মঙ্গলকাব্য গুলোয় দেখি দেব-দেবীরা যেন অনেকটাই মরনশীল মানুষের আদলেই উপস্থাপিত। ব্রাহ্মণ্য সংস্কারে যেমন দেবতারা দূর স্বর্গলোকের অধিবাসী, মর্ত্য মানুষের সীমাবদ্ধতার অনেক উপরে অবস্থান করে, মঙ্গলকাব্যের দেবতারা তেমন নয়। এই দেবতাদের নিয়ে ভক্তরা ঠাট্টা করতে পারে, নিজের পাশের বাড়ির মানুষের মত কোন আনুষ্ঠানিকতা না রেখেও আচরণ করতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যও আদিম সমাজেরই পরিচায়ক। বৈদিক সাহিত্য যখন রচিত হচ্ছে তখনই বৈদিক আর্যদের সমাজে সম্পত্তি দেখা দিয়েছে আর সে সূত্রেই শ্রেণিভেদও মাথা তুলতে শুরু করেছে কিন্তু অদূর অতীতের সংস্কার তখনও তাদের ছেড়ে যায়নি আর তারই বশে দেখি তারাও তাদের দেবতাদের সখা সম্বোধন করছে। এ শুধু সম্বোধনই নয় দেবতাদের তাদের গোষ্ঠীরই একজন হিসেবে গণ্য করছে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এ সম্পর্কে বলছেন, বরুণের সঙ্গে বৈদিক মানুষদের সম্পর্কটা যে সখার মতোই সে বিষয়ে অধ্যাপক ম্যাকডোনাল ইতিপূর্বেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, Varuna is on a footing of friendship with his worshipper, who communes with him in his celestial abode and sometimes sees him with the mental eye. এখানে ওই worshipper শব্দ কতোখানি প্রাসঙ্গিক সে প্রশ্ন অবশ্যই অবান্তর নয়, কেননা, অনেক সময় বৈদিক দেবতারা যেন মানুষদেরই একজন। অগ্নিকে বলা হচ্ছে “নৃবৎসখা সভাবান” (ঋগ্বেদ:৪.২.৫) – অর্থ, মানুষদের মতোই আমাদের সখা এবং সভায় স্থিত। অতএব, ঋগ্বেদে শুধুমাত্র বরুণের বৈদিক মানুষদের এ রকম সখার সম্বন্ধ নয়। অর্যমা সম্বন্ধে অধ্যাপক ম্যাকডোনাল বলছেন, In less than a dozen passages the word has only the appellative senses of ‘comrade’ and ‘groomsman’ এবং অর্যময় কথার অর্থ হলো relating to a comrade। ইন্দ্র ও অগ্নির প্রতিও একই সখাভাব ব্যক্ত হতে দেখা যায় (দেবীপ্রসাদ, ১৩৬৩;পৃ:৫৫৩)।
মঙ্গলকাব্য গুলোয় আমরা দেখি দেবতাদের সম্পর্কে এই মনোভাবটাই বার বার প্রকটিত হয়েছে। মনসামঙ্গল কাব্যে দেখছি সমুদ্র মন্থন করে অমৃত পাবার প্রয়াসে সেই পৌরাণিক কাহিনিটি বিবৃত করতে গিয়ে শিবের কালকুট বিষ গলাধঃকরণ করে অচেতন হয়ে পড়ার আখ্যানটি। বর্ণনায় দেখছি শিব পত্নী ভবানী তাকে মৃত মনে করে মরণশীল মানবীর মতই আহাজারি করতে লাগলেন,
অচেতন ভূতনাথ ললাটে হানএ ঘাত হৈমবতী কান্দে উচ্চস্বরে।
বদন-কমল চায়্যা ধরণ না যায় হিয়া প্রাণপ্রভু উঠ দিগম্বরে।
কাম-ঐরি ত্রিনয়ান কেবল আমার প্রাণ দুখীর আঁচলে যেন হেম।
কঠিন হৃদয় তোর উঠ প্রভু ভস্ম কর ভূতনাথ ভুবন ঈশ্বর। (সনৎকুমার,২০১৫; পৃ: ৫৪)
দেবতারা তো অমর, তাদের মৃত্যু নেই। তাও আবার দেবাদিদেব শিব কালকুট বিষ গলায় নিয়ে অচেতন হলে ভবানী মরনশীল মানবীর মতই কপাল চাপড়ে কান্না শুরু করলেন। এই যে দেবতার অদৈবিক আচরণ এখানেই মঙ্গলকাব্য আর মঙ্গলকাব্যের সমাজ বিশিষ্ট হয়ে আছে। প্রায় মঙ্গলকাব্যের পৌরাণিক উপাখ্যান অংশে শিবের আখ্যানে বা শিবায়ন কাব্য গুলোতেও শিব-পার্বতী একেবারে মানব রসেই উপস্থাপিত হয়েছে। এখানে তাদের পরমেশ্বর-পরমেশ্বরী বলে চেনার উপায় নেই। গাঁয়ের গরীব চাষীরা তাদের মত করেই চিত্রায়িত করেছে শিব-পার্বতীর গেরস্থালী। পার্বতী সাধারণ মানবী মেয়ের মতই স্বামী শিবের কাছে আবদার ধরেন বাপের বাড়ি যাবেন,
অনুমতি দেহ হর যাইব বাপের ঘর যজ্ঞমহোৎসব দেখিবারে।
ত্রিভুবনে যত বৈসে চলিল বাপের বাসে তনয়া কেমনে প্রাণ ধরে।।
চরণে ধরিয়া সাধি কৃপা কর কৃপানিধি যাব পঞ্চদিবসের তরে।
চিরদিন আছে আশ যাইব বাপের পাশ নিবেদন করি জোড় করে।।
সুমঙ্গল সূত্র করে আইনু তোমার ঘরে পূর্ণ হইল বৎসর পাঁচ সাত।
দূর কর বিসম্বাদ পুরহ মনের সাধ মায়ের রন্ধনে খাব ভাত।। (সৌম্যেন্দ্রনাথ, ২০০০; পৃ:১৭)
মায়ের বাড়ি যাননি অনেক দিন। মায়ের বাড়ি গিয়ে মায়ের নিজের হাতে রাঁধা ভাত খেতে ইচ্ছে হচ্ছে পার্বতীর। এই পার্বতী দেবী না মানবী? এখানে যেন দেব আর মানবের মাঝে সীমারেখা বলে কিছু থাকছেনা। আদিম সমাজের মনোবৈশিষ্ট্যই এই, যা আমরা বৈদিক সাহিত্যেও বরুণ প্রসঙ্গে আলোচনায় একটু আগেই দেখেছি। আবার মায়ের বাড়িতে মেয়ে পার্বতী আর মেয়ে জামাই শিবকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে গিয়ে শাশুড়ি মেনকা রুষ্ট হয়ে ওঠেন একেবারে মানব শাশুড়ির মতই,
তোমা ঝিয়ে হৈতে গৌরী মজিল গিরিয়াল।
ঘরে জামাই রাখিয়া পুষিব কতকাল।।
দুগ্ধ উথলিতে গৌরী নাহি দেয় পানি।
সখীসঙ্গে খেল পাশা দিবসরজনী।।
দরিদ্র তোমার পতি পরে বাঘছাল।
সবে ধন বুড়া বৃষ গলে হাড়মাল।।
প্রেত ভূত পিশাচ মিলিল তার সঙ্গ।
অনুদিন কত নাকি কিন্যা দিব ভাঙ্গ।।
রান্ধি বাড়ি আমার কাঁকাল্যে হইল বাত।
ঘরে জামাই রাখিয়া জোগাব কত ভাত।। (সৌম্যেন্দ্রনাথ, ২০০০; পৃ:৩৫)।
এ গঞ্জনা মানবের পক্ষেই সহ্য করা মুশকিল কিন্তু দেবাদিদেব মহেশ্বর শিবও দেখি এই গঞ্জনা ধ্যান গম্ভীর উদাসীনতায় নিতে পারলেননা। শ্বশুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে জীবিকার আর কোন উপায় না দেখে ভিক্ষা করতেই মনস্থ করলেন শিব,
গৌরী সঙ্গে যুক্তি করি চলিলেন ত্রিপুরারি শ্বশুরের ছাড়িয়া বসতি।
ভবনে সম্বল নাহি চিন্তিলেন গোঁসাই ভিক্ষা অনুসারে কৈল মতি।।
ত্রিদশের ঈশ্বর ভিক্ষা মাগে ঘর ঘর আরোহন করি বৃষবরে।
বিভূতি-ভূষণ অঙ্গ বাজান ডম্বরু শৃঙ্গ ফিরিয়া বুলেন ঘরে ঘরে।। (সৌম্যেন্দ্রনাথ, ২০০০; পৃ:৩৫)
এ ভিক্ষাও যে আধ্যাত্মিক সন্নাসীর নিস্পৃহ গোছের ছিলো তাওতো মনে হয়না। বর্ণনাতে দেখি,
ফিরয়ে উজান-ভাটি চৌদিকে কোচের পটী কোচ-বধূ ভিক্ষা দেয় থালে।
থালা হইতে চালগুলি পুরিয়া রাখেন ঝুলি দ্বাদশ লম্বিত ঝুলি দোলে।।
কেহ দেয় চাল কড়ি কেহ দেয় ডালবড়ি কুপী ভরি তৈল দেয় তেলী।
লবণিয়া দেয় লোন ঘৃত-দধি গোপগণ বেন্যা দেয় ভাঙ্গের পুটুলী।। (সৌম্যেন্দ্রনাথ, ২০০০; পৃ:৩৫)।
মধ্যযুগের মনসাদেবী বা চণ্ডীদেবীর পূজা প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় মূলত এই পূজা গুলো মেয়েরাই করতেন। মসনামঙ্গলে দেখি জালু-মালু বিপদে পড়লে জালু-মালুর মা দেবী মনসার কাছেই বিপদ থেকে পরিত্রাণ প্রার্থনা করেন। আবার চাঁদবেনের স্ত্রী সনকা জালু-মালুর সৌভাগ্য দেখে তাদের মার কাছ থেকে মনসা পূজার নিয়ম কানুন শিখে নিজেও পূজা করা শুরু করে। দেবীদের কাছ থেকে সৌভাগ্যটা আসছে নারীদেরই মারফত। আবার দেখি বিয়ের কথাবার্তার সময় বেহুলা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, বার মাসে বার ব্রত পুণ্য তিথি করে যত দেবকার্য করে অবিশ্রাম। (সনৎকুমার,২০১৫; পৃ: ২০২)। বিয়ের সময় লোহার কলাই সিদ্ধ করবার অসম্ভব পরীক্ষার কথা উঠলে বেহুলার মাতা ভয় পেলে বেহুলা আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলে ওঠে,
বেহুলা কহিল মাতা না কর ক্রন্দন।
লোহার কলাই আমি করিব রন্ধন।।
এতেক শুনিঞা বড় ত্রাস লাগে মনে।
লোহার কলাই ঝিএ রান্ধিবে কেমনে।।
মাএরে প্রবোধ দেই বেহুলা সুন্দরী।
বার মাসে বার ব্রত অমাবস্যা করি।। (সনৎকুমার,২০১৫; পৃ: ২০৩)।
ব্রতাচার বা ব্রতপূজা বিষয়টি ছিলো মেয়েমহলেরই ব্যাপার। ব্রতাচারের ফলে যে শান্তি, সমৃদ্ধি আর সৌভাগ্য আসতো তা এই মেয়েদের, এই মা’দের মাধ্যমেই আসতো। অবনীন্দ্রনাথ মেয়েলি ব্রত সম্পর্কে বলছেন, মেয়েলি ব্রতগুলির সব-কটি খাঁটি অবস্থায় পাওয়া যায়না। কালে কালে তাদের এত ভাঙচুর অদলবদল উলোটপালোট হয়ে গেছে যে, কোনটা পুজো কোনটা ব্রত ধরতে হলে আদর্শ ব্রতের লক্ষণগুলির সঙ্গে মিলিয়ে না দেখলে গোলে পড়তে হয়। খাঁটি ব্রতের লক্ষণ মোটমুটি এই বলে নির্দেশ করা যেতে পারে : প্রথমত, খাঁটি ব্রতে ব্রতীর কামনার সঙ্গে ব্রতের সমস্তটার পরিস্কার সাদৃশ্য থাকা চাই; - জল চেয়ে পাদপদ্ম লিখে তাতে ফুল দিলে চলেনা, - জলকে প্রত্যক্ষ করতে হবে বৃষ্টির অনুকরণে ঝারা দিয়ে কিম্বা বৃষ্টির ছবি লিখে বা বৃষ্টির বর্ণনা করে ছড়া বেঁধে অথবা এই তিন ক্রিয়ারই একত্রে অনুষ্ঠান করে। ইচ্ছা বাইরের কোনো ঘটনা থেকে – যেমন আকালের দিনে শস্যের কামনা – কিম্বা নিজের অন্তর থেকে অকারণে উঠে মনকে দোলা দিচ্ছে এবং সেই দোলা মানুষের নানা চেষ্টায় প্রতিফলিত হয়ে একটা চরিতার্থতা পাচ্ছে, ধরতে গেলে, এই হল ব্রত। কিন্তু এর মধ্যে এক কথা রয়েছে। ক্রিয়া যখন একের মধ্যেই ধরা রইল তখনতো সেটিকে ব্রত-অনুষ্ঠান বলা চলে না; ব্রতে দেখি, দশে একই প্রেরণার বশে, একই ক্রিয়া করে চলেছে (অবনীন্দ্রনাথ,২০১২; পৃ:৫৯-৬০)। অবনীন্দ্রনাথের এ উদ্ধৃতি থেকে ব্রত সম্পর্কে যা বলেছেন তাতে বোঝাই যায় এগুলো পূজার থেকে পৃথক একটা আচার। পূজা নয় এগুলোকে যাদুবিশ্বাস মূলক আচার বললেই সঠিক বলা হয়। তুষতুষলির ব্রতের ছড়ায় দেখি, ব্রতী বলছেন,
তুষতুষলি গেল ভেসে বাপ মার ধন এল হেসে
তুষতুষলি গেল ভেসে শ্বশুর শাশুড়ির ধন এল হেসে
তুষতুষলি গেল ভেসে আমার স্বামীর ধন এল হেসে।(শীলা বসাক,১৯৯৮; পৃ:৪৭ )
আবার সেঁজুতি ব্রতের বেলা ব্রতিনী বলছেন,
গঙ্গা-যমুনা পূজ্যন
সোনার থালে ভোজন
সোনার থালে ক্ষীরের লাড়ু
শাঁখের আগে সুবর্ণের খাড়ু। (শীলা বসাক,১৯৯৮; পৃ:১৪৫ )
অথবা,
আমি দিই পিটুলির পানের বাটা
আমার হোক সোনার বাটা।
আমি দিই পিটুলির গয়না
আমার হোক সোনার গয়না। (শীলা বসাক,১৯৯৮; পৃ: ১৫২ )
এ তো সেই সমৃদ্ধির কামনা আর সাদৃশ্যের ভিত্তিতে গড়ে নেওয়া যাদুবিশ্বাস মূলক আচার। আলপনায় পিটুলি গোলা জলের আঁকা পানের বাটা যেন সত্যিকারের সোনার পানের বাটায় পরিণত হয়, আবার পিটুলির জলের আঁকা গয়নাও যেন ব্রতিনীর সোনার গয়নাতে রূপান্তরিত হয়ে যায় এই কামনা। কাউকে বলে দিতে হয়না এই আচার আদিবাসীদের আদিম সংস্কারের আচার। এই আচার গুলোর ওপর ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের প্রভাবে এর কতগুলো সেই চেহারা পেয়ে গেছে অবনীন্দ্রনাথ যাদের আর খাঁটি মেয়েলি ব্রত বলতে চাননি বলেছেন শাস্ত্রীয় ব্রত। মঙ্গলকাব্যের দেবীদের মতই এখানেও সাংসারিক সমৃদ্ধি অর্থাৎ ধন সম্পদের কামনাই রূপ পেয়েছে। এরমকই আরো ব্রতের ছড়ায় দেখি ফিরে ফিরে এসেছে স্বামী, শ্বশুর, পিতা বা ভাইয়ের জীবিকার সাফল্য কামনা, সে বাণিজ্যই হোক চাই অন্য পেশা। ব্রতের ছড়া ছাড়াও এর আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত উপকরণ, ব্রতের উৎপত্তির কাহিনি হিসেবে প্রচারিত গল্প গুলি, ব্রতের আলপনা সবকিছুর মধ্যেই একটা আদিম জগতের ছায়া এখনও দুর্লক্ষ্য নয়। ব্রতাচার নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই, কিন্তু বলতেই হবে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীদের যে সময়টা ছিলো আজকের ব্রতের আচারের মধ্যেও সেই সময়ের ছবিই স্থির হয়ে আছে।
এই মঙ্গলকাব্য আর এ সমাজ মানস ইংরেজদের আগমনের পরও বজায় ছিলো। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি থেকে বলছেন, কথকেরা নিশ্চিহ্ন হইয়াছেন। পটুয়ার দল লোপ পাইয়াছে। চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল গায়কগণ জীবিকার সন্ধানে অন্য বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে। বাল্যকালে দেখিয়াছি একজন কথক ঠাকুর গ্রামে আসিয়াছেন, একা মানুষ, খাওয়া থাকা ছাড়া দিন দুইটি টাকা দক্ষিণা। একখানা হিন্দুপ্রধান গ্রাম, ছোট গ্রাম। চাষীর সংখ্যাই বেশী, সকলেই নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। কথক ঠাকুর একমাস থাকিয়া নগদ ষাটটি টাকা থালা বাটী, নূতন কাপড়, কিছু চাউল প্রভৃতি লইয়া বাড়ী ফিরিলেন। ইহারা কেহ শ্রীমদ্ভাগবত, কেহ মহাভারতের কথকতা করিতেন। গল্পচ্ছলে পাপের বিনাশ, পাপীর শাস্তি, পুণ্যের অভ্যুদয়, পুণ্যবানের শ্রীবৃদ্ধি নানাভাবে লোককে বুঝাইয়া দিতেন (হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ১৯৯৯; পৃ: ৫৩-৫৪)।
বোঝাই যাচ্ছে যুগান্তরের আয়োজন চলছে আগের সেই মঙ্গলকাব্যের সময়টা বিদায় নিচ্ছে। কিন্তু সেই সমাজ মানসের পরিবর্তন কিন্তু সামান্যই হয়েছে। কেননা যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে কথা তাদের জীবনের অর্থনৈতিক ধারায় কোন পরিবর্তনই আসেনি। ইংরেজরা ইউরোপীয় সভ্যতার বাণী নিয়ে এলেও তারাও শোষনের যে খেলা চলছিলো তাতেই নেমে পড়ে আর সেই অবস্থাটাই বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। কেননা এটাই শোষণকে চলমান রাখার অন্যতম পন্থা। ফলে বাইরের পরিবর্তন খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে সামান্যই পরিবর্তন নিয়ে এলো আর এর জন্যই তাদের মানস জগতের পরিবর্তন সামান্যই হয়েছিলো। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সেকালের দুর্গাপূজার বর্ণনাতে বলছেন, যদিও বাঙ্গলার বিজয়া অনুষ্ঠানের সঙ্গে তথাকথিত আর্য-অনার্যের বহু আচার-অনুষ্ঠানের সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে, তথাপি বাঙ্গলার বিজয়া একান্ত আনন্দোৎসব নহে। এই আনন্দের মধ্যে দুঃখের অন্তঃসলিলা একটা সূক্ষ্ম ধারা অনুস্যূত থাকে। “পূজা” বলিলে বাঙ্গলার দুর্গাপূজা ভিন্ন অন্য কিছু বুঝায়না। দশভুজা দুর্গাপ্রতিমার পূজা বাঙ্গালী ভিন্ন অপর কেহ করেওনা। বাঙ্গালী ধনী-দরিদ্র নির্ব্বিশেষে পূজার চারি দিন সকল দুঃখ সকল বেদনা ভুলিবার চেষ্টা করে। অতিবড় দরিদ্রও চারি দিনের আহার্য সংগ্রহ করিয়া রাখে, যৎসামান্য মিষ্টান্নের আয়োজন করে। নিজেরা না পারে ছেলে-মেয়েদের জন্য নূতন বস্ত্র সংগ্রহ করিয়া আনে। আনন্দময়ীর আগমনে বাঙ্গলা যেন আনন্দে মাতিয়া উঠে। তাই বিজয়ার দিন বাঙ্গালীর দুঃখের দিন। মা চলিয়া গেলেন, আবার সেই নিত্যাকার বাস্তব সংসার, সংগ্রামময় দৈনন্দিন জীবন, অভাব-অনটন। কিন্তু দুঃখ কি শুধু এই জন্য? তাহা তো নয়। বাঙ্গালী এই জগতের জননীকে আপন তনয়ারূপে গ্রহণ করিয়াছে। কন্যার পিত্রালয় হইতে শ্বশুরালয়ে যাইবার সময় কন্যা যে বয়সেরই হউক এবং শ্বশুর যত ধন-সম্পদসম্পন্নই হউন, আনন্দের মধ্যেও যে অন্তর্গূঢ় বেদনা জনকজননী, ভ্রাতা-ভগিনী, বন্ধু-প্রতিবেশীর সঙ্গে তনয়ার চক্ষুকেও অশ্রুসিক্ত করে, বিজয়ার দিন সেই বেদনাতেই বাঙ্গালীর হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। নিকটবর্ত্তী নদী, সরোবর অথবা পুস্করিণীতে নবপত্রিকা বিসর্জ্জনে বাহির হইবার পূর্ব্ববর্ত্তী আচার-অনুষ্ঠানগুলি দেখিলেও এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হইবে (হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ১৯৯৯; পৃ: ৮৬-৮৭)।
এখানেও সেই মঙ্গলকাব্যের দেবতার চিত্রায়ণে মানবের ছবি আঁকার ঘটনা। দেবী দুর্গার বিসর্জনকে নাইয়রে আসা বাড়ির মেয়েটির আবার অশ্রুসজল চোখে শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাবার সেই বুক মোচড়ানো অনুভবের সাথে এক করে ফেলা, এ কেবল এই সমাজের পক্ষেই সম্ভব। এই বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় অন্যত্রও বলেছেন, বাঙ্গালী আর এক রূপে মায়ের অর্চনা করিয়াছিল। জগজ্জননীকে সে আপনার মানস কন্যারূপে কোলে তুলিয়া লইয়াছিল। বাঙ্গালী কবি যেদিন শিবমঙ্গলকাব্য রচনা করিয়াছিলেন, সেদিন শিবায়নে বাঙ্গালীর এক দরিদ্র দম্পতির কাঠামোর উপরেই তিনি হরগৌরী চরিত্রের আদর্শ গড়িয়াছিলেন। দরিদ্রের সংসার, হয়ত বয়সেরও অসামঞ্জস্য আছে। কিন্তু অনুরাগের অসদ্ভাব নাই। অনটন আছে, অসন্তোষ নাই। সংসারের খুঁটিনাটি দ্বন্দ-কলহের অন্তরালে আপনভোলা স্বামীকে লইয়া পতিপরয়াণার স্বচ্ছন্দ দিনযাপনের চিত্রে কবি উমাকে আনিয়া প্রতিষ্ঠা করিলেন। বাঙ্গালী সে চিত্রে আপন সংসারের প্রতিচ্ছবি দেখিয়া উমাকে আপনার করিয়া লইল। মঙ্গল কাব্যের পর কবিওয়ালারা আসিল। তাঁহারাই আগমনী গানের রচয়িতা (হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ১৯৯৯; পৃ: ১৭৩)।
মঙ্গলকাব্যের রচয়িতাদের উত্তরাধিকার কিন্তু এভাবেই ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত কোলকাতার কবিওয়ালাদের হাতে চলে আসে। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এই কবিওয়ালাদের সম্পর্কে বলছেন, বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণে শাক্ত পদাবলী রচিত হয়। মধ্যযুগের সাহিত্যে বৈষ্ণব পদকর্তাগণের পর কবিওয়ালাগণ একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছেন। কবিওয়ালাগণের মধ্যে লালু নন্দলাল, রামজীদাস ও রঘুনাথ দাস বয়সে জ্যেষ্ঠ। নিতাই দাস, ভাবনী বেনে, হরু ঠাকুর যথাক্রমে লালু, রামজী ও রঘুর শিষ্য। আমার মনে হয় আগমনী গান কবিওয়ালাগণই প্রথম রচনা করেন। তাঁহাদের গানের তিনটি বিভাগ ছিল – ভবানী-বিষয়, সখী-সংবাদ ও খেউড়। আগমনী গান ভবানী বিষয়ের অন্তর্গত। লালু রামজী ও রঘুর বহু গান লোপ পাইয়াছে। কবিওয়ালাগণ মঙ্গলকাব্য হইতে বহু সাহায্য পাইয়াছিলেন। সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন কবিওয়ালাগণেরই সমসাময়িক। প্রসাদের গান শাক্ত সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করিয়াছে (হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ১৯৯৯; পৃ: ১৭৬)। আবার যেন পুনরুক্তির মতই বলছেন, কবিওয়ালাগণকে অভিনন্দিত করিতে হয় যে, ইহারা এই ভবানী বিষয়ক গানেই একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। আমরা আগমনী গানের কথা বলিতেছি। আগমনী গান কবিওয়ালাগণই প্রথম রচনা করেন (হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ১৯৯৯; পৃ: ১৮৭)।
শাক্তপদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন রামপ্রসাদ সেন। তার ভক্তিপূর্ণ শ্যামা-সঙ্গীত গুলোতে যে মানবিক অনুভবের তীব্রতা তা আদতে দেবীমাতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলেও প্রায় ক্ষেত্রেই ভক্তির সর্বগ্রাসী আবেগে প্রথাবদ্ধ দেবার্চনা ডিঙিয়ে যে ব্যক্তি অনুভবে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলো সেটাই সাধারণ মানুষের চিত্তে দেবীমাতা আর মানবীমাতার মধ্যের পার্থক্যও অনেক সময় মুছে দিয়েছে। আগেই বলেছি যে জনমানসের পটভূমিতে মঙ্গলকাব্য সমূহ রচিত হতো সেই একই জনমানসেই আগমনী গানে দেবী দুর্গাকে নিজের বাড়ির মেয়ে হিসেবে ভেবে নিয়েছে আবার সেই একই অনুভব থেকেই দেবী কালিকাও অনেকাংশেই ঘরের মাতা হয়ে উঠেছেন ভক্ত শ্রোতাদের হৃদয়ে মনে। রবিঠাকুর হয়তো এই মানসিকতার পরিচয় পেয়েই বলেছিলেন, দেবেরে মানব করি, মানবে দেবতা।
এইযে দেবীমাতার মানবীমাতায় রূপান্তর তা বহুলাংশেই ছিলো জনতার চিত্তের মধ্যেই। বাইরের প্রথায় দেবীকে দেবীই ভাবা হতো কিন্তু দেবীর কাছে প্রার্থনা, আরজি জানানোর সময়, ভক্তির আতিশয্যে এই দেবীই রক্তমাংসের মানবীমাতায় রূপান্তরিত হয়ে যেতেন। আসলে গর্ভধারিণী মাতাইতো দেবতা। জন্মের পর থেকে যে স্নেহময়তার আবরণে সন্তানকে তিনি জড়িয়ে রাখেন, সন্তানের শরীরে বিন্দুমাত্র আঘাত না লাগে তার জন্য যেমনটা সদা তৎপর থাকেন, যে মাতৃত্বের অনুভবে সন্তানের মঙ্গলই চেয়ে এসেছেন জীবনভর, এই চরিত্রটি মানবী হলেও দেবতার চেয়ে কম কিসে। ন্যায়পরায়ণ ঈশ্বরের কল্পনা করা হয়েছিলো সমাজের সামষ্টিক পরিবেশকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে। এই ঈশ্বর কঠিন হাতে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করেন বলেই এর কাছে ছাড় নেই, এর চুলচেরা বিচারে কারো ফাঁকি দেবার উপায় নেই। সমাজে সমতার আইন প্রতিষ্ঠায়, অন্যায়ের প্রতিরোধে এই ন্যায়পরায়ণ ঈশ্বরের বিকল্প নেই। কিন্তু মানুষের ব্যক্তি জীবনে প্রয়োজন দয়ালু ঈশ্বরের। যে ঈশ্বর দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও ভক্তকে ক্ষমা করতে ব্যগ্র হয়ে ওঠেন, তাকে পরিত্যাগ করেননা। আমাদের সব ধর্মের ঈশ্বর ভাবনায় আমরা দুটিকেই মিশিয়ে নিয়েছি। আমাদের সামষ্টিক আর ব্যক্তিগত জীবন উভয়ের প্রয়োজনেই দু’ধরনের ঈশ্বরকেই আমাদের প্রয়োজন। একজনকে আমরা গড়ে নিয়েছি আমাদের পিতার আদলে তাই তিনি ন্যায়পরায়ণ, পিতার মতই কঠিন। আমরা সামাজিক হয়ে উঠছি কতটা, সামাজিক ন্যাপরায়ণতার সাথে নিজেদের প্রকৃতিকে কতখানি গড়ে নিতে পারছি তাই দেখেন পিতা। পিতার কাছে মূল্যবান হয়ে থাকে সামাজিক সম্মান, সন্তানের জন্য যাতে সমাজের কাছে তিনি মুখ দেখাতে পারেন। তাই তার অন্যথা হলেই তিনি কঠোর শাসন করেন। কিন্তু মাতার ধ্যান, জ্ঞান সমস্তটাই সন্তানকে ঘিরে, সন্তানের মঙ্গলকে ঘিরে, সন্তানের হাসিমুখের জন্য মা সামাজিক নিয়মকে, তার অনুশাসনকে পর্যন্ত পায়ে ঠেলতে পারেন। সন্তানের মঙ্গল ছাড়া তিনি আর কিছুই চাননা। আমাদের দয়ালু ঈশ্বরের ধারণার জন্ম এই মাতৃস্নেহের সুধার মধ্যেই। তাই আদিবাসী মানুষ যখন ব্রাহ্মণ্য সমাজের গণ্ডীর ভেতর বন্দি হয়ে পড়লো তখন থেকে এই মাতৃস্নেহের সুধারই অন্বেষণ করেছে। মঙ্গলকাব্যের দেবীরা ভক্তকে বিপদে ফেললেও তাই চটজলদি বিপদ থেকে উদ্ধারও করেন আর ধন-সম্পদে ভরে দেন তাদের ঘর। যুগ যত সভ্যতার দিকে এগিয়েছে ততই এই জনমানস দেবীর মূর্তি গড়তে গিয়ে মায়ের মূতিই গড়েছে এবং তা সজ্ঞানেই গড়েছে।
হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বলেছেন বিজয়ার আগমনী গান গুলো কবিওয়ালাদেরই দান। এই কবিওয়ালাদের সময় আর শাক্ত সাধক রামপ্রসাদ সেনের সময়কালটা প্রায় একই। মোটামুটি এসময় থেকেই সমাজে মায়ের মাতৃত্বের উপর একটা দৈব ছায়া পড়তে শুরু করে। ইংরেজ আমলের শিক্ষা দীক্ষায় যে নতুন বাঙালি সমাজ জেগে ওঠে এই সমাজে এই ধারণাটাই আরো বিস্তার লাভ করে। এ সময়টায় পত্র-পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে, সাহিত্য চর্চার বিস্তারও ব্যাপকই ছিলো। অনেক দিন পর একটা জাতি যেন কথা বলতে শুরু করলো। মাতৃভক্তি মূলক আবেগের মধ্যে তাই প্রাচীনধারার তন্ত্রপ্রভাবিত নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধা আর সেই সাথে লৌকিক ও মঙ্গলকাব্যের দেবীদের প্রভাবের সাথে সাথে আধুনিক যুগের ইংরেজ প্রভাবিত ‘সভ্য’ আচরণের কেতা একত্রে মিশে গিয়েছিলো। এরই ফলশ্রুতি ছিলো মা’কে একটা নতুন দৃষ্টিতে দেখা। সাহিত্যে আধুনিকতার আগেই ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে আমরা দেখি খেয়া পারাপারকারিণী ঈশ্বরী-পাটনি জলজ্যান্ত দেবীকে সামনে পেয়েও অতুল ঐশ্বর্য বা সাতমহলা বাড়ি না চেয়ে চাইলো শ্রেফ আপন সন্তানের মঙ্গলটুকুই, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।” মায়ের এই চাওয়ার মধ্যে কিন্তু ভিন্ন ধরণেরএকটা আত্মসম্মানবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে দেখতে পাই। ভারতচন্দ্রের সময় থেকেই সম্ভবত একটা পরিবর্তনের হাওয়া খুব ধীরে হলেও বইতে শুরু করেছিলো। আধুনিক যুগ আসতে আসতে এরই ব্যাপ্তি ঘটবে এও বোঝা যায়।
১৯০৭ সনে প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের শিষ্য অক্ষয়চন্দ্র সরকারের লেখা প্রভাতকুমারের গল্প সমষ্টি ‘ষোড়শী’ গ্রন্থের সমালোচনা । নীরদচন্দ্র চৌধুরী যদিও বলছেন, ‘যে এই লেখাটির মত গোঁড়ামির বশে নির্বুদ্ধিতা প্রকাশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সমগ্র বাংলা লেখাতেও আর একটি দেখা যায়না’ তবুও সেকালের জনমানসের পরিচয় হিসেবেই উদ্ধৃতিটার কিছু মূল্য আছে বলেই উল্লেখ করছি। অক্ষয়বাবু বলছেন, “বঙ্কিমবাবুকে বলিয়াছিলাম, ভিক্টর হুগো যেমন নাইন্টীথ্রিতে একটি মাতৃচ্ছবি দিয়াছেন, আপনি কেন সেইরূপ কিছু দেননা। সতীশবাবুর মা এক টুকরা কমলমণিকে লইয়া আমাদের ত আশা মিটেনা। বঙ্কিমবাবু কার্যত কোন উত্তর দেন নাই। বাঙ্গালি বহুকাল হইতেই মাকে চিনিয়াছিল। ইংরাজি সাহিত্য সেবনে বিকৃত-মস্তিস্ক হইবার পূর্বে ‘মা মা’ করিয়া বাঙ্গালি পাগল হইত আর ছড়ায়, গানে, যাত্রায়, পাঁচালিতে – কি মাতৃগাথাই না গাহিয়া রাখিয়াছে। মহাশক্তি মা, কিন্তু মার উপর একডিগ্রী মা বাঙ্গালি চড়াইয়াছে। গিরিরাণী মেনকা বাঙ্গালির অপূর্ব সৃষ্টি। সংস্কৃত সাহিত্যের যশোদা বাঙ্গালির হস্তে কত মোলায়েম, কত ভাবময়ী – তাহাও কি আবার লিখিয়া বলিতে হইবে, যশোদাকে না দেখিলে ভূতভাবন ভগবানকে কি কেহ নীলমণি গোপাল বলিয়া কোলে টানিতে সাহস করিত, রামপ্রসাদ মার নামে যে জীবনী-শক্তি দিয়া গিয়াছেন, তাহারই প্রসাদে বাঙ্গালি এখনও নড়িতেছে।আর সেই মাকে তোমরা তোমাদের সাধের সাহিত্য হইতে বিতাড়িত করিয়া রাখিবে? (নীরদ চৌধুরী: ১৯৯০; পৃ:৭৮-৭৯)। সেই সময়টার কিছুটা হয়তো পরেই রবি ঠাকুরের “গোরা” উপন্যাসের গোরাকেও বলতে শুনি, “স্ত্রীজাতিকে পুজো করবার জায়গা হল মা’র ঘর সতীলক্ষ্মী গৃহিণীর আসন সেখান থেকে সরিয়ে এনে তাঁদের যে স্তব করা হয়, তার মধ্যে অপমান লুকিয়ে আছে”। তখনকার সমাজের সমাজমানসের ছবিই এই সাহিত্যিক দৃষ্টান্তে। হয়তো খুঁজলে এরকম আরো সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু সত্যিকারের জনতার মনের ছবিটা সে সময়ে কেউ সমীক্ষা করে রাখেনি, কেননা সেসবের খুব একটা চল তখন ছিলোনা। কিন্তু লৌকিক-অলৌকিকে বিশ্বাসের মিশ্রণ যে জনচিত্তের বিশিষ্টতা সেখানে মা সম্পর্কে এক রকম দেবভাবনার সাজুয্য যে সৃষ্টি হয়েছিলো সে সম্পর্কে অনুমান করলে তা বোধহয় খুব ভুল হবেনা।
(চলবে)
তথ্যসূত্রঃ
১. লোকায়ত দর্শন : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ১৩৬৩ ব.। নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
২. কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল : সম্পাদনা- সনৎ কুমার নস্কর,২০১৫। প্রজ্ঞা বিকাশ; ২য় সংস্করণ, কলকাতা।
৩. কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল : সৌম্যেন্দ্রনাথ সরকার,২০০০। গ্রন্থবিকাশ, কলকাতা।
৪. গৌড়বঙ্গ সংস্কৃতি : হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ১৯৯৯। পুস্তক বিপনি; রজতজয়ন্তী বর্ষ প্রকাশন। কলকাতা।
৫. আত্মঘাতী বাঙালী : নীরদচন্দ্র চৌধুরী, ১৯৯০। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স; কলকাতা। ৫ম মুদ্রণ।
৬. বাংলার ব্রত ও অন্যান্য ব্রতকথা : অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর,২০১২। প্রথম দীপায়ন সংস্করণ। দীপায়ন, কলকাতা।
৭. বাংলার ব্রতপার্বণ : শীলা বসাক,১৯৯৮। পুস্তক বিপনি; কলকাতা।
আগের পর্ব গুলোর লিংক :
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : প্রথম পর্ব
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : দ্বিতীয় পর্ব
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : তৃতীয় পর্ব
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : চতুর্থ পর্ব
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : পঞ্চম পর্ব
মন্তব্য
নানবিধ আবোল তাবোল কারণে আমি অনেক দিন পড়ালেখার বাইরে। এই সিরিজটা তৃতীয় পর্বের পর আর পড়া হয়ে উঠেনি। একদিক থেকে খারাপ না, এখন চার, পাঁচ, ছয় একসাথে পড়বো।
---মোখলেস হোসেন
ধন্যবাদ মোখলেস ভাই, পড়ে কেমন লাগলো জানাবেন।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
এইটা একটা দারুণ সিরিজ। পইড়া আইলসামির লাইগা বলা হয় না
অনেক ধন্যবাদ লীলেনদা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আনন্দের সঙ্গে পড়ে চলেছি, প্রত্যেক পর্বই।
"মাতার ধ্যান, জ্ঞান সমস্তটাই সন্তানকে ঘিরে, সন্তানের মঙ্গলকে ঘিরে, সন্তানের হাসিমুখের জন্য মা সামাজিক নিয়মকে, তার অনুশাসনকে পর্যন্ত পায়ে ঠেলতে পারেন। সন্তানের মঙ্গল ছাড়া তিনি আর কিছুই চাননা। আমাদের দয়ালু ঈশ্বরের ধারণার জন্ম এই মাতৃস্নেহের সুধার মধ্যেই। তাই আদিবাসী মানুষ যখন ব্রাহ্মণ্য সমাজের গণ্ডীর ভেতর বন্দি হয়ে পড়লো তখন থেকে এই মাতৃস্নেহের সুধারই অন্বেষণ করেছে। মঙ্গলকাব্যের দেবীরা ভক্তকে বিপদে ফেললেও তাই চটজলদি বিপদ থেকে উদ্ধারও করেন আর ধন-সম্পদে ভরে দেন তাদের ঘর। যুগ যত সভ্যতার দিকে এগিয়েছে ততই এই জনমানস দেবীর মূর্তি গড়তে গিয়ে মায়ের মূতিই গড়েছে এবং তা সজ্ঞানেই গড়েছে।" - এইখানেই মনে হয় পুরো লেখার কেন্দ্রবিন্দুটি ধরা রইল। বই করে বার করলে প্রচ্ছদের ভাঁজ হয়ে যাওয়া অংশে রাখার মত।
এই পর্বের বেশ খানিকটা অংশ হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়-এর লেখা থেকে তুলে ধরা। উদ্ধৃতি বল্যেই মনে হয়। হয়ে থাকলে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের লেখা থেকে উদ্ধৃতি প্রসঙ্গেও একই কথা বলব।
পরের পর্বের জন্য সাগ্রহ অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
লেখাটা পড়া এবং মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ একলহমা। প্রত্যেকটা উদ্ধৃতির শেষেই লেখকের নাম এবং তাদের বইয়ের পৃষ্ঠার নম্বর পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যেক পর্বের লেখাতেই এমন উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে যাতে যৌক্তিক পারম্পর্যটা পাঠক অন্তত নিজেই উপলব্ধি করেন। এ অংশ গুলো নিজের ভাষায় তুলে ধরা যেতো কিন্তু ইচ্ছে করেই লেখকদের নিজের ভাষাটাই রেখে দিয়েছি। “মায়ের দোয়া”র বিশ্বাসটা নিয়ে কৌতুহল থেকেই এই লেখাটা দাঁড় করানো। এটা নিয়ে আরো ভাবতে চাই, আরো তথ্য মিলিয়ে দেখতে চাই। সে হিসেবে লেখাটা একধরণের খসড়া প্রচেষ্টা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
এই শাক্ত প্রভাবিত বঙ্গদেশে সবকিছুর মূলে যিনি অবস্থান করেন বলে প্রাচীন বিশ্বাস বহমান, তিনি হলেন মাতৃকাদেবী বা শক্তিদেবী।এতদঞ্চলের প্রাচীন পরম্পরার সমাজ-মননে মাতৃদেবীর স্থানই সর্বোচ্চে।তাই এখানকার ধ্যান-ধারণার সাথে প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতির মিল অত্যন্ত কম বা নাই বলা চলে। এই অঞ্চল যে বহুকাল আর্যাবর্তের বাইরে ছিল তার প্রমাণ তো মহাভারতেই রয়েছে। অর্থাৎ মাতৃপ্রাধান্য এতদঞ্চলের মাটিবর্তী বৈশিষ্ট্য। তাই এখানকার মানুষ প্রধানত মায়েরই সন্তান। অতএব মায়ের দোয়াই তাদের প্রধান প্রেরণা। মঙ্গলকাব্যের পেছনেও এই প্রেরণাই কাজ করছে বলে মনে করা সংগত।
অবশ্য বর্তমানে চিরায়ত এই বাঙালি সংস্কৃতির উপর যেভাবে ভিন্ন সংস্কৃতির আরোপণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য কতোকাল টিকে থাকবে তা বলা মুশকিল।
বহুকাল পর সচলে ঢুকে এই সিরিজটার বর্তমান পর্বটাই আগে পড়লাম। ভালো লাগলো এ বিষয়ে চর্চার আগ্রহ দেখে। আগের পর্বগুলোও পড়ে নেবো শীঘ্রই। অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
****************************************
ঠিক এই সময়ে ভারতীয় দর্শন গবেষণায় ও বাংলা ভাষায় তার প্রকাশনায় রণদীপম বসু'র মাপের গবেষক খুব বেশি জন আছেন বলে আমার জানা নেই। রণদা' নিতান্ত আমাদের ঘরের লোক বলে আমরা তাঁর যথাযথ মূল্যায়ণটা করি না। এই ভূমির জনমানসের দর্শন সম্পর্কিত কোন বিষয় তিনি যখন এনডোর্স করেন তখন তার সত্যতা ও যথার্থতা নিয়ে আর কোন সন্দেহ থাকে না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
লেখাটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ রণদীপমদা। আপনার লেখার অভাব এখন দারুনভাবে অনুভব করি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
খুব ভালো লাগছে সিরিজটা । বলা হয় না প্রতি পর্বে, কিন্তু মন দিয়ে পড়ছি ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অনেক ধন্যবাদ তুলিরেখা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন