যাবার কথা ছিলো। অথবা পরবর্তী যুগ গুলোয় তা অনেক খানিই নিস্প্রভ হয়ে যাবার কথা কিন্তু তা হয়নি। ব্রাহ্মণ্য শাসন প্রতিষ্ঠার কয়েকশো বছর পরও সমাজে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক উপাদান গুলো দেখি বিপুল বিক্রমে রাজত্ব করেছে।
(চলবে)
তথ্যসূত্রঃ
১. প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ : সুকুমারী ভট্টাচার্য, ২০১০। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা;
২. বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন : ড. অতুল সুর, ২০০৮। সাহিত্যলোক, কলকাতা; ৪র্থ সংস্করণ ।
৩. আত্মঘাতী বাঙালী : নীরদচন্দ্র চৌধুরী, ১৯৯০। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স; কলকাতা। ৫ম মুদ্রণ।
৪. পূজা পার্বণের উৎসকথা : পল্লব সেনগুপ্ত, ২০০১। পুস্তক বিপনি; কলকাতা। তৃতীয় সংস্করণ ।
৫. লোকায়ত দর্শন : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ১৩৬৩ ব.। নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
৬. গৌড়বঙ্গ সংস্কৃতি : হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ১৯৯৯। পুস্তক বিপনি; রজতজয়ন্তী বর্ষ প্রকাশন। কলকাতা।
ছবির লিঙ্ক:
হরপ্পার প্রত্ন নিদর্শন
আগের পর্ব গুলোর লিঙ্ক:
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : প্রথম পর্ব
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : দ্বিতীয় পর্ব
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : তৃতীয় পর্ব
মন্তব্য
কিছুদিন আগে শশী থারুরের "ইনগ্লোরিয়াস এম্পায়ার" পড়ে বেশ চমৎকৃত হয়েছি। সেখানে নিকোলাস ডার্কস-এর "কাস্টস অফ মাইন্ড"-এর সূত্রে থারুর লিখেছেন, এই ব্রাহ্মণশাসিত সমাজ ধারণাটা ইংরেজ শাসনের প্রত্যক্ষ ফল। শাস্ত্রে বহু ধুনফুন থাকলেও ভারতবর্ষ নাকি কখনোই চতুর্বর্ণের ঐ অনড় কাঠামোতে বাড়েনি। রাজশক্তি কমবেশি ক্ষত্রিয় ছিলো, যারা বৈশ্য বণিকদের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল থাকতো বেশির ভাগ সময়। ক্ষমতা এদের হাতেই বরাবর থাকতো। ব্রাহ্মণ এ রাজনৈতিক শক্তির আনুকূল্যে থাকতো, শূদ্রেরা কৃষি ও শিল্পে শ্রম যোগাতো। (কিছুদিন আগে আরেকটা লেখায় পড়লাম, বৈশ্য শব্দটি এসেছে ঋগ্বেদীয় ভাষা "বিশ" থেকে, যার অর্থ কেউ করেছেন বসতিস্থাপক [Settlers], কেউ করেছেন অগ্রচারী [Pioneers]। যে আমলে এ বিশ গোষ্ঠী পূর্বপারস্য থেকে পশ্চিম ভারতে আসে এবং রয়ে যায়, সে আমলে বিদ্যা-যুদ্ধ-কৃষি-ছুটাকাম সবকিছু সবাই করতো। পরবর্তীতে সমাজে উদ্বৃত্ত ধন বাড়তে থাকলে এবং অনার্য গোষ্ঠীসমূহ সমাজে একীভূত হতে থাকলে পেশানুগ বিভাজন শুরু হয়, এবং বৈশ্যরাও তখন তাদের করণীয় কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্যের মাঝে প্রথম দুটিকে ত্যাগ করে শূদ্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে পুরোদস্তুর বণিকবৃত্তিতে নেমে পড়ে।)
কিন্তু ইংরেজরা যখন মুসলমানদের হাত থেকে বাংলা দখল করে, তখন তারা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সাহচর্য পায়। ভারতবর্ষের সামাজিক রীতি কেমন, এ প্রশ্নের জবাবে এ ব্রাহ্মণগোষ্ঠী তখন একটি অনড় ব্রাহ্মণপ্রধান শাস্ত্রীয় রীতি উপস্থাপন করে, যেটা বাস্তব থেকে হাজার বছর ধরে দূরে। সংস্কৃত বিবাদার্ণবসেতু নামে একটি শাস্ত্র থেকে প্রথমে ফারসিতে, পরে ইংরেজিতে জেন্টু কোড অনূদিত হয় ওয়ারেন হেস্টিংসের উৎসাহে। এটির আদলে আইন প্রণয়ন করে ইংরেজরা ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের একটি কট্টর সংস্করণকে মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। থারুর দুয়েকটা উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন, কী করে ইংরেজপূর্ব ভারতে একজন শূদ্র চাইলে ভিন্ন এলাকায় গিয়ে শূদ্রত্বের সমস্যা এড়িয়ে জীবন চালাতে পারতো, কিন্তু বৃটিশ ভারতে সে একজন সর্বভারতীয় সার্বক্ষণিক শূদ্রে পরিণত হয়। বর্ণপ্রথা, নিকোলাস ডার্কসের গবেষণার সূত্রে থারুরের প্রস্তাবমতে, একটি ঔপনিবেশিক পুনর্নির্মাণ। কাস্টস অফ মাইন্ড বইটা পড়া শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ করিনি। কেউ যদি বইটা পুরোটা পড়ে সচলে লেখেন, খুব ভালো হয়।
কর্ণাটকী সেনরা ছাড়া আর কোনো রাজশক্তি কি বাংলায় কট্টর ব্রাহ্মণমাথায়তোলা শাসন বলপ্রয়োগ করে খাটিয়েছে? পুরনো নানা বাংলা কাব্যে যে সমাজের চেহারা পাওয়া যায়, সেখানে কিন্তু পুরুত-মৌলবিদের উৎপাত থেকে প্রায় মুক্ত স্বাধীনচেতা মেয়েদের পরিচয়ই ফুটে ওঠে। মেয়েরা সেখানে যুদ্ধ, ক্রীড়া, তর্ক, রাজনীতি সবকিছুতেই অংশ নিচ্ছে, এমন বর্ণনা নানা জায়গায় আছে। ডার্কস-থারুর প্রস্তাবটা তাই একেবারে অমূলক মনে হয় না।
শশী থারুরের লেখা পড়বো ভাবছি, পড়া হয়নি। আপনার মন্তব্যের এই মজা নতুন নতুন বইয়ের খবর জানা যায়। শশী থারুরের কয়েকটা বই ডাউনলোড করলাম। এখন পড়ার সময়টা পেলেই হয়, ওটাই কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। হিমু ভাই আমারও ধারনা ব্রাহ্মণরা যেভাবে উপস্থাপন করেছে সমাজটা অতখানি সুচারু ভাবে চলতোনা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
এই জন্যই শাস্ত্রের মধ্যে বাস্তবতা খোঁজাটা সম্ভবত খুব নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি না - সেটা অতীত বা বর্তমান যাই হোক। অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয় শাস্ত্রের বহু কথাবার্তাই আসলে শামানদের গোপন ও অপূর্ণ অবদমিত আকাঙ্ক্ষা বা মানসিকতার বাহ্যিক প্রোজেকশন, যার সাথে বাস্তবতার পুরোপুরি মিল থাকে না। অনেক সময় কল্পনায় পোলাও খাওয়ার মত হয়ে যায়। এইসব প্রোজেকশন হয় বাস্তবতাকে বিকৃত করে, নয়তো ওভারলে হয়ে তাকে ঢেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এসব ক্ষেত্রে অন্য সূত্রের অভাব থাকলে প্রোজেকশনের পাশাপাশি প্রোজেকটর ও তার মেকানিজমের দিকেও তাকালেও সত্যের খানিকটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে।
এটা কেন জানি আরও বেশি করে সত্য হয়ে উঠে মেয়েদের বেলায়। এ যুগে হোক, সে যুগে হোক, নারী দেখলেই শামানদের দৈবাবাণীর পরিমান অনেক বেড়ে যায়। এইসব সময় কখনও যদি প্রোজেকশন আর প্রোজেক্টর দু'টোকেই একসাথে দেখার ও দৈববাণী শোনার সুযোগ হয়, দেখবেন প্রোজেকশনের বিবরণ একরকম, অথচ প্রোজেক্টরের চেহারা সেই বিবরণের সাথে একেবারেই সাঙ্ঘর্ষিক বা বেমানান!
****************************************
- ঠিক বলেছেন।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
শশী থারুর তো অজ্ঞ লোক নন্, তিনি কিছু সত্যের অপলাপ করে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়েছেন, কিছু বিষয়কে অতি সরলীকরণ করেছেন। তাতে ইতিহাসটা পালটে যাবে না।
ব্রাহ্মণরা এই দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল না বটে, কিন্তু সমাজ তারাই চালাতো। ব্যাপারটা বর্তমান সৌদী আরবে আল-সৌদ রাজপরিবার (ক্ষত্রিয়) আর ওহাবী মোল্লাদের (ব্রাহ্মণ) জোটের মতো। এক পক্ষ রাষ্ট্র চালায়, যুদ্ধ করে, বেশিটা ভোগ করে; অপর পক্ষ আইন বানায়, বিচার করে, সমাজ চালায়, কলাটা মুলাটা জরিমানার অর্থটা ভোগ করে। সৌদী আরবে বণিক বৈশ্য শ্রেণী এবং বিদেশী শ্রমিক নামক শুদ্র শ্রেণীও আছে।
এই দেশে আর্য্যদের আগমনের পরে মাথাপাকা আর্য্য পণ্ডিতরা একটু একটু করে বর্ণাশ্রম শাস্ত্র আর সমাজ নির্মাণ করেছে। ব্রিটিশ আমলে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা বরং ঔপনিবেশিক শক্তি, নব্য সামন্তদের দল, উঠতি পুঁজিপতিদের দল, বাইরের জগতে সহজ সংস্পর্শ ইত্যাদির কারণে টলোমলো হয়ে পড়ে। ফলে ধর্মীয় সংস্কারকের ছদ্মবেশে গণ্ডায় গণ্ডায় বাবা, স্বামী, প্রভু, মহাপ্রভুদের আবির্ভাব হতে থাকে। মোহনদাসদের মতো ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে খাওয়ার দলেরা নতুন ফরম্যাটে চতুর্বর্ণকে হাজির করে। হিন্দুদের দেখাদেখি মুসলিম সমাজেও আশরাফ-আতরাফ বর্ণভেদ শুরু হয়ে যায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভারতবর্ষের একটা বড় অংশ প্রায় হাজারখানেক বছর বৌদ্ধ শাসকদের অধীনে ছিলো। বৌদ্ধ ধর্ম বৈদিক হিন্দু ধর্মকে বহু জায়গায় ঠেলতে ঠেলতে কিছু বিচ্ছিন্ন পকেটবন্দী করে ফেলেছিলো। বাংলায় সেনদের আগ্রাসনের পর বৈষ্ণব ধর্ম এসে বৌদ্ধ ধর্মের ধ্বংসাবশেষকে গিলে ফেলে বিপুল জনপ্রিয় হয়, সেই বৈষ্ণবরাও তো যতদূর জানি চতুর্বর্ণের ঘোর বিরোধী। ব্রাহ্মণরা সমাজ চালাতো, এই জিনিসটা ব্রাহ্মণের লেখা শাস্ত্রের বাইরে কোথায় কতোটুকু খাটতো, সেটা দেখার বিষয়। আপনি সময় পেলে নিকোলাস ডার্কসের কাস্টস অফ মাইন্ড বইটা পড়ে দেখতে পারেন।
- আংশিক দ্বিমত। ঐ হাজার বছরেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা গোটা ভারতবর্ষে দূরে থাক যে অঞ্চলগুলোতে তাদের শাসন ছিল সেখানেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেনি। ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতে সামাজিক পর্যায়ে হিন্দু আচার অনুশাসন বহাল তবিয়তে বিদ্যমান ছিল। লক্ষ করে দেখুন এই হাজার বছরে হিন্দু ধর্মের প্রধান প্রধান শাস্ত্রগুলো লিপিবদ্ধ হয়েছে, আখ্যানগুলো লিপিবদ্ধ হয়েছে, বড় আকারের প্রবক্তাদেরও আবির্ভাব ঘটেছে। বাংলা (মেঘনা নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত) বা বিহারের মতো জায়গা যেখানে বিপুল সংখ্যক বৌদ্ধ বাস করতো সেখানেও হিন্দু সামাজিকতা ও অনুশাসন রাজ করে গেছে। এই প্রকার কারণগুলোর প্রভাবে ঈশ্বর, পরকাল, বর্ণাশ্রম ইত্যাদির অনুপস্থিতিসম্পন্ন বৌদ্ধ ধর্ম এক সময়ে 'মহাযানী' চেহারা পেয়েছে। এবং হিন্দুরাও বুদ্ধকে বিষ্ণুর নবম অবতার ঘোষণা করতে পেরেছে।
- বৈষ্ণবদের অবস্থা তপন রায়চৌধুরী বর্ণিত 'রোমাই কার্তিক'দের মতো - যারা ধর্মে রোমান ক্যাথলিক কিন্তু জাঁকজমক করে কালী পূজা করে। ব্যাখ্যা ও অনুশাসন পর্যায়ে বৈষ্ণব ধর্মকে সনাতন হিন্দু ধর্মের কাছে প্রতিনিয়ত হাত পাততে হয়, ফলে বৈষ্ণবরা বর্ণাশ্রমের বিরোধী হলেও তাদের পক্ষে সমাজ থেকে বর্ণপ্রথা উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি। এই প্রকার সীমাবদ্ধতার জন্য বৈষ্ণব ধর্ম টিকে থাকতে পারেনি।
- ব্রাহ্মণরা 'প্রশাসক' ছিল এমন দাবি আমি করছি না। যেহেতু সমাজের বেশিরভাগ মানুষ ছিলেন হিন্দু, এবং যেহেতু ঐ আমলে মানুষের জীবনে ধর্মের প্রভাব বেশি ছিল সুতরাং ব্রাহ্মণদের আবিষ্কৃত বর্ণাশ্রমের খড়্গটা ধর্মীয় আইনের খোলসে প্রায়ই তাদের ফালাফালা করতো। বিষয়টা বহু শতাব্দী ধরে অব্যাহত আছে বলে আজকের আধুনিক ভারতেও সেটা টিকে আছে।
নিকোলাস ডার্কসের বইটা যোগাড় করতে পারলে পড়ে ফেলবো। সাজেশনের জন্য ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এটা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা আগ্রহোদ্দীপক ব্যাখ্যা পড়েছিলাম (যদিও ঈষৎ ভিন্ন প্রসঙ্গে, কিন্তু প্রযোজ্য এখানেও) কিছুদিন আগে, উদ্ধৃতি দিই:
আদ্যিকালের ব্রাহ্মণরা যে প্রচুর রাগী রাগী রেসিস্ট বাজে কথা লিখে ভূর্জপত্রের আঁটি বেঁধে পাহাড় গড়ে গেছে, তা নিয়ে কোন সংশয় নেই। কিন্তু ঐ কথাগুলো ইংরেজ উপনিবেশে যতোটা প্রায়োগিক বৈধতা পেয়েছে, তেমনটা আদি ভারতে আসলেই ছিলো কি না, সেটাই প্রশ্ন। ডার্কসের গবেষণা ইতিহাসের ঐ উদাহরণের ফাঁকগুলো নিয়ে, সেইসাথে কী করে শুমারি আর পরিসংখ্যান দিয়ে ইংরেজ এ বর্ণাশ্রমকে সর্বভারতীয় করে তোলে, তার ব্যাখ্যা নিয়ে (যতোদূর পড়েছিলাম)।
আলীজাহ্'র ব্যাখ্যাটা ভারতে হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও ভারতে বৌদ্ধ/জৈন/আজীবক ধর্মের জন্য প্রযোজ্য হয় না।
আদ্যিকালের পণ্ডিতদের লেখা অনুশাসনগুলো বাস্তবে কতোটা কাজের ছিল সেটা বোঝার একটা উপায় হচ্ছে লোকসাহিত্য খেয়াল করা। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে যে সাহিত্য রচিত হয় সেখানে পণ্ডিতদের মিথ্যাচার ছাপিয়ে সত্যটা ফুটে ওঠে। বেদ শুনলে শুদ্রের কানে গরম সীসা ঢেলে দেয়ার ঘটনা হয়তো ঘটেনি তবে শম্বুকের মতো 'অনধিকার চর্চ্চা'র জন্য কাউকে কাউকে প্রাণ হারাতে হয়েছে নিশ্চয়ই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেই তো চলে। বর্ণাশ্রম নিয়ে বাড়াবাড়ি শাস্ত্রগুলো কোন আমলে লেখা হয়েছে, সেটা একটু খোঁজ নিতে হবে। যে বেদ শুনলে শূদ্রের কানে সীসা ঢালার ফতোয়া ব্রাহ্মণরা কোনো এক সময় দিয়েছে, সে বেদেই এই বর্ণভেদ অনেক পরে গুঁজে দেওয়া বলে ভাষাবিদরা মত দিয়েছেন।
লোকসাহিত্যে টুকিটাকি নমুনা পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। কোন জায়গার লোকসাহিত্য, সেটাও দেখার বিষয়। সিন্থিয়া ট্যালবট কাজ করেছিলেন অন্ধ্রের সমাজেতিহাস নিয়ে, তিনিও এই একই প্রস্তাবের অনুসারী: ভারতে বর্ণপ্রথার বর্তমান রূপটি ইংরেজ উপনিবেশের প্রত্যক্ষ ফল, ইতিহাসে এর সমকক্ষ কিছুর উদাহরণ নেই।
অর্ধপ্রাসঙ্গিক: সৈয়দ মুজতবা আলীকে "আলীজা" লিখতে দেখি কয়েকজনকে, কিন্তু কেন? আলীজা মানে কি "আলীর পুত্র" না? ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথকে "ঠাকুরপো" ডাকার মতো হয়ে যায় ।
শাস্ত্র একদিনে তৈরী হয়নি। বহু বছর ধরে একটু একটু করে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বহু পণ্ডিতের অবদানে তৈরী হয়েছে। সুতরাং শাস্ত্র লিপিবদ্ধ হয়েছে তারও বহু পরে - এটা একটা মীমাংসিত বিষয়, এটা নিয়ে তর্ক করা অহেতুক। কাল বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত আধুনিক ধর্ম ইসলামে কুর'আন একজন মাত্র রাসুলের মাধ্যমে অবতীর্ণ হলেও লিপিবদ্ধ হয়েছে তৃতীয় খলিফার সময়ে। সুতরাং সনাতন হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে শাস্ত্র লিপিবদ্ধ করার সময়টা রচনাকালের অনেক পরে হবে সেটাই স্বাভাবিক।॥
আমার অবস্থানটা আরেকটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। আমার বক্তব্য হচ্ছে, শাস্ত্র লিপিবদ্ধ হবার বহুকাল আগে, আর্য্যরা ভারতে আসার পর থেকে স্থানীয় অনার্য্যদের শাসন ও শোষণ করার চেষ্টায় যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করেছে বর্ণভেদ তারই একটা। সুতরাং সামাজিক পর্যায়ে বর্ণভেদটা মোটামুটি ঐসময় থেকে ছিল। এর চার বা পাঁচটা স্তর কালক্রমে তৈরী হয়েছে।
শাস্ত্রে বর্ণভেদের যে কঠোর রূপটা দেখা যায় সেখানে লিপিকারদের কিছু কৃতিত্ব থাকতে পারে। মানে ব্যাপারটা হচ্ছে এমন,
বাস্তবে যা হয়েছিলঃ যদু মধুর হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া আসিল।
প্রাচীন শাস্ত্রে যা লেখা হলোঃ যদু মধুর হাত বাঁধিয়া পিটাইতে পিটাইতে হাজির করিল।
ইংরাজ আমলে যা বলা হলোঃ যদু মধুর হাত-পা বাঁধিয়া পিটাইয়া আধমরা করিয়া জল-বিছুটি দিতে দিতে হাজির করিল।
