আমাদের ভাবী, জুবায়ের ভাইয়ের স্ত্রী, লেখাটি সচলায়তনে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
- আনিস মাহমুদ, সংসারে এক সন্ন্যাসী
বালকবেলা /‘আহা কী যে বালখিল্য’
প্রাপ্তবয়স্ক আর সব মানুষের মতো আমিও বরাবর ভেবে এসেছি, কী ক্ষতি হতো শৈশব-কৈশোরের কালটি আরো একটু দীর্ঘ হলে! সময়টি খুবই হ্রস্ব ছিলো বলে মনে হয়। অথচ এখন লিখতে বসে আশ্চর্য হয়ে দেখছি, আমার ছেলেবেলা এতো দীর্ঘ ছিলো! বুঝিনি। গল্প ফুরায় না। অন্য কারো কাছে এইসব গল্পের কোনো মূল্য আছে কি না জানি না, আমার নিজের কাছে বাল্যকালের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি মানুষ কী ভীষণ প্রিয়। লিখছি আর ভাবছি কতো কিছু বাদ পড়ে গেলো। হয়তো স্মৃতি সবটা ধরে রাখতেও সক্ষম হয়নি। সব কি আর বলা হয়! নাকি তা সম্ভব? হয় না, অসম্পূর্ণ থেকেই যায়। তবু মন্দ কী, শুরু তো হলো।
১. ‘মন বলে আজ রাজশাহী যাই রাজশাহী যাই’
বিবাহিত জীবনের শুরুতে সস্ত্রীক একবার রাজশাহী যেতে হলো। ভুল হলো, বলা উচিত ছিলো ফিরে গিয়েছিলাম। রাজশাহী থেকে আমার সব যাওয়ার শুরু। এই শহর আমাকে প্রথম পৃথিবীর আলো-বাতাস সরবরাহ করেছিলো, তার কাছে আমার ঋণ আছে। আমার জন্মের আগে আমার পিতামাতার নতুন সংসারে একটি মেয়ে এসেছিলো, তাকে এই শহর ধরে রাখেনি। অল্প কয়েকদিনের আয়ু সাঙ্গ করে বিদায় নেয় সে। ফলে, আমি সেই পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তানের জায়গাটি দিব্যি অধিকার করে নিতে সক্ষম হই। না-দেখা বোন সম্পর্কে আমার কোনো অনুভূতি নেই, থাকার কথা নয়। তবু জীবনভর কোনো সময় মনে না এসে পারেনি, আমার বড়ো একজন ভাই বা বোন থাকলে কেমন হতো? তার উত্তর আমার কনিষ্ঠ ভাইবোনদের হয়তো জানা আছে। আমি কী করে জানবো? এ জনমে হবে না।
এই দফায় রাজশাহী গিয়ে মাতৃমঙ্গল হাসপাতালের সাইনবোর্ড দেখিয়ে নতুন বউকে বলি, এইখানে আমার জন্ম হয়েছিলো এক গ্রীষ্মের দুপুরে।
আম্মার কাছে শোনা ছিলো। সাইনবোর্ড বা পুরনো দালান দেখে কোনো অনুভূতি হয় না। জন্মস্থানের মাটি নাকি কীসব কথা বলে, অনেকে শুনতেও পায়। নিরেট গদ্য আমি সেসব কিছুই শুনতে পাই না। রাজশাহী শহর, পদ্মার উন্মুক্ত পাড় বা শহরের ধুলোমাটি, মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল আমাকে কিছু জানায় না। তবু আমার জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে তার জন্যে আমার আলাদা কিছু টান নেই, তা বলি কী করে?
জন্মের মতোই, কিছুটা পরোক্ষ হলেও, ঘটনাক্রমে রাজশাহী আমার বিবাহকাণ্ডে একটি ভূমিকা দখল করে বসে। মনুষ্যজীবনে জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যু এই তিনটি বৃহত্তম ঘটনা, মহাজনরা জানিয়েছেন। ঘটনাচক্রে আমার জীবনে তার প্রথম দুটিতে রাজশাহী এইভাবে জড়িত হয়ে যায়। সর্বশেষটিতেও রাজশাহীর চক্কর থাকবে? জানার উপায় নেই।
২. যেন গতজন্মের কথা
রাজশাহীতে আমার শিশুকালের কোনো স্মৃতি বলতে কিছু নেই। থাকার কথাও নয়। আমরা যখন রাজশাহী থেকে বগুড়া আসি তখন আমার হাঁটি-হাঁটি-পা-পা বয়স। আমার দেড় বছরের ছোটো বোন ঝর্ণা অ্যা অ্যাঁ করছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটি স্মৃতি আমার স্মরণে হানা দেয়। আম্মাকে জিজ্ঞেস করে যাচাই করি। আম্মা অসাধারণ স্মৃতিধর মহিলা। এখন থেকে তিরিশ বছর আগে কোনো বিশেষ ঘটনার দিন বাড়িতে কী রান্না হয়েছিলো তা-ও স্পষ্ট বলে দিতে পারেন, এমনকি সেই দিনটি বুধবার ছিলো না শুক্রবার তা-ও। সুতরাং তাঁর সাক্ষ্যে সন্দেহ করার উপায় নেই।
রাজশাহীতে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে একটি হিন্দু পরিবারের বাস। এককালে তাঁদের জমিদারি ছিলো কোথাও, তখন আর নেই। ক্ষয়িষ্ণু ও বিলীয়মান জমিদার-প্রজাতির প্রতিনিধি এই পরিবারটি। আব্বার কাছে পরে অনেকবার শুনেছি, ভূতপূর্ব জমিদার গৃহকর্তার তখন খরচ করার মতো প্রচুর টাকা ছিলো না। তবে তিনি প্রাণভরে একটি জিনিস খরচ করতেন– কলতলায় বসে প্রচুর পানি খরচ করে টানা দুই ঘণ্টা ধরে স্নান করতেন।
সেই বাড়ির এক বালক – নাম শ্যামল – আমাকে খুব আদর করতো। দিনের বেলার বেশিরভাগ সময় আমার শ্যামলদার কোলে কোলে কাটতো শুনেছি। আমার মুকুল ডাকনামটিও শ্যামলদার দেয়া। আত্মীয়-পরিজন ও বাল্যকালের বন্ধুবান্ধবের কাছে শুধু এখনো টিকে আছে, জীবনের অন্য সবখান থেকে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, হয়তো প্রয়োজনও ফুরিয়েছে বলে। কোথায় শ্যামলদা, জানা নেই, তার দেয়া নাম আমি আজও বহন করি।
একদিন, তখন বোধহয় আমি কলেজে পড়ি, আচমকা এই শ্যামলদার পরনে দেখা একটি শার্টের কথা আমার মনে পড়ে যায়। সাদা জমিনের ওপর হালকা গোলাপি ও নীল রঙের খুব সরু স্ট্রাইপের ফুলহাতা শার্ট। ব্যস এইটুকুই। আম্মাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো, ওইরকম একটি শার্ট সত্যিই শ্যামলদার ছিলো। রাজশাহী ছেড়ে আসার পর তাদের সঙ্গে আর কোনোকালে দেখাসাক্ষাত হয়নি। ওই শার্ট আমার কী করে মনে পড়ে গেলো কে জানে! মস্তিষ্কের কোথায় জমানো ছিলো? বেরিয়ে এলো কোন উপায়ে? মনুষ্যমস্তিষ্ক হয়তো এইরকম আশ্চর্য সব রত্ন ও রহস্যের খনি।
(চলবে)
মন্তব্য
কী ভীষণ মায়াময়, আর মনখারাপ করা লেখা!
জুবায়ের ভাইকে অনেক শ্রদ্ধা।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একইসাথে ভালোলাগা আর মন্দলাগা অনুভুতি জাগল। একটা মানুষ কতরকম স্মৃতিই না ছড়িয়ে রেখে যান।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
সচলায়তনের এমন উদ্যোগকে প্রথমেই সাধুবাদ জানাই।
জুবায়ের ভাইয়ার লেখার আবার পড়তে পারছি তাতেই আমি অনেক খুশি।
--------------------------------------------------------
রাজশাহীর কথা পড়লে মনটা এমনিতেই উদাসী হয়ে যায়।
জুবায়ের ভাইয়ের মতন আমার জন্মস্থানও রাজশাহী শহরেই।
লেখাটা পড়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে আমার সবচেয়ে প্রিয় শহর রাজশাহীতে।
--------------------------------------------------------
খুব ভালো উদ্যোগ।
জুবায়ের ভাই-এর পরিবারের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
সচলায়তনকেও সাধুবাদ।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
একটু পড়ে থেকে গেলাম। শক্তি সঞ্চয় করে আবার বসবো।
জুবায়ের ভাই..........
---------------------------------------------------------
আমরা যারা শিখিনি চাষবাস,ফসলের গীত
গুলালিতে পাখি হত্যা
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
এই লেখাটি উনাকে দিয়ে একরকম জোর করেই লিখিয়েছিলাম , উদ্দেশ্য ছিল আমার ছেলেবেলা নামের ইবুকের প্রথম খন্ডে যাবে । কিন্তু তিনি সময়মতো শেষ করতে পারেন নি । একদিন বলেছিলেন , আপনার ভয়ে জিমেইল চেক করাই ছেড়ে দিতে হবে দেখি , দেখলেই খালি হুমকি দেন ।
পরে জানিয়েছিলেন , লেখাটি অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে , আমি বলেছিলাম তাহলে শুধু আপনার লেখাটি দিয়েই একটা ইবুক করে ফেলব ।
লেখাটি শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হচ্ছে দেখে বিষন্ন মিশ্রিত খুশী হলাম ।
পরিবার থেকে যদি অনুমতি পাওয়া যায় , তাহলে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক লেখাটিকে পিডিএফ করে একটা ইবুক করতে আগ্রহী আমি ।
ধূর ............মনটা আবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।
আপনার আগ্রহের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ই-বুক তৈরিতে পরিবারের পক্ষ থেকে আপত্তি থাকার কোনও কারণ দেখি না।
লেখাটির প্রকাশ শেষ হলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
শূন্য একটা অনুভূতি...
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
জ্ঞাত বর্তমান মানুষের চিন্তাচেতনার মাপকাঠি---- তাই পড়ার শুরুটিতেই হাহাকারের মতন মনে হচ্ছিল 'আহা, এই মানুষটিই আর থাকবেনা শেষ পর্বে'।
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........
...
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এ উদ্যোগ খুব ভাল লাগল।
জুবায়ের ভাইয়ের সচলে প্রকাশিত লেখাগুলোর কোন সংকলন বের করা যায় না?
এসব পড়তে খারাপ লাগে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
আহা ! জুবায়ের ভাই কি কাকতালীযভাবেই তাঁর শৈশবে ফিরে গিয়ে অতঃপর উধাও হয়ে গেলেন ! কী স্বতঃস্ফূর্ত লেখাটা চলছিলো তাঁর....!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
সবকিছু খালি খালি লাগে..........
জুবায়ের ভাইকে লেখার জন্যই চিনি। এই লেখাটা দিয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষটিকে সচল রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের শ্রদ্ধা জানাই।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আমার সাথে তাঁর দেখা হয় নাই। দেখা হইলে কিজানি কেমন হইতো পরিচয়।
লেখাগুলির মধ্যে তাঁকে চিনি, তাঁকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। লেখাগুলি ফিরে ফিরে পড়ি।
আবার শ্রদ্ধায়-
চিনতাম না। এখন জানছি, শূন্যতার মধ্যেই।
খারাপ লাগবে মন, তবু চলুক।
------------------------------------
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
...
পড়তে পারলাম না। কেবলই অন্যমনষ্ক হয়ে নানান ব্লগ-স্মৃতি দাপাদাপি করে...
বালকবেলার জুবায়ের ভাইকে দেখতে পাচ্ছি, কষ্ট না বরং আনন্দ হচ্ছে। চলে যাওয়ার মানেই তো হারিয়ে যাওয়া না। ক'টা মানুষ পারে যাওয়ার পরও মানুষের মনে এমন করে বসত করতে? এমন একটা মানুষের বালকবেলা পড়ে আসলেই তাই আনন্দ হচ্ছে।
------------------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।
দৃশা
.......
কী ব্লগার? ডরাইলা?
জুবায়ের ভাইকে মিস করছি প্রতিনিয়ত।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
নতুন মন্তব্য করুন