বর্ণনাতে এমন ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে থাকলেও যদু যে মধুকে জোর করে ধরে এনেছিল সে সত্যটা পালটে যায় না। শাস্ত্রে যা কিছু লিপিবদ্ধ থাকুক (অথবা মুখে মুখে প্রচলিত থাকুক), তার প্রয়োগের বেলায় ক্ষমতাকাঠামো সংশ্লিষ্টের সাব্জেক্টিভ জাজমেন্ট বড় ব্যাপার। সুতরাং বিশাল ভারতের একেক অঞ্চলে বর্ণভেদের খড়্গের ধার, ওজন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হয়েছে - কিন্তু খড়্গটা ঠিকই ছিল। বর্ণাশ্রম কঠোরতর করে প্রচলনে ইংরেজদের কোন ফায়দা ছিল না। বর্ণভেদের আইনে ইংরেজরা শুদ্রদের পর্যায়ে হবার কথা। তাছাড়া ঔপনিবেশিক শোষণে স্থানীয়দের মধ্যে কঠোর বর্ণভেদ কোন বাড়তি লাভ যোগ করে না। সতীদাহ বা নরবলি'র মতো বিচ্ছিন্ন কিছু বিষয় ছাড়া হিন্দু ধর্মে ইংরেজদের হস্তক্ষেপের ব্যাপার প্রায় নাই।
অর্ধপ্রাসঙ্গিকঃ 'আলীজাহ্' শব্দটার মানে ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কিত বা ঈশ্বরের প্রতিভূ। এই অর্থে কথ্য রীতিতে কখনো কখনো মুসলিম শাসকদের এই সম্বোধনে ডাকা হতো। সম্মানীয় কাউকে যদি মজা করে 'আলীজাহ্' বলা হয় তাহলে ভুল কিছু হয় না। 'আলীজাহ্' মানে আলীর পুত্র কিনা আমার জানা নেই। যদি তা হয়ও তাহলে সৈয়দ সিকান্দার আলীর পুত্র সৈয়দ মুজতবা আলীকে 'আলীজাহ্' বলা ভুল হয় না। তাহলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে 'ঠাকুরপো' ডাকা ভুল কেন? ঠাকুর-এর পুত্রকে 'ঠাকুর পো' ডাকাটা উৎপত্তিগতভাবে সঠিক। কিন্তু ব্যবহারিক পর্যায়ে শ্বশুরকে 'ঠাকুর' বলা হয় বিধায় স্বামীর অনুজদেরকে 'ঠাকুরপো' ডাকা হয়। মাঝখানের স্পেসটাকে তুলে দিয়ে গঠিত এই শব্দটার চেহারাটিকে নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধির সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বর্ণপ্রথার ফাঁকিটা তো ওখানেই। ব্রাহ্মণরা কি ইংরেজদের শূদ্রজ্ঞান করে কানে সীসা ঢালতে পেরেছে কোনোদিন? জার্মান ভারতবিশারদরা তো বেদ পড়ে, অনুবাদ করে, বই লিখে তামা তামা করে ফেলেছে। এখনও ঋগ্বেদ আমলের কোনো লেখা বোঝার জন্য নামীদামী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা একশো-দেড়শো বছর আগে বের করা জার্মান পণ্ডিতের সংস্কৃত অভিধানে হাত দেন।
আপনার বাকি ধারণা কেন সঠিক নয়, সেটা ব্যাখ্যা করতে গেলে মন্তব্যের পাতায় কুলাবে না। সময় করে একটা পোস্ট দেবো। কী করে ইংরেজ ভারত থেকে "রাজা"র শাসন দূর করলো, এবং সমাজে মধ্যস্থতাকারীর দীর্ঘাচরিত ভূমিকায় রাজার শূন্যস্থান ব্রাহ্মণ ইংরেজের প্রশ্রয়ে পূরণ করলো, সে আলাপ চাপা পড়ে গেছে সতীদাহ-নরবলির নিচে। সতীদাহ-নরবলি এসবের প্রসঙ্গ সামনে আনা হয় বর্বর ভারতকে ইংরেজ সভ্য করেছে, এই ধারণা সামনে এনে তিন ট্রিলিয়ন পাউণ্ড-স্টার্লিং সমপরিমাণ চুরি-ডাকাতি হালাল করার জন্য।
তাড়াতাড়ি "সময় করুন"! খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে। বিস্তারিত জানতে আগ্রহী।
****************************************
সময় করে পোস্ট দিন, সেটাই ভালো হবে। তখন ঐ পোস্টে আলোচনা চালানোর চেষ্টা করবো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হিমু ভাই সত্যিই একটা স্বতন্ত্র পোস্ট আপনার হাত থেকে বেরোলে বেশ হয়। সময় টময় ম্যানেজ করে দেখেননা একটু। ডার্কসের বইটা পড়ছি কিন্তু অগাধ সাগরে পড়ে খাবি খাবার মত হচ্ছে ব্যাপারটা। আপনিই ভরসা হিমু ভাই, দেন একটা পোস্ট।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
পাণ্ডবদা, নিকোলাস ডার্কসের বইটা এখানে পাবেন। রেজিস্ট্রেশন করে ঢুকতে হতে পারে, ফ্রি রেজিস্ট্রেশন অবশ্য।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অসংখ্য ধন্যবাদ সোহেল ইমাম!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নিজের ধর্ম সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধীর ভাবনা বেশ ইন্টারেস্টিং-
হিন্দুধর্মের কোন সুনির্দিষ্ট মতবাদ নেই, সে তার সৌভাগ্য, অথবা দুর্ভাগ্য। ......... আমি এক সনাতনী হিন্দু, তবু হিন্দুধর্মের নামে যা যা সাধারণত করা হয়, তাতে আমার শ্রদ্ধা নেই।......... বর্ণাশ্রম ধর্মে বৈদিক সংজ্ঞা অনুযায়ী বিশ্বাস করি, এখনকার প্রচলিত বর্বর সংজ্ঞা অনুযায়ী নয়। বর্নাশ্রম সম্পর্কে বেদের ভাষ্য- "কর্ম ও গুণ ভেদে কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বৈশ্য, কেউ শূদ্র। এদের সবার জন্য ঈশ্বরের সমান ভালোবাসা" (ঋগবেদ ৫.৬০.৫)
বস্তুতপক্ষে বর্নভেদ প্রথার যে অভশাপের ব্যাপারে আমরা অতিশয় উদ্বিগ্ন, বৃটিশপূর্ব বাংলায় তার অস্তিত্ব সেভাবে দেখা যায় না। চতুর্বর্নের একটি বর্ন, বৈশের এখানে কোন হদিস পাওয়া যায় না, যদিও ব্যাবসা-বানিজ্য এখানে অতি প্রাচীন পেশা। বৃটিশ আমলে যাদের আমরা শুদ্র হিসেবে দেখছি, তাদের অনেকেই তখন পর্যন্ত সনাতনী হিন্দু ধর্মের অনুসারী নয়, কেউ কেউ সবে মাত্র হিন্দুত্ব গ্রহন করেছে। বাংলায় হিন্দুধর্মের স্বর্ণযুগ তথা সেন রাজবংশের সময় দেখি, স্বর্ণকারেরা তখন সমাজে খুবই সম্মানজনক অবস্থানে বিরাজমান, পরে বল্লালসেনের সাথে বিরোধের পরিনামে তাদের অবনয়ন, এর পর থেকে তারা শূদ্র। বাংলায় কায়স্থরা শূদ্র, নাকি অন্য কিছু, সেটাও সুনিশ্চিত করে নির্নয় করা যায় নি। তবে হ্যাঁ, ব্রাহ্মণরা বাংলায় চিরকালই বিশেষ সম্মানের পাত্র, সেনদের আগমনেরও অনেক আগে থেকেই, কিন্তু সেটা তাদের জন্মের কারনে বোধ হয় নয়, কর্মের কারনে।
তবে বাংলার বাইরে, প্রধানত হিন্দী বলয়ে বর্নভেদ প্রথার যে বর্বর রুপ আমরা দেখি, তার শুরু হয়েছে সম্ভবত ইংরেজরা আসার আগেই।
আপনার মন্তব্য সব সময়ই চিন্তার খোরাক জোগায় আব্দুল্লাহভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
সোহেল ইমাম – আপনার এই সুলিখিত চমৎকার সিরিজটা খুব মনযোগ দিয়ে পড়ছি, নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করার খোরাক পাচ্ছি। ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়েই শুরু করেছেন লেখাটা বোঝা যাচ্ছে।
আপনার লেখার প্রস্তাবনা, লেখা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সবকিছুর সাথেই লেখার শিরোনামের চমৎকার মিল আছে। অথচ, ফেসবুকের সর্টকার্টে অভ্যস্ত আমাদের চিন্তাভাবনায় কেন যেন শিরোনামটা আপনার চমৎকার সিরিজটার মূল ধারণাটাকে ধারন করতে পারছে না বলে মনে হচ্ছে। আমি নিজেই প্রথমে শিরোনাম দেখে স্কিপ করে চলে গেছি…।
নামের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিনা নৈষাদভাই। আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন দেখে খুব ভালো লাগছে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
কেজো পোস্ট।। মন্তব্যগুলোও।।
হিন্দু ধর্ম যতটা তার চাইতেও এটা অধিক সংস্কৃতি ।।।
বিষয়টার সারবস্তু নিয়ে বলার কিছু নেই
ছানা, ঘি ধাঁচের
তবে সরেস হয়েছে
নামকরনটা
ধন্যবাদ কর্ণজয় সেই প্রথম থেকে লেখাটা পড়তে পড়তে উৎসাহ যুগিয়ে যাবার জন্য।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ব্যাপক শ্রমসাধ্য পোস্ট। অনেক কিছু জানা যাচ্ছে পোস্ট আর দারুণ সব মন্তব্য থেকে। এই চমৎকার পোস্টের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই।
লেখাটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আয়নামতি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
চমৎকার হচ্ছে। মায়ের নাম করে আপনি ইতিহাস, প্রাক-ইতিহাস সব এনে সাজিয়ে দিচ্ছেন।
এই পর্বটা আরো ভাল লাগার কারণ একসময়ে এই বিষ্যের নাড়াচাড়াগুলোকে আবার দেখতে পেলাম।
হিন্দু ধর্ম তথা হিন্দু সংস্কৃতি যে দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছে সেখানে নানা সময়ে বিভিন্ন বিরুদ্ধ শক্তি সঙ্ঘাত-সমঝোতা-হার-জিত-এর মধ্য দিয়ে একটা বড় কাঠামোর মধ্যে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে অথবা বিলীন হয়ে গেছে। সেখানে পরাজিত হওয়া মানে একেবারে মুছে যাওয়া নাও হতে পারে। পরাজিতের সংস্কৃতি বিজয়ীর দরকারে লাগলে সে তাকে তার নিজের মত করে চালু রেখে দিতে পারে, দেয়।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সুন্দর বলেছেন। লেখাটা পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ একলহমা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন